দিনেমার, জাতি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''দিনেমার'''''', ''''''জাতি'''  ডেনমার্কের অধিবাসীরা বাংলাদেশে দিনেমার নামে পরিচিত। সতেরো শতকের প্রথম দিকে দিনেমাররা পূর্বাঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড শুরু করে। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার সম্বলিত একটি অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যের জন্য দিনেমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দিনেমার জাহাজ ভারতে পাঠানো হয়েছিল। এ জাহাজগুলি মশলা, চীনামাটির বাসন-কোসন, হীরা ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে। কোম্পানি-প্রধান রোনাল্ড গ্র্যাপ ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলিতে একটি এবং পরে বালেশ্বরে অপর একটি [[১০৩৮৮৮|বাণিজ্যকুঠি]] স্থাপন করেন। দিনেমারদের কোনো শাহী [[১০৩৩৭৪|ফরমান]] না থাকায় ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে অচিরেই স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় বাসিন্দারা পিপলি বাণিজ্যকুঠি বিধ্বস্ত ও লুট করে এবং দিনেমাররা পিপলি ও বালেশ্বর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দিনেমারদের ’সেন্ট জ্যাকব’ নামীয় জাহাজটি প্রচন্ড ঝড়ে পড়ে পিপলিতে নোঙর করতে চাইলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। [[১০৩৪৪৫|ফৌজদার]] অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। ফৌজদার ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে দিনেমাররা বাংলার উপকূলে জাহাজ ও নৌকা দখল করতে শুরু করে। ১৬৩৮ থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা সাতটি জাহাজ দখল করে। ১৮০ টনি একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সবগুলিই ছিল সাম্পান এবং এতে করে দিনেমারদের প্রত্যাশিত কোনো ফললাভ হয় নি। অন্যান্য ইউরোপীয় বিশেষত ওলন্দাজরা এ ধরনের আক্রমণের বিরোধী ছিল।  
'''দিনেমার, জাতি'''  ডেনমার্কের অধিবাসীরা বাংলাদেশে দিনেমার নামে পরিচিত। সতেরো শতকের প্রথম দিকে দিনেমাররা পূর্বাঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড শুরু করে। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার সম্বলিত একটি অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যের জন্য দিনেমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দিনেমার জাহাজ ভারতে পাঠানো হয়েছিল। এ জাহাজগুলি মশলা, চীনামাটির বাসন-কোসন, হীরা ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে। কোম্পানি-প্রধান রোনাল্ড গ্র্যাপ ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলিতে একটি এবং পরে বালেশ্বরে অপর একটি [[বাণিজ্যকুঠি|বাণিজ্যকুঠি]] স্থাপন করেন। দিনেমারদের কোনো শাহী [[ফরমান|ফরমান]] না থাকায় ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে অচিরেই স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় বাসিন্দারা পিপলি বাণিজ্যকুঠি বিধ্বস্ত ও লুট করে এবং দিনেমাররা পিপলি ও বালেশ্বর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দিনেমারদের ’সেন্ট জ্যাকব’ নামীয় জাহাজটি প্রচন্ড ঝড়ে পড়ে পিপলিতে নোঙর করতে চাইলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। [[ফৌজদার|ফৌজদার]] অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। ফৌজদার ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে দিনেমাররা বাংলার উপকূলে জাহাজ ও নৌকা দখল করতে শুরু করে। ১৬৩৮ থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা সাতটি জাহাজ দখল করে। ১৮০ টনি একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সবগুলিই ছিল সাম্পান এবং এতে করে দিনেমারদের প্রত্যাশিত কোনো ফললাভ হয় নি। অন্যান্য ইউরোপীয় বিশেষত ওলন্দাজরা এ ধরনের আক্রমণের বিরোধী ছিল।  


১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার [[১০৫৫৮১|শাহ সুজা]] ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮০,০০০ টাকা দিতে চাইলে দিনেমাররা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ তারা জলদস্যুতা ও আলাপ-আলোচনা দুইই চালাতে থাকে। সম্ভবত ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে একটা আপোসরফা হয়। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু হলে ডেনমার্কে কোম্পানিটি নতুন পরিস্থিতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।  
১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার [[শাহ সুজা|শাহ সুজা]] ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮০,০০০ টাকা দিতে চাইলে দিনেমাররা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ তারা জলদস্যুতা ও আলাপ-আলোচনা দুইই চালাতে থাকে। সম্ভবত ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে একটা আপোসরফা হয়। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু হলে ডেনমার্কে কোম্পানিটি নতুন পরিস্থিতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।  


ইতোমধ্যে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে দিনেমারদের দস্যুতা অব্যাহত থাকে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তারা মূল্যবান পণ্যসহ বাংলার একটি জাহাজ দখল করে। জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের এচেনে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ওলন্দাজদের মধ্যস্থতাও কোনো মীমাংসা করতে পারে নি। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমাররা বাংলার ত্রিশটি জাহাজ দখল করে। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমারদের পিপলি, বালেশ্বর ও হুগলি এলাকায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দিলে সমঝোতা হয়। মুগল সম্রাট তা অনুমোদন করে ২.৫% বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করেন। দিনেমাররা তখন বাংলা থেকে রেশম, আফিম ও শোরা কেনার পরিকল্পনা করে। তারা বাংলায় ট্র্যাঙ্কুবারের লবণ, ইউরোপীয় তামা, লোহা ও সুরা বিক্রি করত। কিন্তু সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং বালেশ্বর ত্যাগ করার পর দিনেমাররা আবার দস্যুতা শুরু করে।
ইতোমধ্যে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে দিনেমারদের দস্যুতা অব্যাহত থাকে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তারা মূল্যবান পণ্যসহ বাংলার একটি জাহাজ দখল করে। জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের এচেনে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ওলন্দাজদের মধ্যস্থতাও কোনো মীমাংসা করতে পারে নি। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমাররা বাংলার ত্রিশটি জাহাজ দখল করে। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমারদের পিপলি, বালেশ্বর ও হুগলি এলাকায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দিলে সমঝোতা হয়। মুগল সম্রাট তা অনুমোদন করে ২.৫% বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করেন। দিনেমাররা তখন বাংলা থেকে রেশম, আফিম ও শোরা কেনার পরিকল্পনা করে। তারা বাংলায় ট্র্যাঙ্কুবারের লবণ, ইউরোপীয় তামা, লোহা ও সুরা বিক্রি করত। কিন্তু সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং বালেশ্বর ত্যাগ করার পর দিনেমাররা আবার দস্যুতা শুরু করে।
১০ নং লাইন: ১০ নং লাইন:
মনে হয়, বাংলা থেকে ট্র্যাঙ্কুবারে জাহাজে পণ্য-পরিবহণ ব্যবসা লাভজনক হয় নি। বাংলার বাণিজ্যকুঠির প্রতিনিধি জাঁ জঁচিম বড় একটি জাহাজ কিনেন, কিন্তু তার এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যকুঠির কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার এবং বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি প্রায়শ নির্দয় আচরণ করতেন। এর ফলে দুজন কর্মচারী মারা যায় এবং এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোম্পানি বাণিজ্যকুঠির এক কুঠিয়াল উল্ফ র‌্যাভনকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর হিসেবে আগত ইরাসমাস হ্যানসেন এট্রুপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, তখন একদিকে বাণিজ্যকুঠি ছিল পণ্যশূন্য ও অর্থশূন্য এবং অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা দিনেমারদের বিতাড়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
মনে হয়, বাংলা থেকে ট্র্যাঙ্কুবারে জাহাজে পণ্য-পরিবহণ ব্যবসা লাভজনক হয় নি। বাংলার বাণিজ্যকুঠির প্রতিনিধি জাঁ জঁচিম বড় একটি জাহাজ কিনেন, কিন্তু তার এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যকুঠির কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার এবং বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি প্রায়শ নির্দয় আচরণ করতেন। এর ফলে দুজন কর্মচারী মারা যায় এবং এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোম্পানি বাণিজ্যকুঠির এক কুঠিয়াল উল্ফ র‌্যাভনকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর হিসেবে আগত ইরাসমাস হ্যানসেন এট্রুপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, তখন একদিকে বাণিজ্যকুঠি ছিল পণ্যশূন্য ও অর্থশূন্য এবং অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা দিনেমারদের বিতাড়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।


দিনেমারগণ [[১০১৭০৪|চন্দননগর]] থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে অবস্থিত তাদের বসতিতে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয় এবং সুবাহদারের কোনো অনুমতি লাভের আগেই নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে তাদের পুনর্বাসন করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর পর বাংলার [[১০৬০৮৫|সুবাহদার]] এ গ্রামগুলির বকেয়াসহ খাজনা দাবি করেন। দিনেমাররা খাজনা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ক্রোড়ি রামকৃষ্ণ রায় তাদের বসতি আক্রমণ করেন। কিন্তু দিনেমাররা সহজেই তা প্রতিহত করে। ডিসেম্বর মাসে তার অপর একটি আক্রমণও ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর কোনো জাহাজ না আসায় দিনেমারদের তহবিল শূন্য হয়ে পড়ে। [[১০৪৮৪৫|মুর্শিদকুলী খান]] এর কাছে তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যাত হয়। দিনেমাররা তখন তাদের বসতি ত্যাগ করে এবং বড়নগরের কাছে মূল্যবান পণ্যসহ মুসলমানদের একটি বড় জাহাজ দখল করে নেয়। এরপর তারা প্রায় ৩৫০ জন ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈনিক সংগ্রহ করে নদীর মোহনার দিকে অগ্রসর হয়। [[১০০৪৮৬|ইংরেজ]] ও  ফরাসিদের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।  
দিনেমারগণ [[চন্দননগর|চন্দননগর]] থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে অবস্থিত তাদের বসতিতে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয় এবং সুবাহদারের কোনো অনুমতি লাভের আগেই নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে তাদের পুনর্বাসন করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর পর বাংলার [[সুবাহদার|সুবাহদার]] এ গ্রামগুলির বকেয়াসহ খাজনা দাবি করেন। দিনেমাররা খাজনা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ক্রোড়ি রামকৃষ্ণ রায় তাদের বসতি আক্রমণ করেন। কিন্তু দিনেমাররা সহজেই তা প্রতিহত করে। ডিসেম্বর মাসে তার অপর একটি আক্রমণও ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর কোনো জাহাজ না আসায় দিনেমারদের তহবিল শূন্য হয়ে পড়ে। [[মুর্শিদকুলী খান|মুর্শিদকুলী খান]] এর কাছে তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যাত হয়। দিনেমাররা তখন তাদের বসতি ত্যাগ করে এবং বড়নগরের কাছে মূল্যবান পণ্যসহ মুসলমানদের একটি বড় জাহাজ দখল করে নেয়। এরপর তারা প্রায় ৩৫০ জন ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈনিক সংগ্রহ করে নদীর মোহনার দিকে অগ্রসর হয়। [[ইংরেজ|ইংরেজ]] ও  ফরাসিদের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।  


এর ফলে হুগলির ফৌজদার কর্তৃক ডেনমার্কনগরের বসতি লুণ্ঠিত হয়। গঙ্গা ত্যাগ করার আগে এট্রুপ মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং রামকৃষ্ণ ক্রোড়ির বিরুদ্ধে ফরমানের জন্য ৩০,০০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেন, যদিও এ টাকা কোনোদিনই তিনি দেন নি। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শান্তি স্থাপিত হয় এবং দিনেমাররা আবার তাদের বসতিতে ফিরে আসে। সেখানে তখন কোনো ব্যবসাই ছিল না। কোনো তহবিল ও ব্যবসা না থাকায় কুঠিয়ালদের সেখানে থাকা না থাকার মধ্যে র্পাথক্য ছিল না। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে দিনেমাররা  পর্তুগিজদের নিকট তাদের বাণিজ্যকুঠি বিক্রি করে দেয়। অবশ্য প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করা হয় নি এ অজুহাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকুঠিটি দখল করে নেন।  
এর ফলে হুগলির ফৌজদার কর্তৃক ডেনমার্কনগরের বসতি লুণ্ঠিত হয়। গঙ্গা ত্যাগ করার আগে এট্রুপ মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং রামকৃষ্ণ ক্রোড়ির বিরুদ্ধে ফরমানের জন্য ৩০,০০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেন, যদিও এ টাকা কোনোদিনই তিনি দেন নি। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শান্তি স্থাপিত হয় এবং দিনেমাররা আবার তাদের বসতিতে ফিরে আসে। সেখানে তখন কোনো ব্যবসাই ছিল না। কোনো তহবিল ও ব্যবসা না থাকায় কুঠিয়ালদের সেখানে থাকা না থাকার মধ্যে র্পাথক্য ছিল না। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে দিনেমাররা  পর্তুগিজদের নিকট তাদের বাণিজ্যকুঠি বিক্রি করে দেয়। অবশ্য প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করা হয় নি এ অজুহাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকুঠিটি দখল করে নেন।  


১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিনেমাররা ডেনমার্কনগরে তাদের বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু নওয়াব [[১০০৩৫৭|আলীবর্দী খান]] ছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের মধ্যস্থতার কারণে আলীবর্দী দিনেমারদের শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দান করেন। ইংরেজদের স্বার্থ ছিল দিনেমারদের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসালব্ধ অর্থ ইউরোপে পাঠানো। রবার্ট [[১০১২১৯|ক্লাইভ]]. ওয়ারেন [[১০৬৪৫৪|হেস্টিংস]], রবার্ট [[ওর্ম, রবার্ট|ওর্ম]] ও অন্যান্যরা প্রাক-পলাশী আমলে ট্র্যাঙ্কুবারে তৈরি দিনেমার হুন্ডি ইউরোপে পাঠিয়ে দেশিয় বাণিজ্যে দিনেমারদের সহযোগিতা করেছিলেন। ফলে বাংলায় তাদের বাণিজ্য-উদ্যোগের জন্য দিনেমারদের কখনও নগদ অর্থের অভাব হয় নি।  
১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিনেমাররা ডেনমার্কনগরে তাদের বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু নওয়াব [[আলীবর্দী খান|আলীবর্দী খান]] ছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের মধ্যস্থতার কারণে আলীবর্দী দিনেমারদের শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দান করেন। ইংরেজদের স্বার্থ ছিল দিনেমারদের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসালব্ধ অর্থ ইউরোপে পাঠানো। [[ক্লাইভ, রবার্ট|রবার্ট ক্লাইভ]], [[হেস্টিংস, ওয়ারেন|ওয়ারেন হেস্টিংস]], [[ওর্ম, রবার্ট|রবার্ট ওর্ম]] ও অন্যান্যরা প্রাক-পলাশী আমলে ট্র্যাঙ্কুবারে তৈরি দিনেমার হুন্ডি ইউরোপে পাঠিয়ে দেশিয় বাণিজ্যে দিনেমারদের সহযোগিতা করেছিলেন। ফলে বাংলায় তাদের বাণিজ্য-উদ্যোগের জন্য দিনেমারদের কখনও নগদ অর্থের অভাব হয় নি।  


১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজরা শোরা ও আফিম ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করলে অন্যান্য অ-ইংরেজ ইউরোপীয়দের মতো দিনেমাররাও অ-ইংরেজ জাহাজে পণ্য পরিবহণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বেসরকারি খাতের দিনেমার বণিকদের এশিয়ায় বাণিজ্য করার অনুমতি দান করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দিনেমার কোম্পানি বাংলা থেকে তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি বদলে যায় এবং দিনেমাররা অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীরামপুরে মার্কিন জাহাজ ও ধর্মপ্রচারকগণ আসতে থাকেন। আঠারো শতকের নববইয়ের দশক থেকে [[১০৫৭৪০|শ্রীরামপুর]] ধর্মান্তরণ ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। [[১০৫৭৪২|শ্রীরামপুর মিশন]], [[১০৫৭৪৩|শ্রীরামপুর মিশন প্রেস]] ও [[১০৫৭৪১|শ্রীরামপুর কলেজ]] বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।  [অনিরুদ্ধ রায়]
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজরা শোরা ও আফিম ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করলে অন্যান্য অ-ইংরেজ ইউরোপীয়দের মতো দিনেমাররাও অ-ইংরেজ জাহাজে পণ্য পরিবহণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বেসরকারি খাতের দিনেমার বণিকদের এশিয়ায় বাণিজ্য করার অনুমতি দান করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দিনেমার কোম্পানি বাংলা থেকে তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি বদলে যায় এবং দিনেমাররা অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীরামপুরে মার্কিন জাহাজ ও ধর্মপ্রচারকগণ আসতে থাকেন। আঠারো শতকের নববইয়ের দশক থেকে [[শ্রীরামপুর|শ্রীরামপুর]] ধর্মান্তরণ ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। [[|শ্রীরামপুর মিশন|শ্রীরামপুর মিশন]], [[শ্রীরামপুর মিশন প্রেস|শ্রীরামপুর মিশন প্রেস]] ও [[শ্রীরামপুর কলেজ|শ্রীরামপুর কলেজ]] বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।  [অনিরুদ্ধ রায়]
 
<!-- imported from file: দিনেমার, জাতি.html-->
 
[[en:Danes, The]]


[[en:Danes, The]]
[[en:Danes, The]]

০৯:৪০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

দিনেমার, জাতি  ডেনমার্কের অধিবাসীরা বাংলাদেশে দিনেমার নামে পরিচিত। সতেরো শতকের প্রথম দিকে দিনেমাররা পূর্বাঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড শুরু করে। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার সম্বলিত একটি অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যের জন্য দিনেমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দিনেমার জাহাজ ভারতে পাঠানো হয়েছিল। এ জাহাজগুলি মশলা, চীনামাটির বাসন-কোসন, হীরা ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে। কোম্পানি-প্রধান রোনাল্ড গ্র্যাপ ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলিতে একটি এবং পরে বালেশ্বরে অপর একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন। দিনেমারদের কোনো শাহী ফরমান না থাকায় ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে অচিরেই স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় বাসিন্দারা পিপলি বাণিজ্যকুঠি বিধ্বস্ত ও লুট করে এবং দিনেমাররা পিপলি ও বালেশ্বর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দিনেমারদের ’সেন্ট জ্যাকব’ নামীয় জাহাজটি প্রচন্ড ঝড়ে পড়ে পিপলিতে নোঙর করতে চাইলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ফৌজদার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। ফৌজদার ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে দিনেমাররা বাংলার উপকূলে জাহাজ ও নৌকা দখল করতে শুরু করে। ১৬৩৮ থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা সাতটি জাহাজ দখল করে। ১৮০ টনি একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সবগুলিই ছিল সাম্পান এবং এতে করে দিনেমারদের প্রত্যাশিত কোনো ফললাভ হয় নি। অন্যান্য ইউরোপীয় বিশেষত ওলন্দাজরা এ ধরনের আক্রমণের বিরোধী ছিল।

১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজা ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮০,০০০ টাকা দিতে চাইলে দিনেমাররা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ তারা জলদস্যুতা ও আলাপ-আলোচনা দুইই চালাতে থাকে। সম্ভবত ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে একটা আপোসরফা হয়। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু হলে ডেনমার্কে কোম্পানিটি নতুন পরিস্থিতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

ইতোমধ্যে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে দিনেমারদের দস্যুতা অব্যাহত থাকে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তারা মূল্যবান পণ্যসহ বাংলার একটি জাহাজ দখল করে। জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের এচেনে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ওলন্দাজদের মধ্যস্থতাও কোনো মীমাংসা করতে পারে নি। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমাররা বাংলার ত্রিশটি জাহাজ দখল করে। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমারদের পিপলি, বালেশ্বর ও হুগলি এলাকায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দিলে সমঝোতা হয়। মুগল সম্রাট তা অনুমোদন করে ২.৫% বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করেন। দিনেমাররা তখন বাংলা থেকে রেশম, আফিম ও শোরা কেনার পরিকল্পনা করে। তারা বাংলায় ট্র্যাঙ্কুবারের লবণ, ইউরোপীয় তামা, লোহা ও সুরা বিক্রি করত। কিন্তু সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং বালেশ্বর ত্যাগ করার পর দিনেমাররা আবার দস্যুতা শুরু করে।

ডেনমার্কে বাংলার চিনি, শোরা ও বস্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকলে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কোম্পানি বাংলার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। এন্ড্রে এন্ড্রাস ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হন এবং এর ফলে কোম্পানি ক্ষতিপূরণের সব দাবি ত্যাগ করে পূর্বতন বাণিজ্য সুবিধাভোগের অধিকার লাভ করে। চন্দননগরের নিকটে তাদেরকে একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। স্থানটি ডেনমার্কনগর নামে অভিহিত হতো। গুদাম ও অন্যান্য ইমারতগুলি ছিল প্রাচীরবেষ্টিত এবং সেখানে কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ জন। কোম্পানি অবশ্য কোনোদিনই প্রতিশ্রুত ফরমান পায় নি।

মনে হয়, বাংলা থেকে ট্র্যাঙ্কুবারে জাহাজে পণ্য-পরিবহণ ব্যবসা লাভজনক হয় নি। বাংলার বাণিজ্যকুঠির প্রতিনিধি জাঁ জঁচিম বড় একটি জাহাজ কিনেন, কিন্তু তার এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যকুঠির কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার এবং বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি প্রায়শ নির্দয় আচরণ করতেন। এর ফলে দুজন কর্মচারী মারা যায় এবং এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোম্পানি বাণিজ্যকুঠির এক কুঠিয়াল উল্ফ র‌্যাভনকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর হিসেবে আগত ইরাসমাস হ্যানসেন এট্রুপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, তখন একদিকে বাণিজ্যকুঠি ছিল পণ্যশূন্য ও অর্থশূন্য এবং অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা দিনেমারদের বিতাড়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।

দিনেমারগণ চন্দননগর থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে অবস্থিত তাদের বসতিতে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয় এবং সুবাহদারের কোনো অনুমতি লাভের আগেই নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে তাদের পুনর্বাসন করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর পর বাংলার সুবাহদার এ গ্রামগুলির বকেয়াসহ খাজনা দাবি করেন। দিনেমাররা খাজনা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ক্রোড়ি রামকৃষ্ণ রায় তাদের বসতি আক্রমণ করেন। কিন্তু দিনেমাররা সহজেই তা প্রতিহত করে। ডিসেম্বর মাসে তার অপর একটি আক্রমণও ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর কোনো জাহাজ না আসায় দিনেমারদের তহবিল শূন্য হয়ে পড়ে। মুর্শিদকুলী খান এর কাছে তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যাত হয়। দিনেমাররা তখন তাদের বসতি ত্যাগ করে এবং বড়নগরের কাছে মূল্যবান পণ্যসহ মুসলমানদের একটি বড় জাহাজ দখল করে নেয়। এরপর তারা প্রায় ৩৫০ জন ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈনিক সংগ্রহ করে নদীর মোহনার দিকে অগ্রসর হয়। ইংরেজ ও  ফরাসিদের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এর ফলে হুগলির ফৌজদার কর্তৃক ডেনমার্কনগরের বসতি লুণ্ঠিত হয়। গঙ্গা ত্যাগ করার আগে এট্রুপ মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং রামকৃষ্ণ ক্রোড়ির বিরুদ্ধে ফরমানের জন্য ৩০,০০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেন, যদিও এ টাকা কোনোদিনই তিনি দেন নি। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শান্তি স্থাপিত হয় এবং দিনেমাররা আবার তাদের বসতিতে ফিরে আসে। সেখানে তখন কোনো ব্যবসাই ছিল না। কোনো তহবিল ও ব্যবসা না থাকায় কুঠিয়ালদের সেখানে থাকা না থাকার মধ্যে র্পাথক্য ছিল না। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে দিনেমাররা  পর্তুগিজদের নিকট তাদের বাণিজ্যকুঠি বিক্রি করে দেয়। অবশ্য প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করা হয় নি এ অজুহাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকুঠিটি দখল করে নেন।

১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিনেমাররা ডেনমার্কনগরে তাদের বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু নওয়াব আলীবর্দী খান ছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের মধ্যস্থতার কারণে আলীবর্দী দিনেমারদের শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দান করেন। ইংরেজদের স্বার্থ ছিল দিনেমারদের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসালব্ধ অর্থ ইউরোপে পাঠানো। রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, রবার্ট ওর্ম ও অন্যান্যরা প্রাক-পলাশী আমলে ট্র্যাঙ্কুবারে তৈরি দিনেমার হুন্ডি ইউরোপে পাঠিয়ে দেশিয় বাণিজ্যে দিনেমারদের সহযোগিতা করেছিলেন। ফলে বাংলায় তাদের বাণিজ্য-উদ্যোগের জন্য দিনেমারদের কখনও নগদ অর্থের অভাব হয় নি।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজরা শোরা ও আফিম ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করলে অন্যান্য অ-ইংরেজ ইউরোপীয়দের মতো দিনেমাররাও অ-ইংরেজ জাহাজে পণ্য পরিবহণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বেসরকারি খাতের দিনেমার বণিকদের এশিয়ায় বাণিজ্য করার অনুমতি দান করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দিনেমার কোম্পানি বাংলা থেকে তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি বদলে যায় এবং দিনেমাররা অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীরামপুরে মার্কিন জাহাজ ও ধর্মপ্রচারকগণ আসতে থাকেন। আঠারো শতকের নববইয়ের দশক থেকে শ্রীরামপুর ধর্মান্তরণ ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। [[|শ্রীরামপুর মিশন|শ্রীরামপুর মিশন]], শ্রীরামপুর মিশন প্রেসশ্রীরামপুর কলেজ বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।  [অনিরুদ্ধ রায়]