কাজের বিনিময়ে খাদ্য

কাজের বিনিময়ে খাদ্য  ১৯৭৪ সালে দেশব্যাপী চরম খাদ্যাভাব দেখা দিলে বিশেষ করে খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য এবং গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্বের কারণে বৃহত্তর রংপুর জেলার মানুষ অনাহারের সম্মুখীন হলে সরকার ‘ফুড ফর ওয়ার্ক’ বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করে। এ কর্মসূচির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল পল্লী অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং একইসাথে অভাবগ্রস্ত এলাকাগুলিতে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। এ কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামীণ শ্রমিকদের মজুরি নগদ অর্থে না দিয়ে খাদ্যশস্যের মাধ্যমে পরিশোধ করা। ডব্লিউ.এফ পি (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএল-৪৮০-এর আওতায় প্রাপ্ত খাদ্যশস্য দিয়ে এ কর্মসূচির সূচনা করা হয়। এ কর্মসূচি সফল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একে চালু রাখার জন্য পরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড এবং ইইসিভুক্ত দেশসমূহ ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী সাহায্য ও অনুদান প্রদানে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচি পল্লীর অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ উন্নয়নে এক বিরাট কর্মসূচির রূপ ধারণ করে।

অতি দরিদ্র, ভূমিহীন ও বেকার মানুষদের খাদ্য নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকাসহ (কাবিটা) নানা ধরনের কর্মসূচি চালু রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের জেলাগুলিতে আমন ধান কাটার পূর্বে বাংলা কার্তিৃক মাসে (মাঝ সেপ্টেম্বর থেকে মাঝ অক্টোবর) এক ধরনের বেকারত্ব ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় যা মঙ্গা নামে পরিচিত। ২০১০ সালে মানুষের আয় ও ব্যয়ের জরিপ (Household Income and Expenditure Survey, HIES) অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও রেমিটেন্স ধারাবাহিক বৃদ্ধির জন্য দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা জনগোষ্ঠীর হার হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৩১.৫%, যা ২০০৫ সালে ছিল ৪০%।

১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার পল্লী এলাকার সার্বিক উন্নয়ন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশী দাতাদের সহযোগিতায় ‘ভিলেজ এইড’ (ভি-এইড) নামে যে কর্মসূচি শুরু করেছিলেন এ কর্মসূচিকে তারই রূপান্তরিত ও আধুনিক সংস্করণ বলে অভিহিত করা যায়। ভি-এইড কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন খাতে পল্লী এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান করা। সরকার প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে মাঠকর্মী নিয়োগ করেন, যার দায়িত্ব ছিল এ প্রকল্পের ব্যাপারে পল্লী এলাকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। প্রকল্পটির সাথে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলিকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত না করার কারণে এ কর্মসূচি থেকে ঈপ্সিত ফলাফল পাওয়া যায় নি। অবশেষে ১৯৬২ সালে সরকার এ কর্মসূচি বাতিল করে এবং ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’ নামে একটি নতুন কর্মসূচি হাতে নেয় যার লক্ষ্য ছিল রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য খাল খনন ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধন। এ নতুন প্রকল্পের বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারগুলিকে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কারিগরি সহায়তা ও জনবল প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গম বাজারদর থেকে কমমূল্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করে বিক্রয়লব্ধ অর্থে গ্রামীণ অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রামের’ আওতায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তার মধ্যে ছিল মাটির রাস্তা তৈরি, পুরানো রাস্তার মেরামত, খাল খনন এবং বাঁধ নির্মাণ।

১৯৭৪ সালে খাদ্যঘাটতি এলাকাগুলিতে খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি শুরু করা পর্যন্ত ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’ চালু থাকে। এ কর্মসূচি জনগণকে স্বল্পমেয়াদি সাহায্য প্রদান, গ্রামীণ খাদ্য-নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৭৮-৭৯ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় ২৩ লক্ষ টন গমের বিনিময়ে ৬ কোটি কর্মদিবসের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এ কর্মসূচির আওতায় ১৯৮২-৮৩ সালে ৯ কোটি ৮০ লক্ষ কর্মদিবসের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি আজকে যে অবস্থায় রয়েছে তাকে সাবেক ভি-এইড এবং ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রামেরই’ রূপান্তরিত অবস্থা বলা যায়। অবশ্য বাস্তবায়ন-পদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণের দিক থেকে এতে কিছুটা পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধের ক্ষেত্রে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত খাদ্যশস্য বাজারে বিক্রয় করে ঐ বিক্রয়লব্ধ অর্থে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা হতো। বর্তমানে খাদ্যশস্যের মাধ্যমে মজুরি পরিশোধ করা হয়, যদিও সীমিত ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে মজুরি পরিশোধের ব্যবস্থাও রয়েছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এখন সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে যার লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক উন্নয়ন। এ কর্মসূচির জন্য এখন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর নিকট থেকে প্রাপ্ত সাহায্য এবং বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দের সমন্বয়ে একটি সাধারণ তহবিল বা ফান্ড গঠন করা হয়। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ প্রদান করা হয়ে থাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এবং প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত দপ্তর বা সংস্থা এবং কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও-র মাধ্যমে। তবে প্রধান বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত এলজিইডি বা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বন অধিদপ্তর এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কয়েকটি সংস্থা।

কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় প্রাপ্ত সম্পদের একটা অংশ ব্যয় হয় ‘ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা ভিজিএফ’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এ কর্মসূচির আওতায় ১৯৮০-এর দশকে পল্লী এলাকায় দরিদ্র ও দুস্থ মহিলাদের মধ্যে ভিজিএফ কার্ড বিতরণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় দুস্থ বা ভূমিহীন বা বিধবা যাদের অতিসামান্য আয় বা একেবারেই আয়ের সংস্থান নেই বা অত্যন্ত দরিদ্র এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাকে ভিজিএফ কার্ড প্রদান এবং প্রতি মাসে ৩১.২৫ কেজি খাদ্যশস্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। পরে এ কর্মসূচির নামকরণ করা হয় ‘ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট ভিজিডি’। ইতঃপূর্বে এ কর্মসূচির আওতায় একজন মহিলাকে দু বছরের জন্য কার্ড প্রদান করা হতো, এখন কার্ডের মেয়াদ ১৮ মাস। এখন এ কর্মসূচির আওতায় সুযোগ পেতে হলে একজন মহিলাকে কিছুটা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং প্রতি মাসে নিজস্ব ব্যাংক একাউন্টে ২৫ টাকা করে জমা করতে হয়, যাতে ১৮ মাস পরে তারা কোনো উপার্জনমূলক কর্মকান্ড শুরু করতে পারে। ১৮ মাস পরে আবার এর আওতায় নতুন মহিলাদের কার্ড প্রদান করা হয়। বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দুর্যোগের সময় এ তহবিল থেকেই সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে সকল প্রকার মাটি কাটার কাজ করা সহজ বলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অধিকাংশ প্রকল্প এ মৌসুমে বাস্তবায়ন করা হয়। তবে বর্ষা মৌসুমে ‘টেস্ট রিলিফ’ নামে উক্ত কর্মসূচি চালু থাকে। টেস্ট রিলিফের আওতায় যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে বৃক্ষরোপণ এবং স্কুলকলেজ, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদির সংস্কার কাজ ও বাঁশের সেতু নির্মাণ।

যদিও ঐ ধরনের কর্মসূচি চালু রয়েছে কিন্তু বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসেব অনুযায়ী অতি দরিদ্র জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১৭.৬%। ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনও অধিক হারে খাদ্য নিরাপত্তাহীন জনগোষ্ঠী রয়েছে। ২০০৫ সালের HIES জরিপে বলা হয় বাংলাদেশে প্রায় ৬০% মানুষ দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার নূন্যতম পরিমাণ পূরণ করতে অক্ষম।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ডব্লিউএফপি’র সহায়তায় খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় দরিদ্র, অতি দরিদ্র এবং নিম্ম-আয়ের মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করে। চর এলাকায় নারী ও শিশুদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর খাদ্য সহায়তা ও খাদ্যশস্য বিশেষত চাল ও গম আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সারণি ১  খাদ্যশস্যের বার্ষিক আমদানি (মিলিয়ন টন)।

বছর খাদ্য সাহায্য মোট আমদানি
২০০০-০১ ৪৭৯ ১৫৪২
২০০১-০২ ৫০১ ১৭৯০
২০০২-০৩ ২৪২ ৩২০৮
২০০৩-০৪ ২৭৭ ২৭৮৬
২০০৪-০৫ ২৮৯ ৩৩৭২
২০০৫-০৬ ১৯৪ ২৫৬২
২০০৬-০৭ ৯১ ২৪২১
২০০৭-০৮ ২৫৮ ৩৪৬৭
২০০৮-০৯ ১২৯ ৩০১৩
২০০৯-১০ ৬০ ৩৪৪৯
২০১০-১১ ১৬৩ ৫৩১৩

উৎস  খাদ্য বিভাগ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, জানুয়ারি ২০১২।

২০১১-১২ সালের অর্থবছরের শুরু দিকে (১ জুলাই ২০১১ - ১২ জানুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত) সরকার প্রায় ১৫৭৯ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি করে এবং ৮২৪৫৫১ টন খাদ্য বিতারণ করে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে চালুকৃত কাজের বিনিময়ে শিক্ষা (কাবিশি) কর্মসূচিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালের প্রায় ৩,৩৩৩টি শিক্ষা কেন্দ্রের ৭৩,৩২৬ জন শিশুশ্রমিককে (বয়স ১০-১৪ বছর) খাদ্য প্রদান করে যার ৬০% বালিকা। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত ২৯০ মিলিয়ন মেট্রিকটন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করে। যার মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টেস্ট রিলিফ (টিআর) কর্মসূচির অধীনে যথাক্রমে ৩,৩৭,২৫ ও ৩,৮৯,৮১৩ মেট্রিক টন খাদ্য বিতাড়ন করা হয়। [সৈয়দ সাদিকুর রহমান এবং মাহবুবুল আলম]