নীল
নীল (Indigo) বিভিন্ন গাছগাছালি, বিশেষত Indigofera গণের কয়েকটি প্রজাতি থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক রং। ভারত, মধ্য আমেরিকা ও চীন দেশে এগুলি জন্মে। ব্রিটেনে ফলানো woad (Isatis tinctoria) গাছের রসেও নীল রং থাকে। পুরাকালে মিশর, গ্রীস ও রোমের লোকেরাও নীলের কথা জানত। মিশরের ১৮তম রাজবংশের মমিগুলি নীল রঙা কাগজে মোড়া থাকত।
বাংলার ভূখন্ডে Indigofera-এর ১৫ প্রজাতি জন্মে, তন্মধ্যে I. tinctoria নীল রঙের চাষ করা হতো ভারতে। নীল পানিতে দ্রাব্য গ্লুকোসাইড নামের এক ধরনের রাসায়নিক হিসেবে থাকে। যশোর, কৃষ্ণনগর ও বিহার রাজ্যের চাম্পারন জেলায় নীল ভাল ফলত। গাছটি ১.২-১.৮ মিটার লম্বা ও ঝোপবিশিষ্ট। মঞ্জরি পাতার চেয়ে খাটো, পাতা যতটা লম্বা প্রায় ততটাই চওড়া। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফুল ফোটে। ফুল ছোট, ফলগুলি বাঁকা।
নীল রং তৈরির পদ্ধতি নিম্নরূপ: গাছ কেটে বড় কড়াইতে পানির মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখলে সবুজ রঙের নির্যাস বের হয়। তারপর এই নির্যাস নতুন পাত্রে ঢেলে নীল যাতে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে সেজন্য অনেকক্ষণ কাঠি দিয়ে নাড়তে হয়। অদ্রাব্য নীলের তলানি নিচে জমতে থাকে এবং শেষে তা পৃথক করে শুকিয়ে টুকরা টুকরা করে কাটা হয়। ইন্ডিগোটিন ছাড়াও তাতে থাকে নানা পদার্থ, তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিরুবাইন বা ইন্ডিগো রেড, ইন্ডিগো গ্রীন ও ইন্ডিগো ব্রাউন।
নীল গাছের কিছুটা ভেষজগুণও আছে। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদে (চরক সংহিতা) নীলের প্রশস্তি আছে। গাছটির কিছু পোশাকি নামও আছে: নিলিনী, রঞ্জনী, গ্রামিনিয়া, কালোকেশী, নীলপুষ্প ও মধুপত্রিকা। আধুনিক কবিরাজি চিকিৎসায় শিকড় ও পাতা নানা অসুখে ব্যবহূত হয়। পাতার রস জলাতঙ্ক ও মৃগীরোগে উপকারী। নীল গাছ জমির আচ্ছাদন আর সবুজ সার হিসেবেও উত্তম।
বাংলাদেশে নীলচাষ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। ব্রিটিশ নীলকরেরা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করেছে নীলচাষে। নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ ছিল ব্যাপক। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ নীলচাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না থাকায় কৃষক নীলচাষের চেয়ে ধান ও পাট চাষে ঝুঁকে পড়ে। অত্যাচার উৎপীড়নের মাধ্যমে নীলচাষে বাধ্য করলে ১৮৫৯-৬০ সালে নীলচাষীরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ফলে বাংলায় নীলচাষ ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। [নওয়াজেশ আহমদ]
আরও দেখুন নীল প্রতিরোধ আন্দোলন।