সরকার, কবি রসরাজ তারকচন্দ্র

সরকার, কবি রসরাজ তারকচন্দ্র (১৮৪৭-১৯১৪)  কবিয়াল। ১২৫৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে (নভেম্বর ১৮৪৭)  নড়াইল জেলার জয়পুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা কাশীনাথ সরকার ছিলেন একজন লোককবি। তারকচন্দ্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে; পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলেন মাত্র। পরে উত্তরাধিকারসূত্রে এবং স্বীয় প্রচেষ্টাবলে তিনি কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

তারকচন্দ্রের কবিগানের গুরু ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। কবিগানের উদ্ভব কলকাতায় হলেও পূর্ববঙ্গে যাঁদের মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও জনপ্রিয় হয়, তাঁরকচন্দ্র ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। উনিশ শতকের শেষভাগে পূর্ববঙ্গে তিনি কবিগানে যে বিশিষ্টতা দান করেন, তা  কলকাতা পর্বের কবিগানের তুলনায় বহুলাংশে উন্নত ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কবিগানের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান ধুয়া গানের প্রচলন।

তারকচন্দ্র ছিলেন একজন স্বভাবকবি এবং ওড়াকান্দির  হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১১-১৮৭৭) প্রবর্তিত  মতুয়া মতবাদের অনুসারী। পাঠশালার বিদ্যা নিয়ে তিনি দুটি মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ মহাসঙ্কীর্তন ১৯১০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এতে মতুয়ামতবাদ এবং তার সাধনপদ্ধতি হরিনাম কীর্তনের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত। এটিও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে। এছাড়া তাঁর রচিত বহু কবিগানের মধ্যে কয়েকটি শ্রীহরিদর্শন ও মতুয়াসুহূদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

কবিয়াল হিসেবে তারকচন্দ্র সমগ্র পূর্ববঙ্গ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। অসাধারণ যুক্তি, তাৎক্ষণিকভাবে কাব্যরচনার বিস্ময়কর ক্ষমতা এবং মাধুর্যভরা কণ্ঠ দিয়ে তিনি কবিগানকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। কবিগানে এ অসাধারণ সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৬) কর্তৃক ‘প্রেমিক চূড়ামণি’, ইতিনার পন্ডিতগণ কর্তৃক স্বর্ণপদকসহ ‘সুকবি’ এবং যশোরের কালিয়ার পন্ডিতবর্গ কর্তৃক ‘কবিরসরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারকচন্দ্র শেষোক্ত উপাধিটি তাঁর নামের সঙ্গে ব্যবহার করতেন। ১৩২১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে (ডিসেম্বর ১৯১৪) নিজ গ্রাম জয়পুরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।  [দুলাল ভৌমিক]