বাদ্যযন্ত্র: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৪ নং লাইন: | ৪ নং লাইন: | ||
গঠন ও উপাদানগত দিক থেকে বাদ্যযন্ত্রসমূহ তত, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত। ততযন্ত্র তারসংযুক্ত, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলি সেগুলি শুষির, ধাতুনির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনদ্ধ। তত ও শুষিরযন্ত্র [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেও বাজানো যায়, আবার এককভাবেও বাজানো যায়। তাই এগুলির অপর নাম স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র, যেমন সেতার, সরোদ প্রভৃতি। কিন্তু ঘন ও আনদ্ধ যন্ত্র কেবল গান বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেই বাজানো যায়; এগুলির একক কোনো প্রয়োগ নেই; গায়ক ও বাদকের [[তাল|তাল]] ও [[ছন্দ|ছন্দ]] ঠিক রাখাই এগুলির কাজ। তাই এগুলির অপর নাম অনুগতসিদ্ধ, যেমন তানপুরা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি; কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। পন্ডিতদের ধারণা, ড্রামাদি আনদ্ধ বাদ্য সর্বাগ্রে আবিষ্কৃত হয়; পরে মানুষ তত জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আয়ত্ত করে। শুষির ও ঘন জাতীয় যন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে আরও পরে। | গঠন ও উপাদানগত দিক থেকে বাদ্যযন্ত্রসমূহ তত, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত। ততযন্ত্র তারসংযুক্ত, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলি সেগুলি শুষির, ধাতুনির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনদ্ধ। তত ও শুষিরযন্ত্র [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেও বাজানো যায়, আবার এককভাবেও বাজানো যায়। তাই এগুলির অপর নাম স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র, যেমন সেতার, সরোদ প্রভৃতি। কিন্তু ঘন ও আনদ্ধ যন্ত্র কেবল গান বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেই বাজানো যায়; এগুলির একক কোনো প্রয়োগ নেই; গায়ক ও বাদকের [[তাল|তাল]] ও [[ছন্দ|ছন্দ]] ঠিক রাখাই এগুলির কাজ। তাই এগুলির অপর নাম অনুগতসিদ্ধ, যেমন তানপুরা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি; কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। পন্ডিতদের ধারণা, ড্রামাদি আনদ্ধ বাদ্য সর্বাগ্রে আবিষ্কৃত হয়; পরে মানুষ তত জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আয়ত্ত করে। শুষির ও ঘন জাতীয় যন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে আরও পরে। | ||
তত জাতীয় যন্ত্রগুলি দুপ্রকারের: অঙ্গুলিত্র মিজরাব, গুটি বা জওয়া দিয়ে বাজানো হয় এবং ধনুস্তত বা ধনুযন্ত্র ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ততযন্ত্রই বেশি। এগুলির সৃষ্টির পেছনে ধনুকের অবদান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ধনুকে সংযোজিত তার বা গুণ ছোট বা বড় হলে সুরের তারতম্য ঘটে। তাছাড়া তারে অধিক টান দিলে স্বর চড়ে, ঢিল দিলে নামে। স্বরের এই ওঠা-নামা থেকেই প্রথমত বেশ কয়েক প্রকার বাদ্যযন্ত্রের সৃষ্টি হয়। | তত জাতীয় যন্ত্রগুলি দুপ্রকারের: অঙ্গুলিত্র মিজরাব, গুটি বা জওয়া দিয়ে বাজানো হয় এবং ধনুস্তত বা ধনুযন্ত্র ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ততযন্ত্রই বেশি। এগুলির সৃষ্টির পেছনে ধনুকের অবদান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ধনুকে সংযোজিত তার বা গুণ ছোট বা বড় হলে সুরের তারতম্য ঘটে। তাছাড়া তারে অধিক টান দিলে স্বর চড়ে, ঢিল দিলে নামে। স্বরের এই ওঠা-নামা থেকেই প্রথমত বেশ কয়েক প্রকার বাদ্যযন্ত্রের সৃষ্টি হয়। | ||
০৯:৫৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
বাদ্যযন্ত্র সঙ্গীতোপযোগী শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র। এগুলি কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতে ব্যবহূত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে খননকার্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নতমানের এক সাঙ্গীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেরও পরিচয় মেলে। সিন্ধুসভ্যতায় বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
গঠন ও উপাদানগত দিক থেকে বাদ্যযন্ত্রসমূহ তত, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত। ততযন্ত্র তারসংযুক্ত, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলি সেগুলি শুষির, ধাতুনির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনদ্ধ। তত ও শুষিরযন্ত্র সঙ্গীত বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেও বাজানো যায়, আবার এককভাবেও বাজানো যায়। তাই এগুলির অপর নাম স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র, যেমন সেতার, সরোদ প্রভৃতি। কিন্তু ঘন ও আনদ্ধ যন্ত্র কেবল গান বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেই বাজানো যায়; এগুলির একক কোনো প্রয়োগ নেই; গায়ক ও বাদকের তাল ও ছন্দ ঠিক রাখাই এগুলির কাজ। তাই এগুলির অপর নাম অনুগতসিদ্ধ, যেমন তানপুরা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি; কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। পন্ডিতদের ধারণা, ড্রামাদি আনদ্ধ বাদ্য সর্বাগ্রে আবিষ্কৃত হয়; পরে মানুষ তত জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আয়ত্ত করে। শুষির ও ঘন জাতীয় যন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে আরও পরে।
তত জাতীয় যন্ত্রগুলি দুপ্রকারের: অঙ্গুলিত্র মিজরাব, গুটি বা জওয়া দিয়ে বাজানো হয় এবং ধনুস্তত বা ধনুযন্ত্র ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ততযন্ত্রই বেশি। এগুলির সৃষ্টির পেছনে ধনুকের অবদান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ধনুকে সংযোজিত তার বা গুণ ছোট বা বড় হলে সুরের তারতম্য ঘটে। তাছাড়া তারে অধিক টান দিলে স্বর চড়ে, ঢিল দিলে নামে। স্বরের এই ওঠা-নামা থেকেই প্রথমত বেশ কয়েক প্রকার বাদ্যযন্ত্রের সৃষ্টি হয়।
অতীতে বঙ্গদেশে যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হতো সেসবের অনেকগুলিই বর্তমানে বিলুপ্ত বা অব্যবহূত; আবার বর্তমানে অনেক নতুন যন্ত্রেরও আবির্ভাব ঘটেছে। অতীত ও বর্তমানের সেসব যন্ত্রকে সাধারণভাবে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় লোক, উপজাতীয়, উচ্চাঙ্গ ও আধুনিক।
লোকবাদ্যযন্ত্র প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহূত হয়। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে ঢোল-কাঁসর-শঙ্খধ্বনি অত্যাবশ্যক। কোনো কোনো দেবতার মূর্তিকল্পনায়ও বাদ্যযন্ত্রের যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। শঙ্খধারী বিষ্ণু, ডমরুধারী শিব, মুরলীধারী কৃষ্ণ এবং বীণাধারিণী সরস্বতীর মূর্তি এভাবেই কল্পিত হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে সরস্বতী ‘বীণাপাণি’ এবং কৃষ্ণ ‘মুরলীধর’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের বিবাহানুষ্ঠানে সানাই বাজানো হয়, আর হিন্দু বিয়েতে বাজানো হয় সানাই, শঙ্খ, ঢোল, কাঁসর ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, হিন্দুদের মধ্যে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি দিয়ে বধূবরণ ও নবজাতকের আবির্ভাব ঘোষণা করা হয়। এছাড়া শবযাত্রা, শোভাযাত্রা এবং যুদ্ধযাত্রায়ও শঙ্খধ্বনির প্রয়োজন হয়; কাড়া-নাকাড়া, শিঙ্গা, দামামা, বিউগল প্রভৃতি যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র। অতীতে ঢোল-সহরত করে সরকারি নির্দেশ জারি করা হতো।
কতক পেশায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন সাপুড়েরা তুবড়ি বাজিয়ে সাপের খেলা এবং বাজিকররা ডুগডুগি বাজিয়ে বানর-ভল্লুকের খেলা দেখায়। ফেরিওয়ালা ও সার্কাসের জোকাররা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে যথাক্রমে পণ্য ফেরি করে ও তামাসা দেখায়; জুড়ি ও খঞ্জনি বাজিয়ে বৈষ্ণব-বৈরাগী ও ভিখারিরা ভিক্ষা করে।
বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকসমাজে নানা আচার-সংস্কারও প্রচলিত আছে। শঙ্খ ও সানাই মাঙ্গলিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়; আবার রাতে বাঁশি বাজানো অমঙ্গলজনক বলে সাধারণ লোকের মধ্যে একটি সংস্কারও প্রচলিত আছে।
বাংলাদেশে লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বহু প্রাচীন। খিস্টীয় পঞ্চম শতকে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে এ দেশকে সঙ্গীত ও নৃত্যের দেশ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর-ময়নামতীর প্রস্তরফলক ও পোড়ামাটির চিত্রে নৃত্য ও বাদ্যরত মনুষ্যমূর্তি পাওয়া গেছে। এতে কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, মৃদঙ্গ, বাঁশি, মৃৎভান্ড প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের চিত্র দেখা যায়। ঢাক, ডম্ফ, ডমরু প্রভৃতি আনদ্ধ এবং শিঙ্গা, বাঁশি, তুবড়ি প্রতৃতি শুষির যন্ত্রকে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর অবদান বলে মনে করা হয়। নবম-একাদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে গীত-নট-নৃত্য-বাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। চর্যার তিনটি পদে মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রের নাম আছে বীণা, পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডম্বরু। এগুলির মধ্যে পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা ও দুন্দুভি বিবাহোৎসবে বাজানো হতো। এতে বীণা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, শুকনো লাউয়ের খোলের সঙ্গে তাঁতের (সুতার) তার দিয়ে তৈরি এ যন্ত্র ‘সারি’ বা ছড় দিয়ে বাজানো হয়।
আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে রচিত ধর্মপূজার গ্রন্থ শূন্যপুরাণে বিয়াল্লিশ প্রকার যন্ত্রের উল্লেখ আছে, যেমন: ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডম্বরু, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি, শঙ্খ, শিঙ্গা, ঘণ্টা, জয়ঢাক, দামামা, খমক প্রভৃতি। এগুলির অধিকাংশই ধর্মপূজা উপলক্ষে বাজানো হতো। মধ্যযুগে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য (খ্রি ১৩শ-১৮শ শতক) গীতাকারে পরিবেশিত হতো। ওইসব কাব্য এবং চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে ততাদি চার শ্রেণির ৬৬টি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে, যথা: তত রবাব, সপ্তস্বরা, স্বরমন্ডল, রুদ্রবীণা, মধুস্রবা, খমক, দোতারা, পিণাক, পিণাকী ইত্যাদি; শুষির সানাই, শিঙ্গা, মুহরী (মধুকরিকা), উপাঙ্গ, করনাল, বিষাণ, শাঁখ (শঙ্খ), তুরি, বেণু ইত্যাদি; ঘন করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা, ঝাঁঝর, কাঁসর ইত্যাদি এবং আনদ্ধ দুন্দুভি, ডিন্ডিম, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক, বীরঢাক, কাড়া, ডমরু, পটহ, দগড়, পাখোয়াজ, ডম্ফ, ভেরি, ঢাক, ঢোল, মর্দল, জগঝম্প, ডম্বুরু, খঞ্জরি ইত্যাদি। মঙ্গলকাব্যের যুগশেষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের প্রচেষ্টায় বীণা, সারিন্দা, তানপুরা, এসরাজ (আশুরঞ্জনী), চন্দ্রসারং, মনোহরা, সরোদ, একতারা, সেতার, সুরমন্ডল, সুরবাহার, বাঁশি, খটতাল, করতাল, কাঠকরতাল, তবলা-বাঁয়া, কলিজা খাউড়ি, ঢোলক, শ্রীখোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। চৌদ্দ শতকের বৈষ্ণবকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মুরলী বা মোহনবাঁশি ছাড়াও করতাল ও মৃদঙ্গের কথা আছে; শেষের দুটিকে কৃষ্ণের নাচের তালবাদ্য বলা হয়েছে। ষোলো শতকে চৈতন্যদেবের প্রবর্তনায় কীর্তন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল খোল, করতাল ও মন্দিরা।
মধ্যযুগে ভারতীয় সঙ্গীতকলায় মুসলমানদের অবদান অনেক। সুফি সাধকদের সাধন-ভজনে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। রাজসভায়ও বিনোদনমূলক নৃত্য-গীত-বাদ্যের ব্যবস্থা ছিল এবং তাতে অনেক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হতো; মুসলমান রচিত কাব্য, বিশেষত রাগতালনামায় এর বর্ণনা আছে। ডফ, সানাই ও নহবত জাতীয় যন্ত্র মুসলমানদেরই আবিষ্কার।
ইংরেজদের আগমনের পরে এদেশে পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, ফ্লুট, বিউগল, বেঞ্জু ইত্যাদি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র। শহর-গ্রাম সর্বত্র হারমোনিয়াম এখন একটি সাধারণ বাদ্যযন্ত্র এবং এ দিয়েই সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি হয়।
লোকবাদ্যযন্ত্রের উপকরণ নিতান্তই সাধারণ এবং এর গঠন-প্রণালীও সহজ-সরল। লাউয়ের খোল, বেল বা নারিকেলের মালা, বাঁশ, কাঠ, নল, পাতা, মাটি, লোহা, পিতল, সুতা, তার, শিং, শঙ্খ প্রভৃতি দেশজ উপাদান দিয়ে বাদ্যযন্ত্র নির্মিত হয়। সুতা, ঘোড়ার লেজের লোম, ধাতব তার দিয়ে একতারা, দোতারা, বেনা জাতীয় ততযন্ত্র; বাঁশ ও নল দিয়ে বাঁশি ও তুবড়ি জাতীয় শুষিরযন্ত্র; কাঁসা, পিতল প্রভৃতি ধাতব পদার্থ দিয়ে খঞ্জনি, ঘণ্টা জাতীয় ঘনযন্ত্র এবং গরু, ছাগল ও সাপের চামড়া দিয়ে ঢাক, ঢোল, মাদল জাতীয় আনদ্ধযন্ত্র নির্মিত হয়। কতক বাদ্যযন্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদান প্রায় অবিকৃত থাকে, যেমন শঙ্খ ও শিঙ্গা। তালপাতা দিয়ে পাতবাঁশি তৈরি হয়। মাটির সাধারণ হাঁড়ি বা ছোট কলসিও তালবাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। কচি আমের অাঁটি ঘষে ভেঁপু তৈরি করা হয়। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকবাদ্যযন্ত্রের বিবরণ দেওয়া হলো:
ততযন্ত্র এ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে একতারা ও দোতারা বিখ্যাত। একতারা প্রধানত বাউল, বৈষ্ণব বৈরাগী ও মুসলমান ফকিররা মরমি গানের সঙ্গে ব্যবহার করেন; আর দোতারা ব্যবহূত হয় ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি ও কবিগানে। দোতারার ‘কোরডং’ ধ্বনির সঙ্গে ভাওয়াইয়া গানের সুরের নিকট-সাদৃশ্য থাকায় ভাওয়াইয়ার অপর নাম হয়েছে ‘দোতারার গান’।
বেনা যন্ত্রের গঠন ও বাদনরীতি কিছুটা বেহালার মতো। নারিকেলের অর্ধাকার একটি মালা বাঁশের দন্ডের সঙ্গে বেঁধে এটি তৈরি করা হয়। মালার ওপরের দিকে থাকে চামড়ার ছাউনি এবং ছাউনির ওপরে ‘ঘোড়া’র সাহায্যে একগোছা তার দন্ডের মাথায় কানের সঙ্গে বাঁধা হয়। ঘোড়ার লেজের চুলের তৈরি ধনুকসদৃশ ছড় দিয়ে বেনা বাজানো হয়। রংপুর-দিনাজপুরে কুশান ও কেচ্ছা গানে এ যন্ত্রের ব্যবহার আছে।
সারিন্দা সাধারণত মুর্শিদি, বিচার ও কেচ্ছা গানে অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে বাজানো হয়। ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায় ছাদ পেটানো ও খেত নিড়ানো গানেও এর ব্যবহার লক্ষণীয়।
খমক যন্ত্রটি আনন্দলহরীর অপর নাম। ভক্তিমূলক গানে এটি বাজানো হয়। শূন্যপুরাণ ও মঙ্গলকাব্যে গান ও নাচের বাদ্য হিসেবে খমকের উল্লেখ আছে।
শুষির এ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সব সম্প্রদায়ের সব শ্রেণির মানুষই বাঁশি বাজাতে বা শুনতে পছন্দ করে। বাঁশির সুর গানের বাণীকেও ফুটিয়ে তুলতে পারে। সারি, ভাওয়াইয়া, যাত্রা, ঘাটু, কবি প্রভৃতি লোকসঙ্গীতের নানা ধারায় অন্য যন্ত্রের সঙ্গে বাঁশি বাজানো হয়; এটি এককভাবেও বাজানো যায়। বাঁশির উপকরণ অতি সাধারণ। সাধারণত এক-দেড় ফুট লম্বা চিকন বাঁশ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। বর্তমানে কোন কোন বাঁশির দৈর্ঘ্য এর চেয়ে বেশিও হয়ে থাকে। মাথার দিকে একটি গিঁট রেখে বাঁশ কাটা হয়, যাতে ওপরের দিকটা বন্ধ থাকে; এর অপর প্রান্ত থাকে খোলা। গিঁটের কাছে একটি গোল ছিদ্র করা হয়; এটিকে বলে ফুৎকাররন্ধ্র। এর নিচে থাকে পরপর ছয়টি গোল ছিদ্র; এগুলিকে বলে তাররন্ধ্র। ফুৎকাররন্ধ্রে মুখ রেখে আড়াআড়িভাবে বাঁশিটি ধরে অপর ছিদ্রগুলিতে দুই হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা দিয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এটি বাজানো হয়।
আকার ও প্রকারভেদে বাঁশির বিভিন্ন নাম আছে, যেমন: আড়বাঁশি, কদবাঁশি, টিপরাবাঁশি, হরিণাবাঁশি ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে আড়বাঁশি সর্বাধিক প্রচলিত। এর অপর নাম মুরলী, মোহনবাঁশি, বেণু প্রভৃতি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণের মুরলী বা মোহনবাঁশিকে আড়বাঁশি বলা হয়েছে। কৃষ্ণ এই বাঁশির সুরেই রাধার চিত্ত হরণ করেছিলেন। ময়মনসিংহের একটি লোকসঙ্গীতেও একথা বলা হয়েছে: ‘আষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশী মধ্যে দিয়া ছেঁদা/ নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশী কলঙ্কিনী রাধা\’
কদবাঁশির মাথা তেরছাভাবে কেটে কাঠের পাতলা খিল অাঁটা হয় এবং সেখানে ঈষৎ ছিদ্রপথে ফুঁ দিলেই এটি বাজে। এর নিচে চার কোনাকার একটি উন্মুক্ত বায়ুরন্ধ্র থাকে। অঞ্চলভেদে কদবাঁশির বিভিন্ন নাম আছে, যেমন: মুখের মধ্যে পুরে বাজাতে হয় বলে উত্তরবঙ্গে ‘মুখাবাঁশি’, মুখের কাছে খিল থাকে বলে ফরিদপুরে ‘খিলবাঁশি’ এবং মুখ কলমের মতো দেখায় বলে ‘কলমবাঁশি’ বলা হয়। আদিবাসীরা একে বলে ‘লয়বাঁশি’।
জলপাইগুড়ির মুখাবাঁশি কিছুটা ভিন্ন। বাঁশের ছোট-বড় ব্যাসের কয়েকটি চোঙা পরস্পরের মুখে পুরে লম্বা করা হয়। পরে ওপরের সবচেয়ে সরু চোঙাটিতে ফুঁ দিলেই এটি বেজে ওঠে। টিপরাবাঁশির উভয় মুখ খোলা এবং এতে আটটি ছিদ্র থাকে। কদবাঁশির মতো মাথায় ফুঁ দিয়ে এটি বাজানো হয়; তবে উভয় প্রান্ত খোলা থাকে বলে এর বাদনে বিশেষ কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। হরিণাবাঁশি প্রকৃতপক্ষে হরিণ শিকারের বাঁশি। প্রায় এক ফুট দীর্ঘ এ বাঁশির উভয় প্রান্ত খোলা এবং গায়ে কোন ছিদ্র থাকে না। এতে ফুঁ দিলে হরিণশিশুর ডাকের মতো আওয়াজ হয়; এ থেকেই এর নাম হয়েছে হরিণাবাঁশি।
তুবড়ি যন্ত্রের আঞ্চলিক নাম ‘বীণ’। এটি প্রধানত সাপুড়েরা সাপধরা ও সাপখেলার কাজে ব্যবহার করে। তাই এর অন্য নাম ‘নাগিন বীণ’।
শঙ্খ বা শাঁখ একটি অতি পরিচিত শুষির যন্ত্র। সমুদ্র থেকে আহূত শঙ্খের ভেতর-বাইর পরিষ্কার করে এবং তার নাভি কেটে সেখানে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। শঙ্খ হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, বিবাহ ইত্যাদি মাঙ্গলিক ও প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান এবং সঙ্কেতজ্ঞাপনে ব্যবহূত হয়। এছাড়া শাঁখ ও ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ধ্যারতি এবং গৃহে প্রবেশের পূর্বে নতুন বর-বধূকে শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করা হয়। প্রকৃতিদত্ত এ বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার বহু প্রাচীন বলে মনে করা হয়।
শিঙ্গা বা শৃঙ্গ মহিষ-শৃঙ্গের অবয়ববিশিষ্ট একটি শুষির যন্ত্র। অতীতে মহিষের শিং থেকে এটি তৈরি হতো; বর্তমানে ধাতু নির্মিত শিঙ্গা ব্যবহূত হয়। শিবের ত্রিশূলের গায়ে ডমরু ও শিঙ্গা ঝুলতে দেখা যায়। এককালে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা শিঙ্গা ব্যবহার করতেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে শিরালিরা মন্ত্রপাঠ করে ও শিঙ্গা বাজিয়ে মেঘ তাড়াতে ও শিলাবৃষ্টি রোধ করতো। প্রাচীনকালে শিঙ্গা যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র ছিল, একে বলা হতো রণশিঙ্গা। বড় আকারের শিঙ্গাকে বলা হয় রামশিঙ্গা; এগুলি পেতল বা তামার তৈরি। রামশিঙ্গা অতি প্রাচীন যন্ত্র। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দীর্ঘ এর অবয়ব। এটিও অতীতে রণক্ষেত্রে বাজানো হতো।
ভেরী পেতলের তৈরি বাঁশি জাতীয় যন্ত্র; পূর্বে রণক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো।
ভেঁপু অঙ্কুর গজানো আমঅাঁটির খোসা ছড়িয়ে জোড়াবিচি তেরছাভাবে সামান্য ঘষে তৈরি করা হয়। তেরছা অংশ মুখে পুরে ফুঁ দিলে পুঁ পুঁ ধ্বনি সৃষ্টি হয়, এ থেকেই এর নাম হয়েছে ভেঁপু। গ্রামের শিশুদের এটি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র।
ঘনযন্ত্র এ শ্রেণির যন্ত্রের মধ্যে কাঁসর প্রধান। এটি কংসনির্মিত ঈষৎ কানাতোলা থালার আকৃতিবিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্র। এর এক প্রান্তে দুটি ছিদ্র করে দড়ি বেঁধে বাঁহাতে ঝুলিয়ে ডান হাতে কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। হিন্দুদের পূজামন্ডপে ঢোলের সঙ্গে কাঁসরও বাজে। আকারে ঈষৎ ছোট অনুরূপ যন্ত্রকে বলে কাঁসি। এর ধ্বনি অপেক্ষাকৃত তীব্র। বিভিন্ন লোকসঙ্গীতে ঢোলের সঙ্গে কাঁসি বাজানো হয়।
ঘণ্টা দুই রকমের; লোহা বা পেতলের তৈরি পুরু থালার মতো ঘণ্টা মন্দির ও বিদ্যালয়ে সময় নির্দেশ করতে বাজানো হয়। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে এতে ঢং ঢং শব্দ হয়, যা বহু দূর থেকে শোনা যায়। ধুতরা ফুলের মতো দেখতে আর এক ধরনের ঘণ্টা আছে, যা বাজিয়ে পূজারীরা দেবতার আরতি করে। খ্রিস্টানদের গির্জাতেও এ জাতীয় বড় আকারের ঘণ্টা বাজে। ধাতুর তৈরি ঐ কাঠামোর ভেতর দিকে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো একটি ছোট দন্ড ঝোলানো থাকে; ওপরের চূড়া ধরে নাড়া দিলে এটি যন্ত্রের ভেতরের গায়ে আঘাত করে ধ্বনি সৃষ্টি করে। শেকলবাঁধা ঘণ্টা বাংলার স্থাপত্যশিল্পের একটি মোটিফ বলে গণ্য হয়। অতীতে ডাকঘরের রানার রাতে চলার সময় ঘণ্টা ব্যবহার করত। গরু, ছাগল এমনকি হাতির গলায়ও ঘণ্টা বাঁধা হয়।
জুড়ি কংসনির্মিত দুটি বাটি। এর মাঝখানে ছিদ্র করে মোটা সুতায় বেঁধে দুহাতে ধরে পরস্পরের মুখে টোকা দিয়ে বাজানো হয়। বাটির গা স্পর্শ করা যায় না; কারণ তাতে জুড়ির ধ্বনি অস্পষ্ট ও বিকৃত হয়। জুড়ি একাধারে তাল, লয় ও ছন্দ নিরূপণে সাহায্য করে। লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে জুড়ির ব্যবহার আছে। বৈষ্ণব বৈরাগীরা জুড়ি বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করে। জুড়ির অপর নাম মন্দিরা। এটি কাঁসার তৈরি; আকৃতি ছোট বাটির মতো। দুটি বাটি পরস্পরের আঘাতে বাদিত হয়। তাল, লয় ও ছন্দ নিরূপণে মন্দিরা বিশেষ উপযোগী।
করতাল পেতলের তৈরি থালার আকৃতিবিশিষ্ট একটি যন্ত্র; এর বাদনরীতি জুড়ির মতোই। করতালের সুতা বা দড়ি তর্জনীতে জড়িয়ে হাতের তালুতে চাপ ও ছাড় দিয়ে এটি বাজাতে হয়। হাতের এই চাপ-ছাড়ের ওপরই করতালের ধ্বনির উচ্চতা ও মৃদুতা নির্ভর করে। কীর্তনে খোলের অনুষঙ্গ হিসেবে করতাল অপরিহার্য যন্ত্র। ‘যত ছিল নাড়াবুনে, হল সব কীর্তনে/ কাস্তে ভেঙ্গে গড়ায় কত্তাল।’ এই প্রবাদে কীর্তনে করতালের গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে। অঞ্চলবিশেষে এটি খঞ্জনি নামেও পরিচিত।
খড়তাল জোড়-ধরা দুটি কাঠের ফ্রেম; অনেকটা ছুতার মিস্ত্রির রেঁদার মতো দেখতে। একই হাতের আঙ্গুলে ধরে এটি বাজাতে হয়। ভজনাদি গানে তালবাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার আছে।
প্রেমজুড়ি তাঁতযন্ত্রের মাকুর আকৃতিবিশিষ্ট কাঠের দুফালি টুকরার সাহায্যে নির্মিত হয়। হাতের আঙ্গুলে ধরে পরস্পরের গায়ে আঘাত করে এটি বাজাতে হয়। কাঠের ফ্রেমের ভেতরে লোহার ছোট ছোট গুটি ভরা থাকে; এতে কাঠ ও ধাতুর মিশ্রধ্বনি সৃষ্ট হয়। অঞ্চলবিশেষে এটি খুনজুড়ি ও চটি নামেও পরিচিত। জিকির, কেচ্ছা, ফকিরালি প্রভৃতি গানে প্রেমজুড়ি ব্যবহূত হয়।
তাল কাঁসার তৈরি একটি বাদ্যযন্ত্র; দুটি গোলাকার তাল পরস্পরের সঙ্গে আঘাত করে এই যন্ত্র বাজানো হয়।
ঝাঁঝ বা ঝাঁঝর পেতলের তৈরি; এটি মধ্যমাকৃতি ও বৃহদাকৃতি দুপ্রকারের হয়ে থাকে। মধ্যমাকৃতির ঝাঁঝ পরস্পরের আঘাতে এবং বৃহদাকৃতি ঝাঁঝ কাঠি দিয়ে বাজানো হয়।
জলতরঙ্গ কতগুলি চীনা মাটির বাটির সমন্বয়ে তৈরি। বিভিন্ন আকারের বাটিগুলি বড় থেকে ছোট ক্রমানুসারে সাজিয়ে তাতে পানি ভরে সুর নির্ধারণ করা হয় এবং দুটি কাঠির সাহায্যে বাটিতে আঘাত করে বাজানো হয়। এটি গানের অনুষঙ্গে অথবা এককভাবেও বাজানো যায়।
নূপুর চরণবাদ্য। পেতল বা তামার তৈরি বক্রাকার ফাঁপা নল দিয়ে এটি তৈরি হয়। এটি মলের মতো করে পায়ে পড়তে হয়। নূপুর প্রধানত নাচের তালবাদ্য।
ঘুঙুর পেতলের ছোট ছোট এক গুচ্ছ বল বা ঘণ্টা মোটা সুতায় গেঁথে তৈরি করা হয়। এটিও একটি চরণবাদ্য এবং পায়ের গোড়ালির ওপরে পরা হয়। প্রধানত নাচের তালবাদ্য হিসেবে ঘুঙুরের ব্যবহার আছে, তবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সার্কাসের জোকার, বহুরূপী, ফেরিওয়ালা ও খেমটাওয়ালারাও ঘুঙুর ব্যবহার করে।
আনদ্ধযন্ত্র এ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে দুন্দুভি অতি প্রাচীন। অতীতে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, জয়যাত্রা ও দেবালয়ে দুন্দুভি বাজানো হতো। এর প্রকারভেদ ভূমি-দুন্দুভি যুদ্ধে বিপদের আশঙ্কায় এবং বিভিন্ন উৎসব ঘোষণায় ব্যবহূত হতো।
ডিন্ডিম বাজালে ‘ডিম্ ডিম্ ’; আওয়াজ হয় বলে ধ্বনির অনুকরণে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
ঢাক আনদ্ধ জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে প্রধান। ঢাকের ব্যবহার অতি প্রাচীন। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকে ঢাকাদি বাদ্যযন্ত্রের চিত্র আছে। বড় আকারের কাঠের খোলের উভয় মুখে পুরু চামড়ার ছাউনি দিয়ে ঢাক তৈরি করা হয়। খোলটি আনুমানিক এক হাত ব্যাস ও দুই হাত দীর্ঘ হয়ে থাকে। মোটা ফিতার সাহায্যে বাম কাঁধে কোল বরাবর ঝুলিয়ে দুই হাতে কাঠির সাহায্যে এটি বাজাতে হয়।
বাংলায় ঢাক একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র, তাই একে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রবাদবাক্যের সৃষ্টি হয়েছে, যেমন: ‘ধর্মের ঢাক আপনি বাজে’, ‘নিজের ঢাক নিজেই পেটানো’, ‘ঢাক থুয়ে চন্ডী পাঠ’ ইত্যাদি। ‘গাজনের নাই ঠিক ঠিকানা/ ডাক দিয়ে কয় ঢাক বাজা না।’ মালদহে প্রচলিত এই প্রবাদে গম্ভীরা নাচ-গানে ঢাক বাজানোর কথা আছে। ঢাকের ব্যবহার আজও বাংলার সর্বত্র অক্ষুণ্ণ আছে। বিশেষত হিন্দুদের পূজামন্ডপে ঢাক ও কাঁসর বাদ্য আবশ্যিক। বড় আকারের ঢাক জয়ঢাক বা বীরঢাক নামে পরিচিত; এগুলি অতীতে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো।
ঢোল ঢাকের চেয়ে আকারে ছোট। চর্মাচ্ছাদিত এই যন্ত্রটির ব্যবহার অধিক। সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় তালবাদ্য হিসেবে ঢোলের ব্যবহার ব্যাপক। কবি, যাত্রা, জারি, গম্ভীরা, আলকাপ প্রভৃতি গানে অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে ঢোলও বাজে। পূজা, বিবাহ, মুহররমের শোভাযাত্রা, লাঠিখেলা, কুস্তির আখড়া সর্বত্র ঢোল বাজানো হয়। কিছুকাল আগে পর্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ঢোল বাজিয়ে সরকারি পরোয়ানা জারি করা হতো। একে বলা হতো ঢোল-সহরত। দক্ষ ঢুলি বাদনের কৌশলে ঢোলে বিশেষ বোল তুলতে পারে।
ঢোলক হচ্ছে ঢোলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এটি মেয়েলি গীত, খেমটা নাচ-গান এবং কোন কোন ভিক্ষোপজীবীর গানে ব্যবহূত হয়। ঢোল ও ঢোলক প্রয়োজন অনুযায়ী বসে বা দাঁড়িয়ে বাজানো যায়।
ঢামসা চর্মাচ্ছাদিত এই যন্ত্রটির একদিকে মুখ থাকে এবং মুখটি প্রশস্ত। গলার সঙ্গে সামনে ঝুলিয়ে দুই হাতে কাঠির সাহায্যে এটি বাজাতে হয়। অতীতে এটি যুদ্ধের বাদ্য ছিল; এখন শোভাযাত্রায় ব্যবহূত হয়।
খোল সাধারণত মাটির তৈরি; আগুনে পুড়িয়ে একে শক্ত করা হয। মাটির তৈরি বলে খোলের শাস্ত্রীয় নাম ‘মৃদঙ্গ’ (মৃৎ + অঙ্গ)। এটি একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। মোচাকৃতির লম্বা খোলের উভয় মুখে চামড়ার ছাউনি থাকে এবং ছাউনির মাঝখানে গাবের তাপ্পি লাগানো হয়। খোলের ডাইনামুখ ছোট এবং বাঁয়ামুখ অপেক্ষাকৃত বড়। ফিতার সাহায্যে গলায় ঝুলিয়ে অথবা মাটিতে রেখে বসে খালি হাতে এটি বাজানো হয়। কীর্তন গান ও মণিপুরী নৃত্যের সঙ্গে খোল বা মৃদঙ্গ বাজানো হয়। মধ্যযুগের ভক্তিরত্নাকর কাব্যে খোল-করতালকে শ্রীচৈতন্যের সম্পত্তি বলা হয়েছে।
শ্রীখোল মৃত্তিকা নির্মিত একটি আনদ্ধ যন্ত্র, এর গঠন-প্রণালী মৃদঙ্গের মতো। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই বাদ্যযন্ত্রটির প্রচলন বেশি দৃষ্ট হয়।
মাদল মাটির খোলের তৈরি স্থূলাকার একটি যন্ত্র; পল্লী অঞ্চলে উৎসবের সময় এটি বাজানো হয়। আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে এবং ঝুমুর নাচ-গানে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা হয়।
বাঁয়া বাটির আকারবিশিষ্ট একটি যন্ত্র। এর মুখে চামড়ার ছাউনি থাকে। বাউলরা বামপাশে কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাম হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে এটি বাজায়। এ সময় তাদের ডান হাতে থাকে একতারা। কোন কোন অঞ্চলে এটি ‘ডুগি’ নামেও পরিচিত। একে তবলার লৌকিক সংস্করণ বলা যায়।
ডুগডুগি সাধারণত শিবের গাজন, সাপখেলা, বানরনাচ ও ভল্লুকের খেলায় ব্যবহূত হয়। এর বড় সংস্করণের নাম বিষম ঢাকি। দুটির মধ্যে পার্থক্য হলো, ডুগডুগির মতো এতে গুলতিযুক্ত সুতা বাঁধা থাকে না এবং খাড়াখাড়িভাবে রেখে হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে এটি বাজাতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে মনসার ভাসান বা ঝাঁপান গানে বিষম ঢাকি বাজানোর রীতি আছে।
কাড়া ধামার মতো দেখতে কাঠের ফ্রেমের একদিকে শক্ত চামড়ার ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়। ফিতার সাহায্যে গলায় ঝুলিয়ে দুহাতে দুটি সরু কাঠি দিয়ে এটি বাজানো হয়। প্রাচীনকালে কাড়া-নাকাড়া যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র ছিল। কাড়া বাজিয়ে রাজাদেশ ঘোষণার কথা জানা যায় ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যে: ‘কাড়াসোরে কি কথা কোটাল কয় ফুটে।’ ব্রিটিশ আমলেও এর প্রচলন ছিল।
খঞ্জরি তালবাদ্য; জারি ও ঘাটু নাচ-গানের আসরে ঢোলের সঙ্গে এটি বাজানো হয়। খঞ্জরির অনুরূপ আরেকটি যন্ত্র আছে যা ডফ বা ডম্ফ নামে পরিচিত। তবে ডফ আকারে অপেক্ষাকৃত বড়। ডফ ফারসি শব্দ; জিপসিদের নাচ-গানে এটি ব্যবহূত হয়। মুসলমানরা এদেশে ডফ আমদানি করে। ষোলো শতকের কবি মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে ডম্ফ যন্ত্রের উল্লেখ আছে: ‘প্রমথপতি কাছে/ ত্রিদশ পতি নাচে/ ডম্ফ ধিক ধিক ধিঙ্গা \’ ফরিদপুর অঞ্চলে এটি ‘ডোম্ফা’ এবং সিলেটে ‘ডপকি’ নামে পরিচিত। বেদেরা ভোজবাজির খেলায় ঢোলের সঙ্গে ডফ বাজায়।
এগুলি ছাড়া পাইল্যা নামে এক ধরনের লোকবাদ্যযন্ত্র আছে। এটি আসলে একটি সাধারণ মৃৎপাত্র, যার নাম পাতিল এবং আঞ্চলিক উচ্চারণে একে বলা হয় পাইল্যা। লোকসঙ্গীতে তালবাদ্যরূপে এটি ব্যবহূত হয়। বাদনকৌশলে পাইল্যার পেটে তবলা এবং মুখে বাঁয়া সদৃশ ধ্বনি তোলা হয়। এজন্য একে তবলা-বাঁয়ার লৌকিক সংস্করণ বলা যায়। পাইল্যা একই আঙ্গিকে ঘন ও শুষির যন্ত্রের প্রয়োজন সিদ্ধ করে। [ওয়াকিল আহমদ]
উপজাতীয় বাদ্যযন্ত্র বিশ্বের প্রায় সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীই নৃত্যগীতপ্রিয়। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় যে কোন উৎসব-অনুষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র সহকারে তারা একক বা বৃন্দ নৃত্যগীতি পরিবেশন করে। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহও তাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রবহমান রেখেছে। উত্তরাঞ্চলের সাঁওতালদের নৃত্যগীতে ব্যবহূত হয় তন্দা, টামাক, ডান্ডা, ঢাক, ঢোল, বাঁশি, সিঙ্গা, মাদল প্রভৃতি যন্ত্র। বৃহত্তর সিলেটের গারো এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, যেমন: চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, ম্রো, বম্, উসুই, পঙ্খো, খুমি, লুসাই, চাক প্রভৃতি স্ব-স্ব উৎসব-অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে থাকে।
উপজাতীয়দের যন্ত্রগুলি স্থানীয়ভাবে নির্মিত। সেগুলির মধ্যে কতিপয় যন্ত্র বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া বাজানো নিষেধ। ঢোল, বাঁশি ও বেহালার ব্যবহারই উজাতীয়দের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বাঁশি জাতীয় যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে প্লুং, তু, বাজি, শিমুর, শিঙ্গা ও ক্লাওনেট। প্লুং ঐতিহ্যগতভাবে ম্রো ও খুমি জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পূজাপার্বণে। ম্রো ভাষায় প্লুং শব্দের অর্থ বাঁশি। পাহাড়ে উৎপন্ন একপ্রকার তিতা লাউয়ের খোল এবং সরু বাঁশের নলদ্বারা ম্রো এবং খুমি জনগোষ্ঠী নিজস্ব কারিগরি কলাকৌশলে প্লুং তৈরি করে। নলের সংখ্যানুসারে ম্রো সমাজে এর চার প্রকার নাম প্রচলিত আছে, যেমন: ১. নিচে তিনটি ও ওপরে দুটি নল থাকলে তার নাম তিনতেং প্লুং বা তুলেরুম প্লুং; ২. নিচে দুটি ও ওপরে দুটি থাকলে তাকে বলে প্লুংকে; ৩. নিচে দুটি ও ওপরে একটি থাকলে বলে প্লুংমা এবং ৪. নিচে পাঁচটি ও ওপরে চারটি থাকলে তার নাম হয় রিনাপ্লুং। ম্রো এবং খুমি সমাজে কোনকিছুর জন্য মানত করার বিশেষ অনুষ্ঠানে প্লুং এবং কলেরা, মহামারী অথবা দৈব-দুর্বিপাকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে কেবল রিনাপ্লুং ব্যবহার করা হয়।
বাঁশিকে চাকমা জনগোষ্ঠী বলে বাজি। বিভিন্ন মাপের পাহাড়ি বাঁশ দিয়ে বাজি তৈরি করা হয়। বাজিতে কিছু কারুকার্যও করা থাকে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী বাঁশির নাম শিমুর। বাঁশের তৈরি সাধারণ বাঁশির চেয়ে শিমুর কিছুটা লম্বা ও অধিক ছিদ্রযুক্ত। ত্রিপুরাদের ‘পরাইয়া নৃত্য’ ও পূজাপার্বণে এ বাঁশি ব্যবহূত হয়। সাধারণত চাকমা ও তঞ্চংগ্যা জনগোষ্ঠীর লোকেরা চার-পাঁচ হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে শিঙ্গা তৈরি করে।
ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে খাইং, খা-অম, বুঙ্গ, পেহ্ ও গঙ্গ বা দারখোয়াং। উসুই জনগোষ্ঠীর ঢোলের নাম খাইং। দৈর্ঘ্যে দুহাত থেকে আড়াই হাত এবং প্রস্থে এক হাতের বেশি এই বাদ্যযন্ত্রটি বাঘ বা ছাগলের চামড়া এবং হালকা গামারি জাতীয় কাঠের ফ্রেম দিয়ে তারা নিজস্ব কারিগরি কৌশলে তৈরি করে। খা-অম খাইং-এর মতোই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। গরাইয়া পূজা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে খা-অম বাজানো অপরিহার্য। মারমা জনগোষ্ঠীর ছোট আকারের ঢোলকে বলা হয় বুঙ্গ। এটি দৈর্ঘ্যে দশ ইঞ্চি এবং প্রস্থে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। কাঠ ও বন্য পশুর চামড়া দিয়ে বুঙ্গ তৈরি করা হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অন্য যন্ত্রের পাশাপাশি বুঙ্গও বাজানো হয়। কাঠ ও চামড়ার তৈরি পেহ্ সাধারণত দুই ফুট লম্বা ও এক ফুট চওড়া হয়। এতে কাঠি দিয়ে ঢোলের বোল তোলা হয়। অষ্টধাতুর তৈরি চাকতির মতো গোলাকার গঙ্গ বা মঙ্গকে পঙ্খো ভাষায় বলা হয় দারখোয়াং। এর মাঝখানটা থাকে উঁচু; সেখানে কাঠের দন্ড দিয়ে আঘাত করলে ঘণ্টার মতো আওয়াজ হয়। ম্রো এবং খুমিদের গোহত্যা অনুষ্ঠানে, শিবপূজারি পঙ্খোদের শিকার ও যুদ্ধনৃত্যে এবং চাকমা, মারমা ও চাকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে এই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হয়।
খেং খরং, বে-আনা, ধুধুক, ক্রি-চয়, ফকির দাঙ্গাইস, সেঁদা, চং প্রেই এবং একতারা হলো বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। খেং খরংকে মারমারা বলে খ্রে খ্রং এবং ত্রিপুরারা বলে সাংমুঙ্। চাকমা, তঞ্চংগ্যা, মারমা এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাঁশের কঞ্চি দিয়ে এটি তৈরি করে বিভিন্ন আনন্দ-উৎসবে বাজিয়ে থাকে। তবে চাকমাদের মধ্যে এর ব্যবহার বেশি। বেহালার মতোই বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নিজস্ব কারিগরি দক্ষতায় নির্মিত বে-আনাকে চাকমা ভাষায় বলা হয় বেলা, মারমা ভাষায় বেয়াঁজ এবং ম্রো ভাষায় ত্র। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাঁশনির্মিত এ জাতীয় বেহালার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্পকর্ম আদিবাসীদের শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে।
বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ধুধুক চাকমা, তঞ্চংগ্যা ও ত্রিপুরাদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত। এ বাদ্যযন্ত্রকে চাকমা ও তঞ্চংগ্যারা বলে তুত্রুমাও এবং ত্রিপুরারা বলে টুটু-আ। দুপ্রান্ত বন্ধ দুহাত লম্বা এক খন্ড বাঁশের ঠিক মাঝখান বরাবর একটি গোলাকৃতি ছিদ্র করা হয়। তারপর বাঁশের পিঠ থেকে বেত তোলার মতো করে সরু দুটি বাখারি বের করে বেহালার মতো তৈরি করা হয়। মারমাদের বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ক্রি-চয়। কাঠ ও কাঁসার সাহায্যে তৈরি এই বাদ্যযন্ত্রে কাঠের গোল চাকতির ওপর পনেরো-বিশটি তার সংযুক্ত থাকে। দুটি কাঠির সাহায্যে এতে সুর তোলা হয়। এদের আর একটি ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের নাম দুংমং। ফকির দাঙ্গাইস হলো ত্রিপুরা ও উসুইদের একতারা বিশেষ। কাঠ খোদাই করে একতারার মতো তৈরি করে ঠিক মাঝখানে লম্বালম্বিভাবে একটি তার স্থাপন করা হয়। কাঠি বা হাত দিয়ে তারে সুর তোলা হয়। উসুই নির্মিত ব্যতিক্রমধর্মী গিটার হল সেঁদা। দেখতে অনেকটা ঘুঘু পাখির বাসার মতো। দুই-তিন হাত লম্বা ও দেড় হাত চওড়া এক খন্ড কাঠ খোদাই করে এটি নির্মিত হয়। এর ফাঁপা স্থানটি চামড়া দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে। এতে তিনটি তার সংযুক্ত করা হয়। চং প্রেই উসুইদের আর একটি ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। প্রায় আড়াই হাত লম্বা কাঠ খোদাই করে গিটারের মতো তিনটি তার সংযুক্ত করা হয়। এর প্রথম তারটি দিয়ে বেশি সুর তোলা হয়। তাই এর নিচে পাঁচটি ছোট কাঠি মোম দিয়ে আটকে রাখা হয়। ম্রো এবং খুমি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহূত একতারা লাউয়ের বা নারিকেলের খোলের সাহায্যে নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহের নৃত্যগীতের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে এসব বাদ্যযন্ত্র আবহমান কাল থেকে ব্যবহূত হয়ে আসছে। এগুলির সঙ্গে তাদের হূদয়োৎসারিত আবেগ, সঙ্ঘবদ্ধ জীবনাচরণ, জীবনজীবিকা এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ধ্যানধারণা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। [মোমেন চৌধুরী]
উচ্চাঙ্গবাদ্যযন্ত্র এ শ্রেণির যন্ত্রগুলি সাধারণত রাগসঙ্গীত বা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে ব্যবহূত হয় এবং এর বেশির ভাগই তত জাতীয়, যেমন: সেতার, সরোদ, এসরাজ, সুরবাহার, বীণা, তানপুরা, দিলরুবা প্রভৃতি। তবে অন্য তিন প্রকার যন্ত্রসমূহের কোন কোনটিও এক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়, যেমন: বাঁশি, সানাই, তবলা ইত্যাদি। প্রথম দুটি আবার লোকবাদ্যযন্ত্রের মধ্যেও গণ্য।
ততযন্ত্র সব ততযন্ত্রই বীণা পর্যায়ভুক্ত, অর্থাৎ তত আর বীণা সমার্থক। বীণা একটি অতি প্রাচীন ও আলাপযোগ্য যন্ত্র। এতে চামড়া ও লোহা উভয় প্রকারের তন্ত্রী ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রসমূহের মধ্যে বীণা শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত, কারণ এতে এমন কতগুলি সুর ও গমকের কাজ দেখানো যায় যা অন্য কোনো যন্ত্রে সম্ভব নয়। বীণার সুর মধুর, তবে ক্ষণস্থায়ী এবং বেশি দূর পর্যন্ত শোনা যায় না।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার বীণার প্রচলন ছিল এবং সেগুলির গঠন ও সুরে বৈচিত্র্যও ছিল, যেমন: মহতী, আলাপিনী (মেঘতন্ত্রের তাঁত, কার্পাস বা রেশমের সুতা ব্যবহার্য), উদুম্বরী, একতন্ত্রী, কিন্নরী, কুব্জিকা, কচ্ছপী, কুমিকা, ঘোষবতী, চিত্রা (সপ্ততন্ত্রী), জয়া, জ্যৈষ্ঠা, তুম্বুরু (তম্বুরা), ত্রিতন্ত্রী, ত্রিস্বরী, দক্ষিণী, নকুল (দ্বিতন্ত্রী), নকুলোষ্ঠী, নাদেস্বর, নারদীয়, নিঃশঙ্ক, পরিবাদিনী, পিণাকী, পোন, প্রসারিণী, বল্লকী, বিপঞ্চী (নবতন্ত্রী), ব্রহ্ম, ভরত, মত্তকোকিলা (একবিংশতিতন্ত্রী), রঞ্জনী, রাবণহন্তক, রুদ্র (রবাব), শততন্ত্রী, শারদীয় (সরোদ), শ্রুতি (দ্বাবিংশতিতন্ত্রী), ষট্কর্ণ, সারঙ্গ (সারেঙ্গী), সুর (সুরশৃঙ্গার), স্বর ও হন্তিকা। এগুলির অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। কোনো কোনোটি আবার নতুন নামে প্রচলিত আছে। মহতী বীণা এ শ্রেণির যন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য। এরই প্রচলিত নাম বীণা। মীড়-গমক-মূর্ছনার অনুরণনে সুর-লহরীর আবেশময় রূপ কেবল বীণাযন্ত্রেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। বীণা আদি ও মৌলিক যন্ত্র। পরবর্তীকালের রবাব, সেতার, সুরবাহার, সুরশৃঙ্গার প্রভৃতি ততযন্ত্র বীণা থেকেই উদ্ভূত।
তানপুরা প্রাচীন তম্বুরারই নবীন সংস্করণ। এটি এককভাবে বাজানো যায় না, তবে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তানপুরার তারগুলি থেকে যে মধুর স্বর নির্গত হয় তা শ্রোতাদের মনে এক অপূর্ব আবেশের সৃষ্টি করে। রুদ্রবীণা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বেশ খ্যাত ছিল। স্বরোদীয় বীণা রুদ্রবীণারই উন্নত সংস্করণ। এর ওপরের অংশ সরোদের অনুরূপ। বর্তমানে এর প্রচলন নেই। স্বরবীণা বা সুরবীণা যন্ত্রটিও দেখতে রুদ্রবীণার মতো। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা আছে, তবে বর্তমানে যন্ত্রটি লুপ্তপ্রায়। মধ্যযুগে প্রচলিত বীণাগুলির মধ্যে পিণাকী, বল্লকী ও রুদ্রবীণা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পিণাকী বীণার আকৃতি ধনুকের মতো, ছড়ের সাহায্যে বাজানো হতো। এর মতো বল্লকী বীণাও বাংলায় বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। সপ্তস্বরা নামে একটি যন্ত্রও তখন প্রচলিত ছিল। পূর্বে স্বরমন্ডল যন্ত্রটি বীণাযন্ত্র নামেই অভিহিত হতো, কিন্তু বর্তমানে স্বরমন্ডল একটি পৃথক যন্ত্র। ধুসরী বা দুসরী নামে আরেক প্রকার বীণার প্রচলন ছিল, কিন্তু তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীনকালে ধুসারেকা নামে এক প্রকার বীণা প্রচলিত ছিল। ধুসরী ও ধুসারেকা একই গোত্রের বীণা।
কপিলাস বীণা বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই যন্ত্রটিকে কপিলাসিকা, কৈলাস বা আদ্যবীণা নামেও অভিহিত করা হতো। কচ্ছপী বীণা কাছূয়া সেতার নামে পরিচিত। এটি একটি পুরাতন ও প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতবিদ আমির খসরু এর আবিষ্কর্তা। সপ্ততন্ত্রী বীণা দেখতে কচ্ছপী বীণার অনুরূপ। আমির খসরু সৃষ্ট ত্রিতন্ত্রী তিন তারবিশিষ্ট বীণা। মহতী, কচ্ছপী ও রুদ্র এই তিনটি বীণার মিশ্রণে সৃষ্টি করা হয় সুরশৃঙ্গার বীণা। তানসেন বংশীয় প্রসিদ্ধ বীণকার জাফর খাঁ ও প্যার খাঁ এ যন্ত্রের উদ্ভাবক। ময়ূরী বীণার নিচের অংশ ময়ূরের আকৃতি বিশিষ্ট; তাই এর নাম ময়ূরী বীণা। এটি তাউস নামেও অভিহিত হতো। সুরবাহার বীণা ধ্রুপদ অঙ্গের যন্ত্র। বর্তমানে এটি শুধু সুরবাহার নামেই প্রচলিত। লক্ষ্ণৌ নিবাসী সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওমরাও খাঁ তাঁর শিষ্য গোলাম মোহাম্মদ খাঁর জন্য এ যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেন। মধুস্রবা নামে একপ্রকার বীণা মধুস্যন্দী নামেও পরিচিত ছিল। এর সুর খুব মিষ্টি বিধায় নাম হয়েছে মধুস্রবা। যন্ত্র নামে এক প্রকার বীণার প্রচলন ছিল। মুগল আমলে এই যন্ত্রের সংস্কার সাধন করা হয়।
সেতার উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে ব্যবহূত বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। আমির খসরু এর উদ্ভাবক। সেতার ত্রিতন্ত্রী বীণার উন্নত সংস্করণ। পারস্য ভাষায় ‘সে’ মানে ‘তিন’; তিনটি তারের সমন্বয়ে তৈরি বলে আমির খসরু এর নামকরণ করেন সেতার। প্রাচীনকালে সেতার তিনটি তার সহযোগে বাজানো হতো, কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ পাল্টাতে থাকে। বর্তমান সেতারে তিনটির পরিবর্তে আঠারোটি পর্যন্ত তার ব্যবহার করা হয়।
সেতার দুই প্রকার- সাধারণ ও তরফদার। সাধারণ সেতারে সাতটি তার থাকে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা এ ধরনের সেতার ব্যবহার করে। তর্জনীতে মিজরাব লাগিয়ে তারে আঘাত করে সেতার বাজাতে হয়। ‘মিজরাব’ আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় আঘাত করাকে বলে ‘জর্ব’, এ থেকেই মিজরাব হয়েছে। তরফদার সেতারে সাধারণ সেতারের মতো সাতটি তার ছাড়াও আরও এগারোটি তার সংযুক্ত থাকে। এগুলি অনুরণনের জন্য ব্যবহূত হয়। মেঘনাদ সেতার গোত্রীয় আলাপের বাদ্যযন্ত্র। এর আওয়াজ বেশ গুরুগম্ভীর। মন্দ্রস্বরের জন্য মেঘনাদ ব্যবহূত হয়ে থাকে। এটি সুরবাহারের চেয়ে খানিকটা ছোট, কিন্তু সেতারের চেয়ে বড়। সুরচৈন সেতারের অনুরূপ আরেকটি বাদ্যযন্ত্র। অনেকটা তরফহীন সেতারের বড় সংস্করণ। এ যন্ত্রেও আলাপ বাজানো হয়ে থাকে।
সরোদ অঙ্গুলিত্র গোষ্ঠীর একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। রবাব ও দোতারার সংমিশ্রণে এর উৎপত্তি। রবাব পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের যন্ত্র, আর দোতারা বাংলাদেশের লোকযন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে রবাব থেকেই সরোদের উৎপত্তি বলে স্বীকৃত। ‘সেহ্রুদ’ শব্দ থেকে সরোদের নামকরণ করা হয়েছে।
এসরাজ একটি তত বাদ্যযন্ত্র; এটি আশুরঞ্জনী নামেও পরিচিত। এসরাজ মিষ্টি সুরের যন্ত্র। সারিন্দা, সেতার ও সারেঙ্গী এই তিনটি যন্ত্রের মিশ্রণে এর জন্ম। এসরাজ এককভাবে এবং গানের সঙ্গে অনুগামী যন্ত্র হিসেবেও বাজানো যায়। তারসানাই দেখতে এসরাজ যন্ত্রের অনুরূপ। ঊভয়ের গঠনপ্রণালী অভিন্ন। যন্ত্রটির বিশেষত্ব হলো এর প্রধান বা নায়কী তারে একটি সাউন্ড বক্স থাকে। তারসানাইয়ের সুর বেশ সূক্ষ্ম ও করুণ। দিলরুবা এসরাজ জাতীয় অপর একটি বাদ্যযন্ত্র। গঠনপ্রণালীতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। এর খোল এসরাজের মতো গোলাকার নয়, চ্যাপটা। মনোহরা এসরাজ গোত্রেরই তত যন্ত্র। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এর স্রষ্টা। এর সুরের মাধুর্য খুবই আকর্ষণীয়। মন্দ্রবাহার এসরাজ জাতীয় একটি ধনুযন্ত্র। এসরাজের চেয়ে এর আকৃতি বড়। মন্দ্রবাহারের আওয়াজ বেশ গম্ভীর ও মন্দ্র। এটি আলাপ বা অনুগামী যন্ত্র। নাদতরঙ্গ এসরাজ গোত্রের ততযন্ত্র; এসরাজের মতো ছড় দিয়ে বাজানো হয়। নাদতরঙ্গ সম্মেলক বা ঐকতান যন্ত্রসঙ্গীতে ব্যবহূত হয়।
সুরমন্ডল বহুতারবিশিষ্ট একটি ততযন্ত্র। এর তারগুলি জোড়া সুর হিসেবে বাঁধা হয় এবং তিন সপ্তকের সুরে বেঁধে দুটি কাঠি দিয়ে জোড়া তারের ওপর আঘাত করে বাজাতে হয়। সুরমন্ডল এককভাবেও বাজানো যায়, আবার অনুগামী যন্ত্র হিসেবেও বাজানো যায়। সন্তুর সুরমন্ডল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র; এর গঠন-প্রকৃতি ও বাদ্যরীতি সুরমন্ডলের ন্যায়। এটি একক বা ঐকতান যন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়।
সারেঙ্গী অনুগত যন্ত্র হলেও বর্তমানে স্বতন্ত্র যন্ত্র হিসেবেও ব্যবহূত হয়। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে এর বিশেষ ব্যবহার আছে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ছড় দিয়ে যন্ত্রটি বাজাতে হয়। সারেঙ্গীর আওয়াজ মিষ্টি। গজল, খেয়াল, টপ্পা, কাওয়ালি, ঠুংরি ইত্যাদি গানের সঙ্গে সারেঙ্গী বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। মন্দ্রনাদ মন্দ্রস্বরের একটি অনুগতসিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র। এর উদ্ভাবক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। সুররবাব বাজাবার নিয়ম সুরশৃঙ্গারের মতো।
স্বরসংগ্রহ যন্ত্রের দন্ডটি এসরাজের মতো, কিন্তু খোলটি সরোদের মতো। অশ্বগুচ্ছযুক্ত ছড় দিয়ে এটি বাজানো হয়। এর উদ্ভাবক ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ। যন্ত্রটি ‘বীণরাজ’ নামেও পরিচিত। মেঘডম্বুর আফতাবউদ্দিন উদ্ভাবিত আরেকটি যন্ত্র। এক তারবিশিষ্ট এ যন্ত্রটি দেখতে ধনুকের মতো। অর্ধচন্দ্রাকার ছড় দিয়ে এটি বাজাতে হয় এবং এর সুর খুব মিষ্টি।
শুষিরযন্ত্র এ জাতীয় যন্ত্রের মধ্যে সানাই প্রধান। এটি বাঁশি গোত্রের একটি যন্ত্র। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের পাশাপাশি লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার আছে। এর ‘সানাই’ নামকরণ হয়েছে ফারসি শব্দ শাহ্নাই থেকে, যার অর্থ বড় নল। যে শুষিরযন্ত্রের নলটি বড়, সেটাই সানাই। মুসলিম বিজয়ের পর যন্ত্রটি বাংলাদেশে আসে। ধুতরা ফুলের মতো পেতলের তৈরি যন্ত্রটি ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় এবং নলের ছিদ্রে দুই হাতের আঙুল দিয়ে স্বর নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সানাই যন্ত্রটি সাধারণত এককভাবে বাজানো হয় না। এক প্রকার সানাই আছে যাতে একটানা ষড়জ (সা) স্বরটি বাজানো হয়; তার সঙ্গে ছোট টিকারা যন্ত্রে সঙ্গত করা হয়। এই তিনটি যন্ত্র সমবেতভাবে বাজালে তাকে বলে রৌশনচৌকি, যার প্রচলিত নাম নহবত। পূর্বকালে নহবত বাজানোর জন্য রাজপ্রাসাদের প্রধান তোরণের উপরিভাগে নহবতখানা নির্মাণ করা হতো। সেখানে প্রতি প্রহরান্তে নহবত বাজাবার রীতি ছিল। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে সানাই বাজে; পুরুলিয়ার ছৌ-নাচে সানাই ব্যবহূত হয়।
ন্যাসতরঙ্গ নামে ধাতুর তৈরি আর এক প্রকার শুষিরযন্ত্র আছে; শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে এ থেকে সুর বের করতে হয়।
ঘনযন্ত্র উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে ঘনযন্ত্রের তেমন ব্যবহার নেই।
আনদ্ধযন্ত্র এ শ্রেণির যন্ত্রের মধ্যে পাখোয়াজ উল্লেখযোগ্য। এটি প্রাচীন মৃদঙ্গ থেকে সৃষ্ট এবং কাঠের তৈরি। ‘পাখোয়াজ’ শব্দটি ফারসি শব্দ ‘পাখ-আওয়াজ’ (যা থেকে পবিত্র ধ্বনি নিঃসৃত হয়) থেকে গৃহীত হয়েছে। এর আওয়াজ মধুর ও গম্ভীর। মৃদঙ্গের সঙ্গে পাখোয়াজের আকৃতিগত পার্থক্য আছে। বীণা, সুরবাহার, ধ্রুপদ, ধামার প্রভৃতির সঙ্গে পাখোয়াজ বিশেষভাবে ব্যবহূত হয়। ওস্তাদ আমির খসরু পাখোয়াজকে দুভাগে ভাগ করে তবলা-বাঁয়ার সৃষ্টি করেন। তবলা-বাঁয়া সঙ্গীতের তাল ও মাত্রা নির্দেশক যন্ত্র। এটি মূলত অনুগামী যন্ত্র এবং যুগ্মভাবে বাজানো হয়; তবে স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহার আছে।
আধুনিক বাদ্যযন্ত্র এ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্র বলতে সাধারণত সেগুলিকেই বোঝায়, যেগুলির উদ্ভব ভারতবর্ষে নয় এবং আধুনিককালে পাশ্চাত্য থেকে এদেশে এসেছে। হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার ইত্যাদি এই শ্রেণির যন্ত্র। হারমোনিয়াম এক ধরণের শুষির যন্ত্র। সংযু্ক্ত বেলোর সাহায্যে বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো রিড চালনা করে এটি বাজানো হয়। এতে তিন ধরণের স্বরবিভাজন থাকে উদারা, মুদারা ও তারা। কণ্ঠসঙ্গীতে এর ব্যবহার অপরিহার্য।
বেহালা ইউরোপীয় যন্ত্র হলেও বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। ইংরেজরা একে ‘ভায়লিন’ এবং ইতালীয়রা ‘ভিয়ালো’ বলে। ‘ভিয়ালো’ শব্দের অপভ্রংশ হিসেবে ‘বেহালা’ শব্দটি প্রচলিত হয়েছে। মুগল আমলে পাশ্চাত্য বণিকরা এ যন্ত্র এদেশে নিয়ে আসে এবং ক্রমে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাগসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত উভয় ক্ষেত্রেই বেহালা বাদিত হয়।
বেহালায় হালকা কাঠের তৈরি চ্যাপ্টা বাদনপ্রকোষ্ঠের সঙ্গে একটি ক্রমশ সরু ও ক্ষুদ্র বাদনদন্ড থাকে। চার তারবিশিষ্ট এই যন্ত্রের দুটি তার তাঁত, একটি লৌহ এবং অপরটি নিকেল নির্মিত। লোমের তৈরি ছড়ি দিয়ে এতে সুর তোলা হয়। বেহালার সুর মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো মনোহর। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় আখড়াই গানে এর বিশেষ ব্যবহার ছিল। একক বা সম্মিলিত বাদনে এটি ব্যবহূত হয়।
গিটার ছয় তারবিশিষ্ট তত জাতীয় যন্ত্র। এটি দেখতে প্রায় বেহালার মতো, তবে আকারে বেহালার চেয়ে বড়। গিটার দুই প্রকার স্প্যানিশ ও হাওয়াইন। বর্তমানে সঙ্গীতক্ষেত্রে এটি বেশ জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটি একক বা ঐকতানে বাদিত হয়; গানের সঙ্গে রাগালাপেও এটি ব্যবহূত হয়ে থাকে। [মোবারক হোসেন খান]
গ্রন্থপঞ্জি নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব), কলকাতা, ১৯৪৫; রাজেশ্বর মিত্র, বাংলার সঙ্গীত (মধ্যযুগ), কলকাতা, ১৯৫৫; জিতেন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রসাধক, কলকাতা, ১৯৫৮; মোবারক হোসেন খান, বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ, ঢাকা, ১৯৮২; জাফর আহমদ হানাফী, উপজাতীয় নন্দন সংস্কৃতি, বাংলাদেশ শিল্প একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩; James Hastings (ed), Encyclopeadia of Religion and Ethics, Vol. IX, London, 1953।