তাকাবি

তাকাবি জমিদারি আমলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য একজন রায়তকে তার উপরস্থ জোতদার কর্তৃক প্রদত্ত অগ্রিম মুদ্রা। তাকাবি শব্দটি সংস্কৃত ‘টাকা’ ও আরবি ‘কাভি’ শব্দের যুক্ত রূপ যার অর্থ শক্তি বা শক্তিশালী করা। মুগলরা এবং পরবর্তীকালে কোম্পানি সরকার দুঃস্থ রায়তদের চাষের সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ফেরৎযোগ্য নগদ অর্থের অগ্রিম বোঝাতে তাকাবি শব্দটি ব্যবহার করত। উনিশ শতকের শেষার্ধে বিভিন্ন সমবায় সমিতি, ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণ প্রবর্তনের পর থেকে তাকাবি শব্দটি লুপ্ত হয়ে যায়। তাকাবি একটি ধারণা হিসেবে জমিদারি ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলি একে কৃষিঋণ আখ্যা দেয়।

মুগল আমলে তাকাবি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। বন্যা, খরা, মহামারী ইত্যাদি যেকোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চাষবাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুগল সরকার রাজস্ব সংগ্রহ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিত কিংবা কমিয়ে দিত। অধিকন্তু, কৃষককুলের চাষবাসে সামর্থ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তাকাবি-অগ্রিম প্রদান করত। এর বিতরণকারী মাধ্যম ছিল জমিদার ও তালুকদার। এদেরকে রায়তদের তাকাবি ঋণ দিতে এবং সরকারি রাজস্বের হিসাবে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করতে বলা হতো। আকালের সময় প্রদত্ত তাকাবি-অগ্রিম ফেরৎ নেওয়া হতো আকাল-উত্তর সময়ে। এ ধরনের ঋণ আধুনিক সুদের ন্যায় যেকোন অতিরিক্ত কর থেকে মুক্ত ছিল।

উপনিবেশিক সরকার কৃষিঋণের তাকাবি প্রথাকে বাতিল করে দেয়। ১৭৯৩ সালের দ্বিতীয় ও পঞ্চদশ রেগুলেশন স্পষ্ট করে দেয় যে, তাকাবি তখন থেকে শুধু জমিদার ও অন্য জোতদারদের নিজ দায়িত্বে থাকবে এবং রায়তদের তাকাবি-অগ্রিম দেওয়ার নামে তারা কোনো রেয়াত দাবি করতে পারবে না। বাস্তব কারণেই জমিদারদের কৃষিঋণের তাকাবি প্রথা চালিয়ে যেতে হয়েছিল, কারণ তারা জানত যে তাকাবি বন্ধ করা হলে ছাড়া রায়তরা এস্টেট থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যাবে। সেজন্য নিজেদের স্বার্থেই, জমিদাররা দুর্যোগকালে রায়তদের তাকাবি ঋণ আগাম দিত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জমির জন্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির দরুন জমিদাররা ক্রমশ তাকাবি ঋণ বন্ধ করে দেয়। প্রজাস্বত্ব আইনগুলি দ্বারা জমিতে প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাও জমিদারদের তাকাবি প্রত্যাহারের আরেকটি কারণ।  [সিরাজুল ইসলাম]