তুর্কি, জাতি

তুর্কি, জাতি  তেরো শতকের প্রারম্ভে প্রথম মুসলিম বিজেতা বখতিয়ার খলজীর সঙ্গে বাংলায় তুর্কিদের আগমন ঘটে।  বখতিয়ার খলজী ছিলেন তুর্কি জাতির খলজী গোত্রসম্ভূত। এঁরা সিস্তানের পূর্ব সীমান্তের গড়মসির নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমানে স্থানটির নাম দাশ্ত-ই-মার্গো।যখতিয়ার ও অন্যান্য তুর্কিরা উন্নততর জীবিকার সন্ধানে জন্মভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। গৌড় (লক্ষ্মণাবতী) ও তার পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার পর বখতিয়ার খলজী শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তাঁর অধীনস্থ রাজ্যকে কয়েকটি ইকতায় বিভক্ত করেন এবং তিনজন প্রতিনিধির ওপর এগুলির শাসনভার ন্যস্ত করেন। এঁরা ছিলেন আলী মর্দান খলজী, মুহম্মদ শিরাণ খলজী ও হুসামউদ্দীন ইওজ খলজী। এছাড়া তিনি মুসলিম সমাজ বিকাশেও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসবের মধ্যে ছিল মসজিদ, মাদ্রাসা এবং সুফি সাধকদের জন্য খানকাহ প্রতিষ্ঠা। বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর তাঁর তিন সেনাপতি মুহম্মদ শিরাণ খলজী, আলী মর্দান খলজী ও হুসামউদ্দীন ইওজ খলজীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এঁরা একের পর এক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এ খলজী মালিকদের মধ্যে হুসামউদ্দীন ইওজ খলজী ছিলেন সবচেয়ে সফল শাসক। তিনি ছিলেন শান্ত, সুচতুর, বিচক্ষণ ও তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। ১২১২ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী উপাধি ধারণ করেন। তিনি বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মহাসড়ক নির্মাণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ। কৌশলগত কারণে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ ও একটি নৌবহর গড়ে তোলেন।

বাংলা যখন খলজীদের শাসনাধীনে তখন ইলবারি তুর্কিগণ দিল্লিতে রাজত্ব করছিলেন। তাঁরা লক্ষ্মণাবতীতে খলজী সার্বভৌমত্বকে সুনজরে দেখেন নি। সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ ছিলেন ইলবারি তুর্কি। তিনি লক্ষমণাবতীর স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেন নি। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইওজ খলজীকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতী দিল্লি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন। খলজীরা তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী ষাট বছর লক্ষ্মণাবতী শাসন করেন দিল্লির ইলবারিগণ। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তুর্কি অভিজাতগণ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং সুলতানগণ তাঁদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন। দিল্লি থেকে প্রেরিত বাংলার গভর্নরগণ ছিলেন তুর্কি অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। তাঁরা সকলেই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। কখনও কখনও তাঁরা লক্ষ্মণাবতীর ক্ষমতা দখলের জন্য একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ফলে লক্ষ্মণাবতীর মুসলিম রাজ্যের সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়। দিল্লির সুলতান  গিয়াসউদ্দীন বলবন এর মৃত্যুর (১২৮৭) পর কলহ আরও চরমে পৌঁছে। এ সুযোগে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দীন ফিরুজ শাহের নেতৃত্বে খলজীগণ দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। বলবনের পুত্র বুগরা খান বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবেই দিল্লিতে ইলবারি তুর্কিরা ক্ষমতা হারান এবং খলজীগণ তা দখল করেন। অন্যদিকে ইলবারিগণ বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

১২৯০ থেকে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় বাংলার মুসলিম রাজ্য সাতগাঁও, সোনারগাঁও, ময়মনসিংহ ও সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক এক অভিযান চালিয়ে লক্ষমণাবতী দখল করেন। বাংলায় তুগলক (কারাউনা তুর্কি) শাসন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহাল ছিল। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে  ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ে স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দিল্লি সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে  আলাউদ্দীন আলী শাহ লক্ষ্মণাবতীতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অবশেষে সিজিস্তান থেকে আগত তুর্কি ভাগ্যান্বেষী হাজী ইলিয়াস লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসন দখল করে সুলতান শামসুদ্দীন  ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করেন। তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তুর্কি শাসনের নবযুগের সূচনা হয়। ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলা স্বীয় অধিকারে আনেন এবং লক্ষ্মণাবতী রাজ্যকে  বাঙ্গালাহ রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। বাংলায় ইলিয়াস শাহ ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের রাজত্বকাল ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এর মধ্যবর্তী ২৩ বছর (১৪১২ থেকে ১৪৩৫ খ্রি.) রাজা গণেশ ও তাঁর উত্তরাধিকারীগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইলিয়াস শাহী বংশের সর্বশেষ সুলতান  জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ তাঁর হাবশী ক্রীতদাস কর্তৃক নিহত হলে বাংলায় তুর্কি শাসনের অবসান ঘটে।

হাবশীরা স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ তাদের ক্ষমতাচ্যূত করেন। তিনি ছিলেন সৈয়দ বংশীয়। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহ এর ক্ষমতা দখলের ফলে হোসেন শাহী রাজবংশের পতন ঘটে এবং বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমলের অবসান হয়। আফগানরা বাংলা শাসন করেন ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় মুগল শাসন। মুগলরা ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বপর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময় তুর্কিদের ভাগ্য সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তারা এদেশীয় সমাজে দৃঢ়ভাবে মিশে যায়, কেউ কেউ হয়ত মুগলদের চাকরিতেও যোগ দেয়।  শাহজাহান এর রাজত্বকালে মুহম্মদ কুলী সেলিম নামে একজন বিখ্যাত তুর্কি কবি ছিলেন। পরবর্তীকালের নাজিমদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তুর্কিদের প্রাধান্য পুনরায় শুরু হয় সুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান এর (১৬২৭-১৬৩৯) সময় থেকে। তিনি তাঁর শ্বশুর মুর্শিদকুলী খান-এর মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন একজন আফসার গোত্রীয় তুর্কি। আলীবর্দী খান ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাজী আহমদ উড়িষ্যার নায়েব সুবাহদার সুজাউদ্দীন মুহম্মদ খানের দরবারে বিশিষ্ট পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত।

সুজাউদ্দীন যখন মুর্শিদাবাদের নাজিম পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন আলীবর্দী, হাজী আহমদ ও তাঁর তিন পুত্র গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। হাজী আহমদ ছিলেন নওয়াব এর প্রধান উপদেষ্টাদের একজন। আলীবর্দী তাঁর তিন কন্যার বিবাহ দেন তিন ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে। এঁরা সকলেই ছিলেন হাজী আহমদের পুত্র। সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান মসনদে আসীন হন। সরফরাজ খানকে পরাজিত করে আলীবর্দী খান মসনদ দখল করেন। সুতরাং মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর (১৭২৭) পর তুর্কি বংশোদ্ভূতরা মুগলদের অধীনে বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তুর্কিদের আগমন ও তুর্কিশাসন বাংলার জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। তুর্কি শাসকগণ বাংলায় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ইসলামি সংস্কৃতিকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দান করে। শাসনামলের শুরুতেই তারা মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণে ব্রতী হয়। উলামা ও সুফি সাধকদের ধর্ম প্রচার ও সংস্কার কার্যে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান। তুর্কি শাসকগণ এবং সম্ভবত অপরাপর তুর্কিরাও বাংলায় আসে স্থায়িভাবে বসবাসের জন্য এবং এ দেশকেই তারা নিজেদের আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা কখনও বাংলার সম্পদ ও সঞ্চিত ধনদৌলত স্বদেশে পাচার করে নি কিংবা এদেশ ত্যাগ করার অভিপ্রায়ও তাদের ছিল না। তারা স্থাপত্য ও হস্তলিপিতে আগ্রহী ছিল। তাদের তৈরি কিছু মসজিদ এখনও বিদ্যমান। এগুলি সুদৃশ্য ও সুনির্মিত। স্থাপত্য নির্মাণে তুর্কিরা পোড়া ইট ব্যবহার করত। আবার কখনও কখনও পাথর আমদানি করত। তারা স্থাপত্য শিল্পে নিত্যনতুন রীতি ও কলাকৌশল প্রবর্তন করে। দুর্গ এবং সেতু নির্মাণেও তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। এসব ইমারতের গাত্রে খোদিত লিপিতে তারা সূক্ষ্ম ও সুন্দর হস্তলিপির নমুনা তুলে ধরে। তুর্কিদের মধ্যে কেউ কেউ সড়ক ও সেতু নির্মাণ, বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ ও পরিখা খনন এবং এভাবে পানির প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মতো জনহিতকর কাজ সম্পাদন করে।

তুর্কি শাসকরা ছিলেন উদারপন্থী। তাঁরা প্রশাসনিক পদে অমুসলিমদের নিয়োগ দেন, এমনকি মন্ত্রী কিংবা সেনাবাহিনীর উচ্চপদেও এদের নিয়োগ দান করা হয়। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ এর শাসনামলে রাজা গণেশ মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেন এবং তিনি প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন। তুর্কি সুলতানগণ ফারসি ও বাংলা উভয় ভাষার সাহিত্য ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ বিশেষভাবে পারস্যদেশীয় কবিদের উৎসাহ প্রদান করতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন খ্যাতনামা কবি। মালিক-উস-শুয়ারা (কবিদের রাজা বা সভাকবি) নামে পরিচিত আমীর জয়নুদ্দীন ছিলেন সবচেয়ে নামকরা। ইবরাহিম কাওয়াম ফারুকী ছিলেন একজন অভিধান রচয়িতা। তিনি ফারহাঙ-ই-ইবরাহিম কাওয়াম ফারুকী বা শরফনামা গ্রন্থের রচয়িতা। সুলতানের প্রশংসাসূচক কয়েকটি কবিতাও তিনি রচনা করেন। বারবক শাহ হিন্দু কবিদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচয়িতা কবি মালাধর বসুকে তিনি ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সুলতান বহু অমুসলিমকে রাজকার্যে নিয়োজিত করেন এবং তাদের বিভিন্ন খেতাব প্রদান করেন।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  Sayyid Ghulam Husain Salim, Riaz-us-Salatin, Calcutta, 1898; JN Sarkar (ed), History of Bengal, vol II, Dhaka University, 1948; Minhaj-I-Siraj, Tabaqat-i-Nasiri, Calcutta, 1964; A Subhan, Tarikh-I-Bengalah-I-Mahabat Jangi of Ynsuf Ali, (Eng trans), Calcutta, 1982; A Karim, Social History of the Muslims in Bengal, down to AD. 1538, 2nd edition, Chittagong 1985; A Karim, Banglar Itihas: Sultani Amal (in Bangla), Dhaka, 1999.