ফরমান
ফরমান (হাসবুল হুকুম, নিশান, পরওয়ানা) মুগল সাংবিধানিক শব্দ, যার অর্থ সম্রাট কর্তৃক জারিকৃত অ-প্রত্যাহারযোগ্য রাজকীয় অনুশাসন। আজকের দিনে কোন বিলের মাধ্যমে প্রণীত এবং রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক অনুমোদিত আইনের সমতুল্য হচ্ছে এ ফরমান। সম্রাট ইচ্ছামত ফরমান জারি করতে পারতেন না। রাজকীয় ফরমান জারির ক্ষেত্রে সবসময়ই কিছু প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতো। সম্রাটের নিকট কোন প্রজার আবেদন অথবা রাজকীয় নীতি-সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেও ফরমান জারি করা হতো। উভয় ক্ষেত্রেই সর্বপ্রথম দরবারের আমীররা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং সবশেষে সম্রাটের নিকট উপস্থাপনের পূর্বে উজির বিষয়টি দেখতেন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে ঐকমত্যে পৌঁছলে ফরমানের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হতো এবং সম্রাটের সম্মতির জন্য তা পড়ে শোনানো হতো। সম্রাটের সম্মতির পর তাতে রাজকীয় সিল প্রদান করে ফরমানবরদারের কাছে দেওয়া হতো প্রচার ও প্রয়োগের জন্য। কোন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফরমান জারি করা হলে দলিলটির প্রথমাংশে এর ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে কেন এটা মান্য করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক তা ব্যাখ্যা করা হতো। ফরমানের সবচেয়ে সুপরিচিত উদাহরণ হচ্ছে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদত্ত ফরমান (১২ আগস্ট ১৭৬৫)। এর মাধ্যমে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি প্রদান করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে ফরমান জারি করা হলে ফরমানের মুখবন্ধে এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হতো।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জারিকৃত অনুশাসনের অন্যান্য অভিধাগুলি হচ্ছে হাসবুল হুকুম, নিশান ও পরওয়ানা। উজির কর্তৃক স্বাক্ষরিত রাজকীয় আদেশকে বলা হয় ‘হাসবুল হুকুম’ আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতা সাধারণত হাসবুল হুকুমের মাধ্যমে সম্পাদন করা হতো। সুবাহদার বা নওয়াবও হুকুম জারি করতে পারতেন। সুবাহদার বা নওয়াব পাদশাহীর উত্তরাধিকারী শাহজাদা হলে তাঁর জারি করা হুকুমকে বলা হতো নিশান, অন্যথায় তা হতো পরওয়ানা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র ও বাংলার সুবাহদার শাহ সুজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বার্ষিক নির্দিষ্ট ৩,০০০ টাকা রাজসরকারে খাজনা প্রদানের বিনিময়ে বাণিজ্য শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়ে এক নিশান জারি (১৬৫১) করেছিলেন। কিন্তু যুবরাজ নন এমন নওয়াবদের জারিকৃত সব হুকুমই ছিল পরওয়ানা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানিকে কলকাতায় নির্মীয়মাণ দুর্গ ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়ে পরওয়ানা (নিশান নয়) জারি করেছিলেন। রাজকীয় আইন ও বিচারের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোন নিশান বা পরওয়ানা সম্রাট ইচ্ছা করলে বাতিল ঘোষণা করতে পারতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সম্রাট আওরঙ্গজেব যখন জানতে পারেন যে, তাঁর পৌত্র বাংলার সুবাহদার শাহজাদা আজিমুদ্দীন (আজিম-উস-শান) এক ‘নিশান‘ জারির মাধ্যমে ‘সওদা-ই-খাস’ নামে একচেটিয়া ব্যক্তিগত ব্যবসায় চালাচ্ছেন, তখন তাঁকে ডেকে কঠোর তিরস্কার করেন এবং ঐ নিশান বাতিল ঘোষণা করেন। উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত বাংলার ইউরোপীয় জেলা-কালেক্টরগণ ‘পরওয়ানা’র মতো করে আদেশ জারি করতেন। [সিরাজুল ইসলাম]