দারিদ্র্য

দারিদ্র্য  এমন অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারায়। সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসন, জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং বন্যা, জলোচ্ছ্বাসখরা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্য সৃষ্টি করে।

১৯৮০-র দশকে দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য বাংলাদেশে একটি সহজ ও একমাত্রিক সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। এ সংজ্ঞানুযায়ী দারিদ্র্য হচ্ছে খাদ্য গ্রহণের এমন একটি স্তর যা থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কিলো-ক্যালরি পাওয়া যায় না। দারিদ্র্যপীড়িত জনসংখ্যার প্রাক্কলন কয়েকটি পদ্ধতিতে প্রস্ত্তত করা হয়। প্রথমত, ভোগ অভ্যাস এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করে একটি খাদ্য তালিকা চিহ্নিত করা হয় যা নির্দিষ্ট পরিমাণ পুষ্টি তথা প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতিদিন ২,১১২ কিলো ক্যালরি এবং ৫৮ গ্রাম প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে। পরবর্তীকালে উল্লিখিত খাদ্যতালিকার ব্যয় অপেক্ষা ১.২৫ গুণ কম মাথাপিছু আয়সম্পন্ন পরিবারগুলিকে মধ্যম শ্রেণির দরিদ্র এবং নির্ধারিত প্রারম্ভিক আয়ের চেয়ে ৮৫% কম মাথাপিছু আয়সম্পন্ন পরিবারগুলিকে চরম দরিদ্র পরিবার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সাধারণত পল্লী অঞ্চলের দারিদ্রে্যর আপতন এবং স্তর পরিমাপের জন্য উপরিউক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। পৌর এলাকার দারিদ্র্য পরিমাপের ক্ষেত্রে ক্যালরি গ্রহণের প্রারম্ভিক মাত্রা ছিল পল্লী এলাকার জন্য নির্ধারিত মাত্রা অপেক্ষা কিছুটা উচ্চতর। অবশ্য, বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং নীতিমালার কারণে জনপ্রতি কিলো ক্যালরির প্রারম্ভিক মাত্রা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দারিদ্র্যাবস্থা প্রাক্কলনের জন্য ব্যবহূত তথ্য ও উপাত্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা-ব্যয় নির্ধারণ জরিপ থেকে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ৪৭.১% লোক দারিদ্র্যসীমা এবং ২৪.৬% লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অপরদিকে, শহরাঞ্চলের ৪৯.৭% দারিদ্র্যসীমা এবং ২৭.৩% চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্রে্যর আপতন ও স্তর পরিমাপের জন্য বিবিএস ১৯৯৫ সালে মৌলিক চাহিদার খরচ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। এ পদ্ধতিতে দরিদ্রকে দরিদ্র এবং অনপেক্ষ দরিদ্র-এ দুভাগে চিহ্নিত করা হয় এবং দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫.৬% অনপেক্ষ দরিদ্র ও ৫৩.১% দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। দারিদ্রে্যর বহুমাত্রিক পরিমাপের ক্ষেত্রে অনেকগুলি গুণগত বিষয় বা চলক তথা পুষ্টি, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, নিরাপত্তা, বাসস্থান সুবিধা, পানীয় জল, শিক্ষা, আয়ু, সম্পদের অংশীদারিত্ব ও ভোগের অধিকার এবং সমস্যাবলির সাথে মানিয়ে চলা বা সমস্যা হ্রাস করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি ও ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়। এসব চলক মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) সংযুক্তি করে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয় ১৩২তম। আর ২০০৭-০৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) অনুযায়ী মানুষের জীবন ধারণের গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে ১৪০তম। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০০৯ এর  রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ৪০% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে।

বাংলাদেশের চলমান দারিদ্র্যাবস্থার জন্য বহুবিধ বিষয়, যথা অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, মাথাপিছু সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহার, অশিক্ষা, মাথাপিছু কম পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি ও বনভূমি, রুগ্নস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা, পরিবেশের অবক্ষয়, বন ধ্বংস, কৃষির ওপর অতি নির্ভরশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নারী নির্যাতন ও নারীদের বঞ্চিতকরণ এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা দায়ী।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক নীতি অনুসরণ করে। পাকিস্তান সরকার সারাদেশের সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যক্তিখাতকে সবিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানকে ন্যূনতম অর্থ বরাদ্দ-পূর্বক সরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়ন কার্যক্রম চালানো হয়। আর পূর্ব পাকিস্তানকে করে রাখা হয় একান্তই কৃষিনির্ভর। ফলে ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের একজন নাগরিকের গড় আয় দাঁড়ায় একজন পশ্চিম পাকিস্তানির আয়ের ৭৪%। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানে দারিদ্র্য পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে এবং তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকেও গ্রাস করে। ১৯৮৫ সালে একজন বাংলাদেশির মাথাপিছু গড় আয় ছিল একজন পাকিস্তানির মাথাপিছু আয়ের মাত্র ৪০%, একজন থাই নাগরিকের ১৯% এবং একজন দক্ষিণ কোরীয় নাগরিকের মাত্র ৭%।

বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য পরিস্থিতির অপর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। বিগত ৫০, ১০০ বা ১৫০ বৎসর পূর্বে আয় বণ্টনের নিম্নসীমায় যত সংখ্যক লোক ছিল, বর্তমানে তার সংখ্যা অনেক কম। ১৮৩০-এর দশকে কৃষি মজুরির দৈনিক হার ছিল ৬ কেজি চাউল। ১৮৮০-র দশকে ছিল তা ৫ কেজি অপেক্ষা সামান্য বেশি। ১৯৩০-র দশকে একজন কৃষিশ্রমিক তার একদিনের মজুরি দ্বারা সাড়ে পাঁচ কেজি মোটা চাল কিনতে পারত, বর্তমানে একুশ শতকের শুরুতেও তা একই পর্যায়ে রয়ে গেছে। কিন্তু একজন কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের জন্য একই অর্থনীতিতে শিল্প ও কৃষির বাণিজ্য শর্তে ভারসাম্য বহুলাংশে অবনমিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের একজন ব্যক্তি আরও খারাপ অবস্থায় জীবনযাপন করছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের জনগণের ভোগান্তির আরেকটি কারণ। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে বাংলাদেশের মোট সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যায় এবং শুরুতেই দেশের অর্থনীতি মারাত্মক জটিলতার সম্মুখীন হয়। নিজস্ব সীমিত সম্পদ ও প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের দ্বারা বাংলাদেশকে ভারত থেকে ফিরে আসা ১০ মিলিয়ন শরণার্থী এবং দেশের ভিতরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞে সর্বস্বান্ত ২০ মিলিয়ন লোককে পুনর্বাসিত করতে হয়েছে। তদুপরি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি, সার ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধি এবং লেনদেন ভারসাম্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুতর আঘাত হানে। ১৯৭৪ সালে শস্যহানি এবং বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তিতে ভাটা ও শিথিলতা দেশের অর্থনীতিকে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ প্রায় দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এর ফলে নিঃস্ব লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯৭৫ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৩% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে থাকে। পরবর্তীকালে এ অবস্থার সামান্য উন্নতি হয় এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ১৯৮১-৮২ সালে ৭৪%-এ নেমে আসে। এরপর দারিদ্র্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে থাকে। কিছু সময় পর আবার দেশের উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে এবং ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের প্রলঙ্ককরী বন্যার ফলে বাংলাদেশ পুনরায় আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বন্যা-পরবর্তীকালে ১৯৮৮-৮৯ সালে দেশে খাদ্যশস্যের বাম্পার ফলন হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এর পরবর্তী ২-৩ বৎসর দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির কোনো স্থিতিশীল উন্নয়ন ঘটে নি।

ভূমির বৈষম্যমূলক বিতরণ এবং অপূর্ণ ব্যবহার, ভূমি ও অভূমি-বহির্ভূত সম্পদের ওপর দরিদ্রদের দখলদারিত্বের অভাব, কারিগরি ও প্রকৌশলগত পশ্চাদগতি, বৈষম্যমূলক আয়বণ্টন এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১৯৯০-এর দশকে দেশের মানুষ অমানবিক দারিদ্রে্যর শিকার হয়। মাত্র ৪২৩ ইউএস ডলার মাথাপিছু আয় (২০০৫) নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র, ঘনবসতিপূর্ণ এবং পৌর ও পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক দারিদ্রে্যর বিবেচনায় স্বল্পোন্নত দেশের একটি। ১৯৯০-২০০৪ সময়কালে মোট জনসংখ্যার ৪১.৩% প্রতিদিন ১ ডলারের নীচে আয় করে এবং ৮৪% প্রতিদিন ২ ডলারের নীচে আয় করে। ২০০৪ সালের পর পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি বরং বৈষম্য ও বেকারত্ব আরো প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃহদাংশ পল্লী অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে আয়বৈষম্য ও বেকারত্ব প্রতিনিয়ত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৬৩/৬৪ সালের স্থিরমূল্যে ১৯৭৩/৭৪ সালে বাংলাদেশের পল্লী ও পৌর এলাকার আয় বণ্টনের গিনি সূচক ছিল যথাক্রমে ০.৩৪০ ও ০.৩৭৫। ১৯৮৫/৮৬ সালে ০.৩৬২ ও ০.৩৬৫ এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে তা ছিল যথাক্রমে ০.৩৮৪ ও ০.৪৪৪। ২০০০ সালে বাংলাদেশের দরিদ্র ১০% জনগণের  জাতীয় আয় বা ভোগের ক্ষেত্রে অংশ ছিল মাত্র ৩.৭%, এর মধ্যে অতি দরিদ্র ২০% এর ছিল ৮.৬% এবং ২০% ধনবানদের ছিল ৪২.৭% এবং ১০% ধনবানদের অংশ ছিল ২৭.৯%।

বাংলাদেশে সরকার দীর্ঘকাল ধরেই পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন-সংক্রান্ত প্রচেষ্টাগুলি বহুমুখী, এদের মধ্যে পল্লী সমবায় সমিতি, ঋণদান ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, মৎস্য ও গবাদিপশু উন্নয়ন, পল্লী এলাকায় শিল্প স্থাপন, এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পল্লী জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করার লক্ষ্যে এ যাবৎ গৃহীত দেশের সবকয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মাত্রাভেদে পল্লী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান জোরদার করা হয়েছে। পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড’ সরকারের একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী এজেন্সি। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য পল্লী উন্নয়ন বোর্ড ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ সকল কর্মসূচির মধ্যে গ্রামভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন এবং সেগুলিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সম্প্রসারিত সেচ স্কিম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্যতম। সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত অন্যান্য দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের মধ্যে গুচ্ছগ্রাম (১৯৮৮-৯৩), দুস্থ উন্নয়ন প্রকল্প (১৯৯০-৯২), উপজেলা সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্প,  রেশম উৎপাদন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ এবং স্ব-কর্মসংস্থানের উদ্যোগে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান প্রণিধানযোগ্য।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও  কুটির শিল্প সংস্থা, সমাজকল্যাণ বিভাগ, মহিলা অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, কৃষি অধিদপ্তর, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিভাগ ইত্যাদি সরকারি সংস্থা দারিদ্র্য বিমোচন কাজে সম্পৃক্ত এবং এদের স্ব স্ব বিভাগীয় দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অপরদিকে, হতদরিদ্র নারীসমাজ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, বেকার যুবক-যুবতীদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশে বহুসংখ্যক স্থানীয় ও বদেশি এনজিও নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত এনজিওগুলির মধ্যে 

গ্রামীণ ব্যাংকব্র্যাক, আশা, প্রশিকা ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রমের জন্য দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সম্পৃক্ত সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির মধ্যে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি, ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য ঋণদান প্রকল্প বহুল পরিচিত। এছাড়া বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও স্থানীয় উৎসের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পসমূহের মধ্যে রুরাল ফিন্যান্স এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট, বাংলাদেশ-সুইস এগ্রিকালচারাল প্রজেক্ট এবং নরওয়েজীয় উন্নয়ন সংস্থা নোরাড-এর ক্ষুদ্র ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা-উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য উল্লিখিত কর্মসূচিসমূহ বাদে আরও কিছু প্রচলিত কর্মসূচি কার্যকর রয়েছে। তবে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এ সকল বিশেষ উদ্দেশ্যভিত্তিক কর্মসূচির অবদান কতখানি তার কোনো নির্ভরযোগ্য খতিয়ান পাওয়া যায় না। এরূপ কর্মসূচির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে  কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা), শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য (শিবিখা), বয়স্ক ভাতা, দরিদ্র ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান,  কীটনাশক ও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ, ভিজিডি ইত্যাদি। বর্ধিত হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার অকৃষি খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ সকল একক ও সমন্বিত উদ্যোগের ফলে দরিদ্রদের অধিকার কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পেয়েছে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে তাদের ক্ষমতায়নও ঘটছে। তবে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যাবস্থার উন্নয়নে এ সকল প্রথাগত কর্মসূচির অবদান তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে ১৯৯৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে দরিদ্রের হার ছিল ৪৭% যা ১৯৯৯ ও ২০১০ সালে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ৪৪.৭% ও ৪২%। বিআইডিএস এর ড. বিণায়েক সেন বলেন, ২০০৫-২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচন হয় ৪৫.৭% থেকে ৩২.১% অর্থাৎ মাত্র ১৩.৬% কিন্তু জাতীয়ভাবে বলা হয় ৮.৫%। সম্প্রতি Household Expenditures Survey (HEI) জরিপে বলা হয়, দারিদ্র বিমোচন জাতীয় পর্যায়ে বছরে গড়ে হ্রাস পায় ৪.২৫% যেখানে রাজশাহী ও খুলনায় হ্রাসের হার ছিল যথাক্রমে ৮.৬৮% ও ৮.৪% কিন্তু শুধুমাত্র ঢাকায় ছিল ০.৯৮%। তাই বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। দারিদ্রে্যর মোকাবেলা করার জন্য দরকার যথাযথ পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও একাগ্রতা এবং সর্বোপরি দক্ষ ও সমন্বিত বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ ও কর্মপ্রেরণা।  [এস.এম মাহফুজুর রহমান]