নাট্যমঞ্চ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৬ নং লাইন: | ৬ নং লাইন: | ||
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়, যেমন: ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন, গণগ্রন্থাগার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, কচিকাঁচা মিলনায়তন, ওয়াপদা মিলনায়তন, [[অশ্বিনীকুমার টাউন হল|অশ্বিনীকুমার টাউন হল]] (বরিশাল, ১৯৩০), জে.এম.সেন হল (চট্টগ্রাম), মুসলিম হল (চট্টগ্রাম) ইত্যাদি। উভয় বঙ্গের কয়েকটি প্রধান নাট্যমঞ্চের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো: | ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়, যেমন: ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন, গণগ্রন্থাগার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, কচিকাঁচা মিলনায়তন, ওয়াপদা মিলনায়তন, [[অশ্বিনীকুমার টাউন হল|অশ্বিনীকুমার টাউন হল]] (বরিশাল, ১৯৩০), জে.এম.সেন হল (চট্টগ্রাম), মুসলিম হল (চট্টগ্রাম) ইত্যাদি। উভয় বঙ্গের কয়েকটি প্রধান নাট্যমঞ্চের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো: | ||
''এমারেল্ড থিয়েটার'' ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলুটোলা নিবাসী গোপাললাল শীল এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে থিয়েটারের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্যপট ও পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করান এবং গ্যাসের আলোর পরিবর্তে ডায়নামোর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৮ অক্টোবর থিয়েটারের উদ্বোধন দিবসে কেদারলাল চৌধুরীর একখানি পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ হয়; কিন্তু দক্ষ পরিচালনার অভাবে থিয়েটারের দর্শকসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় গোপাল শীলের আমন্ত্রণে [[ঘোষ, গিরিশচন্দ্র|গিরিশচন্দ্র ঘোষ]] এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েকখানি পুরাতন ও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেগুলির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র ও বিষাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। | |||
কিছুদিন পরে প্রখ্যাত মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর এর মঞ্চসজ্জায় নিযুক্ত হন। কিন্তু খেয়ালি মানুষ গোপাল শীল দুবছরের মাথায় থিয়েটার বিক্রি করে দেন। তার পরেও বিভিন্ন মালিকানায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। কেদারলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, [[মিত্র, রায়বাহাদুর দীনবন্ধু|দীনবন্ধু মিত্র]], অতুলকৃষ্ণ মিত্র, [[ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ|ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ]] এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়। এর প্রধান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন [[মুস্তফি, অর্ধেন্দুশেখর|অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি]], মহেন্দ্র বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, বনবিহারিণী, ক্ষেত্রমণি, সুকুমারী, কুসুম, গুল্ফন হরি প্রমুখ। | কিছুদিন পরে প্রখ্যাত মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর এর মঞ্চসজ্জায় নিযুক্ত হন। কিন্তু খেয়ালি মানুষ গোপাল শীল দুবছরের মাথায় থিয়েটার বিক্রি করে দেন। তার পরেও বিভিন্ন মালিকানায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। কেদারলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, [[মিত্র, রায়বাহাদুর দীনবন্ধু|দীনবন্ধু মিত্র]], অতুলকৃষ্ণ মিত্র, [[ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ|ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ]] এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়। এর প্রধান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন [[মুস্তফি, অর্ধেন্দুশেখর|অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি]], মহেন্দ্র বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, বনবিহারিণী, ক্ষেত্রমণি, সুকুমারী, কুসুম, গুল্ফন হরি প্রমুখ। | ||
''ওরিয়েন্টাল থিয়েটার'' ১৮৫৩ সালে কলকাতার ২৬৮ নং গরানহাটা, চিৎপুরে গৌরমোহন আড্ডির ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল বাড়ির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের অভিনয়ের জন্য মি. ক্লিঞ্জার ও মিসেস এলিস ছাত্রদের শিক্ষা দেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় এবং এর দ্বিতীয় অভিনয় হয় ৫ অক্টোবর। | |||
১৮৫৪ সালের ২ ও ১৭ মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় মার্চেন্ট অফ ভেনিস। মিসেস গ্রেইর্গ নামে জনৈকা মহিলা ‘পোর্সিয়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেক্সপীয়রের হেনরি ফোর্থ ও হেনরি পার্কার মেরিডিথের এ্যামেচার নাটকদুটি অভিনীত হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে শেক্সপীয়রের আর একখানি নাটক অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে। | ১৮৫৪ সালের ২ ও ১৭ মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় মার্চেন্ট অফ ভেনিস। মিসেস গ্রেইর্গ নামে জনৈকা মহিলা ‘পোর্সিয়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেক্সপীয়রের হেনরি ফোর্থ ও হেনরি পার্কার মেরিডিথের এ্যামেচার নাটকদুটি অভিনীত হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে শেক্সপীয়রের আর একখানি নাটক অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে। | ||
ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের ব্যয় নির্বাহ হতো টিকেট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে, যেহেতু এটি কোন বিত্তবানের প্রাসাদের থিয়েটার ছিল না। এর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন এবং বিবরণসমূহ [[সংবাদ প্রভাকর|সংবাদ প্রভাকর]], বেঙ্গল হরকরা, [[হিন্দু প্যাট্রিয়ট|হিন্দু প্যাট্রিয়ট]], দি মর্নিং ক্রনিকল, দি সিটিজেন ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। | ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের ব্যয় নির্বাহ হতো টিকেট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে, যেহেতু এটি কোন বিত্তবানের প্রাসাদের থিয়েটার ছিল না। এর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন এবং বিবরণসমূহ [[সংবাদ প্রভাকর|সংবাদ প্রভাকর]], বেঙ্গল হরকরা, [[হিন্দু প্যাট্রিয়ট|হিন্দু প্যাট্রিয়ট]], দি মর্নিং ক্রনিকল, দি সিটিজেন ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | ||
[ | ''ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ'' ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে কোনও এক সময় পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথমে ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চ; কিন্তু এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে [[ক্রাউন থিয়েটার|ক্রাউন থিয়েটার]] সেটি ভেঙ্গে নতুন করে মঞ্চ নির্মাণ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে মঞ্চটি এক সময় ইসলামপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৭ সালে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় অভিনেতা-অভিনেত্রী সেখানে যোগ দেন এবং এর ফলে ক্রাউনের কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুকাল পরে ক্রাউন থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলে নাট্যমঞ্চ হিসেবে এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। | ||
''' | ''গাইড হাউস মিলনায়তন'' ঢাকার নিউ বেইলী রোডে বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। আশির দশক থেকে এই মঞ্চটি নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যাবৃদ্ধি, নতুন নতুন নাট্যদলের উদ্ভব, নাটকের দর্শক সৃষ্টি ইত্যাদি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গাইড হাউস মিলনায়তনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা শহরে এখানেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী শুরু হয়। | ||
গাইড হাউস মিলনায়তনে বিভিন্ন নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: বহুবচনের প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২), ইডিপাস (১৯৮২); থিয়েটারের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), ঘরে-বাইরে (১৯৮৫), কোকিলারা (১৯৮৯), আন্তিগোনে (১৯৯২); ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা (১৯৭৮); নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দেওয়ান গাজীর কিস্সা, বিসর্জন (১৯৮৫); সুবচন নাট্য সংসদের জীবন ঘষে আগুন (১৯৮৬); লোক নাট্যদলের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯১), মহাপ্রয়াণ (১৯৯৪), একাত্তরের দিনগুলো (১৯৯৫); সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আসমান তারা শাড়ী (১৯৯১), বাজিমাৎ (১৯৯৪); কুশিলব নাট্য সম্প্রদায়ের নো ভেকেনসি (১৯৯১); নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু (১৯৯১), লালসালু (১৯৯১), তুঘলোক (১৯৯২); সড়কের হ্যালুসিনেশন (১৯৯২); ঢাকা লিটল থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস (১৯৯৩); থিয়েটার আর্টের কোর্ট মার্শাল (১৯৯৩), কালান্তর (১৯৯৪), গোলাপজান (১৯৯৫); কণ্ঠশীলনের পুতুল খেলা (১৯৯৩), ভৃত্য রাজকতন্ত্র (১৯৯৫); ঢাকা সুবচন নাট্যদলের বিবিসাব (১৯৯৪); ঢাকা পদাতিকের ফেরা (১৯৯৪); জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের পাবলিক (১৯৯৫) ইত্যাদি। | |||
গাইড হাউস মিলনায়তনে বিভিন্ন নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: বহুবচনের প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২), | |||
বাংলাদেশে দলীয় মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) গাইড হাউস মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে মঞ্চস্থ করে মানব ও প্রকৃতি, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ভাষা আন্দোলন, নদী পাড়ের জীবন, মাদকাশক্তি এবং স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। নাটক ও মূকাভিনয় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে। | বাংলাদেশে দলীয় মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) গাইড হাউস মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে মঞ্চস্থ করে মানব ও প্রকৃতি, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ভাষা আন্দোলন, নদী পাড়ের জীবন, মাদকাশক্তি এবং স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। নাটক ও মূকাভিনয় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে। | ||
''গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার'' ১৮৭৩ সালে ভুবনমোহন নিয়োগী কর্তৃক কলকাতার বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান মিনার্ভা থিয়েটারের স্থলে) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পরে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটি লিজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচালনা করেন; কিন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যেই কৃষ্ণধন ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং ভূবনমোহন পুনরায় থিয়েটারটি নিজের হাতে নিয়ে পূর্বনামেই চালাতে থাকেন। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতলাল বসুর হীরকচূর্ণ ও উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী নাটক এখানে অভিনীত হয়। হীরকচূর্ণ নাটকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম রেলগাড়ি দেখানো হয়। পরবর্তীকালে এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: প্রকৃত বন্ধু, সরোজিনী, বিদ্যাসুন্দর, গজদানন্দ ও যুবরাজ, কর্ণাটকুমার ইত্যাদি। | |||
''' | গজদানন্দ ও যুবরাজ একটি কৌতুক নাটক; মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস (সপ্তম এডওয়ার্ড) ১৮৭৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলে তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত হয়। এতে সরকারি মহলে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং পুলিশ এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। রচয়িতা উপেন্দ্রনাথ পুলিশকে বিদ্রূপ করে ''The Police of Pig and Sheep'' নামে আরও একটি কৌতুক নাটক রচনা করেন এবং ১৮৭৬ সালের ১ মার্চ নাটকটি এখানে মঞ্চস্থ হয়। এর পরিণতি হিসেবে নাট্যাভিনয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ঐ বছরই [[অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬|অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন]] প্রণয়ন করে। এভাবে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি কারণে ভুবনমোহন সর্বস্বান্ত হয়ে থিয়েটারের সংস্রব ত্যাগ করেন এবং অন্যরাও থিয়েটার ছেড়ে চলে যান। ১৮৮০ সালে প্রতাপচাঁদ জহুরী নামে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এটি ক্রয় করে গিরিশ ঘোষকে পরিচালনার দায়িত্ব দেন। [জিল্লুর রহমান জন] | ||
''জোড়াসাঁকো নাট্যশালা১'' প্যারীমোহন বসু কর্তৃক ১৮৫৪ সালে তাঁর কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের নিজস্ব বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই ৩ মে এই মঞ্চে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকটি অভিনীত হয়। মহেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণধন দত্ত, যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। সংবাদ প্রভাকর (৫ মে ১৮৫৪) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় চারশত ভারতীয় ও ইংরেজ দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা (১১ মে ১৮৫৪) নাট্যশালার নিকট বাঙালি দর্শকদের জন্য বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়। | |||
''' | ''জোড়াসাঁকো নাট্যশালা২'' ১৮৬৫ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেকালের বিখ্যাত গোপাল উড়িয়ার যাত্রাগান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মঞ্চাভিনয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলীর সহায়তায় এ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা এবং গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবুবিলাস নাটক অভিনীত হয়। এরপর উদ্যোক্তাগণ সমকালীন সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক আহবান করে পুরস্কারসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। বিচারকদের বিচারে রামনারায়ণ তর্করত্নের নবনাটক শ্রেষ্ঠরূপে নির্বাচিত হয় এবং নাট্যকারকে একটি রূপার থালায় ২০০ রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি নাটকটি অভিনীত হয়। অক্ষয় মজুমদার, সারদা গাঙ্গুলী, [[ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ|জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর]] প্রমুখ এতে অভিনয় করেন। ৯ জানুয়ারি ন্যাশনাল ও ২৮ জানুয়ারি [[সোমপ্রকাশ|সোমপ্রকাশ]] পত্রিকায় উক্ত প্রযোজনার উচ্চ প্রশংসা করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল জোড়াসাঁকো নাট্যশালার শেষ অভিনয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | ||
''ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার'' জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী কর্তৃক ১৮৯৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোরীলাল প্রথমে ক্রাউন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু এক সময় এর শিল্পী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দিলে তিনি ক্রাউনেরই কতিপয় শিল্পী নিয়ে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বর্তমান লায়ন সিনেমা হলের জায়গায় এ মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল। | |||
[জিল্লুর রহমান জন] | ডায়মন্ড কলকাতা থেকে অভিনেত্রী এনে, প্রয়োজনে স্থানীয় বাইজিদের দিয়ে অভিনয় করাত। এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: দুর্গেশনন্দিনী, দেবীচৌধুরানী, বিজয় বসন্ত, আলীবাবা, নবীন তপস্বিনী, বিল্বমঙ্গল, নন্দদুলাল, তরুবালা ইত্যাদি। এর টিকেটের হার ছিল দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা ও চার আনা। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার প্রচলনের পেছনে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। [জিল্লুর রহমান জন] | ||
''ন্যাশনাল থিয়েটার'' ১৮৭২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের সভ্যগণ সর্বশ্রেণীর দর্শকদের সুবিধার্থে একটি সাধারণ রঙ্গালয় প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী এটি নির্মিত হয়। এ কারণে মঞ্চটি প্রথম বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ হিসেবে খ্যাত। | |||
রঙ্গালয়ের টিকেট বিক্রয়ের অর্থে শুধু নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার ব্যয়টুকু নির্বাহ করাই ছিল ন্যাশনালের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে ৩৩ নং চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের মন্দির ভবনে একটি অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয় এবং মঞ্চের নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু এরূপ একটি অস্থায়ী ও যৎকিঞ্চিৎ সজ্জিত মঞ্চের ‘ন্যাশনাল’ নাম নিয়ে দলপতি গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে সাধারণ সভ্যদের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি দলত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পালন করেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। প্রথম দিকে প্রতি শনিবার এখানে অভিনয় হতো; পরের দিকে সপ্তাহে দুদিনও হয়েছে। | রঙ্গালয়ের টিকেট বিক্রয়ের অর্থে শুধু নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার ব্যয়টুকু নির্বাহ করাই ছিল ন্যাশনালের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে ৩৩ নং চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের মন্দির ভবনে একটি অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয় এবং মঞ্চের নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু এরূপ একটি অস্থায়ী ও যৎকিঞ্চিৎ সজ্জিত মঞ্চের ‘ন্যাশনাল’ নাম নিয়ে দলপতি গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে সাধারণ সভ্যদের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি দলত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পালন করেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। প্রথম দিকে প্রতি শনিবার এখানে অভিনয় হতো; পরের দিকে সপ্তাহে দুদিনও হয়েছে। | ||
৫০ নং লাইন: | ৪৪ নং লাইন: | ||
ন্যাশনাল থিয়েটারে শেষ অভিনয় হয় ১৮৭৩ সালের ৮ মার্চ। এর অল্পদিন পরেই ন্যাশনাল দুটি দলে ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন দলের নাম হয় ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। সমকালীন সুলভ সমাচার, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মিরর, ইংলিশম্যান ইত্যাদি পত্রিকায় ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | ন্যাশনাল থিয়েটারে শেষ অভিনয় হয় ১৮৭৩ সালের ৮ মার্চ। এর অল্পদিন পরেই ন্যাশনাল দুটি দলে ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন দলের নাম হয় ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। সমকালীন সুলভ সমাচার, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মিরর, ইংলিশম্যান ইত্যাদি পত্রিকায় ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | ||
''পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি'' ১৮৬৫ সালে (মতান্তরে ১৮৭০-৭২ সালের মধ্যে) পুরান ঢাকায় বর্তমান জগন্নাথ কলেজের স্থানে জমিদার মোহিনীমোহন দাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। একে কেন্দ্র করে একটি নাট্যসমাজও গড়ে উঠেছিল। ১৮৭২ সালে রামাভিষেক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে এই রঙ্গমঞ্চই ঢাকায় প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যাভিনয় শুরু করে। টিকেটের হার ছিল চার, দুই ও এক টাকা, যা সময়ের বিবেচনায় ছিল অনেক বেশি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত রামাভিষেক নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। | |||
‘প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার’ (১৮৬১) নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভাড়া নিয়ে অভিনয় করত। তবে এ মঞ্চে শুধু নাটকই প্রদর্শিত হতো না, ঢাকার অধিকাংশ সভাও এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। এদিক থেকে এটি তখন টাউন হলের প্রয়োজন মিটিয়েছে। ১৮৭৩ সালে মোহিনীমোহন দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ,'' ''নবীন তপস্বিনী,'' ''সধবার একাদশী,'' ''যেমন কর্ম তেমন ফল, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, ভারত মাতা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত। | ‘প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার’ (১৮৬১) নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভাড়া নিয়ে অভিনয় করত। তবে এ মঞ্চে শুধু নাটকই প্রদর্শিত হতো না, ঢাকার অধিকাংশ সভাও এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। এদিক থেকে এটি তখন টাউন হলের প্রয়োজন মিটিয়েছে। ১৮৭৩ সালে মোহিনীমোহন দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ,'' ''নবীন তপস্বিনী,'' ''সধবার একাদশী,'' ''যেমন কর্ম তেমন ফল, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, ভারত মাতা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত। [জিল্লুর রহমান জন] | ||
''বঙ্গ নাট্যালয়১'' ১৮৫৯ সালে জমিদার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টায় তাঁদের কলকাতাস্থ পাথুরিয়া ঘাটা প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা বছর জুলাই মাসে কালিদাসের [[সংস্কৃত|সংস্কৃত]] নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম্-এর অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ৭ জুলাই অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত উক্ত নাটকের বঙ্গানুবাদ। এরপর পাঁচ বছর এই নাট্যশালার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ১৮৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি যতীন্দ্রমোহন নতুন দল গঠন করে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। এরপরেই অভিনীত হয় বুঝলে কিনা ব্যঙ্গ্যনাট্য। পরবর্তীকালে অভিনীত নাটকগুলি সবই রামনারায়ণকৃত: যেমন কর্ম তেমন ফল, চক্ষুদান, মালতীমাধব, উভয়সঙ্কট ও রুক্মিণীহরণ। | |||
বঙ্গ নাট্যালয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্য ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, মদনমোহন বর্মণ, মহেন্দ্র মুখার্জী, রাধাপ্রসাদ বসাক, কৃষ্ণধন ব্যানার্জী প্রমুখ। ১৮৭২ সালে এর কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যায়। | বঙ্গ নাট্যালয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্য ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, মদনমোহন বর্মণ, মহেন্দ্র মুখার্জী, রাধাপ্রসাদ বসাক, কৃষ্ণধন ব্যানার্জী প্রমুখ। ১৮৭২ সালে এর কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যায়। | ||
''বঙ্গ নাট্যালয়২'' বলদেব ধর ও চুনিলাল ধরের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৮৬৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই মার্চ মাসে মনোমোহন বসুর রামাভিষেক নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে কলকাতার ২৫ নং বিশ্বনাথ মতিলাল লেনের (বহুবাজার) গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে এর যাত্রা শুরু হয়। উমাচারণ ঘোষ, অম্বিকা ব্যানার্জী, বিহারীলাল ধর, বলদেব ধর, আশুতোষ চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। | |||
পরবর্তী পাঁচ বছর বঙ্গ নাট্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৮৭৪ সালে এলাহাবাদের নীলকমল মিত্রসহ কয়েকজন নাট্যামোদী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৭ জানুয়ারি তাঁরা মনোমোহন বসুর সতী নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। একই নাট্যকারের হরিশ্চন্দ্র নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এটিই ছিল বঙ্গ নাট্যালয়ের শেষ প্রযোজনা। বঙ্গ নাট্যালয়ই প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রবেশপত্র ব্যবহার করে। | পরবর্তী পাঁচ বছর বঙ্গ নাট্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৮৭৪ সালে এলাহাবাদের নীলকমল মিত্রসহ কয়েকজন নাট্যামোদী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৭ জানুয়ারি তাঁরা মনোমোহন বসুর সতী নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। একই নাট্যকারের হরিশ্চন্দ্র নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এটিই ছিল বঙ্গ নাট্যালয়ের শেষ প্রযোজনা। বঙ্গ নাট্যালয়ই প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রবেশপত্র ব্যবহার করে। | ||
''বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ'' ১৮৫৭ সালে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো সিংহ বাড়িতে [[সিংহ, কালীপ্রসন্ন|কালীপ্রসন্ন সিংহ]] কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল কালীপ্রসন্ন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যোৎসাহিনী সভা নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গবিশেষ। প্রতিষ্ঠা বছর ১১ এপ্রিল ভট্টনারায়ণের সংস্কৃত নাটক বেণীসংহার-এর রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত বঙ্গানুবাদের অভিনয়ের মাধ্যমে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন হয়। কালীপ্রসন্ন স্বয়ং ‘ভানুমতী’ নামে একটি মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন। সংবাদ প্রভাকর (১৫ এপ্রিল) পত্রিকায় এই অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসাসহ সংবাদ পরিবেশিত হয়। | |||
এই রঙ্গমঞ্চে অভিনীত দ্বিতীয় নাটক কালীপ্রসন্ন অনূদিত কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় (২৪ নভেম্বর)। কালীপ্রসন্ন সিংহ, মহেন্দ্রনাথ মুখার্জী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি) প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি বিদোৎসাহিনী মঞ্চে অভিনয় করেন। | এই রঙ্গমঞ্চে অভিনীত দ্বিতীয় নাটক কালীপ্রসন্ন অনূদিত কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় (২৪ নভেম্বর)। কালীপ্রসন্ন সিংহ, মহেন্দ্রনাথ মুখার্জী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি) প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি বিদোৎসাহিনী মঞ্চে অভিনয় করেন। | ||
''বেঙ্গল থিয়েটার'' ১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক কলকাতার ৯ নং বিডন স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয়। মিসেস লুইস-এর চৌরঙ্গীর ‘লাইসিয়াম’ থিয়েটারের অনুকরণে শরৎচন্দ্র থিয়েটার বাড়িটি নির্মাণ করেন। নিজস্ব জমির ওপর নির্মিত বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ এটিই প্রথম। | |||
শরৎচন্দ্র এই নাট্যশালাটি যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য পন্ডিত [[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর|ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর]], মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ মনীষীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠা দিবসে এখানে মাইকেলের শর্মিষ্ঠা নাটকটি অভিনীত হয়। তারপর সুদীর্ঘ ২৮ বছরের পথপরিক্রমায় বেঙ্গল থিয়েটার ১১০টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ করে। স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এই থিয়েটারেই প্রথম জগত্তারিণী, এলোকেশী, গোলাপ (সুকুমারী) এবং শ্যামা নামে চারজন মহিলা অভিনেত্রীকে নিযুক্ত করা হয়। | শরৎচন্দ্র এই নাট্যশালাটি যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য পন্ডিত [[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর|ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর]], মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ মনীষীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠা দিবসে এখানে মাইকেলের শর্মিষ্ঠা নাটকটি অভিনীত হয়। তারপর সুদীর্ঘ ২৮ বছরের পথপরিক্রমায় বেঙ্গল থিয়েটার ১১০টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ করে। স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এই থিয়েটারেই প্রথম জগত্তারিণী, এলোকেশী, গোলাপ (সুকুমারী) এবং শ্যামা নামে চারজন মহিলা অভিনেত্রীকে নিযুক্ত করা হয়। | ||
বেঙ্গল থিয়েটার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, [[ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ|রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]], রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদসহ বহু প্রখ্যাত নাট্যকারের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক এবং ব্যঙ্গনাট্য, [[প্রহসন|প্রহসন]] | বেঙ্গল থিয়েটার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, [[ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ|রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]], রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদসহ বহু প্রখ্যাত নাট্যকারের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক এবং ব্যঙ্গনাট্য, [[প্রহসন|প্রহসন]] ইত্যাদি মঞ্চস্থ করে। শরৎচন্দ্র ঘোষ, বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অমৃতলাল বসু, খগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মহেন্দ্রলাল বসু, এলোকেশী, গোলাপ, শ্যামা, জগত্তারিণী, কুসুম কুমারী এবং আরও অনেক প্রখ্যাত শিল্পীর অভিনয়ে বেঙ্গল থিয়েটার বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সম্রাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত অভিনেত্রী [[দাসী, বিনোদিনী|বিনোদিনী]] এই বেঙ্গল থিয়েটারেই তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু করেন। ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রমোদরঞ্জনী নাকটখানির অভিনয়ের পর বেঙ্গল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। | ||
''বেঙ্গলী থিয়েটার'' প্রথম বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটার, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ মনীষী হেরাসিম লেবেদেফ কর্তৃক কলকাতার ২৫ নং ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) প্রতিষ্ঠিত হয়। লেবেদেফ তাঁর বাংলা ভাষার শিক্ষক গোলকনাথ দাসের সহাতায় এটি নির্মাণ করেন। তিনি দি ডিসগাইজ ও লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর নামক দুটি ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। গোলকনাথের প্রস্তাবে দি ডিসগাইজ-এর বাংলা অনুবাদ কাল্পনিক সংবদল মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা হয়। এ ব্যাপারে ক্যালকাটা গেজেট-এর ২৬ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, টিকিট বিক্রির হার ছিল এরূপ: বক্স ও পিট- ৮ টাকা এবং গ্যালারি- ৪ টাকা। পরের দিন ২৭ নভেম্বর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। | |||
বেঙ্গলী থিয়েটারে শেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ। এদিন বিশেষ আসনের মূল্য ছিল এক স্বর্ণমুদ্রা। বেঙ্গলী থিয়েটারে সপ্তাহে মাত্র দুটি প্রদর্শনী হতো। উল্লেখ্য যে, লেবেদেফের বেঙ্গলী থিয়েটারই প্রথম এশীয় ভাষায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার-রীতি প্রয়োগ করে। | বেঙ্গলী থিয়েটারে শেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ। এদিন বিশেষ আসনের মূল্য ছিল এক স্বর্ণমুদ্রা। বেঙ্গলী থিয়েটারে সপ্তাহে মাত্র দুটি প্রদর্শনী হতো। উল্লেখ্য যে, লেবেদেফের বেঙ্গলী থিয়েটারই প্রথম এশীয় ভাষায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার-রীতি প্রয়োগ করে। | ||
''বেলগাছিয়া থিয়েটার'' ১৮৫৮ সালে কলকাতার পাইকপাড়ার রাজভ্রাতৃদ্বয় ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে তাঁদের বেলগাছিয়া ভিলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যতীন্দ্রমোহ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, গৌরদাস বসাক ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছর ৩১ জুলাই রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত সংস্কৃত নাটক রত্নাবলী-র বঙ্গানুবাদ মঞ্চায়নের মাধ্যমে বেলগাছিয়া থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। ইংরেজ দর্শকদের সুবিধার্থে মধুসূদন ইংরেজিতে নাটকের সারাংশ লিখে দেন। | |||
পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হয় মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক। প্রিয়নাথ দত্ত, হেমচন্দ্র মুখার্জী, গৌরদাস বসাক, কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, [[মিত্র, রাজা রাজেন্দ্রলাল|রাজেন্দ্রলাল মিত্র]] প্রমুখ অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন। [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রথম ভারতীয় ঐকতান বাদন ব্যবহূত হয়; এতে নেতৃত্ব দেন | পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হয় মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক। প্রিয়নাথ দত্ত, হেমচন্দ্র মুখার্জী, গৌরদাস বসাক, কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, [[মিত্র, রাজা রাজেন্দ্রলাল|রাজেন্দ্রলাল মিত্র]] প্রমুখ অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন। [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রথম ভারতীয় ঐকতান বাদন ব্যবহূত হয়; এতে নেতৃত্ব দেন [[গোস্বামী, ক্ষেত্রমোহন|ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী]] ও যদুনাথ পাল। তৎকালীন সংবাদ প্রভাকর ও হিন্দু পত্রিকায় বেলগাছিয়া থিয়েটারের অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে বেলগাছিয়া থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | ||
''মহিলা সমিতি মিলনায়তন'' ঢাকার বেইলী রোডে অবস্থিত। এর মঞ্চটি সাধারণভাবে ‘মহিলা সমিতি মঞ্চ’ নামে পরিচিত এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটি ঢাকার নাট্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গ্রুপ থিয়েটার-চর্চাভিত্তিক নাট্যমঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন নাট্যদল নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। ঢাকায় নাটকের দর্শক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই মঞ্চে প্রদর্শিত নাট্যসমূহ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যদিও নাট্যমঞ্চায়নের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। এ মঞ্চে নাট্যপ্রদর্শনী ব্যতীত অন্য কোন সভা-সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয় না বললেই চলে। | |||
১৯৭৩ সালে এ মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হয় | ১৯৭৩ সালে এ মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হয় বার্নাড শ’ রচিত এবং ড্রামা সার্কল প্রযোজিত দান্তের মৃত্যু নাটকটি। এই দলের পরবর্তী দুটি প্রযোজনা হলো মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান (১৯৮০) এবং বিজয় তেন্ডুলকারের চুপ আদালত চলছে (১৯৮৪)। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৭৩ সালে মঞ্চস্থ করে বিদগ্ধ রমণীকুল, তৈল সংকট, ক্রস পারপাস ও নিষিদ্ধ পল্লীতে। এভাবে আরণ্যক নাট্যদল, ঢাকা থিয়েটার, নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা পদাতিক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (নাটক বিভাগ), বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, লোকনাট্যদল, ঢাকা লিটল থিয়েটার, সড়ক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, [[লায়ন থিয়েটার|লায়ন থিয়েটার]] প্রভৃতি নাট্যগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে। | ||
বাংলাদেশের প্রথম মূকাভিনয় দল ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) মহিলা সমিতি মঞ্চে ১৯৯০ সালে প্রদর্শন করে বখাটে ছেলের পরিণতি, বালক ও পাখি, জেলে, প্রেম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। ঢাকাভিত্তিক নাট্যদল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি নাট্যদল, একাধিক ভারতীয় নাট্যদল এবং [[ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই), বাংলাদেশ|ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট]] (আই.টি.আই), বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত উৎসবে আগত বিদেশি কয়েকটি নাট্য সংগঠনের নাটকও এই মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়েছে। | বাংলাদেশের প্রথম মূকাভিনয় দল ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) মহিলা সমিতি মঞ্চে ১৯৯০ সালে প্রদর্শন করে বখাটে ছেলের পরিণতি, বালক ও পাখি, জেলে, প্রেম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। ঢাকাভিত্তিক নাট্যদল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি নাট্যদল, একাধিক ভারতীয় নাট্যদল এবং [[ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই), বাংলাদেশ|ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট]] (আই.টি.আই), বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত উৎসবে আগত বিদেশি কয়েকটি নাট্য সংগঠনের নাটকও এই মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়েছে। | ||
''মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট'' ১৯৫০ সালে পুরনো ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ বিজয়া-র প্রদর্শনী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে বিজন ভট্টাচার্যের নাটক জবানবন্দি মঞ্চস্থ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ। ১৯৫২ সালে মঞ্চস্থ হয় সিকান্দার আবু জাফরের ঐতিহাসিক নাটক সিরাজউদ্দৌলা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডক্টরস ক্লাব ও কলেজ ছাত্র-সংসদ যথাক্রমে মানময়ী গার্লস স্কুল ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বীপান্তর এবং অগ্রদূত নাট্যসংঘ বিধায়ক ভট্টাচার্যের মাটির ঘর মঞ্চস্থ করে। নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি এ মঞ্চে অন্যান্য সভা-সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। [জিল্লুর রহমান জন] | |||
''মিনার্ভা থিয়েটার'' ১৮৯৩ সালে কলকাতার ৬ নং বিডন স্ট্রিটস্থ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই ২৮ জানুয়ারি নগেন্দ্রভূষণ মুখার্জীর অর্থানুকূল্যে গিরিশচন্দ্র অনূদিত শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত গিরিশচন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ, অমৃতলাল, অমরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য নাট্যকার রচিত প্রায় ৬০খানা নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্র কর্তৃক পুনর্গঠিত হয়ে তাঁর ব্যবস্থাপনায় ১৯২২ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ে মিনার্ভায় বিভিন্ন ধরনের পঞ্চাশোর্ধ্ব নাটক অভিনীত হয়। ১৯২২ সালের ১৮ অক্টোবর এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে মিনার্ভা ভস্মীভূত হয়ে যায়। | |||
১৯২৫ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের নেতৃত্বে মিনার্ভা পুনর্নিমিত হয় এবং ৮ আগস্ট মহাতাপচন্দ্র ঘোষের আত্মদর্শন নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মিনার্ভা পরিচালনা করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর হেমেন্দ্র মজুমদার, দিলোয়ার হোসেন, চন্ডীচরণ ব্যানার্জী, এল.সি গুপ্ত, রাসবিহারী সরকার প্রমুখ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ রঙ্গালয় হিসেবে মিনার্ভাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করেন। | ১৯২৫ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের নেতৃত্বে মিনার্ভা পুনর্নিমিত হয় এবং ৮ আগস্ট মহাতাপচন্দ্র ঘোষের আত্মদর্শন নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মিনার্ভা পরিচালনা করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর হেমেন্দ্র মজুমদার, দিলোয়ার হোসেন, চন্ডীচরণ ব্যানার্জী, এল.সি গুপ্ত, রাসবিহারী সরকার প্রমুখ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ রঙ্গালয় হিসেবে মিনার্ভাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করেন। | ||
৯৬ নং লাইন: | ৮৮ নং লাইন: | ||
১৯৫৯ সালে [[মিত্র, শম্ভু|শম্ভু মিত্র]] মিনার্ভায় নাট্য প্রযোজনা করেন। ঐ বছর জুন মাসে উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিয়ে নিয়মিতভাবে পেশাদারি ভিত্তিতে নাট্য প্রযোজনা শুরু করলে মিনার্ভা থিয়েটারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ এক দশক উৎপল দত্ত অনূদিত ও পরিচালিত শেক্সপীয়রের কয়েকটি নাটকসহ ছায়ানট, নীচের মহল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, ভি''-''আই''-''পি, তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল, মানুষের অধিকার প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৮ সালে লিটল থিয়েটারের প্রস্থানের পর মিনার্ভায় এক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়; তবে অদ্যাবধি থিয়েটারের ভগ্নপ্রায় বাড়িটি উনিশ শতকের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করছে। | ১৯৫৯ সালে [[মিত্র, শম্ভু|শম্ভু মিত্র]] মিনার্ভায় নাট্য প্রযোজনা করেন। ঐ বছর জুন মাসে উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিয়ে নিয়মিতভাবে পেশাদারি ভিত্তিতে নাট্য প্রযোজনা শুরু করলে মিনার্ভা থিয়েটারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ এক দশক উৎপল দত্ত অনূদিত ও পরিচালিত শেক্সপীয়রের কয়েকটি নাটকসহ ছায়ানট, নীচের মহল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, ভি''-''আই''-''পি, তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল, মানুষের অধিকার প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৮ সালে লিটল থিয়েটারের প্রস্থানের পর মিনার্ভায় এক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়; তবে অদ্যাবধি থিয়েটারের ভগ্নপ্রায় বাড়িটি উনিশ শতকের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করছে। | ||
''মেট্রোপলিটন থিয়েটার'' হিন্দু ‘বিধবা বিবাহ’ প্রথা প্রচলনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার মানসে ১৮৫৯ সালে মুরলীধর সেন কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত বক্তা ও সমাজ-সংস্কারক [[সেন, কেশবচন্দ্র|কেশবচন্দ্র সেন]], ধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর উদ্যোক্তা ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৩ এপ্রিল কলকাতার চিৎপুর সিঁদুরিয়া পট্টির গোপাল মল্লিকের বাড়িতে উমেশচন্দ্র সেনের নাটক বিধবা বিবাহ মঞ্চায়নের মাধ্যমে এটি উদ্বোধিত হয়। বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অক্ষয় মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, কুঞ্জবিহারী সেন প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। অভিনয় পরিচালনা করেন কেশবচন্দ্র সেন এবং দৃশ্যপট অঙ্কন করেন ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী মি.হল বাইন। সংবাদ প্রভাকর (১৪ মে) পত্রিকায় এ অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | |||
''রঙমহল থিয়েটার'' ১৯৩১ সালে কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (বর্তমান বিধান সরণী) রবীন্দ্রনাথ রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে (অন্ধ গায়ক) ও রবি রায় পরিচালকের এবং অমর ঘোষ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ষষ্টী গাঙ্গুলী, নির্মলচন্দ্র, এস আহমেদ, ডি.এন ধর, [[ঘোষ, হরচন্দ্র|হরচন্দ্র ঘোষ]], হেমচন্দ্র দে প্রমুখ মিলে রঙমহল থিয়েটারকে একটি যৌথ কোম্পানির চরিত্র দান করেন। | |||
প্রতিষ্ঠা বছরের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে রঙমহল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। [[ভাদুড়ী, শিশিরকুমার|শিশিরকুমার ভাদুড়ী]] এর পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন করেন আর্ট থিয়েটারের পরিচালক, নাট্যকার ও অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। | প্রতিষ্ঠা বছরের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে রঙমহল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। [[ভাদুড়ী, শিশিরকুমার|শিশিরকুমার ভাদুড়ী]] এর পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন করেন আর্ট থিয়েটারের পরিচালক, নাট্যকার ও অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। | ||
১০৮ নং লাইন: | ৯৮ নং লাইন: | ||
এরপর বহু ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে রঙমহল থিয়েটার অগ্রসর হয়। থিয়েটারের মালিকানাও পরিবর্তিত হয় এবং অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিবর্তন ঘটে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ব্যঙ্গ্যবিষয়ক নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে। কোন কোন নাটক (যেমন উল্কা) একাদিক্রমে ৫০০ রজনী অভিনীত হয়ে বাংলা থিয়েটারে সাড়া জাগিয়েছে। পরবর্তীকালে এই মঞ্চে যাঁরা নাট্য পরিচালনা করেন কিংবা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) প্রমুখ। মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: শতবর্ষ আগে, কবি, দুই পুরুষ, মায়ামৃগ, একমুঠো আকাশ, এক পেয়ালা কফি, সাহেব বিবি গোলাম, অনর্থ, চক্র ইত্যাদি। ১৯৭৫ সাল থেকে ক্যাবারে নৃত্য চালু হলে রঙমহলের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়; রুচিবান অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী রঙমহল ত্যাগ করেন এবং এর ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রঙমহল থিয়েটার এখনও টিকে আছে। | এরপর বহু ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে রঙমহল থিয়েটার অগ্রসর হয়। থিয়েটারের মালিকানাও পরিবর্তিত হয় এবং অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিবর্তন ঘটে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ব্যঙ্গ্যবিষয়ক নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে। কোন কোন নাটক (যেমন উল্কা) একাদিক্রমে ৫০০ রজনী অভিনীত হয়ে বাংলা থিয়েটারে সাড়া জাগিয়েছে। পরবর্তীকালে এই মঞ্চে যাঁরা নাট্য পরিচালনা করেন কিংবা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) প্রমুখ। মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: শতবর্ষ আগে, কবি, দুই পুরুষ, মায়ামৃগ, একমুঠো আকাশ, এক পেয়ালা কফি, সাহেব বিবি গোলাম, অনর্থ, চক্র ইত্যাদি। ১৯৭৫ সাল থেকে ক্যাবারে নৃত্য চালু হলে রঙমহলের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়; রুচিবান অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী রঙমহল ত্যাগ করেন এবং এর ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রঙমহল থিয়েটার এখনও টিকে আছে। | ||
''লায়ন থিয়েটার'' ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। বিশ শতকের প্রথম দিকে মীর্জা আবদুল কাদের ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ক্রয় করে এর নতুন নামকরণ করেন লায়ন থিয়েটার। এখানে বাংলা নাটকের পাশাপাশি [[উর্দু|উর্দু]] নাটকও মঞ্চস্থ হতো। উর্দু নাটকগুলির মধ্যে ছিল জালমা ও পারাস্তা, বুলবুল এ বিমার ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যকার যোগেন গুপ্তের চিড়িয়াখানা এবং বিপিন বিহারী চামের লাঞ্ছনা নামক দুটি প্রহসনও এখানে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় ফিল্মের আবির্ভাব হলে লায়ন থিয়েটারে নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে ‘লায়ন সিনেমা’ নামে এটিকে প্রেক্ষাগৃহে পরিণত করা হয় এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। [জিল্লুর রহমান জন] | |||
''স্টার থিয়েটার১'' ১৮৮৩ সালে কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান বিডন স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিন্যুর সংযোগস্থল) প্রতিষ্ঠিত হয়। গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন। গুর্মুখ রায় নামে জনৈক অবাঙালি যুবক থিয়েটারে অর্থলগ্নী করেন। তিনি সুন্দরী নটী বিনোদিনীর নামানুসারে ‘বি’ থিয়েটার নামকরণের শর্ত আরোপ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘স্টার’ থিয়েটার নাম হয়। | |||
প্রতিষ্ঠা বছর ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বিক্রি করে দিলে অমৃতলাল বসু, দাসু নিয়োগী ও হরি বোস এটি ক্রয় করেন এবং ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করেন। এরপর স্টার থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। | প্রতিষ্ঠা বছর ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বিক্রি করে দিলে অমৃতলাল বসু, দাসু নিয়োগী ও হরি বোস এটি ক্রয় করেন এবং ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করেন। এরপর স্টার থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। | ||
১১৬ নং লাইন: | ১০৬ নং লাইন: | ||
স্টার থিয়েটারে মোট ২০খানি নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং সেসবের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র, বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পি। একবার [[রামকৃষ্ণ, শ্রী|রামকৃষ্ণ]] পরমহংসদেব ধর্মীয় নাটক চৈতন্যলীলা দেখতে এসে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন। ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই স্টার থিয়েটারে শেষ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। | স্টার থিয়েটারে মোট ২০খানি নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং সেসবের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র, বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পি। একবার [[রামকৃষ্ণ, শ্রী|রামকৃষ্ণ]] পরমহংসদেব ধর্মীয় নাটক চৈতন্যলীলা দেখতে এসে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন। ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই স্টার থিয়েটারে শেষ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। | ||
''স্টার থিয়েটার২'' ১৮৮৮ সালে কলকাতার হাতিবাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার ভেঙ্গে যাওয়ার পর মূলত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের উদ্যোগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মদাস সুর এবং ইঞ্জিনিয়ার যোগেন গুপ্তের নকশা অনুযায়ী থিয়েটার হাউস ও তার মঞ্চ নির্মিত হয়। এক সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষও এর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৫ মে ‘সেবক’ ছদ্মনামে গিরিশ ঘোষ রচিত নসীরাম নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নবনির্মিত হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। | |||
১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে বহুবার স্টারের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও আধুনিকীকরণও হয়েছে। শেষদিকে এর মঞ্চটি ছিল ঘূর্ণায়মান। গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অপরেশচন্দ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, দেবনারায়ণ গুপ্তসহ ৮০ জনেরও বেশি নাট্যকারের প্রায় ২৫০টি বাংলা নাটক এ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হিন্দি নাটক অভিনীত হয়েছে ১২টিরও বেশি। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, গঙ্গামণি, কাদম্বিনী, অমর দত্ত, দানীবাবু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার, [[চৌধুরী, অহীন্দ্র নটসূর্য|অহীন্দ্র চৌধুরী]], নীহারবালা, সরযূবালা, ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, প্রেমাংশু বসু, অনুপকুমার প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী স্টারে অভিনয় করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঐতিহ্যমন্ডিত এ থিয়েটার হাউসটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। | ১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে বহুবার স্টারের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও আধুনিকীকরণও হয়েছে। শেষদিকে এর মঞ্চটি ছিল ঘূর্ণায়মান। গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অপরেশচন্দ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, দেবনারায়ণ গুপ্তসহ ৮০ জনেরও বেশি নাট্যকারের প্রায় ২৫০টি বাংলা নাটক এ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হিন্দি নাটক অভিনীত হয়েছে ১২টিরও বেশি। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, গঙ্গামণি, কাদম্বিনী, অমর দত্ত, দানীবাবু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার, [[চৌধুরী, অহীন্দ্র নটসূর্য|অহীন্দ্র চৌধুরী]], নীহারবালা, সরযূবালা, ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, প্রেমাংশু বসু, অনুপকুমার প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী স্টারে অভিনয় করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঐতিহ্যমন্ডিত এ থিয়েটার হাউসটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। | ||
''হিন্দু থিয়েটার'' ১৮৩১ সালে কলকাতার প্রান্তে শুঁড়ো-নারিকেলভাঙ্গায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও এ মঞ্চে কোন বাংলা নাটক অভিনীত হয় নি। প্রতিষ্ঠা বছর ২৮ ডিসেম্বর শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের পঞ্চম অঙ্ক এবং ভবভূতির সংস্কৃত নাটক উত্তররামচরিতম্-এর প্রথম অঙ্কের ইংরেজি অনুবাদ অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বারোদ্ঘাটন হয়। গঙ্গাচরণ সেন, রামচন্দ্র মিত্র, [[হিন্দু কলেজ|হিন্দু কলেজ]] ও সংস্কৃত কলেজের ছাত্রবৃন্দ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ নাথিং সুপারফ্লুয়াস নামে একখানি ইংরেজি প্রহসন অভিনীত হওয়ার পর হিন্দু থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এটি বাঙালি দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারে নি। [গণেশ মুখোপাধ্যায়] | |||
[[en:Theatre Stage]] | [[en:Theatre Stage]] |
১০:৫০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
নাট্যমঞ্চ প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী লেবেদেফ। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) তিনি ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ স্থাপন করে ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ-নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল, যেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই অভিনীত হতো।
লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন, যেমন: হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায়ও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি (১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ (১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার (১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০৫), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ( টাঙ্গাইল, ১৯১১) ইত্যাদি। এ সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষ, এলেংগা, শিবপুর, আলোয়া ও করটিয়ার জমিদাররা বেশ কয়েকটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়, যেমন: ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন, গণগ্রন্থাগার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, কচিকাঁচা মিলনায়তন, ওয়াপদা মিলনায়তন, অশ্বিনীকুমার টাউন হল (বরিশাল, ১৯৩০), জে.এম.সেন হল (চট্টগ্রাম), মুসলিম হল (চট্টগ্রাম) ইত্যাদি। উভয় বঙ্গের কয়েকটি প্রধান নাট্যমঞ্চের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো:
এমারেল্ড থিয়েটার ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলুটোলা নিবাসী গোপাললাল শীল এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে থিয়েটারের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্যপট ও পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করান এবং গ্যাসের আলোর পরিবর্তে ডায়নামোর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৮ অক্টোবর থিয়েটারের উদ্বোধন দিবসে কেদারলাল চৌধুরীর একখানি পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ হয়; কিন্তু দক্ষ পরিচালনার অভাবে থিয়েটারের দর্শকসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় গোপাল শীলের আমন্ত্রণে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েকখানি পুরাতন ও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেগুলির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র ও বিষাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
কিছুদিন পরে প্রখ্যাত মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর এর মঞ্চসজ্জায় নিযুক্ত হন। কিন্তু খেয়ালি মানুষ গোপাল শীল দুবছরের মাথায় থিয়েটার বিক্রি করে দেন। তার পরেও বিভিন্ন মালিকানায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। কেদারলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়। এর প্রধান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি, মহেন্দ্র বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, বনবিহারিণী, ক্ষেত্রমণি, সুকুমারী, কুসুম, গুল্ফন হরি প্রমুখ।
ওরিয়েন্টাল থিয়েটার ১৮৫৩ সালে কলকাতার ২৬৮ নং গরানহাটা, চিৎপুরে গৌরমোহন আড্ডির ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল বাড়ির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের অভিনয়ের জন্য মি. ক্লিঞ্জার ও মিসেস এলিস ছাত্রদের শিক্ষা দেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় এবং এর দ্বিতীয় অভিনয় হয় ৫ অক্টোবর।
১৮৫৪ সালের ২ ও ১৭ মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় মার্চেন্ট অফ ভেনিস। মিসেস গ্রেইর্গ নামে জনৈকা মহিলা ‘পোর্সিয়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেক্সপীয়রের হেনরি ফোর্থ ও হেনরি পার্কার মেরিডিথের এ্যামেচার নাটকদুটি অভিনীত হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে শেক্সপীয়রের আর একখানি নাটক অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে।
ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের ব্যয় নির্বাহ হতো টিকেট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে, যেহেতু এটি কোন বিত্তবানের প্রাসাদের থিয়েটার ছিল না। এর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন এবং বিবরণসমূহ সংবাদ প্রভাকর, বেঙ্গল হরকরা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দি মর্নিং ক্রনিকল, দি সিটিজেন ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে কোনও এক সময় পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথমে ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চ; কিন্তু এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাউন থিয়েটার সেটি ভেঙ্গে নতুন করে মঞ্চ নির্মাণ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে মঞ্চটি এক সময় ইসলামপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৭ সালে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় অভিনেতা-অভিনেত্রী সেখানে যোগ দেন এবং এর ফলে ক্রাউনের কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুকাল পরে ক্রাউন থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলে নাট্যমঞ্চ হিসেবে এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গাইড হাউস মিলনায়তন ঢাকার নিউ বেইলী রোডে বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। আশির দশক থেকে এই মঞ্চটি নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যাবৃদ্ধি, নতুন নতুন নাট্যদলের উদ্ভব, নাটকের দর্শক সৃষ্টি ইত্যাদি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গাইড হাউস মিলনায়তনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা শহরে এখানেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী শুরু হয়।
গাইড হাউস মিলনায়তনে বিভিন্ন নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: বহুবচনের প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২), ইডিপাস (১৯৮২); থিয়েটারের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), ঘরে-বাইরে (১৯৮৫), কোকিলারা (১৯৮৯), আন্তিগোনে (১৯৯২); ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা (১৯৭৮); নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দেওয়ান গাজীর কিস্সা, বিসর্জন (১৯৮৫); সুবচন নাট্য সংসদের জীবন ঘষে আগুন (১৯৮৬); লোক নাট্যদলের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯১), মহাপ্রয়াণ (১৯৯৪), একাত্তরের দিনগুলো (১৯৯৫); সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আসমান তারা শাড়ী (১৯৯১), বাজিমাৎ (১৯৯৪); কুশিলব নাট্য সম্প্রদায়ের নো ভেকেনসি (১৯৯১); নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু (১৯৯১), লালসালু (১৯৯১), তুঘলোক (১৯৯২); সড়কের হ্যালুসিনেশন (১৯৯২); ঢাকা লিটল থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস (১৯৯৩); থিয়েটার আর্টের কোর্ট মার্শাল (১৯৯৩), কালান্তর (১৯৯৪), গোলাপজান (১৯৯৫); কণ্ঠশীলনের পুতুল খেলা (১৯৯৩), ভৃত্য রাজকতন্ত্র (১৯৯৫); ঢাকা সুবচন নাট্যদলের বিবিসাব (১৯৯৪); ঢাকা পদাতিকের ফেরা (১৯৯৪); জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের পাবলিক (১৯৯৫) ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দলীয় মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) গাইড হাউস মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে মঞ্চস্থ করে মানব ও প্রকৃতি, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ভাষা আন্দোলন, নদী পাড়ের জীবন, মাদকাশক্তি এবং স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। নাটক ও মূকাভিনয় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৩ সালে ভুবনমোহন নিয়োগী কর্তৃক কলকাতার বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান মিনার্ভা থিয়েটারের স্থলে) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পরে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটি লিজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচালনা করেন; কিন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যেই কৃষ্ণধন ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং ভূবনমোহন পুনরায় থিয়েটারটি নিজের হাতে নিয়ে পূর্বনামেই চালাতে থাকেন। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতলাল বসুর হীরকচূর্ণ ও উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী নাটক এখানে অভিনীত হয়। হীরকচূর্ণ নাটকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম রেলগাড়ি দেখানো হয়। পরবর্তীকালে এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: প্রকৃত বন্ধু, সরোজিনী, বিদ্যাসুন্দর, গজদানন্দ ও যুবরাজ, কর্ণাটকুমার ইত্যাদি।
গজদানন্দ ও যুবরাজ একটি কৌতুক নাটক; মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস (সপ্তম এডওয়ার্ড) ১৮৭৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলে তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত হয়। এতে সরকারি মহলে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং পুলিশ এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। রচয়িতা উপেন্দ্রনাথ পুলিশকে বিদ্রূপ করে The Police of Pig and Sheep নামে আরও একটি কৌতুক নাটক রচনা করেন এবং ১৮৭৬ সালের ১ মার্চ নাটকটি এখানে মঞ্চস্থ হয়। এর পরিণতি হিসেবে নাট্যাভিনয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ঐ বছরই অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। এভাবে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি কারণে ভুবনমোহন সর্বস্বান্ত হয়ে থিয়েটারের সংস্রব ত্যাগ করেন এবং অন্যরাও থিয়েটার ছেড়ে চলে যান। ১৮৮০ সালে প্রতাপচাঁদ জহুরী নামে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এটি ক্রয় করে গিরিশ ঘোষকে পরিচালনার দায়িত্ব দেন। [জিল্লুর রহমান জন]
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা১ প্যারীমোহন বসু কর্তৃক ১৮৫৪ সালে তাঁর কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের নিজস্ব বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই ৩ মে এই মঞ্চে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকটি অভিনীত হয়। মহেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণধন দত্ত, যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। সংবাদ প্রভাকর (৫ মে ১৮৫৪) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় চারশত ভারতীয় ও ইংরেজ দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা (১১ মে ১৮৫৪) নাট্যশালার নিকট বাঙালি দর্শকদের জন্য বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়।
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা২ ১৮৬৫ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেকালের বিখ্যাত গোপাল উড়িয়ার যাত্রাগান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মঞ্চাভিনয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলীর সহায়তায় এ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা এবং গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবুবিলাস নাটক অভিনীত হয়। এরপর উদ্যোক্তাগণ সমকালীন সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক আহবান করে পুরস্কারসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। বিচারকদের বিচারে রামনারায়ণ তর্করত্নের নবনাটক শ্রেষ্ঠরূপে নির্বাচিত হয় এবং নাট্যকারকে একটি রূপার থালায় ২০০ রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি নাটকটি অভিনীত হয়। অক্ষয় মজুমদার, সারদা গাঙ্গুলী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এতে অভিনয় করেন। ৯ জানুয়ারি ন্যাশনাল ও ২৮ জানুয়ারি সোমপ্রকাশ পত্রিকায় উক্ত প্রযোজনার উচ্চ প্রশংসা করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল জোড়াসাঁকো নাট্যশালার শেষ অভিনয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী কর্তৃক ১৮৯৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোরীলাল প্রথমে ক্রাউন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু এক সময় এর শিল্পী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দিলে তিনি ক্রাউনেরই কতিপয় শিল্পী নিয়ে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বর্তমান লায়ন সিনেমা হলের জায়গায় এ মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল।
ডায়মন্ড কলকাতা থেকে অভিনেত্রী এনে, প্রয়োজনে স্থানীয় বাইজিদের দিয়ে অভিনয় করাত। এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: দুর্গেশনন্দিনী, দেবীচৌধুরানী, বিজয় বসন্ত, আলীবাবা, নবীন তপস্বিনী, বিল্বমঙ্গল, নন্দদুলাল, তরুবালা ইত্যাদি। এর টিকেটের হার ছিল দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা ও চার আনা। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার প্রচলনের পেছনে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। [জিল্লুর রহমান জন]
ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের সভ্যগণ সর্বশ্রেণীর দর্শকদের সুবিধার্থে একটি সাধারণ রঙ্গালয় প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী এটি নির্মিত হয়। এ কারণে মঞ্চটি প্রথম বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ হিসেবে খ্যাত।
রঙ্গালয়ের টিকেট বিক্রয়ের অর্থে শুধু নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার ব্যয়টুকু নির্বাহ করাই ছিল ন্যাশনালের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে ৩৩ নং চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের মন্দির ভবনে একটি অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয় এবং মঞ্চের নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু এরূপ একটি অস্থায়ী ও যৎকিঞ্চিৎ সজ্জিত মঞ্চের ‘ন্যাশনাল’ নাম নিয়ে দলপতি গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে সাধারণ সভ্যদের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি দলত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পালন করেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। প্রথম দিকে প্রতি শনিবার এখানে অভিনয় হতো; পরের দিকে সপ্তাহে দুদিনও হয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্র ছাড়াও শিশিরকুমার ঘোষ, কিরণচন্দ্র ব্যানার্জী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রামনারায়ণ তর্করত্নেরও কয়েকটি নাটক ন্যাশনালে অভিনীত হয়েছে। মাঝে মাঝে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি হাস্যরসাত্মক প্যান্টোমাইম পরিবেশন করতেন। উল্লেখযোগ্য অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন অর্ধেন্দু মুস্তফি, নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মতিলাল সুর, মহেন্দ্রনাথ বসু, অমৃতলাল বসু প্রমুখ। ১৮৭৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হিন্দুমেলা নাটকে অভিনয়ের জন্য গিরিশচন্দ্র পুনরায় এতে যোগ দেন।
ন্যাশনাল থিয়েটারে শেষ অভিনয় হয় ১৮৭৩ সালের ৮ মার্চ। এর অল্পদিন পরেই ন্যাশনাল দুটি দলে ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন দলের নাম হয় ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। সমকালীন সুলভ সমাচার, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মিরর, ইংলিশম্যান ইত্যাদি পত্রিকায় ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ১৮৬৫ সালে (মতান্তরে ১৮৭০-৭২ সালের মধ্যে) পুরান ঢাকায় বর্তমান জগন্নাথ কলেজের স্থানে জমিদার মোহিনীমোহন দাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। একে কেন্দ্র করে একটি নাট্যসমাজও গড়ে উঠেছিল। ১৮৭২ সালে রামাভিষেক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে এই রঙ্গমঞ্চই ঢাকায় প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যাভিনয় শুরু করে। টিকেটের হার ছিল চার, দুই ও এক টাকা, যা সময়ের বিবেচনায় ছিল অনেক বেশি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত রামাভিষেক নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার’ (১৮৬১) নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভাড়া নিয়ে অভিনয় করত। তবে এ মঞ্চে শুধু নাটকই প্রদর্শিত হতো না, ঢাকার অধিকাংশ সভাও এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। এদিক থেকে এটি তখন টাউন হলের প্রয়োজন মিটিয়েছে। ১৮৭৩ সালে মোহিনীমোহন দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, যেমন কর্ম তেমন ফল, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, ভারত মাতা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত। [জিল্লুর রহমান জন]
বঙ্গ নাট্যালয়১ ১৮৫৯ সালে জমিদার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টায় তাঁদের কলকাতাস্থ পাথুরিয়া ঘাটা প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা বছর জুলাই মাসে কালিদাসের সংস্কৃত নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম্-এর অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ৭ জুলাই অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত উক্ত নাটকের বঙ্গানুবাদ। এরপর পাঁচ বছর এই নাট্যশালার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ১৮৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি যতীন্দ্রমোহন নতুন দল গঠন করে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। এরপরেই অভিনীত হয় বুঝলে কিনা ব্যঙ্গ্যনাট্য। পরবর্তীকালে অভিনীত নাটকগুলি সবই রামনারায়ণকৃত: যেমন কর্ম তেমন ফল, চক্ষুদান, মালতীমাধব, উভয়সঙ্কট ও রুক্মিণীহরণ।
বঙ্গ নাট্যালয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্য ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, মদনমোহন বর্মণ, মহেন্দ্র মুখার্জী, রাধাপ্রসাদ বসাক, কৃষ্ণধন ব্যানার্জী প্রমুখ। ১৮৭২ সালে এর কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গ নাট্যালয়২ বলদেব ধর ও চুনিলাল ধরের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৮৬৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই মার্চ মাসে মনোমোহন বসুর রামাভিষেক নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে কলকাতার ২৫ নং বিশ্বনাথ মতিলাল লেনের (বহুবাজার) গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে এর যাত্রা শুরু হয়। উমাচারণ ঘোষ, অম্বিকা ব্যানার্জী, বিহারীলাল ধর, বলদেব ধর, আশুতোষ চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন।
পরবর্তী পাঁচ বছর বঙ্গ নাট্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৮৭৪ সালে এলাহাবাদের নীলকমল মিত্রসহ কয়েকজন নাট্যামোদী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৭ জানুয়ারি তাঁরা মনোমোহন বসুর সতী নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। একই নাট্যকারের হরিশ্চন্দ্র নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এটিই ছিল বঙ্গ নাট্যালয়ের শেষ প্রযোজনা। বঙ্গ নাট্যালয়ই প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রবেশপত্র ব্যবহার করে।
বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ ১৮৫৭ সালে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো সিংহ বাড়িতে কালীপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল কালীপ্রসন্ন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যোৎসাহিনী সভা নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গবিশেষ। প্রতিষ্ঠা বছর ১১ এপ্রিল ভট্টনারায়ণের সংস্কৃত নাটক বেণীসংহার-এর রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত বঙ্গানুবাদের অভিনয়ের মাধ্যমে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন হয়। কালীপ্রসন্ন স্বয়ং ‘ভানুমতী’ নামে একটি মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন। সংবাদ প্রভাকর (১৫ এপ্রিল) পত্রিকায় এই অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসাসহ সংবাদ পরিবেশিত হয়।
এই রঙ্গমঞ্চে অভিনীত দ্বিতীয় নাটক কালীপ্রসন্ন অনূদিত কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় (২৪ নভেম্বর)। কালীপ্রসন্ন সিংহ, মহেন্দ্রনাথ মুখার্জী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি) প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি বিদোৎসাহিনী মঞ্চে অভিনয় করেন।
বেঙ্গল থিয়েটার ১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক কলকাতার ৯ নং বিডন স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয়। মিসেস লুইস-এর চৌরঙ্গীর ‘লাইসিয়াম’ থিয়েটারের অনুকরণে শরৎচন্দ্র থিয়েটার বাড়িটি নির্মাণ করেন। নিজস্ব জমির ওপর নির্মিত বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ এটিই প্রথম।
শরৎচন্দ্র এই নাট্যশালাটি যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ মনীষীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠা দিবসে এখানে মাইকেলের শর্মিষ্ঠা নাটকটি অভিনীত হয়। তারপর সুদীর্ঘ ২৮ বছরের পথপরিক্রমায় বেঙ্গল থিয়েটার ১১০টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ করে। স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এই থিয়েটারেই প্রথম জগত্তারিণী, এলোকেশী, গোলাপ (সুকুমারী) এবং শ্যামা নামে চারজন মহিলা অভিনেত্রীকে নিযুক্ত করা হয়।
বেঙ্গল থিয়েটার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদসহ বহু প্রখ্যাত নাট্যকারের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক এবং ব্যঙ্গনাট্য, প্রহসন ইত্যাদি মঞ্চস্থ করে। শরৎচন্দ্র ঘোষ, বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অমৃতলাল বসু, খগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মহেন্দ্রলাল বসু, এলোকেশী, গোলাপ, শ্যামা, জগত্তারিণী, কুসুম কুমারী এবং আরও অনেক প্রখ্যাত শিল্পীর অভিনয়ে বেঙ্গল থিয়েটার বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সম্রাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত অভিনেত্রী বিনোদিনী এই বেঙ্গল থিয়েটারেই তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু করেন। ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রমোদরঞ্জনী নাকটখানির অভিনয়ের পর বেঙ্গল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
বেঙ্গলী থিয়েটার প্রথম বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটার, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ মনীষী হেরাসিম লেবেদেফ কর্তৃক কলকাতার ২৫ নং ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) প্রতিষ্ঠিত হয়। লেবেদেফ তাঁর বাংলা ভাষার শিক্ষক গোলকনাথ দাসের সহাতায় এটি নির্মাণ করেন। তিনি দি ডিসগাইজ ও লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর নামক দুটি ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। গোলকনাথের প্রস্তাবে দি ডিসগাইজ-এর বাংলা অনুবাদ কাল্পনিক সংবদল মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা হয়। এ ব্যাপারে ক্যালকাটা গেজেট-এর ২৬ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, টিকিট বিক্রির হার ছিল এরূপ: বক্স ও পিট- ৮ টাকা এবং গ্যালারি- ৪ টাকা। পরের দিন ২৭ নভেম্বর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
বেঙ্গলী থিয়েটারে শেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ। এদিন বিশেষ আসনের মূল্য ছিল এক স্বর্ণমুদ্রা। বেঙ্গলী থিয়েটারে সপ্তাহে মাত্র দুটি প্রদর্শনী হতো। উল্লেখ্য যে, লেবেদেফের বেঙ্গলী থিয়েটারই প্রথম এশীয় ভাষায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার-রীতি প্রয়োগ করে।
বেলগাছিয়া থিয়েটার ১৮৫৮ সালে কলকাতার পাইকপাড়ার রাজভ্রাতৃদ্বয় ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে তাঁদের বেলগাছিয়া ভিলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যতীন্দ্রমোহ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, গৌরদাস বসাক ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছর ৩১ জুলাই রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত সংস্কৃত নাটক রত্নাবলী-র বঙ্গানুবাদ মঞ্চায়নের মাধ্যমে বেলগাছিয়া থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। ইংরেজ দর্শকদের সুবিধার্থে মধুসূদন ইংরেজিতে নাটকের সারাংশ লিখে দেন।
পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হয় মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক। প্রিয়নাথ দত্ত, হেমচন্দ্র মুখার্জী, গৌরদাস বসাক, কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রথম ভারতীয় ঐকতান বাদন ব্যবহূত হয়; এতে নেতৃত্ব দেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ও যদুনাথ পাল। তৎকালীন সংবাদ প্রভাকর ও হিন্দু পত্রিকায় বেলগাছিয়া থিয়েটারের অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে বেলগাছিয়া থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
মহিলা সমিতি মিলনায়তন ঢাকার বেইলী রোডে অবস্থিত। এর মঞ্চটি সাধারণভাবে ‘মহিলা সমিতি মঞ্চ’ নামে পরিচিত এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটি ঢাকার নাট্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গ্রুপ থিয়েটার-চর্চাভিত্তিক নাট্যমঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন নাট্যদল নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। ঢাকায় নাটকের দর্শক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই মঞ্চে প্রদর্শিত নাট্যসমূহ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যদিও নাট্যমঞ্চায়নের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। এ মঞ্চে নাট্যপ্রদর্শনী ব্যতীত অন্য কোন সভা-সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয় না বললেই চলে।
১৯৭৩ সালে এ মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হয় বার্নাড শ’ রচিত এবং ড্রামা সার্কল প্রযোজিত দান্তের মৃত্যু নাটকটি। এই দলের পরবর্তী দুটি প্রযোজনা হলো মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান (১৯৮০) এবং বিজয় তেন্ডুলকারের চুপ আদালত চলছে (১৯৮৪)। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৭৩ সালে মঞ্চস্থ করে বিদগ্ধ রমণীকুল, তৈল সংকট, ক্রস পারপাস ও নিষিদ্ধ পল্লীতে। এভাবে আরণ্যক নাট্যদল, ঢাকা থিয়েটার, নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা পদাতিক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (নাটক বিভাগ), বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, লোকনাট্যদল, ঢাকা লিটল থিয়েটার, সড়ক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, লায়ন থিয়েটার প্রভৃতি নাট্যগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম মূকাভিনয় দল ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) মহিলা সমিতি মঞ্চে ১৯৯০ সালে প্রদর্শন করে বখাটে ছেলের পরিণতি, বালক ও পাখি, জেলে, প্রেম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। ঢাকাভিত্তিক নাট্যদল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি নাট্যদল, একাধিক ভারতীয় নাট্যদল এবং ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই), বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত উৎসবে আগত বিদেশি কয়েকটি নাট্য সংগঠনের নাটকও এই মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়েছে।
মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট ১৯৫০ সালে পুরনো ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ বিজয়া-র প্রদর্শনী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে বিজন ভট্টাচার্যের নাটক জবানবন্দি মঞ্চস্থ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ। ১৯৫২ সালে মঞ্চস্থ হয় সিকান্দার আবু জাফরের ঐতিহাসিক নাটক সিরাজউদ্দৌলা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডক্টরস ক্লাব ও কলেজ ছাত্র-সংসদ যথাক্রমে মানময়ী গার্লস স্কুল ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বীপান্তর এবং অগ্রদূত নাট্যসংঘ বিধায়ক ভট্টাচার্যের মাটির ঘর মঞ্চস্থ করে। নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি এ মঞ্চে অন্যান্য সভা-সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। [জিল্লুর রহমান জন]
মিনার্ভা থিয়েটার ১৮৯৩ সালে কলকাতার ৬ নং বিডন স্ট্রিটস্থ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই ২৮ জানুয়ারি নগেন্দ্রভূষণ মুখার্জীর অর্থানুকূল্যে গিরিশচন্দ্র অনূদিত শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত গিরিশচন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ, অমৃতলাল, অমরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য নাট্যকার রচিত প্রায় ৬০খানা নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্র কর্তৃক পুনর্গঠিত হয়ে তাঁর ব্যবস্থাপনায় ১৯২২ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ে মিনার্ভায় বিভিন্ন ধরনের পঞ্চাশোর্ধ্ব নাটক অভিনীত হয়। ১৯২২ সালের ১৮ অক্টোবর এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে মিনার্ভা ভস্মীভূত হয়ে যায়।
১৯২৫ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের নেতৃত্বে মিনার্ভা পুনর্নিমিত হয় এবং ৮ আগস্ট মহাতাপচন্দ্র ঘোষের আত্মদর্শন নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মিনার্ভা পরিচালনা করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর হেমেন্দ্র মজুমদার, দিলোয়ার হোসেন, চন্ডীচরণ ব্যানার্জী, এল.সি গুপ্ত, রাসবিহারী সরকার প্রমুখ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ রঙ্গালয় হিসেবে মিনার্ভাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করেন।
১৯৫৯ সালে শম্ভু মিত্র মিনার্ভায় নাট্য প্রযোজনা করেন। ঐ বছর জুন মাসে উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিয়ে নিয়মিতভাবে পেশাদারি ভিত্তিতে নাট্য প্রযোজনা শুরু করলে মিনার্ভা থিয়েটারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ এক দশক উৎপল দত্ত অনূদিত ও পরিচালিত শেক্সপীয়রের কয়েকটি নাটকসহ ছায়ানট, নীচের মহল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, ভি-আই-পি, তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল, মানুষের অধিকার প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৮ সালে লিটল থিয়েটারের প্রস্থানের পর মিনার্ভায় এক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়; তবে অদ্যাবধি থিয়েটারের ভগ্নপ্রায় বাড়িটি উনিশ শতকের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করছে।
মেট্রোপলিটন থিয়েটার হিন্দু ‘বিধবা বিবাহ’ প্রথা প্রচলনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার মানসে ১৮৫৯ সালে মুরলীধর সেন কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত বক্তা ও সমাজ-সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন, ধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর উদ্যোক্তা ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৩ এপ্রিল কলকাতার চিৎপুর সিঁদুরিয়া পট্টির গোপাল মল্লিকের বাড়িতে উমেশচন্দ্র সেনের নাটক বিধবা বিবাহ মঞ্চায়নের মাধ্যমে এটি উদ্বোধিত হয়। বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অক্ষয় মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, কুঞ্জবিহারী সেন প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। অভিনয় পরিচালনা করেন কেশবচন্দ্র সেন এবং দৃশ্যপট অঙ্কন করেন ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী মি.হল বাইন। সংবাদ প্রভাকর (১৪ মে) পত্রিকায় এ অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
রঙমহল থিয়েটার ১৯৩১ সালে কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (বর্তমান বিধান সরণী) রবীন্দ্রনাথ রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে (অন্ধ গায়ক) ও রবি রায় পরিচালকের এবং অমর ঘোষ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ষষ্টী গাঙ্গুলী, নির্মলচন্দ্র, এস আহমেদ, ডি.এন ধর, হরচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র দে প্রমুখ মিলে রঙমহল থিয়েটারকে একটি যৌথ কোম্পানির চরিত্র দান করেন।
প্রতিষ্ঠা বছরের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে রঙমহল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। শিশিরকুমার ভাদুড়ী এর পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন করেন আর্ট থিয়েটারের পরিচালক, নাট্যকার ও অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
১৯৩২ সালের ১৭ জানুয়ারি রঙমহল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় বিজয়িনী নাটক; ২ এপ্রিল বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের বনের পাখি এবং ২৫ জুন উৎপলেন্দু সেনের সিন্ধুগৌরব। বনের পাখি নাটকটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই নাটকে অভিনয় করেন রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সন্তোষ সিংহ, ধীরাজ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, চারুবালা, শশীবালা, শেফালিকা, সরযূবালা দেবী প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই সেকালের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৫ এপ্রিল অভিনীত হয় অনুরূপা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত নাটক মহানিশা। এ নাটকটিও জনপ্রিয় হয় এবং এতেই সতু সেনের প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতায় প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ব্যবহূত হয়।
এরপর বহু ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে রঙমহল থিয়েটার অগ্রসর হয়। থিয়েটারের মালিকানাও পরিবর্তিত হয় এবং অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিবর্তন ঘটে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ব্যঙ্গ্যবিষয়ক নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে। কোন কোন নাটক (যেমন উল্কা) একাদিক্রমে ৫০০ রজনী অভিনীত হয়ে বাংলা থিয়েটারে সাড়া জাগিয়েছে। পরবর্তীকালে এই মঞ্চে যাঁরা নাট্য পরিচালনা করেন কিংবা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) প্রমুখ। মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: শতবর্ষ আগে, কবি, দুই পুরুষ, মায়ামৃগ, একমুঠো আকাশ, এক পেয়ালা কফি, সাহেব বিবি গোলাম, অনর্থ, চক্র ইত্যাদি। ১৯৭৫ সাল থেকে ক্যাবারে নৃত্য চালু হলে রঙমহলের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়; রুচিবান অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী রঙমহল ত্যাগ করেন এবং এর ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রঙমহল থিয়েটার এখনও টিকে আছে।
লায়ন থিয়েটার ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। বিশ শতকের প্রথম দিকে মীর্জা আবদুল কাদের ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ক্রয় করে এর নতুন নামকরণ করেন লায়ন থিয়েটার। এখানে বাংলা নাটকের পাশাপাশি উর্দু নাটকও মঞ্চস্থ হতো। উর্দু নাটকগুলির মধ্যে ছিল জালমা ও পারাস্তা, বুলবুল এ বিমার ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যকার যোগেন গুপ্তের চিড়িয়াখানা এবং বিপিন বিহারী চামের লাঞ্ছনা নামক দুটি প্রহসনও এখানে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় ফিল্মের আবির্ভাব হলে লায়ন থিয়েটারে নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে ‘লায়ন সিনেমা’ নামে এটিকে প্রেক্ষাগৃহে পরিণত করা হয় এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। [জিল্লুর রহমান জন]
স্টার থিয়েটার১ ১৮৮৩ সালে কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান বিডন স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিন্যুর সংযোগস্থল) প্রতিষ্ঠিত হয়। গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন। গুর্মুখ রায় নামে জনৈক অবাঙালি যুবক থিয়েটারে অর্থলগ্নী করেন। তিনি সুন্দরী নটী বিনোদিনীর নামানুসারে ‘বি’ থিয়েটার নামকরণের শর্ত আরোপ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘স্টার’ থিয়েটার নাম হয়।
প্রতিষ্ঠা বছর ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বিক্রি করে দিলে অমৃতলাল বসু, দাসু নিয়োগী ও হরি বোস এটি ক্রয় করেন এবং ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করেন। এরপর স্টার থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
স্টার থিয়েটারে মোট ২০খানি নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং সেসবের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র, বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পি। একবার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ধর্মীয় নাটক চৈতন্যলীলা দেখতে এসে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন। ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই স্টার থিয়েটারে শেষ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়।
স্টার থিয়েটার২ ১৮৮৮ সালে কলকাতার হাতিবাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার ভেঙ্গে যাওয়ার পর মূলত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের উদ্যোগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মদাস সুর এবং ইঞ্জিনিয়ার যোগেন গুপ্তের নকশা অনুযায়ী থিয়েটার হাউস ও তার মঞ্চ নির্মিত হয়। এক সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষও এর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৫ মে ‘সেবক’ ছদ্মনামে গিরিশ ঘোষ রচিত নসীরাম নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নবনির্মিত হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়।
১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে বহুবার স্টারের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও আধুনিকীকরণও হয়েছে। শেষদিকে এর মঞ্চটি ছিল ঘূর্ণায়মান। গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অপরেশচন্দ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, দেবনারায়ণ গুপ্তসহ ৮০ জনেরও বেশি নাট্যকারের প্রায় ২৫০টি বাংলা নাটক এ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হিন্দি নাটক অভিনীত হয়েছে ১২টিরও বেশি। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, গঙ্গামণি, কাদম্বিনী, অমর দত্ত, দানীবাবু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরী, নীহারবালা, সরযূবালা, ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, প্রেমাংশু বসু, অনুপকুমার প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী স্টারে অভিনয় করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঐতিহ্যমন্ডিত এ থিয়েটার হাউসটি ভস্মীভূত হয়ে যায়।
হিন্দু থিয়েটার ১৮৩১ সালে কলকাতার প্রান্তে শুঁড়ো-নারিকেলভাঙ্গায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও এ মঞ্চে কোন বাংলা নাটক অভিনীত হয় নি। প্রতিষ্ঠা বছর ২৮ ডিসেম্বর শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের পঞ্চম অঙ্ক এবং ভবভূতির সংস্কৃত নাটক উত্তররামচরিতম্-এর প্রথম অঙ্কের ইংরেজি অনুবাদ অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বারোদ্ঘাটন হয়। গঙ্গাচরণ সেন, রামচন্দ্র মিত্র, হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজের ছাত্রবৃন্দ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ নাথিং সুপারফ্লুয়াস নামে একখানি ইংরেজি প্রহসন অভিনীত হওয়ার পর হিন্দু থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এটি বাঙালি দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারে নি। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]