তেলিয়াগড়ি

তেলিয়াগড়ি ভারতের বিহার প্রদেশের সাঁওতাল পরগনাধীন সাহিবগঞ্জ থানার একটি বিখ্যাত গিরিপথ। এক সময় এ পথ দিয়েই আক্রমণকারীরা বাংলায় প্রবেশ করত। আবুল ফজলের সময়ে (ষোল শতক) তেলিয়াগড়ি ছিল বাংলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা। তেলিয়াগড়ি, ত্রিহুত এবং ঝাড়খন্ড কেবল এ তিনটি স্থলপথের মাধ্যমেই উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাংলা সংযুক্ত হতে পারত। গঙ্গার দক্ষিণ তীরবর্তী সংকীর্ণ তেলিয়াগড়ি গিরিপথটির উত্তরে নদীর খাড়া তীর এবং দক্ষিণে রয়েছে রাজমহল পাহাড়। পথটি পাটনা হতে আরম্ভ হয়ে গঙ্গার দক্ষিণ তীর ধরে খাড়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ভাগলপুর এবং কোলং অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের উত্তর সীমা পর্যন্ত ৮০ মাইল বিস্তৃত। উত্তরে বিস্তৃত গঙ্গা এবং দক্ষিণে খাড়া রাজমহল পাহাড় ও সাঁওতাল পরগণা ও বীরভূমের অসমতল এলাকা তেলিয়াগড়ি পথকে সংকীর্ণ করেছে। সুপ্রাচীনকাল হতেই তেলিয়াগড়ি বাংলার ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে পরিচিত এবং সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করে পথটিকে সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করা হয়েছিল। সামরিক বিবেচনায় সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে গিরিপথটির পশ্চিম মুখে বাংলার স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের পক্ষেও বিশাল শত্রুবাহিনীকে বাধা দেওয়া সম্ভবপর হতো। মুসলিম বাংলার সামরিক নেতৃবৃন্দ উত্তর ভারত হতে যে কোনো বহিরাক্রমণের প্রথম প্রতিরোধ হিসেবে তেলিয়াগড়ির অবস্থানগত সুবিধার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেন।

গঙ্গা দিয়ে শত্রু আগমন প্রতিহত করতে বাংলার নৌসেনারা গিরিপথটির পাশের নদীতে টহল দিত। তেলিয়াগড়িতে বহিরাক্রমণকারী শক্তিকে ধৈর্য এবং হয়রানির কঠোর পরীক্ষা দিতে হতো। সেজন্য প্রায়ই ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত আক্রমণকারীরা বাংলা জয়ের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে তেলিয়াগড়ি হতেই ফিরে যেত। কখনও বাংলার সর্তক বাহিনী বহিরাগত ক্লান্ত এবং অসতর্ক আক্রমণকারীদের অতর্কিত আক্রমন করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিত। গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজীর (১২১২-১২২৭ খ্রি.) অধীনস্থ সৈন্যরা বাংলার দিকে দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ-এর (১২১০-১২৩৬ খ্রি.) অগ্রযাত্রাকে তেলিয়াগড়িতে বেশ কিছু দিনের জন্য প্রতিহত করেছিল। গিরিপথটির সামরিক সুবিধাজনক অবস্থিতি সম্পর্কে অবগত সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.) বাংলায় প্রবেশের জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন এবং বৃত্তাকারে ঘুরে এসে ত্রিহুতের পথে তিনি বাংলায় প্রবেশ করেন। সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলকও (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.) এ পথ পরিত্যাগ করে ত্রিহুতের পথ ঘুরে বাংলায় আসেন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান (পরবর্তীকালে শেরশাহ, ১৫৪০-১৫৪৫ খ্রি.)-এর পুত্র জালাল খানের অধীনস্থ আফগান সৈন্যবাহিনীর একটি অংশ তেলিয়াগড়িতে মুগল সম্রাট হুমায়ুন (১৫৩০-১৫৪০ খ্রি.; ১৫৫৬ খ্রি.)-এর বিশাল বাহিনীকে প্রতিহত করে। এ গিরিপথেই ১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে ছয় মাসেরও বেশি সময় পর্যন্ত দাউদ খান কররানী (১৫৭২-১৫৭৬ খ্রি.) মুগল সম্রাট আকবরএর সেনাপতি খান জাহানের সেনাবাহিনীর গতিরোধ করে রাখেন। প্রধানত সামরিক সুবিধাজনক অবস্থানের বিবেচনায় মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে তেলিয়াগড়ি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার   করে আছে।  [মোঃ আক্তারুজ্জামন]