মাসুম খান কাবুলি

মাসুম খান কাবুলি  আফগান দলপতি এবং সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বাংলা ও বিহারে মুগল সেনা কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের নেতা। মাসুম খান ছিলেন খোরাসানের অন্তর্গত তুবরাতের সাইয়্যিদ বংশীয় এক অভিজাত। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের অনুজ মির্জা মুহম্মদ হাকিমের দুধ ভাই। তাঁর পুরো নাম আবুল ফতেহ মুহম্মদ মাসুম খান। তবে মাসুম খান কাবুলি নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।

কাবুলের শাসনকর্তা মির্জা হাকিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন মাসুম খান। বদখ্শানের শাসনকর্তা সুলায়মান মির্যা ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে অভিযান করে রাজধানী অবরোধ করলে মির্জা হাকিম রাজধানী রক্ষার দায়িত্ব মাসুম খানের উপর ন্যস্ত করে কাবুলের দক্ষিণে গরবন্দ এলাকায় আশ্রয় নেন। মাসুম খান সুলায়মান মির্যাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মির্যা হাকিমের সঙ্গে মাসুম খানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মির্যা হাকিমের ভগ্নিপতি খাজা হাসান নকশবন্দির সঙ্গে মাসুম খানের কোনো এক বিবাদে মির্যা হাকিম খাজা হাসানের প্রতি অন্যায় অনুকূল্য প্রদর্শন করায় মাসুম খান শাহী দরবারে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সন্দিহান ও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে কোন এক সময় তিনি মির্যা হাকিমকে ত্যাগ করে সম্রাট আকবরের দরবারে হাজির হন। সম্রাট তাঁকে ৫০০ সওয়ারি মনসবদার নিয়োগ করে পাটনায় জায়গির প্রদান করেন। সুলায়মান কররানীর সেনাপতি কালা পাহাড়ের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে জয়লাভের পর সম্রাট তাঁকে এক হাজার সওয়ারি মনসব পদে উন্নীত করেন। উপঢৌকন হিসেবে একটি অশ্ব ও বিশেষ খেতাবসহ তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।

অবশ্য মাসুম খান ও আকবরের মধ্যে সুসম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জনশ্রুতি আছে যে, বাংলার মুগল সুবাহদার মুজাফফর খান তুরবাতি এবং বিহারের মুগল কর্মকর্তাদের অবিবেচনা প্রসূত নীতির কারণেই মাসুম খান বিদ্রোহের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হওয়ার পর পরই মুজাফফর খান রাজস্ব আদায় এবং ঘোড়া দাগানোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নেন। একটি শাহী ফরমান কার্যকর করতে গিয়ে তিনি বাংলার অধিকাংশ আমীরদের জায়গির পরিবর্তন করেন। বিহারেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিহারের দেওয়ান মোল্লা তায়ীব ও বখশী রায় পুরুখোতম শাহী ফরমান বলে মাসুম খান, আরব বাহাদুর, সুর্খ বদখ্শী ও অন্যান্য আমীরদের জায়গির পরিবর্তন করেন। অধিকন্তু তারা তাদের রূঢ় আচরণে আমীরদের বিরোধী ভাবাপন্ন করে তোলেন।

বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়োজিত মুগল সেনাপতিরা লুণ্ঠন ও বলপূর্বক অর্থ আদায় করে প্রচুর সম্পদ আয়ত্ত করেন। আর এদিকে কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ও বিহারে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত বেসামরিক কর্মকর্তারা সামরিক কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের জবাবদিহিতা চেয়ে এ অবৈধ অর্থ সংগ্রহ বন্ধ করার দাবি জানায়। ফলে উভয় প্রদেশে বেআইনিভাবে রাজস্ব আদায় ও বলপূর্বক ভূমি আত্মসাতের বিরুদ্ধে সামরিক কর্মকর্তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাসুম খান কাবুলি সঙ্গে সঙ্গে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন।

তিনি আরব বাহাদুর ও সুর্খ বদখ্শীসহ বিহারের অসন্তষ্ট আমীরদের সহযোগে সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষেপিয়ে তোলেন এবং তারা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইত্যবসরে মাসুম কাবুলির অনুসারীরা বাংলার অসন্তষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। বাংলার অফিসাররা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি তাঁড়া (তান্ডা) ত্যাগ করে এবং নয় দিন পর প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাসুম খান কাবুলির নেতৃত্বে বিহারের বিদ্রোহীরা বাংলার বিদ্রোহীদের সঙ্গে মৈত্রীজোট স্থাপন করেন। মাসুম খান দক্ষিণবঙ্গের (ঘোড়াঘাট) কাকশাল নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেন এবং তাঁর বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে গৌড় অভিমুখে অগ্রসর হন। বাংলার মুগল সুবাহদার মুজাফফর খান তুরবাতি তেলিয়াগড়ি পথে মাসুম খানের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য খাজা শামসুদ্দিনের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধে মাসুম খান তেলিয়াগড়ি অধিকার করেন এবং কাকশাল বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলিত হন।

এই সঙ্কটময় পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সুবাহদার মুজাফফর খান তুরবাতি তাঁড়া দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরদিন সকালে বিদ্রোহীদের সম্মিলিত বাহিনী দুর্গের ফটক ভেঙে দলে দলে দুর্গে প্রবেশ করে এবং তারা দুর্গে রক্ষিত শাহী কর্মকর্তাদের সঞ্চিত ধনসম্পদ লুট করতে শুরু করে। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল বিদ্রোহীরা মুজাফফর খান তুরবাতিকে হত্যা করে। তারা কাবুলের শাসনকর্তা মির্জা মুহম্মদ হাকিমকে সম্রাট ঘোষণা করে এবং তাঁর নামে খুতবা পাঠ করা হয়। নতুন সম্রাটের পক্ষে বিদ্রোহের নায়কদের নতুন নতুন পদে নিয়োগ ও উচ্চ খেতাব প্রদান করা হয়। তাদের যথেচ্ছভাবে জায়গির সনদ দেয়া হয়। অনুপস্থিত মির্জা হাকিমের পক্ষে সম্রাটের পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ঘোষণা করা হয় মাসুম খান কাবুলিকে। মাসুম খান ‘খান-ই-দওয়ান’ খেতাব গ্রহণ করেন। বাবা খান কাকশাল নিজেই গ্রহণ করেন ‘খান-ই-খানান’ খেতাব। তাঁকে বাংলার সুবাহদার নিয়োগ করা হয়। এরূপে বাংলা ও বিহার আকবরের সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের জন্য সম্রাট আকবর সেনাপতি সাদিক খান, তারসুন মুহাম্মদ খান এবং আরও কতিপয় আমীরসহ রাজা টোডরমলকে প্রেরণ করেন। মুগল বাহিনী মুঙ্গের শহরে পৌঁছলে মাসুম কাবুলি কাকশাল নেতৃবৃন্দ ও মির্জা শামসুদ্দিন হোসেনসহ ৩০,০০০ অশ্বারোহী ৫০০ হাতী এবং এক বিশাল নৌবহর ও গোলন্দাজ বাহিনীসহ তাদের বাধাদানের জন্য অগ্রসর হন। বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রার সংবাদ পেয়ে রাজা টোডরমল তাঁর বাহিনীসহ মুঙ্গের দুর্গে আশ্রয় নেন। বিদ্রোহীরা দুর্গ অবরোধ করে। চার মাস অবরোধের পর বিদ্রোহীদের শিবিরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। কাকশাল নেতা বাবা খান কাকশালের তখন অন্তিম অবস্থা। কাকশাল নেতারা হতোদ্যম হয়ে পড়েন এবং তাদের মধ্যে মুগলদের পক্ষে যোগ দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে জোটের ঐক্য শিথিল হয়ে পড়ে এবং মাসুম খান কাবুলি বিহার অভিমুখে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন। রাজা টোডরমল মাসুম কাবুলিকে অনুসরণ করে বিহারে পৌঁছেন। দক্ষিণ বিহারে এক মুগল বাহিনী পাটনা থেকে মাসুম খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে বিহার, গয়া ও শেরগাতি দখল করে নেয় (সেপ্টেম্বরের শেষ, ১৫৮০)। এরপর মাসুম বাংলা অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করেন। ইত্যবসরে আকবরের বাহিনী কাবুলে প্রবেশ করে (৩ আগস্ট ১৫৮০) মির্যা মুহম্মদ হাকিমকে পার্বত্য অঞ্চলে বিতাড়িত করে।

কাকশাল নেতা বাবা খান কাকশালের মৃত্যুর পর মাসুম খান বিদ্রোহীদের একচ্ছত্র নেতৃত্বে সমাসীন হন। তিনি  উড়িষ্যা ও দক্ষিণবঙ্গের কতক অংশের অধিপতি কুতলু খান লোহানীর সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন। এ সময়েই মাসুম খান বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন এবং নিজে ‘সুলতানুল আযম’ উপাধি গ্রহণ করেন। পাবনা জেলায় চাটমোহর গ্রামে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের  শিলালিপি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শিলালিপিতে ক্ষোদিত আছে: এই বিশাল মসজিদটি ৯৮৯ হিজরিতে (১৫৮১-১৫৮২ খ্রি) মহান সুলতান, সাইয়্যিদ বংশীয়দের স্তম্ভ স্বরূপ আবুল ফতেহ মুহম্মদ মাসুম খানের শাসনকালে নির্মিত হয়। শিলালিপিতে মসজিদের নির্মাণকাল ৯৮৯ হিজরির (১৫৮১-১৫৮২ খ্রি) উল্লেখ এবং পাবনা জেলার একটি মসজিদে এই শিলালিপির অবস্থান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মাসুম খান সুলতানুল আযম খেতাব গ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলার এ অংশে অথবা সন্নিহিত রাজ্যে অন্তত ঐ বছরে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সমসাময়িক ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে, মাসুম খানের রাজনৈতিক কর্মকান্ড কোনো বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা পরিব্যাপ্ত ছিল সমগ্র বাংলায়। মাসুম খান তাঁড়া, রাজমহল, মালদহ, দিনাজপুর, হুগলি, বগুড়া এবং পরে ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় মুগলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মাসুম খান বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাধর ছিলেন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মুগলদের দ্বারা বিহার থেকে বিতাড়িত হন এবং বাংলায় এসে তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করেন। এটা নিশ্চিত যে, ১৫৮১ থেকে ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের সর্বসময় নেতৃত্ব তাঁর করায়ত্ত ছিল। কিন্তু ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।

১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মুগল সুবাদার খান-ই-আযম মুঙ্গের ও কহলগাঁয়ের পথে রাজমহলের নিকটবর্তী কাটিগং অভিমুখে অগ্রসর হন। মাসুম খান তাঁর বাহিনী নিয়ে তাঁকে বাধা দেয়ার জন্য কাটিগং-এ এসে পৌঁছেন (২৭ মার্চ ১৫৮৩)। প্রায় এক মাস ধরে দুই বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি যুদ্ধের পর মাসুম খান ও কাকশাল গোত্রের মধ্যকার ঐক্যে ভাঙন ধরে এবং বেশসংখ্যক বিদ্রোহী নেতা মুগল কূটনৈতিক প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে খান-ই-আযমের সঙ্গে যোগ দেন। এই বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষিপ্ত হয়ে মাসুম খান কাকশাল গোত্রের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কাকশালদের ঘাটি ঘোড়াঘাট শহর এবং নিকটবর্তী প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর প্রচন্ড আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু খান-ই-আযম কর্তৃক প্রেরিত এক বাহিনী কাকশালদের সাহায্যে দ্রুত অগ্রসর হয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। আফগান ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে মাসুম খানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিকে ঘন ঘন মুগল আক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি ঈসা খানের রাজ্যে আশ্রয় নেন।

অচিরেই মাসুম খান এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কাকশাল নেতা মির্জা বেগ কাকশালকে শাস্তি দানের জন্য ভাটি অঞ্চল থেকে অগ্রসর হন। মির্জা বেগ তখন তাজপুরে (দিনাজপুর জেলায়) মুগল সেনাপতি তারসুন মুহাম্মদ খানের নিকট আশ্রয় নেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে মাসুম খানের আক্রমণের মুখে তারসুন খান তাজপুরে এক দুর্গে আশ্রয় নেন। মাসুম খানের বাহিনী তাঁড়ার ২২ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা জুড়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালায়। মাসুম খান তখন নতুন মুগল সুবাহদার  শাহবাজ খান এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যমুনার অপর তীরে অবস্থান নেন। সেখানে উভয় পক্ষের যুদ্ধে (১৫ নভেম্বর ১৫৮৩) মাসুম খান পরাজিত হন এবং ভাটি রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন। শাহবাজ খান দ্রুত তাঁড়া থেকে শেরপুরে (বগুড়ায়) পৌঁছে বিদ্রোহীদের আবাসস্থল লুণ্ঠন করেন। আফগানদের ১৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ বিদ্রোহীদের পরিবারবর্গকে বন্দী করে নিয়ে যান।

এর পর শাহবাজ খান মাসুম খানকে অনুসরণ করে ভাটি অভিমুখে অগ্রসর হন। কুচবিহার অভিযানে (১৫৮৩) ঈসা খানের ব্যস্ততার সুযোগে শাহবাজ খান খিজিরপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। তিনি শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরে ঈসা খানের দুটি দুর্গ সহজেই অধিকার করেন। এরপর তিনি ঈসা খানের রাজধানী সোনারগাঁও অধিকার করেন এবং  কাত্রাবো লুণ্ঠন করেন। মুগলবাহিনী  এসারসিন্ধুর দখল করে টোকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে মাসুম খান এক চর এলাকায় আশ্রয় নেন। ঈসা খান কুচবিহার থেকে ফিরে মাসুম কাবুলিসহ শাহবাজ খানের মোকাবিলা করেন। প্রতিদিন দুপক্ষে জলে ও স্থলে খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারসুন মুহাম্মদ খানের অধীনে শাহবাজ খান কর্তৃক বাজিতপুরের বিরুদ্ধে প্রেরিত এক খন্ড বাহিনীর উপর মাসুম খানের সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এই বাহিনীকে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারসুন তাদের হাতে বন্দী হন এবং আহত অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়।

তাঁর সামরিক ঘাঁটি টোক থেকে শাহবাজ খান ঈসা খানের নিকট দাবি জানান যেন মাসুম খানকে তার নিকট সোপর্দ করা হয় অথবা তার রাজ্য থেকে মাসুম খানকে বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু ভাটির অধিপতি নিছক আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন, আর অপেক্ষা করতে থাকেন বর্ষার আগমনের জন্য। আফগান সৈন্যরা রাতের বেলা পনেরটি স্থানে ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ কেটে দেয় এবং পানিতে ডুবে যায় শাহবাজের শিবির এবং কামান ও গোলাবারুদ। শাহবাজ খান কোনরকমে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে শাহবাজ খানের অসন্তষ্ট ও অধিনস্থ সেনাপতিরা তাঁকে পরিত্যাগ করে। ফলে শাহবাজ খান শত্রুর মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে ভাওয়াল ত্যাগ করে তাঁড়া অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করেন। এত দ্রুত তাঁকে পশ্চাদপসরণ করতে হয় যে, তিনি তার সঞ্চিত সকল সম্পদ ফেলে রেখে যান এবং তার বহুসংখ্যক সৈন্য আফগানদের হাতে বন্দী হয়। এরপর মাসুম খান শেরপুর (বগুড়ায়) অভিমুখে অগ্রসর হন এবং  আফগানদের একটি বাহিনী মালদহ পর্যন্ত সমগ্র এলাকা দখল করে নেয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শাহবাজ খান মাসুম খানের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং শেরপুর পর্যন্ত হূতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। মুগল বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে মাসুম খান ফতেহাবাদ পরগণায় (ফরিদপুর) আশ্রয় গ্রহণ করেন।

১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মুগল সেনাপতি ওয়াজির খান ও সাদিক খান মাসুম খানের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। ইত্যবসরে মাসুম খান গঙ্গা, যমুনা ও সকনি নদীর সঙ্গমস্থলে (হুগলির ত্রিবেনী) দুটি দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি বেগ মুহাম্মদ ও উলুগ বেগকে দুর্গ দুটির দায়িত্বে নিয়োজিত করে নিজে নিম্নাঞ্চলে অবস্থান নেন এবং শত্রুর মোকাবিলার জন্য যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। ঈসা খান মাসুম খানের সাহায্যে এক নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। দুপক্ষে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসের শেষ দিন এক নৌযুদ্ধে মাসুম খান পরাজিত হন। ত্রিমোহনীতে তাঁর দু’টি দুর্গ শত্রু কর্তৃক অধিকৃত হয়।

১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান মুগলদের সঙ্গে এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। ঈসা খান ও মুগল সুবাহদার শাহবাজ খানের মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে মাসুম খানের পুত্রকে সম্রাটের দরবারে প্রেরণ করা হয়। এমন সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে, মাসুমের জন্য সবচেয়ে উত্তম কাজ হবে হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কায় গমন করা এবং পরিশেষে দিল্লিতে সম্রাটের দরবারে পৌঁছানো।

এ মীমাংসার পরও মুগলের বিরুদ্ধে মাসুম খানের যুদ্ধ শেষ হয়নি। কুচবিহারের রাজা ও মুগলদের সামন্ত লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতিদ্বন্দ্বী রঘুদেবের প্রতি ঈসা খানের সমর্থনকে কেন্দ্র করে ঈসা খান নতুনভাবে মুগল সুবাদার মানসিংহের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঈসা খান রঘুদেবের সাহায্যে কোচবিহারে অভিযান করলে মানসিংহ এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ঈসা খানের আবাসস্থল লুণ্ঠনের জন্য তার পুত্র দুর্জনসিংহের নেতৃত্বে স্থল ও জলপথে এক অভিযান প্রেরণ করেন। নৌপথে প্রেরিত বাহিনী পথে কতক স্থানে যথেচ্ছ লুণ্ঠন চালিয়ে ঈসা খান ও মাসুম খানের পারিবারিক আবাসস্থল কাত্রাবো অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। ঈসা খান ও মাসুম খানের সম্মিলিত বিশাল নৌবহর দুর্জন সিংহের নৌবাহিনীকে বিক্রমপুরের ১৯ কিলোমিটার দূরে এক স্থানে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে (৫ সেপ্টেম্বর ১৫৯৭)। যুদ্ধে দুর্জন সিংহসহ বহু সৈন্য নিহত এবং কিছু সংখ্যক বন্দী হয়। বস্ত্তত এটিই ছিল মুগল বাহিনীর বিরুদ্ধে মাসুম খানের শেষ যুদ্ধ।

মাসুম খান ছিলেন সম্রাট আকবরের শাসনামলে সবচেয়ে চমকপ্রদ এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ চাতুর্য ও কৌশলে তিনি বিহারে মুগল সামরিক কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং অচিরেই বাংলার বিদ্রোহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিহারের বিদ্রোহীদের সংযোগ ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলায় বিদ্রোহীদের সর্বময় নেতৃত্বের অধিকারী হন। প্রথমে উত্তরবঙ্গের কাকশালদের এবং পরে ভাটির অধিপতি ঈসা খান মসনদ-ই-আলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি মুগলদের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বিহার ও বাংলায় একের পর এক এমন সব বিদ্রোহ সংগঠিত করেন যে, এর জন্য সম্রাট আকবরকে প্রায় সতের বছর (১৫৮০-১৫৯৭) এই বিদ্রোহ দমনে তাঁর সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত রাখতে হয়।

মাসুম খান ছিলেন এক অসাধারণ সংগঠক। তাঁর জীবনচরিত বীরত্ব, সাহসিকতা ও চমকপ্রদ সমরনায়কত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি বরাবরই ছিলেন দৃঢ়চিত্ত, অসাধারণ মনোবলের অধিকারী। মুগল সেনাপতিদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধবিগ্রহ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, একজন কুশলী যোদ্ধার সার্বিক গুণাবলির অধিকারী ছিলেন তিনি। কাকশালরা যখন রণক্ষেত্রে তাঁকে পরিত্যাগ করে যায় তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ভাটির অধিপতি ঈসা খানের সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন মৈত্রী সম্পর্ক এবং যৌথভাবে মুগল আগ্রাসন প্রতিহত করেন। শেষ অবধি তিনি মুগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান, কখনো আপস বা নতি স্বীকার করেননি। সুদূর আফগানিস্তান থেকে বাংলায় একজন বহিরাগত হয়েও মাসুম খান কালক্রমে বাংলার রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন। কোনো সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী রাজ্য গড়ে তুলতে না পারলেও তিনি বাংলার বৃহত্তর অংশে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে কাত্রাবোতে তাঁর মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মাসুমাবাদে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাধিসৌধে তিনি সমাহিত আছেন। সম্ভবত সৌধটি নিজেই নির্মাণ করান।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]