বাঙ্গালাহ
বাঙ্গালাহ চৌদ্দ শতক হতে, বিশেষ করে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহএর আমল থেকে রাজ্যের নাম হিসেবে অধিকতর স্পষ্টভাবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। তখন এ রাজ্যটি বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতীয় পশ্চিম বাংলা নিয়ে গঠিত ছিল। প্রাক-মুসলিম যুগে রাজ্যটি বিভিন্ন জনপদের নামে পরিচিত ছিল। যেমন, গৌড়, রাঢ়, বঙ্গ, পুন্ড্র, সমতট প্রভৃতি নামে অভিহিত ছিল। এ জনপদগুলির মধ্যে বঙ্গ ও গৌড় প্রাধান্য ও খ্যাতি লাভ করেছিল। মুসলিম আমলের প্রাথমিক পর্যায়ে গৌড় (লখনৌতিতে রূপান্তরিত), বঙ্গ (মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভাষায়- বঙ), বরেন্দ্র (মুসলিমদের- বারিন্দ) এবং সমতট (মুসলিমদের- সকনত) ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক সত্তায় উল্লিখিত হয়েছে। জিয়াউদ্দীন বরনীই হলেন প্রথম মুসলিম ঐতিহাসিক যিনি ইকলিম-ই-বাঙ্গালাহ অথবা দিয়ার-ই-বাঙ্গালাহ (যার দ্বারা তিনি বাংলাকে বুঝিয়েছেন) শব্দগুলি ব্যবহার করেন। ইলিয়াস শাহ কর্তৃক লখনৌতি,সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও একত্রিত হওয়ার পর শামস-ই-সিরাজ ইলিয়াস শাহকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ এবং ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইলিয়াস শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সালতানাত প্রায় দুশ বছর টিকে ছিল এবং এ সময় বাঙ্গালাহ নামের বহুল পরিচিতি ঘটে। এ অঞ্চলে মুগলদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুগলগণ বাঙ্গালাহকে মুগল সাম্রাজ্যে একটি সুবাহ (প্রদেশ) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এ প্রদেশ সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ নামই পর্তুগিজ বিবরণে বেঙ্গালা রূপে দেখা যায়। ইংরেজরা বেঙ্গলাকে বেঙ্গল বলে অভিহিত করেন। এভাবে দেখা যায় যে, চৌদ্দ শতক থেকেই বাঙ্গালাহ নামের পরিচিতি ঘটে এবং এ অঞ্চল বলতে বর্তমানের বাংলাদেশ ও ভারতীয় পশ্চিম বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত প্রায় সব ভূভাগকেই বোঝায়।
মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাঙ্গালাহ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন এভাবে যে, বাঙ্গালাহর প্রাচীন নাম ছিল বঙ। এর পূর্বেকার শাসকগণ সমগ্র প্রদেশে পাশে ২০ গজ এবং উচ্চতায় ১০ গজ উঁচু বাঁধ নির্মাণ করেন। এগুলিকে ‘আল’ বলা হতো। বঙ-এর সাথে আল যুক্ত হয়ে দেশটির বাঙ্গালাহ নামের উৎপত্তি হয় এবং তা ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। কেউ হয়ত আবুল ফজলের ব্যাখ্যার সাথে একমত নাও হতে পারেন, তবে এটা পরিষ্কার যে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাঙ্গালাহ ‘বঙ’ অর্থাৎ প্রাক-মুসলিম যুগের ‘বঙ্গ’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। [আবদুল মমিন চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি আবদুল করিম, ‘বঙ্গ:বঙ্গালা:বাংলাদেশ’, মানববিদ্যা বক্তৃতা, ঢাকা, ১৯৮৭।