হুগলি নগরী
হুগলি নগরী ষোল শতকে পর্তুগিজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। হুগলি নদীর ঠিক পশ্চিম তীরে অবস্থিত এবং বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবাংলার একই নামের জেলার প্রধান কেন্দ্র। বর্তমানে এটি মহাসড়ক ও রেল যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ষোল শতকে পর্তুগিজদের বসতি স্থাপনের পূর্বে হুগলি ছিল ভাগীরথী নদীর ডান তীরের একটি ছোট গ্রাম। সাতগাঁও থেকে পশ্চিম দিকে দুই মাইল মতো দূরত্বে গ্রামটিতে ছিল মাত্র কয়েকটি খড়ের কুঁড়ে ঘর ও বাঁশ ঝাড়ের সমাহার। এখানে পর্তুগিজ বণিকরা হিজলী থেকে আনা লবণ বোঝাই জাহাজ নিয়ে আসত এবং লবণ বিক্রি করে চলে যেত। তখন এটি ছিল শুধুই একটি গঞ্জ বা হাট। ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে পেড্রো ট্যাভারসের নেতৃত্বে একটি ফিরিঙ্গি প্রতিনিধি দল সম্রাট আকবর-এর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি) সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলায় পর্তুগিজদের জন্য একটি শহর স্থাপন করার অনুমতি লাভ করে। তাদেরকে সেসময় পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, এমনকি তারা ধর্ম প্রচার, ধর্মান্তকরণ এবং চার্চ নির্মাণেরও অনুমতি লাভ করে। এই মিশনের প্রকৃত ফল হলো ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফরমান লাভ এবং হুগলিতে পর্তুগিজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে এখানেই একটি গ্রামে বিখ্যাত অগাস্টান গীর্জা নির্মিত হয়। এই এলাকাটিই পরবর্তীকালে ব্যান্ডেল (বন্দর-এর পর্তুগিজ রূপ) নামে পরিচিত হয়। এছাড়াও জেসুইটদের জন্য এখানে কলেজ, অনাথ-আশ্রম ও আরও কিছু ছোট-খাটো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়। এভাবেই পর্তুগিজদের এক সময়ের উপনিবেশ হুগলি একটি উন্নত নগরে পরিণত হয়।
পর্তুগিজ উৎস থেকে জানা যায় যে, ষোল ও সতের শতকে বাংলার সব বাণিজ্য বন্দরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে সম্ভাবণাময় ও সর্বাধিক জনবহুল বন্দর ছিল এই হুগলি বন্দর। বন্দর হিসেবে হুগলির গুরুত্বের কারণে এর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং নাম হয় পোর্টো পিকুয়েনো বা ছোট বন্দর। এই মর্যাদা এতদিন পর্যন্ত সাতগাঁও ভোগ করে আসছিল। ভারত, চীন, মালাক্কা ও ম্যানিলা থেকে অসংখ্য জাহাজ এখানে নোঙর করত। হিন্দুস্থানী, মোঙ্গল, পারস্যদেশীয় ও আর্মেনীয় বণিকগণ এখানে আসা শুরু করে। প্রথম দিকে বন্দরটি ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত, না ছিল কোন দুর্গ, না কোন প্রতিরক্ষা প্রাচীর, এমনকি এর চারপাশে প্রতিরক্ষার জন্য কোন খাড়িও ছিল না। কিন্তু সতের শতকে বন্দরটির বর্ধিত সম্ভাবনা ও এর জনসংখ্যা পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুগল সম্রাটের অনুমতিতেই পর্তুগিজসহ হুগলির অধিবাসীরা প্রতিরক্ষা ও স্থানীয় ব্যবস্থাপনা নিজেরাই পরিচালনা করত। অবশ্য এলাকাটি তখনও সম্রাটের এখতিয়ারে ছিল। স্পেন ও পর্তুগালের রাজা হুগলিতে মেয়র হিসেবে জনৈক ক্যাপ্টেন কনভিডরকে মনোনীত করেন। চার জন সহকারী তাকে সহযোগিতা করতেন। গোয়ার দূরত্বের কারণে সিংহলের (শ্রীলঙ্কা) গভর্নরের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয় বন্দরটির প্রতিরক্ষার দায়িত্ব। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন গভর্নর প্রতি বছর এই দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন। সময়ের সাথে সাথে বহু ফিরিঙ্গি হুগলিতে জমা হয় এবং বেশ বড় বড় ভবন নির্মাণ করে এবং সেগুলিকে কামান, গোলা-বারুদ ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রে শক্তিশালী করে।
কিন্তু খুব শীঘ্রই শহরের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেই সাথে পর্তুগিজদের নৈতিক অধোপতন ও জলদস্যুতায় তাদের আগ্রহের কারণে মুগল সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি) বাংলার সুবাহদার কাসিম খানকে হুগলি অধিকার, পর্তুগিজ শক্তি ধ্বংস ও তাদের বন্দি করার নির্দেশ দেন। কাসিম খান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন হুগলি অবরোধ করেন এবং ১৫ সেপ্টেম্বর তা দখল করেন। এই অভিযানের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার পর্তুগিজ নিহত, গোলা-বারুদে বিধ্বস্ত, পানিতে ডুবে অথবা আগুনে পুড়ে মারা যায়। অন্যদিকে রাজকীয় বাহিনী প্রায় এক হাজার সৈন্য হারায়।
পর্তুগিজরা বিতাড়িত হওয়ার পর শাহ সুজার সুবাহদারি আমলে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হুগলিতে তাদের ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। কিন্তু পরবর্তীকালে মুগল ও ইংরেজদের দ্বন্দ্বের কারণে ইংরেজরা ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট হুগলি ছেড়ে সুতানটিতে বসতি স্থাপণ করে। পরে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার উত্থান হুগলির পতন ঘটায়। যদিও রাজনৈতিক দৃষ্টি কোণ থেকে শহরটি তার পূর্বেকার জৌলস হারায় তথাপি মুর্শিদাবাদের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সাংস্কৃতিক দিক থেকে শিয়া বসতি এবং শিয়া ধর্মতত্ত্ব ও পারস্য সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে তার মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বন্দর শহরটি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি ইংরেজদের দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত, লুণ্ঠিত ও ভষ্মিভূত হয়।
শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এখনও টিকে আছে একটি মুসলিম ইমামবারা (শিয়া সম্প্রদায়ের মিলনস্থল) ও ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটি পর্তুগিজ চার্চ। ইংরেজ শাসনামলে হুগলি শহরটিতে পুনরায় কিছু উন্নতি সাধিত হয়। ১৮৬৫ সালে হুগলি ও চুঁচুড়া একত্রে একটি পৌরসভা হিসেবে আবির্ভুত হয়। বর্তমানে হুগলি জেলা পশ্চিমবাংলার একটি অন্যতম শিল্প নগরী। [মোঃ আখতারুজ্জামান]
গ্রন্থপঞ্জি JJA Campos, History of the Portuguese in Bengal, Calcutta, 1919; JN Sarkar (ed.), History of Bengal, vol-II, Dhaka University, 3rd impression, 1976.