হিন্দু প্যাট্রিয়ট

হিন্দু প্যাট্রিয়ট সাপ্তাহিক পত্রিকা। এটি জনৈক মধুসূদন রায়ের মালিকানায় এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে  গিরিশচন্দ্র ঘোষের সহযোগিতায় ১৮৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫ সালের জুন মাসে এর মালিকানার পরিবর্তন হয়। ভবানীপুরের  হরিশচন্দ্র মুখার্জীর বড় ভাই হারাণচন্দ্র মুখার্জী এর নতুন স্বত্বাধিকারী হন। প্রকৃতপক্ষে হরিশচন্দ্রই পত্রিকাটি ক্রয় করেন। কিন্তু মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অধীনে চাকরি করার কারণে তিনি বিষয়টি গোপন রাখতে বাধ্য হন। মিলিটারি অডিটর তাঁর অধীনস্থ কাউকে কোন পত্রিকার মালিক-সম্পাদক হিসেবে অনুমোদন করতেন না।

সিপাহি বিপ­বোত্তর সময়ে  নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দরিদ্র ভাগ্যহীন নীল  রায়তদের এরূপ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিয়মিত সম্পাদকীয় জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং শিক্ষিত ভারতীয়দের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সার্বিক নিন্দা জ্ঞাপন আদায়ে সমর্থ হয়।

প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় গুরুত্ব আরোপিত অন্যান্য প্রধান বিষয়গুলি ছিল নারীশিক্ষা এবং হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ। নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে পত্রিকাটি সকলকে জন ডিণ্টংকওয়াটার  বেথুন-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করার জন্য আহবান জানায়। বিধবা পুনর্বিবাহ প্রশ্নে এটি সংস্কারবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে এবং এ ধরনের বিবাহকে আইনগত ভিত্তি প্রদানের বিষয়টি সমর্থন করে। অবশ্য পত্রিকাটি হিন্দুসমাজে বিবাহবিচ্ছেদ আইন প্রয়োগের বিরোধিতা করে।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর প্রধান উদ্দেশ্য ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অনিয়ম প্রকাশ করা হলেও পত্রিকাটি ব্রিটিশ জনগণ ও পার্লামেন্টের উদারনীতি প্রসঙ্গে অত্যন্ত উচ্চ আশা পোষণ করে। তাই পত্রিকাটি এই মর্মে পরামর্শ দেয় যে, যখনই ব্রিটিশ ভারতীয় প্রশাসন জনগণের অভিযোগ প্রতিকারে ব্যর্থ হবে তখনই তারা যেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার উন্নতি বিধানে ব্রিটিশ জনগণ ও পার্লামেন্টের শরণাপন্ন হয়। ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত বহুবিধ অনিয়ম পত্রিকাটি কখনও এই উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে নি যাতে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। বরং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা এবং এর কারণ সম্পর্কে প্রশাসনকে সচেতন করে তোলার জন্য বিভিন্ন অনিয়মের সমালোচনা করা হয়, যাতে সরকার দ্রুত ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। হিন্দু প্যাট্রিয়টের কাছে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুধু অন্ধ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ছিল না, বরং তা ছিল উচ্চতর মহৎ কিছু যাকে জনকল্যাণের জন্য সমর্থন করা উচিত। ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতীয়দের এখনও অনেক কিছু শিক্ষার আছে এবং এ কারণেই এখানে ইংরেজ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়া উচিত ১৮৫৫ সালের ১১ অক্টোবর প্রকাশিত পত্রিকার দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে এ ধারণার একটি সুস্পষ্ট বিবরণ প্রকাশিত হয়।

এভাবে সিপাহি বিপ্লবের সময় ব্রিটিশ সরকার যখন ১৮৫৭ সালের অ্যাক্ট ১৫-র (Act XV of 1857) মাধ্যমে ভারতের সংবাদ পত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন এর প্রতিবাদে Hindu Intelligencer সাময়িকভাবে প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর বিশেষ কোন প্রতিবাদ করে নি।

আবার সমসাময়িক বিশেষজ্ঞ রামগোপাল সান্যাল-এর মতে, সিপাহি বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্যাট্রিয়ট ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে। এতে গভর্নর জেনারেল  ক্যানিং এবং প্রভাবশালী ইংরেজ পার্লামেন্টারিয়ান লর্ড গ্রেনভিল খুবই অভিভূত হন।

জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও উচ্চমূল্যের কারণে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারে নি। হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মৃত্যুর বহু পরে এই ঘটনা ঘটে এবং  শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং  কৃষ্টদাস পাল এর মতো বিখ্যাত বাঙালি এর পরবর্তী সম্পাদক হন। কৃষ্টদাস পালের মৃত্যুর (১৮৮৪) পর রাজকুমার সর্বাধিকারী এর নতুন সম্পাদক হন। তাঁর চেষ্টায়ই হিন্দু প্যাট্রিয়ট ১৬ মার্চ ১৮৯২ সাল থেকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হলেও ব্যবস্থাপনায় পর্যায়ক্রমিক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। [অভিজিৎ দত্ত]