সাতগাঁও

সাতগাঁও মধ্যযুগীয় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর। প্রাচীনকালে এটি সপ্তগ্রাম নামে পরিচিত ছিল। প্রাক-মুসলিম যুগে সাতগাঁও হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল। এটি বর্তমানে পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে এবং সরস্বতী-হুগলির সঙ্গমস্থলের নিকটে অবস্থিত ছিল। ধারণা করা হয় যে, সরস্বতী নদী রূপনারায়ণ নদীর খাতের উপর দিয়ে প্রবহমান ছিল। এ রূপনারায়ণ নদীর তীরেই ছিল  তাম্রলিপ্তি বন্দরের অবস্থান। সাত শতকের শেষের দিকে সরস্বতী নদী হুগলি নদীর বর্তমান গতিপথের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। বারো শতকের প্রথম দিকে সরস্বতী নদী ত্রিবেণীর সংযোগস্থল (গঙ্গা, সরস্বতী ও যমুনা নদীর) থেকে বের হয়ে আসে এবং পশ্চিম দিকে কিছুদূর প্রবাহিত হওয়ার পর হাওড়ার বিপরীতে বেতরে হুগলি নদীর সাথে পুনরায় মিলিত হওয়ার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নেয়। এভাবে প্রবাহিত হওয়ার ফলে একটি শাখানদী সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে দৃষ্ট ধ্বংসাবশেষ থেকে বোঝা যায় যে, শাখানদীর উপরের অংশে নদীর দক্ষিণ তীরে সাতগাঁও অবস্থিত ছিল। পর্তুগিজদের সংক্ষিপ্ত বিবরণেও সাতগাঁওয়ের ওই একই অবস্থান দেখা যায়। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, শাখানদীটিই ছিল হুগলি নদীর মূল প্রবাহ এবং হুগলি নদীর বর্তমান প্রবাহ তখন গঠন প্রক্রিয়াধীন ছিল।

দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের পৌত্র সুলতান রুকনউদ্দীন কায়কাউসের (১২৯১-১৩০০ খ্রি) সময়ে ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে সপ্তগ্রাম সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনাধীনে আসে। এ বিজয়ের সাথে বিখ্যাত যোদ্ধা-সুফিসাধক জাফর খান গাজীর নাম জড়িত আছে। সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের (১৩০১-১৩২২ খ্রি) আমলে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, বিশেষ করে  সোনারগাঁও অধিকার করার জন্য সপ্তগ্রাম নগরটি সামরিক ঘাটি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে  গিয়াসউদ্দীন তুগলক বাংলা জয় করেন এবং এটিকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করেন। সাতগাঁও ছিল এ প্রশাসনিক বিভাগসমূহের মধ্যে একটি। মুহম্মদ বিন তুগলকের শাসনামলে ৭২৯ হিজরিতে (১৩২৮ খ্রি) এটি একটি টাকশাল শহরে পরিণত হয়। টাকশাল শহর হিসেবে সাতগাঁও একশত বছরেরও অধিকাল টিকে ছিল। শেরশাহর আমলে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে পুনরায় মুদ্রা প্রচারিত হয় এবং তাঁর পুত্র ইসলাম শাহর শাসনামলে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে শেষবারের মতো মুদ্রা জারি হয়। মুদ্রায় সাতগাঁওকে  আরসাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, সাতগাঁও একটি প্রশাসনিক কেন্দ্রও ছিল। টাকশাল স্থাপিত হওয়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও বণিকেরা সাতগাঁওয়ে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে এবং পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে  পান্ডুয়া থেকে রাজধানী গৌড়ে স্থানান্তরিত হলে সাতগাঁও বন্দরটি সমুদ্র বন্দর হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। এ বন্দর থেকে প্রধান রপ্তানি দ্রব্যসমূহের মধ্যে ছিল চাল, সুতিবস্ত্র, লাক্ষা, চিনি, মরিচ, শুকনো হরীতকী প্রভৃতি।

সাতগাঁওয়ে ১৪৪৫ হতে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের সাতটি  শিলালিপি পাওয়া গেছে। এগুলিতে দফতর হিসেবে সাজলা মনখাবাদের উল্লেখ আছে। সাতগাঁও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলের প্রশাসকের উপাধি ছিল সেনাপতি ও উজির। তিনি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরীতে (১৫৯৫-৯৬) সাতগাঁওকে বাংলার উনিশটি সরকারের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করেন। সাতগাঁও সরকারে ৫৩টি মহল (রাজস্ব ইউনিট) ছিল এবং এর আয় ছিল ৪,১৬,১১৮/- টাকা। সাতগাঁও বন্দরের বার্ষিক রাজস্ব ছিল ৩০,০০০/- টাকা। মুগলদের বাংলা বিজয়ের পূর্বেই সাতগাঁও এতদঞ্চলের সদর দফতর হিসেবে পরিগণিত হওয়ার মতো অবস্থায় উন্নীত হয়েছিল।

সাতগাঁও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিল। শিলালিপি (১২৯৮ এবং ১৩১৩ খ্রি) থেকে জানা যায় যে, সাতগাঁওয়ের শাসক জাফর খান সাতগাঁওয়ে আবাসিক মাদ্রাসাসহ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের জন্য আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল। সমকালীন  বাংলা সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, সাতগাঁও  সংস্কৃত শিক্ষারও কেন্দ্র ছিল। বিপ্রদাসের মতে, পনেরো শতকে সাতগাঁওয়ে অনেক সন্ন্যাসী ও আশ্রম ছিল এবং শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ সেখানে বসবাস করতেন। বিপ্রদাস পিপিলাই ১৪৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম) নগরের বর্ণনা দেন। সেখানে সারিবদ্ধ সুসজ্জিত ঘর-বাড়ি ছিল যেখানে হিন্দুরা সঙ্গীতের মূর্ছনায় দেব-দেবীর উপাসনা করত। সেখানে মুগল ও পাঠানসহ বহু শ্রেণির মুসলমানও বসবাস করত। কিন্তু বিপ্রদাসের বর্ণনায় বন্দরের নাম ছিল না। ষোল শতকের প্রথমদিকে মালাক্কা থেকে আগত  পর্তুগিজ লেখক  তোমে পিরে সাতগাঁওকে উত্তম প্রবেশযোগ্য একটি সুন্দর বন্দর বলে উলে­খ করেন। তিনি দশ হাজার অধিবাসীর কথা উল্লেখ করেছেন। দুজন বাঙালি কবি বৃন্দাবন দাস এবং জয়ানন্দও সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের লেখায় দেখা যায় যে, সাতগাঁওয়ে বহু ধনী বণিক বসবাস করতেন। তাঁদের কারও কারও ভবনে প্রাচীর বেষ্টনী ও সুউচ্চ প্রবেশদ্বার ছিল এবং জানালাগুলি ছিল গ্লাস দ্বারা সজ্জিত।  শ্রী চৈতন্যএর সমসাময়িক বাসুদেব ঘোষ সপ্তগ্রামে বিভিন্ন পেশাজীবী লোকের কথা উল্লেখ করেছেন। বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল ‘সুবর্ণ বণিক’ (স্বর্ণ ব্যবসায়ী), ‘গন্ধ বণিক’ (সুগন্ধী ব্যবসায়ী) এবং ‘কংস বণিক’ (ধাতু ব্যবসায়ী)।

সুবর্ণ বণিকের ‘কুলজি’ গ্রন্থে (এ গ্রন্থের সপ্রমাণতা সন্দেহজনক) সপ্তগ্রামের করজন সমাজ সম্পর্কে বর্ণনা আছে। কথিত আছে যে, সুলতান আলাউদ্দীন  হোসেন শাহ এ সমাজের বণিকদেরকে নির্যাতন করেছেন। তোমে পিরের বক্তব্যেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। কিছুকাল পরে, সম্ভবত বাংলায় পর্তুগিজদের আগমনের পর, তাদের সাথে সম্পৃক্ততার প্রশ্ন নিয়ে করজন সমাজ বিভক্ত হয়ে যায়। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান  গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের সাতগাঁও এবং চট্টগ্রামে  কারখানা স্থাপন করার অনুমতি প্রদান করেন।

১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পর্তুগিজরা এখানে  বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। শেরশাহ এবং  হুমায়ুনএর আক্রমণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্যেও ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে সীজার  ফ্রেডারিক সাতগাঁও বন্দরে বত্রিশ হতে পঁয়ত্রিশটি জাহাজ দেখেন। তবে সে সময়ে পর্তুগিজদের বড় জাহাজগুলি হতে মালামাল বেতরে নামিয়ে সেখান থেকে ছোট ছোট নৌকায় করে সাতগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এ অবস্থা কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফরাসি পর্যটক ভিনসেন্ট লিব্ল্যাঙ্ক সাতগাঁও বাজারে দ্রব্যমূল্যের অনুচ্চ হার উল্লেখ করেন। তিনি মন্দিরে বাদ্যবাজিয়ে লোকদেরকে উপাসনা করতে দেখেন। এমনকি, ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে রালফ  ফিচ সাতগাঁওকে একটি সমৃদ্ধিশালী নগর হিসেবে দেখতে পান। এ সময়ের মধ্যে পর্তুগিজরা হুগলি বন্দর প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। কিন্তু সাতগাঁও তখনও বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে পাটনার ইংরেজ প্রতিনিধিরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হতে মালামালসহ পর্তুগিজদের জাহাজ সাতগাঁওয়ে আসার কথা জানায়। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মুগলদের হুগলি বিজয়ের পর শুল্ক অফিস সাতগাঁও থেকে হুগলিতে স্থানান্তরিত হয়। এতে সাতগাঁও বন্দরের পতনের কথা বোঝা যায়। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর উক্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, সপ্তগ্রামের বাঙালি বণিকরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে যেতেন না।

রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ত্রিশ বিঘা হতে বাঁশবারিয়ার মধ্যবর্তী নগরটিকে পেশার ভিত্তিতে কয়েকটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করেন। ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় যে, সরস্বতী নদীর দক্ষিণ তীর অভিজাতবর্গের দখলে ছিল।  ফরাসি পর্যটক বাজার থেকে স্বল্প দূরে অবস্থিত জনৈক অভিজাতব্যক্তির এরকম একটি বাসভবনে অবস্থান করেছিলেন। দেখা যায়, বৈষ্ণবগণ তাদের আশ্রমগুলি নদীর দক্ষিণ তীরের পশ্চিম দিকে স্থাপন করেন। মনে হয়, পরবর্তী অভিবাসিগণ নদীর উত্তর তীর দখল করতে শুরু করেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে একটি সেতু নির্মাণ করেন। পর্তুগিজদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, নগরটি নদীর দক্ষিণ তীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার পর হঠাৎ নদীর সমান্তরালে দক্ষিণ দিকে মোড় নেয় এবং পরে আকস্মিকভাবে পূর্বদিকে ভাগীরথীর দিকে দিক পরিবর্তন করে। ফরাসি পর্যটকের বর্ণনানুযায়ী মনে হয় যে, নগরটি ভাগীরথী নদী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এভাবে নগরটি অষ্টকোণাকৃতি রূপ লাভ করে। ফলে নগরের উন্নয়নে তিনটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। প্রথম ধারায় নগরটি পশ্চিম দিকে নদীর সমান্তরালে অগ্রসর হয়। দ্বিতীয় ধারায়, যা সম্ভবত অনতিবিলম্বেই শুরু হয়েছিল, নদী সমান্তরালে দক্ষিণ দিকে বিকাশ লাভ করে এবং তৃতীয়ত, নগরটি পূর্বদিকে অগ্রসর হয়, যখন ভাগীরথীর দিকে প্রবাহিত হওয়ার জন্য নগরটি নদী থেকে দূরে সরে যায়। এ থেকে সরস্বতী নদীর, বিশেষ করে পলিজনিত কারণে এর নিম্নাংশের ক্রমশ ভরাট হওয়া এবং ভাগীরথী নদীতে যানবাহনের অত্যধিক চলাচলের কথা অনুমান করা যায়।

ষোল শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নগরটি ক্রমাগতভাবে সঙ্কটের সম্মুখীন হতে থাকে।  গৌড় হতে রাজধানী প্রথমে  তান্ডা এবং পরে নদীর অপর পাড়ে রাজমহলে স্থানান্তরিত করার পরপরই মুগল-আফগান সংঘর্ষ সাতগাঁও বন্দরের পশ্চাৎভূমির বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয়। ওই সময়ে আরাকানিদের সহযোগিতায় পর্তুগিজ জলদস্যুরা ভাগীরথী নদীর মোহনা নিয়ন্ত্রণ করছিল। ফলে নগর ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ইতোমধ্যে সরস্বতী নদীর অনাব্যের কথা প্রচারিত হয়েছিল। ফলে পর্তুগিজরা ভাগীরথীর তীরে হুগলিকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের পর সাতগাঁও বন্দর প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলিতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সপ্তগ্রাম কাগজ ও অন্যান্য হস্তশিল্পের উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত টিকে ছিল। ডাচ পর্যটক স্ট্যাভারনিয়াস ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে এ নগরের কথা উল্লেখ করেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে ওলন্দাজ কর্মকর্তাগণ নিকটবর্তী  চুঁচুড়া শহর থেকে সাতগাঁওয়ে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে আসলে নগরটিকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পান। নগরটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর প্রায় স্বাধীন জমিদারদের সহায়তায় এর কিছু এলাকা, যেমন বাঁশবারিয়ার উত্থান হতে থাকে।

ঐতিহাসিকগণ সপ্তগ্রামের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার জন্য পলিজনিত কারণে সরস্বতী নদীর ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু এটা প্রতীয়মান হয় যে, নগরটির বিলুপ্তির পেছনে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহ ও হুমায়ুনের আক্রমণ এবং মুগল-আফগানদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই, যা ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল এবং বাণিজ্যিক সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, অধিকতর যুক্তিসংগত কারণ। পলি জমে সরস্বতী নদীর অনাব্য হয়ে পড়া ছিল দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া চলছিল কয়েক শতক ধরে, যা শুরু হয়েছিল পনেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, যখন নগরটি উন্নতির শিখরে ছিল। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অরাজকতার কারণে অধিকতর দ্রুতগতিতে এর পতন ঘটেছিল।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তগ্রামের উত্থান হয় নি। নগরের সঙ্কীর্ণতামুক্ত উদার প্রকৃতি, এমনকি সংকটময় পরিস্থিতিতেও, প্রমাণ করে যে, নগরটি ছিল বর্ণ, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঊর্ধ্বে। এর আবির্ভাব ঘটেছিল তৎকালীন বাণিজ্যিক তৎপরতার সংযোগের ফলে এবং এর বিলুপ্তির জন্য জটিল রাজনৈতিক অবস্থাই বিশেষভাবে কাজ করেছিল। রাজনৈতিক প্রয়োজনে একই সময়ে নিকটবর্তী ভাগীরথী নদীর প্রধান প্রবাহে হুগলি বন্দর গড়ে ওঠে। বাংলায় সালতানাতের পতনের সাথে সাথে সাতগাঁও ধীরে ধীরে বন্দরের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। [অনিরুদ্ধ রায় এবং মোঃ আখতারুজ্জামান]

গ্রন্থপঞ্জি  DG Crawford, ‘Satgaon or Triveni’, Journal of the Asiatic Society of Bengal, III, 1909; RD Banerji, ‘Saptagram or Satgaon’, Journal of the Asiatic Society of Bengal, V, 7, 1909; Aniruddha Ray, ‘Morphology of Medieval Saptagram or Satgaon’, Journal of Bengal Art, 4, Dhaka, 1999; Manaswita Sanyal, ‘Saptagram, c 1300-1632’, Aitihasik, (Bangla), 4, Calcutta, 1977.