অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬

অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬  বাঙালির সৃজনশীল কর্মকান্ড ও জনমতের বিরুদ্ধে উপনিবেশিক সরকারের একটি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ। নাটক ও থিয়েটারের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটতে থাকে, কিন্তু সে অনুপাতে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হয় না। সরকারি চাকুরিতে বস্ত্তত শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের হাতে। নীল, চা, তামাক ইত্যাদির পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক চাষাবাদও নিয়ন্ত্রণ করত ইউরোপীয়রা। বণিক ও নীলকরগণ অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণকে শোষণে লিপ্ত ছিল। নীলচাষের জন্য নির্ধারিত জেলাসমূহের শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটরা স্পষ্টতই ছিল নীলকরদের পক্ষের লোক।

নীলকর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের শোষণ ও অবিচার অনেক নাট্যকর্মের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। দীনবন্ধু মিত্রের নীল-দর্পণ, মধুসূদন দত্তের বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রো এবং একেই কি বলে সভ্যতা, কিরণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোজিনী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরুবিক্রম, দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের চা-কর-দর্পণ, উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী ও অন্যান্য নাটক দেখতে প্রচুর লোক ভীড় জমাতেন। এসব ও অন্যান্য নাটকে নীলকর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের শোষণ, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যগুলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের উদ্রেক করত। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল এসব নাটক মঞ্চায়নকে নাশকতামূলক কার্যকলাপ বলে ব্যাখ্যা করেন। তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ হিসেবে নানা গুজবের ভূমিকার কথা কেন্দ্রীয় সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি সরকারকে এ মর্মে আরও সতর্ক করে দেন যে, দেশে ইতোমধ্যে স্থানীয়ভিত্তিক কৃষক বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ঘটে চলেছে যা ভবিষ্যতে একটি জাতীয় বিপ্লবের আকারে সংগঠিত হতে পারে। হিন্দু মেলার বার্ষিক সম্মেলনগুলোতে যেসব দেশপ্রেমমূলক ও ব্রিটিশ বিরোধী নাটক মঞ্চস্থ হয় সরকার সেগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন। রিচার্ড টেম্পল সরকারের নিকট এ সুপারিশ পেশ করেন যে, যেহেতু বিদ্যমান আইনে এ ধরনের নাটকগুলো নিষিদ্ধ করার কোনো ক্ষমতা সরকারের নেই, সেহেতু কুৎসাপূর্ণ ও নাশকতামূলক নাটকাদি রচনা ও মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করে অবিলম্বে একটি আইন প্রণয়ন করা উচিত।

১৮৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার বাংলা সরকারকে কতিপয় নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশে বলা হয় যে, যখন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনে করবেন যে মঞ্চস্থ হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এমন কোনো নাটক, পুতুলনাচ বা অন্য নাট্যকর্ম কুৎসাপূর্ণ বা নাশকতামূলক প্রকৃতির বা তা থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে বা সে ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের জন্য ক্ষতিকর, নৈতিকভাবে হানিকর হতে পারে বা অন্য কোনোভাবে জনস্বার্থের পক্ষে হানিকর হয়, তাহলে সরকার আদেশবলে সে ধরনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করতে পারেন। অধ্যাদেশে আরও বলা হয় যে, ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে শুধু যে প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরাই আইনত শাস্তিযোগ্য হবেন তা নয়, দর্শক এবং থিয়েটার বা মঞ্চের মালিকরাও আইনত শাস্তির যোগ্য হবেন। অধ্যাদেশটি ১৮৭৬ সালের ১৪ মার্চ আইনে পরিণত হয়।

অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রতিবাদ করেন। জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনসমূহ আইনটিকে একটি ঘৃণ্য কালো আইন হিসেবে বিবেচনা করতেন। তারা এ আইনের বিরুদ্ধে কার্যকর জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা জনসমর্থন লাভে ব্যর্থ হন। জমিদার শ্রেণীর একটি সংগঠন  ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন আইনটি সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিল। নবগঠিত  ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন আইনটির প্রতি বিরূপ ছিল, কিন্তু এ আইনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।  মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি এ আইনের ব্যাপারে নীরবতা পালন করে। শুধু  হিন্দু মেলা ও এর সমর্থক সংবাদপত্রগুলো এ আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। দেশিয় বাংলা পত্রপত্রিকা ও জনমত এ আইনকে ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের দমননীতির আরও একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত করে।

ভারত বিভক্তির পর ১৯৫৪ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট, ১৯৫৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং ১৯৫৮ সালে পাঞ্জাব হাইকোর্ট এ আইনকে অকার্যকর ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওয়েস্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্স বিল নামে আইনের একটি নতুন খসড়া তৈরি করে। কিন্তু গণপ্রতিবাদের মুখে সরকার ১৯৬৩ সালে বিলটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ রহিত করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]