ঋণ ব্যবস্থা
ঋণ ব্যবস্থা ল্যাটিন শব্দ ‘ক্রেডে’ (সংস্কৃত-ল্যাটিন ক্রাড) থেকে উদ্ভূত ইংরেজি ক্রেডিট শব্দটি অর্থনীতিতে ঋণ বোঝালেও এর অর্থ আসলে কোনো এক জনের (সংস্থার) প্রতি অন্যের আস্থা। ঋণ বা ধার অর্থে ক্রেডিট হচ্ছে পরে মূল্য ফেরত পাওয়া যাবে এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে অর্থ বা পণ্য দিয়ে দেওয়া (বিক্রয় করা)। অধিকাংশ ঋণই বস্ত্তত আর্থিক ঋণ, যাতে পাওনাদার প্রথমে দেনাদারকে কোনো একটি পরিমাণ অর্থ ধার দেয় এবং পরবর্তী সময়ে সুদসহ প্রদত্ত অর্থ ফেরত আদায় করে। আবার ক্রেডিট শব্দটি ঋণের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধ ক্ষমতাও বোঝায়।
ঋণের বিবর্তনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। সুদূর অতীতে, চাষবাস ও বিনিময় অর্থনীতির সূচনাকালে উদ্বৃত্ত চাষিরা ঘাটতি চাষিদের ধারেখাদ্যশস্য ও বীজ যোগান দিত এবং পরবর্তী সময়ে, ফসলের মৌসুমে প্রদত্ত পরিমাণের ওপর কিছুটা বাড়তি ধরে মোট পাওনা ফেরত আদায় করত। অর্থনীতির মুদ্রায়ন তথা টাকার বিনিময়ে পণ্য ও সেবা লেনদেন চালু হওয়ার পর থেকে ধারে ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থার দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। পণ্য কেনাবেচায় নগদ ঋণ বা ব্যবসা ঋণ (trade credit)-এর পাশাপাশি অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক ও নানা ধরনের অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর ঋণ-পদ্ধতি বিকশিত হতে থাকে। তবে ঋণ ব্যবস্থার বিকাশে যাদের ভূমিকা বিশেষ অগ্রগণ্য তারা হচ্ছে দেশি মহাজন, স্বর্ণকার ও বণিকশ্রেণী।
ঋণ শ্রেণিকরণের জন্য বিভিন্ন ভিত্তি ও পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণভাবে প্রযোজ্য কয়েকটি ভিত্তি হচ্ছে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার ধরন, ঋণের উদ্দেশ্য এবং ঋণের মেয়াদ। ঋণগ্রহীতার ধরন অনুযায়ী ঋণ ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক এবং সরকারি ঋণ প্রভৃতি হতে পারে। ঋণ হতে পারে ভোক্তা ঋণ, উৎপাদন ঋণ বা ফটকা কারবারি ঋণ; স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ; নগদ বা মালামাল ঋণ; কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প, কৃষি ইত্যাদিতে ব্যবহূত ঋণ। এ ছাড়া ঋণকে গ্রামীণ ও পৌর- এ দুভাগেও ভাগ করা যায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অনেক সময়ই এটি শুধু অর্থনৈতিক লেনদেনে সীমাবদ্ধ থাকে না। গ্রামীণ ঋণের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক উৎস হচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাসমূহ এবং এনজিও ও অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাসমূহ। অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসের মধ্যে আছে বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় বিত্তশালী লোকজন, মহাজন, বর্গামালিক, উদ্বৃত্ত চাষি, দোকান মালিক ইত্যাদি। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সুদমুক্ত। পেশাদার কারিগররা তাদের তৈরি মাল-ক্রয়কারীদের থেকে বিনা সুদে কাঁচামাল ধার পায়, জমি-মালিকরাও প্রায়ই বিনা সুদে বর্গাদারদের কৃষি উপকরণ ধার দিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে সুদ না থাকলেও ঋণগ্রহীতারা ঋণদাতাদের নিকট অন্যভাবে দায়বদ্ধ থাকে। ইসলামি রীতি বা চিরাচরিত দেশিয় সংস্কৃতির ধারায় অনেকেই বিনা সুদে কর্জ বা হাওলাত নামের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিয়ে আর্থিক সঙ্কটে পতিত লোকদের সাময়িক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। তবে মহাজন, এমনকি অনেক গ্রামীণ ধনী পরিবার কর্তৃক দরিদ্র বা বিপদগ্রস্তদের ঋণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে চড়াসুদে ঋণ আদায়ের নানা ইতিবৃত্ত বাংলায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই সুবিদিত। গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সাধারণত ভোগ-ব্যয় মেটানো, কোনো ব্যবসার জন্য প্রাথমিক মূলধন সৃষ্টি, পুরনো দেনা পরিশোধ এবং বিয়ে, উৎসব, চিকিৎসা ইত্যাদির খরচ সঙ্কুলান, গৃহ নির্মাণ প্রভৃতি কাজে ব্যবহূত হয়।
বাংলাদেশে ঋণ ব্যবস্থা বাংলায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই ঋণ দেওয়া-নেওয়া ও ঋণের জন্য উপরি তথা সুদ পরিশোধের প্রথা প্রচলিত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে, বৈদিক যুগে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লেনদেনের অস্তিত্ব ছিল। তবে সে সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কাজটি ছিল মূলত মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। মনু-র আমলে ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কার্যক্রম ব্যাংক-এর ধরন পায়। মনু মানুষদের পরামর্শ দিতেন, তারা যেন সৎ, আইনশাস্ত্রে বিজ্ঞ, শ্রদ্ধাভাজন ও বিত্তশালী আত্মীয়-স্বজনের নিকট নিজেদের টাকা-পয়সা জমা রাখে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন মঙ্গলকাব্য আখ্যানে উল্লেখ আছে, প্রাচীন বাংলায় ধারে টাকাপয়সা ও মালামাল লেনদেনের চর্চা ছিল এবং এসব লেনদেনে সুদ পরিশোধেরও রীতি প্রচলিত ছিল।
বাংলায় ঋণব্যবস্থার ভিত্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মুগল আমলে। প্রথম দিকের মুগল শাসকরাই স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটান এবং নানা শ্রেণির মানুষকে টাকায় লেনদেন ও ঋণপ্রদান জাতীয় কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। স্থানীয় মহাজন, পুঁজিপতি, ব্যাংকার, বেনিয়া ও নানা পেশার ব্যবসায়ীরা মুগল আমলেই অর্থ ব্যবসায় এগিয়ে আসেন এবং ঋণব্যবস্থার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। গোড়ার দিকের সুপ্রতিষ্ঠিত ঋণব্যবস্থার একটি ছিল দাদনি প্রথা, যার আওতায় তাঁতি, স্থানীয় চাষি বা শিল্পদ্রব্য উৎপাদনকারীরা দেশি বা বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পণ্য/পণ্যাদি উৎপাদনের জন্য ঋণ নিত এবং নির্দিষ্ট সময় পরে উৎপন্ন সামগ্রী দিয়ে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতো। বাংলায় ঋণব্যবস্থার একটি বড় মাইলফলক হচ্ছে ১৭০০ সালে কলকাতায় হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক ব্যাংক। মুগল বাংলায় নামকরা মহাজনদের একটি ছিল জগৎ শেঠ পরিবার। হুগলি, ঢাকা, মুর্শিদাবাদসহ বাংলার নানা এলাকায় তাদের ব্যবসায় বিস্তৃত ছিল। জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদ আঠারো শতকের গোড়ার দিকে পাটনা থেকে ঢাকায় এসে একটি কোম্পানি চালু করেন। মুগল শাসকেরা জগৎশেঠ পরিবার,অন্যান্য বণিক পরিবার, মহাজন এবং ঋণ-দাদন-লগ্নি ব্যবসায় নিয়োজিত গ্রামীণ ব্যবসায়ী ও দোকানিদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক কারবারকে উৎসাহিত করতেন। আঠারো শতকের প্রথম দিকে মহাজনেরা আবাদের মৌসুম শুরুর পূর্বে কৃষকদের ঋণ দিত। ফসল তোলার পর এ ঋণের দেনা ফসল দিয়ে শোধ করতে হতো এবং মহাজনেরা তা গুদামে রেখে সুবিধামতো সময়ে বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা পেত। দিনাজপুর, পূর্ণিয়া ও অন্যান্য জেলায় জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিনিধিরা এ জাতীয় যেসব ঋণ দিত তার ওপরে সুদের হার ছিল মাসে দু থেকে চার শতাংশ আর স্থানীয় মহাজনদের নেওয়া সুদের হার ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি।
আঠারো শতকে বাংলায় অর্থ ও ঋণ লেনদেন ব্যবসার কর্তৃত্ব ছিল শেঠ, সর্রফ, মহাজন ও পোদ্দারদের হাতে। এদের হাত দিয়েই বড় অঙ্কের ঋণের অর্থ স্থানান্তরের জন্য হুন্ডির প্রচলন শুরু হয়। ঋণদাতা তথা ব্যাংকাররা আর্থিক লেনদেন পরিচালনায় কমিশনের নিয়মও চালু করে। দেশিয় ব্যাংকারদের জন্য হুন্ডিই ছিল ঋণের প্রধান হাতিয়ার। হুন্ডি হচ্ছে একটি চিরকুট যার সাহায্য কোনো ব্যক্তি অন্যত্র অবস্থিত কোনো ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কোনো স্থান থেকে নেওয়া ঋণ স্বল্পসময়ে অন্য কোনো স্থানে প্রেরণ বা পৌঁছানোর জন্য হুন্ডি ছিল সবচেয়ে সুবিধাজনক মাধ্যম। ঋণ বা অর্থদাতা ব্যক্তি তার প্রতিনিধির নামে লেখা এ চিরকুট দিত ঋণের (অর্থের) প্রাপক বা তার প্রতিনিধির হাতে এবং চিরকুটটি (হুন্ডিটি) যার নামে লেখা তার সমক্ষে উপস্থাপন করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন। আঠারো শতকে সুরাট ও অন্যান্য বড় বাণিজ্যকেন্দ্রে পাঠানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কেনা পণ্যের মূল্য পরিশোধে ব্যবসায়ীরা দু মাস মেয়াদি হুন্ডি ব্যবহার করতেন। স্থানীয় কোনো ব্যবসায়ী থেকে টাকা ধার নিয়ে পণ্যের সরবরাহকারীর মূল্য পরিশোধ করা হতো এবং ঋণদাতা দু মাসের মধ্যে এভাবে সৃষ্ট দেনা সুদসহ ফেরত পেতেন। এসব পণ্য সরবরাহের উৎস ছিল মূলত ঢাকা, পাটনা ও মুর্শিদাবাদ এবং এ সকল স্থানের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রদত্ত ঋণের ঝুঁকি সুদের হেরফের ঘটাত।
ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বাজারে বাংলা থেকে পণ্য রপ্তানিতে নিয়োজিত ইংরেজ ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং এশীয় বণিকেরা স্থানীয় উৎপাদনকারীদের রপ্তানিযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা দানের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিত। এসব ঋণ বাংলার অর্থনীতিতে নগদ অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি করে। নিজেদের উৎপাদন ব্যয় মেটাতে কৃষক ও দেশিয় কারিগরদের বিপুল অংশই স্থানীয় মহাজন ও বিদেশিদের দেওয়া ঋণের উপর নির্ভরশীল ছিল। আবার স্থানীয় মহাজন, বণিক ও ব্যাংকার গোষ্ঠীও তহবিল জোটাতে বিদেশি কোম্পানির নিকট থেকে ঋণ নিত। এ সকল স্থানীয় ব্যবসায়ীর নিকট ১৭২০-২১ সলে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির মোট পাওনা ছিল ২৪ লক্ষ রুপি। ১৭২৪ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট শুধু কাশিমবাজারের বণিক-ব্যবসায়ীদের দেনা ছিল ১৫ লক্ষ রুপি। বাংলায় ওলন্দাজদের মোট পাওনা ১৭৫৪ সালে দাঁড়ায় ২৮ লক্ষ ৩০ হাজার রুপি। ১৭৫৫ থেকে ১৭৫৭ এ তিন বছরে জগৎশেঠ পরিবার ওলন্দাজদের নিকট মোট ২৩ লক্ষ ৮৬ হাজার রুপি দেনা করে। এ সময় জগৎশেঠ পরিবারের নিকট ফরাসিদের পাওনা ছিল ১৫ লক্ষ রুপি। তবে বাংলায় তখনও ঋণ দেওয়া হতো মূলত কোনোরকম কাগজপত্র ছাড়াই শুধু বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যাওয়ার পর বাংলায় মহাজন ও বণিকগোষ্ঠী এবং জগৎশেঠ পরিবারসহ টাকা ও ঋণের ব্যবসায় নিয়োজিত সকলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মুগল আমলের শেষ দিকে বাংলায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থার অবনতি অর্থনীতির জন্য বেশ ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার একটি লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশেরা এখানে বেশ কয়েকটি এজেন্সি ঘর প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলাদেশে ঋণব্যবস্থা আনুষ্ঠানিক রূপ নিতে শুরু করে আঠারো শতকের শেষভাগে এবং ব্রিটিশ আমলে এর প্রভূত উন্নতি ঘটে। ব্রিটিশ আমলে বাংলায় ১৪টি ব্যাংক এবং ১৭টি লোন অফিস চালু হয়।
১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর পাকিস্তান ব্রিটিশ ব্যাংক ব্যবস্থার উত্তরাধিকার হিসেবে দেশি ও বিদেশি ব্যাংকসমূহের মোট ৬৩৭টি শাখা নিয়ে একটি ব্যাংক ও ঋণ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো পায়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান দেশে ঋণব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণ-সংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকিং-এ অগ্রগতি ছাড়াও ২৪ বছরে পাকিস্তানে কৃষি, শিল্প ও গৃহনির্মাণ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান স্থাপনে বেশ সাফল্য অর্জিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এ জাতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ সংস্থা এবং গৃহনির্মাণ অর্থসংস্থান সংস্থা।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঋণব্যবস্থায় ছিল ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট ১,১৩০টি শাখা। এ সময়ে ঋণব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিদ্যমান অপ্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গ ছিল মহাজন, দোকানি ও অন্যান্য নানা ধরনের ধারপ্রদানকারী গোষ্ঠী। তবে হাতে নগদ টাকা তেমন না থাকায় এ সকল অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসের ভূমিকা স্বাধীনতার পরের প্রথম বছরগুলিতে নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য ছিল।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এ ছাড়া পূর্বে বিদ্যমান ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে পুনর্বিন্যস্ত করে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। একই বছর বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা নামে দুটি এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক নামে নতুন একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে উন্নয়ন অর্থসংস্থানের জন্য রেয়াতি সুদহারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উৎসস্বরূপ এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং ব্যাংক ফর ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ( বেসিক ব্যাংক)। ৩১ মার্চ ২০০০ পর্যন্ত এ সকল উন্নয়ন অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠান বা বিশেষায়িত ব্যাংক মোট ৬,৯৫১.২২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। ক্ষুদ্র শিল্পখাতে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি ঋণদানের এ জাতীয় একটি উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন। দেশের সমবায় ব্যাংকসমূহ কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে।
দেশের পুঁজিবাজারের বিকাশ ও তার মাধ্যমে শিল্পোন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ গঠিত হয়। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি ঋণ ও বিনিয়োগ কোম্পানি। ন্যাশনাল ক্রেডিট লি. এবং বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি. নামের দুটি কোম্পানি ছাড়াও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সরকারি খাতে অনেক নতুন ব্যাংক, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, লিজিং কোম্পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসবের মধ্যে আছে অন্তত ২৫টি নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক, চারটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২৭টি, মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠান ও ২২টি অন্যান্যঅব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশে ১৩টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক চালু আছে।
দেশের ঋণব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ায় ঋণ সরবরাহের পরিমাণও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৭ সালের জুন মাসে মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ১১৫.৩ কোটি টাকা যা ২০০০ সালের ৩০ জুন তারিখে দাঁড়ায় ৫,৫৮২.৫ কোটি টাকা। কৃষি, শিল্প, স্থাবর সম্পত্তি, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, বীমা, পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে এবং দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কর্মকান্ডে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক ২৭.৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ক্ষুদ্রঋণ খাতে বিশেষায়িত গ্রামীণ ব্যাংক মূলত দারিদ্র্য বিমোচন ও মহিলাদের ক্ষমতায়নে নিয়োজিত এবং ৩০ জুন ২০০০ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ১৫৭ কোটি টাকা। একই সময় পর্যন্ত ১৯৯৮-এর সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত কর্মসংস্থান ব্যাংক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পখাতে নিয়োজিতদের ঋণ দিয়েছে মোট ৮.৫ কোটি টাকা। এ সময় অবধি বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন কর্তৃক দেওয়া গৃহঋণের মোট পরিমাণ ছিল ২৭৬.৬ কোটি টাকা এবং দেশের ২৭টি ইজারা কোম্পানির দেওয়া দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ১৩৩.২ কোটি টাকা।
এনজিও ও সমস্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারি ও বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে একটি নতুন ধরনের ঋণব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে দেশে এক হাজারেরও অধিক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান অর্থসংস্থান কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, এগুলির অধিকাংশই দেশি বা বিদেশি এনজিও। আর এদের লক্ষ্যগোষ্ঠী হচ্ছে চালু ব্যাংকঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত দরিদ্র জনগণ। ৩৬৯টি এনজিও, গ্রামীণ ব্যাংক, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ঋণ কার্যক্রম থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে এ সকল সংস্থা ন্যূনাধিক ৪৯ লক্ষ সদস্যকে মোট ৫৩৫.৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।
ব্যাংক ঋণ ব্যাংক ঋণ বলতে দেশের তফসিলী ব্যাংকসমূহ কর্তৃক প্রদত্ত মোট ঋণকে বুঝায়। এর দুটি ভাগ রয়েছে- ক) আগাম ও খ) বাট্টাকৃত বিলসমূহ। বর্তমানে (জুন ২০১০) ৪টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ৪টি বিশেষায়িত, ৩০টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংক নিয়ে মোট তফসিলী ব্যাংক গঠিত। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে তফসিলী ব্যাংকসমূহের সম্মিলিত ঋণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২,৪৯,০০৩.৩৮ কোটি টাকা যার শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি অংশ শহুরে এলাকায় প্রদত্ত। বিগত দশ বছরে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বাৎসরিক ভিত্তিতে গড়ে শতকরা ৩১ ভাগেরও বেশি। এর আগের দশকে এ ঋণের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ১৮.০ ভাগ।
১৯৯৯ সালের পূর্বে প্রদত্ত ব্যাংক ঋণের একটা বড় অংশ কু-ঋণে পরিণত হয়। অদক্ষ ঋণ ব্যবস্থপনা, ঋণ প্রদানে স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নির্দেশনাভিত্তিক ঋণ বিতরণ এবং ঋণ প্রদান উত্তর নীরিক্ষা ও তত্ত্বাবধায়নের অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আর্থিকখাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ব্যাংসমূহের কাঠামোগত পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতি প্রবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ঋণ ব্যবস্থপনায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ফলে ২০০৮ সালের শেষে কু-ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের শতকরা ১০.৮ ভাগে নেমে আসে।
বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় যেখানে ব্যাংকসমূহ নিজেরাই তাদের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক হারে বিতরণ করার পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যদিও কতিপয় ক্ষেত্রে সরকার সুদ হারের সর্বোচ্চ সীমা নির্দেশ করে দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক ঋণের গুরুত্ব ভারীত গড় বার্ষিক সুদ হার দাঁড়ায় শতকরা ১২.৩১ ভাগ। তবে শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকসমূহের জন্য অবশ্য এ হার প্রযোজ্য নয়। তারা সুদের পরিবর্তে লাভ/লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।
ব্যাংক শ্রেণিভিত্তিক ঋণের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে মোট ব্যাংক ঋণের স্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যক ব্যবস্থাসমূহ, বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এবং বিদেশি ব্যাংকসমূহের অংশ ছিল যথাক্রমে শতকরা ২২.৪৫ ভাগ, শতকরা ৬.৯০ ভাগ, শতকরা ৬৩.৭৫ ভাগ এবং শতকরা ৬.৯০ ভাগ। অর্থনৈতিক খাতভিত্তিক ব্যাংক ঋণের প্রবাহ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, মোট ঋণের শতকরা ৬.১৫ ভাগ কৃষি খাতে, শতকরা ২১.৬৩ ভাগ শিল্প খাতে, শতকরা ১৫.৮০ ভাগ চলতি মূলধন খাতে, শতকরা ৩৬.৭৯ ভাগ ব্যবসায় খাতে, শতকরা ৬.৮৫ ভাগ নির্মাণ খাতে, শতকরা ১.৪৭ ভাগ পরিবহণ খাতে এবং শতকরা ১২.০১ ভাগ অন্যান্য খাতে প্রদত্ত।
কৃষি ঋণ মুগল বাংলায় মহাজন বা লগ্নি কারবারীরাই ছিল কৃষিঋণের প্রধান উৎস। মহাজনি ব্যবস্থা খুবই প্রাচীন, বৈদিক যুগেও এর অস্তিত্ব ছিল। বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের অব্যবহিত পূর্বে ফারসিতে লেখা রিসালা-ই-জিরাত গ্রন্থের বর্ণনামতে, সে আমলে কৃষকেরা প্রায়ই খাজনা দিতে না পারার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত আর মাঝে মাঝেই খরার ক্ষয়ক্ষতি পূরণে, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির বাড়তি ব্যয় মেটাতে কিংবা নানারকম বিবাদের ফয়সালা করতে যেসব খরচ হতো তার জন্য তাদের কারও না কারও কাছে ধার-কর্জ নিতে হতো। মহাজন ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ধনী পড়শি ব্যক্তিরা এসব অবস্থায় ঋণের উৎস হিসেবে কাজ করত। ব্রিটিশ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় দাদনি প্রথা এর মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন ঋণ দিত।
ঐতিহ্যগতভাবে, ভারতীয় মহাজনেরা কৃষকদের নগদ অর্থে বা পণ্যসামগ্রীতে যে ঋণ দিত তা পরবর্তী সময়ে চড়া সুদে ফেরত নিত, তবে তারা কৃষকদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু দাদনি ব্যবস্থা চালু করে ঋণদাতা ব্যক্তি বা সংস্থা ঋণকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন-সংক্রান্ত সবকিছুর সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলে। এ ব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট ফসলের বিপরীতে ঋণ দিয়ে উৎপাদিত ফসলের একটি বা সম্পূর্ণ অংশ দিয়েই তা আদায়ের বিধান চালু হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে বিক্রয়ের জন্য কৃষকেরা যত খাদ্যশস্য উৎপাদন করে তার প্রায় সবটাই ছিল শস্য ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীদের ঋণে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তুঁত এবং নীল চাষের জন্য ঋণ চালু করে। কৃষকেরা তাদের পণ্য আগাম বন্ধক রেখেও ঋণ নিত। তবে এতসব ঋণব্যবস্থা বাংলার কৃষিকে উন্নত বা আধুনিক করার জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না। কৃষিতে ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য তহবিল জোটাতে স্থানীয় মুদ্রা বাজার ছিল খুবই সীমিত। কৃষির উন্নতির জন্য ব্রিটেন থেকেই পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যায় নি।
উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলার কৃষি অর্থনীতি তার স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এ সময় কৃষকেরা উচ্চহার ও চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে স্থায়িভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাদের উৎপাদন ও আয় কমে যায় এবং তারা অর্থনীতির সার্বিক কাঠামোগত ত্রুটির শিকার হয়। গ্রামীণ মহাজন, কাবুলিওয়ালা, জোতদার, সাহা, বেনিয়া, তেলি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতারা গ্রামাঞ্চলে যেসব সাধারণ ও কৃষিঋণ দিত সেগুলির সুদের হার ছিল বার্ষিক ২৫% থেকে ৪০%। দেনাগ্রস্ত কৃষক তার দেনা পরিশোধের জন্য তার ফসলের সম্পূর্ণ বা বৃহদাংশ প্রায়ই পাওনাদারদের নিকট সস্তায় বিক্রয় করতে বাধ্য হতো। ১৯২৮-১৯৩৭ সালের মহামন্দার সময়ে কৃষিপণ্যের মূল্য যেভাবে পড়ে যায় তাতে কৃষকদের দেনাগ্রস্ততা আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২৯-১৯৩৫ সালে কৃষিপণ্যের মূল্য বাংলার অনেক প্রদেশে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। এতে কৃষকদের অর্থনৈতিক দুর্দশা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
মহাজনি কারবারে নিয়োজিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের উচ্চহারে সুদ আদায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলায় একটি স্থায়ী সমস্যা ছিল। এর প্রতিবাদে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় অনেক কৃষক আন্দোলনও সংঘটিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারের অর্থ বিভাগ বাংলাসহ ভারতের সব অঞ্চলে উচ্চহারে সুদ আদায় বন্ধ করার জন্য বেশকিছু সুপারিশ প্রণয়ন করে। ব্রিটিশ শাসকেরা আরও কয়েকটি অনুরূপ তদন্ত কমিটি ও কমিশন গঠন করে। এসব কমিটি ও কমিশন গ্রাম এলাকায় ঋণগ্রস্ততা ও কৃষিতে তার প্রভাব নানাভাবে খতিয়ে দেখে। ফলে অনেক নতুন প্রতিবেদন ও আইন প্রণীত হয়। এসবের মধ্যে ছিল ভূমি উন্নয়ন আইন ১৮৮৩, কৃষিঋণ আইন ১৮৮৪, নিকোলসনের প্রতিবেদন, ম্যাকলাগান কমিটি প্রতিবেদন ১৯১৪, কৃষি-বিষয়ক রাজকীয় কমিশনের প্রতিবেদন ১৯২৯, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাংক তদন্ত প্রতিবেদন ১৯৩০, বঙ্গীয় অর্থনৈতিক তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদন ১৯৩৪, পুনর্বাসন বিষয়ক তদন্ত প্রতিবেদন ১৯৪৩ ও ১৯৪৪, বঙ্গীয় শস্য জরিপ ১৯৪৪-৪৫, বঙ্গীয় দেনাগ্রস্ততা জরিপ ১৯৪৬, পল্লি দেনাগ্রস্ততা তদন্ত এবং দেনা বন্দোবস্ত বোর্ড গঠনের প্রতিবেদন। বাংলার কৃষকদের দেনাগ্রস্ততা সমস্যা নিরসনে এসবের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বঙ্গীয় দেনাগ্রস্ততা অব্যাহতি বিলের ভিত্তিতে বঙ্গীয় কৃষি দেনাদার আইন ১৯৩৫ পাস হয়। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্বব আইন সংশোধন করে ১৯২৮ সালের পূর্বে বন্ধকি সূত্রে সৃষ্ট সকল দেনা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়।
মহাজনদের অর্থঋণ-বিষয়ক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বঙ্গীয় মহাজন আইন ১৯৪০-এ বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়। পূর্বে সুদের জন্য দেওয়া ঋণ-আইনে সুদ সম্পর্কে যেসব বিধান ছিল ইতোমধ্যে তাতে কিছু বিধি সংযোজন করে বঙ্গীয় মহাজন আইন ১৯৩৩ বিধান করেছিল যে জামানতি ঋণের ক্ষেত্রে ১৫%-এর অধিক এবং অজামানতি ঋণের ক্ষেত্রে ২০%-এর অধিক সুদ আরোপ করা হলে উদ্বৃত্ত সুদ অবৈধ বলে গণ্য হবে। ব্রিটিশ আমলেই বাংলায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রচলনের পাশাপাশি ঋণের বেশকিছূ প্রাতিষ্ঠানিক উৎস চালু করা হয়। ১৯১২ সালে পাস হয় সমবায় সমিতি আইন এবং একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংক। ১৯৪০ সলে বঙ্গীয় সমবায় সমিতি আইন সংশোধন করে সমবায়ের নিয়মকানুনে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানে কৃষিঋণ সমস্যায় অনেক নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ সময় কৃষি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় কৃষি ও কৃষিঋণ বিষয়ে বেশ কয়েকটি নতুন কমিটি ও কমিশন গঠন করা হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাকিস্তান কৃষি তদন্ত কমিটি ১৯৫১, বিশেষজ্ঞ কমিটি, পশ্চিম পাকিস্তান সমবায় তদন্ত কমিটি, ঋণ তদন্ত কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশন। প্রায় সব কমিটি ও কমিশনই কৃষি অর্থসংস্থানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালীকরণের সুপারিশ করে। দেশে কৃষিঋণের ব্যাপক চাহিদার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিশেষায়িত কৃষিঋণ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে মনোযোগের ভরকেন্দ্র ছিল জরুরি ভিত্তিতে কৃষির উন্নয়ন প্রয়োজন এমন সব বিশেষ এলাকা। ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নামে চিহ্নিত কিছু মডেল এলাকা বাছাই করে সেখানে অধিকতর কৃষি উৎপাদন এবং কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম পর্যায়ে এভাবে চিহ্নিত এলাকা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৭টি জেলা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ৭টি মহকুমা। পরবর্তী সময়ে এ কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ করা হয়।
বাস্তবে ঋণকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হলেও পাকিস্তানে কৃষিঋণ ছিল মূলত দু ধরনের-মৌসুমি ঋণ এবং উন্নয়ন ঋণ। মৌসুমি ঋণ দেওয়া হতো নানা ধরনের চলতি ব্যয় মেটানোর জন্য। উন্নয়ন ঋণ মূলধন জাতীয় ব্যয় মেটাতো। নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন বা একটি নির্দিষ্ট মৌসুমের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়া হতো। কৃষকদের সাধারণত ক্ষেত প্রস্ত্ততের জন্য নির্দিষ্ট মৌসুমে ঋণ দরকার হতো আর ঋণের অর্থ তারা পরিশোধ করত ফসল তোলার পর। বছরের রবি ও খরিপ- এ দু মৌসুমের জন্য আলাদা আলাদাভাবে বা একবারে ঋণ নিয়ে তারা ফসল তোলার পর আলাদা দু কিস্তিতে বা বছরের শেষে এক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করত। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ক্ষেত তৈরি ছাড়া বীজ ক্রয়, সার ক্রয় ইত্যাদি কাজেও প্রয়োজন হতো।
দেশে কৃষিঋণ পাওয়ার উপযোগী ঋণগ্রহীতার ঋণযোগ্যতা বিচারের প্রধান মাপকাঠি ছিল মালিকানাধীন জমির পরিমাণ। সরকারি-বেসরকারি সব ঋণদাতা সংস্থাই একই নিয়মে চলতো। তবে জমি বন্ধক রেখে তার বিনিময়ে ঋণ নেওয়া ছাড়াও ঋণগ্রহীতার জন্য অপর একটি পথ খোলা ছিল। যেকোনো জমির মালিক তার পক্ষে জামিন হিসেবে নিশ্চয়তা দিলেও ঋণ পাওয়া যেত।
১৯৪৭-এর পর বাংলাদেশে চালু থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ও কৃষিঋণ বিষয়ক আইন হচ্ছে ১৯৪০ সালে সংশোধিত বঙ্গীয় কৃষি দেনাদার আইন ১৯৩৫, বঙ্গীয় মহাজন আইন ১৯৩৯ এবং পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকারের দেওয়া কৃষিঋণ ১৯৫৬ সালে ছিল ২.৮ কোটি রুপি এবং তা ১৯৬১-৬২ সালে ছিল ২.৫ কোটি। সরকার প্রত্যক্ষ ঋণদাতা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে তাকাবি ঋণ ও পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিঋণ চালু রেখেছিল। কৃষিঋণ প্রদানে সমবায় সমিতি ও সংগঠনগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ৮টি জমি বন্ধকী ব্যাংক ছিল। এগুলির সদস্য ছিল ৭,৫৬৭ জন, শেয়ার মূলধন ২.৭ লক্ষ রুপি এবং চালু মূলধন ২৪.৮ লক্ষ রুপি। ১৯৫৯-৬০ অর্থবছরে এ কয়েকটি ব্যাংক কৃষিখাতে ৬.৩ লক্ষ রুপি ঋণ দেয়। এসব ঋণের উদ্দেশ্য ছিল যাতে কৃষকদের পুরনো দেনা মেটানো এবং জমির দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন। ১৯৪৮-৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ৮৩টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক চালু ছিল। তবে এগুলির সংখ্যা ১৯৬০ সালে ৫৬-তে নেমে আসে। ১৯৫৯-৬০ সালে এদের দেওয়া মোট কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ২.৮৮ কোটি রুপি। পূর্ব পাকিস্তানে যেসব জায়গায় কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ছিলনা সেখানে ছিল কেন্দ্রীয় বহুমুখী সমিতি। ১৯৫৯-৬০ সালে এ জাতীয় সমিতি ছিল ৬২টি এবং ঋণগ্রহীতাদের নিকট তাদের দেওয়া মোট ঋণ ছিল ৬০.২৪ লক্ষ রুপি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় এখানে ১২টি ব্যাংকের ১১৩০টি শাখার একটি দুর্বল ব্যাংক কাঠামো ছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ এ কয়েক বছর বাংলাদেশে কৃষিঋণ বিতরণের প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (প্রাক্তন কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক) এবং সমবায় সমিতিসমূহ। কৃষিঋণের সরবরাহ ও প্রবাহ বাড়াতে সরকার ১৯৭৬ সালে বিশেষ কৃষিঋণ কর্মসূচির আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংসমূহকে কৃষিঋণ দিতে নির্দেশ দেয়। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল মৌসুমি শস্যঋণ প্রদান। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে কৃষিঋণ দেওয়া শুরু করলে ১৯৭৬-৭৭ সালে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রদত্ত কৃষিঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭.৫০ কোটি টাকা, যা ১৯৯৯-২০০০ সালে ছিল ৭৬৩.০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এখন ৮৪৪টি শাখা এবং এ ব্যাংকের রাজশাহী বিভাগের শাখাসমূহ নিয়ে গঠিত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের শাখা ৩০১টি। ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১.৪৫ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। একই বছর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বিতরণ করেছে ২,৬৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশে সকল কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি, সমবায় জমি-বন্ধক ব্যাংক, কেন্দ্রীয় আখচাষি সমিতি, থানা সমবায় সমিতি ও অন্যান্য সমবায় সমিতির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১১। ২০০০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ ব্যাংক মোট ২৭.৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যার ২৫.৯ কোটি টাকাই দেওয়া হয় কৃষিখাতে। বাংলাদেশের কৃষিখাতে দেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার ৯.৭৫% থেকে ১৫.৫%। তালিকাবদ্ধ ব্যাংক ছাড়া দেশে ৮টি অতালিকাবদ্ধ ব্যাংকও কৃষিঋণ কার্যক্রমে ভূমিকা রাখছে। তবে এদের অংশগ্রহণের মাত্রা ও ধরন সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে সাম্প্রতিককালে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকসহ সকল তফসিলী ব্যাংক কৃষিঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। এলাকাভিত্তিতে উৎপাদিত বিশেষ বিশেষ কৃষি পণ্যের উৎপাদন বিপণনে সহায়তাদানের জন্য বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি (PPP) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কৃষিঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কৃষিঋণ বিতরণ সহজ করার লক্ষ্যে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে কৃষকদের ঋণ হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বার্ষিক ঋণ কর্মসূচীর আওতায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট ৯৩৭৯.২০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যার বিপরীতে মোট ৯২৮৪.৪৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়।
অভ্যন্তরীণ ঋণ দেশের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের গুরুত্ব অপরিসীম। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থার আওতায় যে ঋণের প্রবাহ ঘটে তাকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বলে। তফসিলী ব্যাংকসমূহ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণ-এর আওতায়ভূক্ত। তবে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদত্ত ঋণ-এর আওতাভূক্ত নয়। এ ঋণের তিনটি বিভাজন রয়েছে যথা ১) সরকারি ২) রাষ্ট্রায়ত্ব এবং ৩) বেসরকারি খাত। ২০০৯ সালের জুন শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমান দাঁড়ায় ২,৪৯,০৪০.০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ব এবং বেসরকারি খাতের অংশ ছিল যথাক্রমে শতকরা ২০ ভাগ, ৪ ভাগ ও ৭৬ ভাগ। একদশক পূর্বে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণে উক্ত খাতসমূহের অংশ ছিল যথাক্রমে শতকরা ৩০ ভাগ, ৮ ভাগ ও ৬২ ভাগ। সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচী জোরদারকরণ এবং অর্থনীতিতে বেসরকারীকরণ নীতিতে ভূমিকা সম্প্রসারণ করায় অভ্যন্তরীণ ঋণে এরূপ খাতওয়ারী পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। [আবুল কালাম আজাদ]