অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ
অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, ভূস্বামী, দোকানি, কৃষক, পেশাজীবী সম্প্রদায়, কাবুলি, ফেরিওয়ালা, মহাজন প্রভৃতি শ্রেণির হাতে লেনদেনকৃত ঋণের বাজার সাধারণভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের আওতায় পড়ে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বাজার শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতে বিদ্যমান থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণকে মূলত গ্রামীণ অর্থবাজারেরই অঙ্গ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অল্প কিছুদিন আগেও গ্রাম এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। আজও তা যেটুকু আছে গ্রামের দরিদ্র জনগণ তার সুবিধা অল্পই পায়। ফলে কৃষক এবং স্থানীয় দরিদ্র ও প্রান্তিক বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীর লোকেরা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়স্বজন ও পেশাদার মহাজনদের নিকট থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে তাদের পুঁজির চাহিদা পূরণ করে।
স্থানীয় ঋণবাজারে দীর্ঘদিনের বহাল থাকা আধিপত্য আর পল্লী এলাকার জনগণকে দেওয়া নানা ধরনের ঋণসেবার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিম্ন আয়ের লোকদের কাছে সহজপ্রাপ্য। এ ছাড়া সব গ্রামাঞ্চল ও ক্ষুদ্রায়তন অর্থবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ না পৌঁছার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণই প্রয়োজনে একমাত্র সহায়।
সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা চালুর গোড়ার দিকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ চালু হয়। একেবারে সূচনাপর্বে উদ্বৃত্ত চাষিরা ঘাটতি চাষিদের অনুরোধে তাদেরকে খাদ্যশস্য ও বীজ ধার দিত। ফসল তোলার পর আবার তাদের কাছ থেকে কিছুটা ধরাটসহ পূর্বে দেওয়া শস্য ও বীজ ফেরত আদায় করত। দ্রব্য-বিনিময় প্রথার বদলে মুদ্রায় বিনিময় চালু হওয়ার পর অর্থের মাধ্যমে ধারকর্জেরও ব্যবস্থা চালু হয়। ব্যবসায় ঋণ ও অন্যান্য অনেক প্রয়োজনেই ঋণ লেনদেন একটি মুদ্রাগত লেনদেনে পরিণত হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সংস্থা বা সংগঠনের সৃষ্টি হয় অনেক দেরিতে। মহাজন, স্বর্ণকার, স্থানীয় বণিক ইত্যাদি শ্রেণির সক্রিয় ধারের ব্যবসা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণব্যবস্থা সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে। ১১৭১-এ ইতালিতে বিশ্বের প্রথম ব্যাংক ‘ব্যাংক অব ভেনিস’ প্রতিষ্ঠার পর এ ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়।
অতীতে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের প্রধান উৎস ছিল মহাজন, স্বর্ণকার এবং বণিক সম্প্রদায়। মহাজনরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দিলেও প্রায়ই তারা ঋণের জামানত হিসেবে স্বর্ণালঙ্কার, পিতল বা কাঁসার বাসনকোসন ইত্যাদি রেখে দিত। তারা আবার জনসাধারণের অনেকের টাকা আমানত রাখার ব্যবসাও করত। মহাজনদের সুদখোর বলে খেদ প্রকাশ করা হলেও তারাই প্রাচীন অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পথ সুগম করতে সহায়তা করে। আজও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সমাজের একটি বড় অংশের জনগণ ব্যাংক ঋণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না এবং তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থাও নিতান্তই সীমিত। ফলে তাদের কাছে মহাজনসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সকল উৎস অনেকাংশে আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে। ঋণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে প্রাচীনকালে স্বর্ণকারদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। জনগণ বস্ত্তত নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য স্বর্ণকারদের নিকট তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখত। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলসহ বিশ্বের প্রায় সবস্থানেই স্বর্ণকাররা ছিল ধনী এবং তাদের সৎ ও নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করা হতো। তবে জামানত রেখে সবাই যেহেতু একসঙ্গে তাদের সব অর্থ ফেরত নিতো না, সে কারণে স্বর্ণকারদের হাতে সর্বদাই যথেষ্ট উদ্বৃত্ত অর্থ জমা থাকত। এ অর্থ দিয়েই তাদের সুদের বিনিময়ে ধার দেওয়ার কারবার শুরু হয়। একইভাবে, বণিকরাও তাদের ব্যবসায়ে অর্জিত মুনাফার একটি অংশ সুদের বিনিময়ে ধারে লেনদেনে লাগানো শুরু করে। চতুর্দশ শতকে ইতালির লম্বার্ডে এলাকা থেকে একদল বণিক ইংল্যান্ডে এসে সেখানে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করে এবং তাদের বসতির এলাকাটি লম্বার্ড স্ট্রিট নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রচুর অর্থের মালিক এ বণিকরাই ইংল্যান্ডে সুদের কারবার চালু করে। জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির লোকজনও তাদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিত।
বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাংলায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই ঋণ দেওয়া-নেওয়া ও ঋণের জন্যে উপরি তথা সুদ পরিশোধের প্রথা প্রচলিত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, বৈদিক যুগে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লেনদেনের অস্তিত্ব ছিল। তবে সে সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কাজটি হতো মূলত মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। মনুর আমলে ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কার্যক্রম ব্যাংকিং-এর ধরন পায়। মনু মানুষকে পরামর্শ দিতেন, তারা যেন সৎ, আইনশাস্ত্রে বিজ্ঞ এবং শ্রদ্ধাভাজন ও বিত্তশালী আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত ব্যক্তিদের নিকট নিজেদের টাকা-পয়সা জমা রাখে। মঙ্গলকাব্য নামক প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও ধারে টাকাপয়সা ও মালামাল লেনদেনের চর্চার উল্লেখ রয়েছে। এসব লেনদেনে সুদ পরিশোধেরও রীতি প্রচলিত ছিল।
বাংলায় ঋণ ব্যবস্থার ভিত্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মুগল আমলে। প্রথম দিকের মুগল শাসকরাই স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটান এবং নানা শ্রেণির মানুষকে টাকায় লেনদেন ও ঋণপ্রদান জাতীয় কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। স্থানীয় মহাজন, পুঁজিপতি, ব্যাংকার, বেনিয়া ও নানা পেশার ব্যবসায়ীরা মুগল আমলেই অর্থ ব্যবসায়ে এগিয়ে আসেন এবং ঋণ ব্যবস্থার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। গোড়ার দিকের সুপ্রতিষ্ঠিত ঋণ ব্যবস্থার একটি ছিল দাদনি প্রথা, যার আওতায় তাঁতি, স্থানীয় চাষি বা শিল্পদ্রব্য উৎপাদনকারীরা দেশি বা বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পণ্য/পণ্যাদি উৎপাদনের জন্য ঋণ নিত এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর উৎপন্ন সামগ্রী দিয়ে সুদসহ এ জাতীয় ঋণ পরিশোধ করত।
বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থার একটি বড় মাইলফলক হচ্ছে ১৭০০ সালে কলকাতায় ব্যাংক অব হিন্দুস্থান প্রতিষ্ঠা। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক ব্যাংক। মুগল বাংলায় নামকরা মহাজনদের একটি ছিল জগৎ শেঠ পরিবার। হুগলি, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও বাংলার নানা এলাকায় তাদের ব্যবসা বিস্তৃত ছিল। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদ আঠারো শতকের গোড়ার দিকে পাটনা থেকে ঢাকা এসে এখানে একটি কোম্পানি চালু করেন। মুগল শাসকরা জগৎ শেঠ পরিবার, অন্যান্য বণিক পরিবার, মহাজন এবং ঋণ-দাদন-লগ্নি ব্যবসায় নিয়োজিত গ্রামীণ ব্যবসায়ী ও দোকানিদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং কারবারকে উৎসাহিত করতেন। আঠারো শতকের প্রথম দিকে মহাজনরা আবাদের মৌসুম শুরুর পূর্বে কৃষকদের ঋণ দিত। ফসল তোলার পর এ ঋণের দেনা ফসলের মাধ্যমেই শোধ করতে হতো এবং মহাজনরা তা গুদামে রেখে সুবিধামতো সময়ে বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা পেত। দিনাজপুর, পূর্ণিয়া ও অন্যান্য জেলায় জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিনিধিরা এ জাতীয় যেসব ঋণ দিত তার উপরে সুদের হার ছিল মাসে দু থেকে চার শতাংশ। স্থানীয় মহাজনদের নেওয়া সুদের হার ছিল এর চেয়েও অনেক বেশি।
ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বাজারে বাংলা থেকে পণ্য রপ্তানিতে নিয়োজিত ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং এশীয় বণিকরা স্থানীয় উৎপাদনকারীদের রপ্তানিযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা দানের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিত। এসব ঋণ বাংলার অর্থনীতিতে নগদ অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি করে। নিজেদের উৎপাদন ব্যয় মেটাতে কৃষক ও দেশিয় কারিগরদের বিপুল অংশই স্থানীয় মহাজন ও বিদেশিদের দেওয়া ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আবার স্থানীয় মহাজন, বণিক ও ব্যাংকার গোষ্ঠীও তহবিল জোটাতে বিদেশি কোম্পানির নিকট থেকে ঋণ নিত। এ সকল স্থানীয় ব্যবসায়ীর নিকট ১৭২০-২১ সালে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির মোট পাওনা ছিল ২৪ লক্ষ রুপি। ১৭২৪ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট শুধু কাসিমবাজারের বণিক-ব্যবসায়ীদের দেনা ছিল ১৫ লক্ষ রুপি। বাংলায় ওলন্দাজদের মোট পাওনা ১৭৫৪ সালে দাঁড়ায় ২৮ লক্ষ ৩০ হাজার রুপি। ১৭৫৫ থেকে ১৭৫৭ এ তিন বছরে জগৎ শেঠের কুঠি ওলন্দাজদের নিকট মোট ২৩ লক্ষ ৮৬ হাজার রুপি দেনা তৈরি করে। এ সময় জগতশেঠের কুঠির নিকট ফরাসিদের পাওনা ছিল ১৫ লক্ষ রুপি। তবে বাংলায় তখনও ঋণ দেওয়া হতো মূলত শুধুই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়াই।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যাওয়ার পর বাংলায় মহাজন ও বণিক গোষ্ঠী এবং জগৎ শেঠ পরিবারসহ টাকা ও ঋণের ব্যবসায়ে নিয়োজিত সকলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মুগল আমলের শেষদিকে বাংলায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবনতি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জন্য বেশ ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার একটি লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশরা এখানে বেশ কয়েকটি এজেন্সি-ঘর প্রতিষ্ঠা করে।
ঐতিহ্যগতভাবে, ভারতীয় মহাজনরা কৃষকদের নগদ অর্থে বা পণ্যসামগ্রীতে যে ঋণ দিত তা পরবর্তী সময়ে চড়া সুদে ফেরত নিত, তবে তারা কৃষকদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু দাদনি ব্যবস্থা চালু করে ঋণদাতা ব্যক্তি বা সংস্থা ঋণকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনের সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে বিক্রয়ের জন্য কৃষকরা যত খাদ্যশস্য উৎপাদন করে তার প্রায় সবটাই ছিল শস্য-ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীদের ঋণে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তুঁত এবং নীল চাষের জন্যে ঋণ চালু করে। কৃষকরা তাদের পণ্য আগাম বন্ধক রেখেও ঋণ নিত। তবে এতসব ঋণব্যবস্থা বাংলার কৃষিকে উন্নত বা আধুনিক করার জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না। কৃষিতে ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংগ্রহে স্থানীয় মুদ্রা বাজার ছিল খুবই সীমিত। কৃষির উন্নতির জন্য ব্রিটেন থেকেও পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যায় নি।
গ্রামীণ মহাজন, কাবুলীওয়ালা, জোতদার, সাহা, বেনিয়া, তেলি ও অন্যান্য ঋণদাতারা ২৫% থেকে ৪০% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করতো। কৃষক প্রায়শই ফসলের একাংশ অথবা পুরো ফসলই বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতো। অপরদিকে ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩৭ সালের মহামন্দার সময় কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস পেলে কৃষকের ঋণগ্রস্থতার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এই অবস্থায় স্থানীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের উপর পাওয়া তথ্য সাপেক্ষে পরিস্থিতি মূল্যায়ণের জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় কেন্দ্রিয় ব্যাংকিং তদন্ত কমিটি গঠন করে। মহাজনী সুদের দৌরাত্ম্য লাঘবে বেঙ্গল মহাজনী আইন ১৯৪০ প্রণীত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি ‘উচ্চসুদ ঋণ আইন ১৯১৮’ অথবা ‘বেঙ্গল মহাজনী আইন ১৯৩৩’ এর নতুন সংযুক্তি। সর্বশেষ প্রণীত আইন অনুযায়ী নিরাপদ ঋণের জন্য ১৫% এবং অ-নিরাপদ ঋণের জন্য ২০% এর বেশি সুদ নেয়াকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ব্রিটিশ ব্যাংকিং ব্যবস্থার উত্তরাধিকার হিসেবে দেশি ও বিদেশি ব্যাংকসমূহের মোট ৬৩৭টি শাখা সম্বলিত একটি ব্যাংকিং ও ঋণ-প্রতিষ্ঠানের কাঠামো পায়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান দেশে ঋণ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্যে নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণ সংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকিং-এ অগ্রগতি ছাড়াও ২৪ বছরে পাকিস্তানে কৃষি, শিল্প ও গৃহনির্মাণ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান স্থাপনে বেশ সাফল্য অর্জিত হয়। পূর্বপাকিস্তানে এ জাতীয় শাখার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্পঋণ ও বিনিয়োগ সংস্থা এবং গৃহনির্মাণ অর্থসংস্থান সংস্থা।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঋণব্যবস্থায় ছিল ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট ১,১৩০টি শাখা। এ সময়ে ঋণব্যবস্থার বিদ্যমান অপ্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গ ছিল মহাজন, দোকানি ও অন্যান্য নানা ধরনের ঋণদাতা গোষ্ঠী। তবে হাতে নগদ টাকা তেমন না থাকায় এ সকল অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসের ভূমিকা স্বাধীনতার পরের প্রথমে বছরগুলিতে নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য ছিল।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থার দ্রুত বিকাশ ঘটলেও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের আধিপত্য পূর্বের তুলনায় তেমন কমেনি। আজও বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রধান অংশই আসে অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন উৎস থেকে।
বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের প্রায় ৯০% মানুষ কোনো না কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত। এদের ৬০ থেকে ৭০% ঋণ নেয় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, স্থানীয় ধনী ব্যক্তি বা পরিবার, দোকান মালিক, ফড়িয়া, দালাল, ব্যাপারী বা আড়তদার, মহাজন, নানা ধরনের পেশার লোকদের দ্বারা তৈরি সমিতি, যুব সমিতি, মহিলা সংগঠন ইত্যাদি উৎস থেকে। গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ হিসেবে প্রচলিত এসব বিভিন্ন উৎসের অংশ হচ্ছে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ২৭%, প্রতিবেশী ২১%, স্থানীয় ধনী ব্যক্তি ১৬%, পেশাদার (লগ্নিকারবারি) মহাজন ১৫%, স্বর্ণকার ১%, দোকান মালিক/মধ্যস্থকারবারি (ব্যাপারী, ফড়িয়া, আড়তদার ইত্যাদি) ১৪%, বর্গাদার ভূস্বামী ৭%।
অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে নেওয়া ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য টাকায় সুদ পরিশোধ করতে হয় না। তবে সুদ হিসেবে যে দায় থাকে তা উশুল করা হয় বিভিন্ন উপায়ে। কর্জ, শস্য ঋণ, বন্ধকী ঋণ, দাদন, কামলা ঋণ, খাইখালাসি, লাগিত বা পত্তন, কট, রেহান, পোষানি, সাফ-কবলা, ফিরতিনামা ইত্যাদি নানা ধরনের ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যে ফসল, সম্পত্তি বা তার অংশ এবং কায়িক শ্রম দিতে হয়। কর্জ বা হাওলাত সাধারণত নেওয়া হয় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও শুভানুধ্যায়ীদের থেকে এবং এর জন্যে সুদ পরিশোধ করতে হয় না। এ ঋণের পরিমাণ সচরাচর সামান্য এবং এর জন্য কোনো দলিল বা জামানত থাকে না, ঋণ প্রদান ও পরিশোধ আদায় - দুটিই সমাধা হয় সরল বিশ্বাসের ভিত্তিতে। দাদন নিলে তা উৎপাদিত ফসল দিয়েই সুদসহ শোধ করতে হয় আর এক্ষেত্রে ফসলের দাম বাজারদর অপেক্ষা কম হারে ধরা হয়। ধান-ঋণও আগাম নির্ধারিত পরিমাণ ধান দিয়ে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হয়। অনেক সময় ঋণগ্রহীতা ঋণের কোনো অংশ বা সুদ পরিশোধের জন্য ঋণদাতার জমিতে বা তার প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যত্র কায়িক শ্রম দেবে এমন অঙ্গীকারও করে থাকে এবং বস্ত্তত তা পালনও করে। কট ও খাইখালাসি ঋণের ক্ষেত্রে জমি বিবেচ্য হয় জামানত হিসেবে এবং ঋণদাতা ঋণ প্রদানের পর থেকেই জমির ওপর সাময়িক দখল ভোগ করতে থাকে, তার আবাদ ও ফসলের মালিকানা পায়। ঋণদাতা উক্ত জমির আবাদ থেকে যে মুনাফা পায় তা দিয়েও সুদসহ ঋণ উশুল হতে পারে এবং এরপর ঋণগ্রহীতা জমি ফেরত পায়। তবে অব্যাহত ঋণগ্রস্ততার কারণে এ জাতীয় জমি শেষপর্যন্ত প্রায়শ ঋণদাতার মালিকানায় স্থায়িভাবে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। লাগিত বা পত্তনের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ঋণের বিনিময়ে ঋণগ্রহীতাকে তার জমি এক বছর সময় ভোগদখলের জন্য দিয়ে দেয়। ফিরতিনামা, সাফ-কবলা ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার সময় ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা জামানত হিসেবে নির্দিষ্ট জমির দখল, মালিকানা ইত্যাদি বিষয়ে দলিল সম্পাদন করে নেয়। বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ইত্যাদি এলাকায় মূলী নামের একপ্রকার অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের প্রচলন আছে। নগদ টাকায় এ জাতীয় ঋণ নিয়ে সুদ ও আসল ফেরত দিতে হয় ফসল দিয়ে এবং তা মৌসুমের প্রথম ফসল কাটার পরই প্রদেয়। মূলী ঋণের সুদহার ১৮০% পর্যন্ত হতে পারে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ভোগ ও বিনিয়োগ- উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহূত হয়। ভোগ জাতীয় যেসব উদ্দেশ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রায়ই ব্যবহূত হয় সেগুলি হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি ও পারিবারিক অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যয় এবং বিবাহ, বিশেষ উৎসব ইত্যাদিতে ব্যয়। আর বিনিয়োগ বা মূলধন জাতীয় যেসব কাজে তা ব্যবহূত হয় সেগুলি হচ্ছে কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, পশু ক্রয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায় চালু ও পরিচালনা, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যয়বহন ইত্যাদি। ধান চালের ব্যবসায়, কাপড়ের ব্যবসায়, পাটের ব্যবসায় বা কাঠের ব্যবসায় ইত্যাদিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে প্রায় অপরিবর্তিত রূপে প্রচলিত আছে।
১৯৫৬ সালে পূর্ববাংলার পল্লী অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অংশ ছিল ৪.৫৩% এবং ৯৫.৪৭%, ১৯৬৬-এ তা দাঁড়ায় ১৩.৮৯% ও ৮৬.১১% ১৯৭৪-এ ১৪% ও ৮৬%, এবং ১৯৮৯-এ ২৫% ও ৭৫%। এ সময়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর সুদের হার ছিল বছরে ৬০% থেকে ১১০% পর্যন্ত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এনজিওসমূহের তৎপরতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পল্লী এলাকার জনগণকে এক হাজারেরও বেশি এনজিও ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। তবে গত ১৫-২০ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ যথেষ্ট সম্প্রসারিত হলেও পল্লী এলাকায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ এখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে সহজে ঋণ পাওয়া যায়। এর বরাদ্দ এবং ছাড়করণে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই বলে প্রয়োজনের মুহূর্তে এটি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য এবং এর প্রক্রিয়াকরণ-ব্যয়ও নেই। তবে এ ঋণের সুদহার যথেষ্ট চড়া, প্রায়ই প্রয়োজনে ব্যবহূত না হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যয় হয় অনুৎপাদনশীল খাতে, আর ঋণগ্রহীতাদের অজ্ঞতা, সরলতা ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এ জাতীয় ঋণদাতারা অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ হস্তগত করে, ত্বরান্বিত করে দরিদ্রের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের একটি গ্রামে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের সহজপ্রাপ্তি এবং উভয়ের মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক দরিদ্রের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখছে। [আবুল কালাম আজাদ]
গ্রন্থপঞ্জি Saurabh Sinha, Imran Matin, ‘Informal Credit Transactions of Micro-Credit Borrowers in Rural Bangladesh’, IDS (Institute of Development Studies) Bulletin pages 66–80, October 1998.