শাহ সুজা

শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০) সুবাহ-বাংলার মুগল ভাইসরয়। তিনি ছিলেন সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তাঁর জন্ম হয়। যুবরাজ থাকাকালে তিনি বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়ে সেনাপতি ও প্রশাসক হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সুজার কর্মদক্ষতা বিষয়ে সম্রাটের অগাধ আস্থা ছিল, যার ফলে তাঁর মনসব (পদ) ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০,০০০ জাট ও ১৫০০০ সওয়ারে উন্নীত হয়।

শাহজাহান ইসলাম খান মাসহাদীকে দরবারে ডেকে পাঠান এবং শাহ সুজাকে ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করেন। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ঊড়িষ্যা প্রদেশের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। ১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ বছরের কিছু অধিক সময় ধরে তিনি প্রদেশ দুটি শাসন করেন। এ সময়ে তাঁর শাসনের দুটি সংক্ষিপ্ত বিরতি ছিল প্রথম বিরতি হয় ১৬৪৭-৪৮ পর্যন্ত। প্রথম বিরতিতে আফগানিস্তানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে তিনি সম্রাটের সঙ্গে ছিলেন, দ্বিতীয় বিরতি ঘটে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে তখন তিনি এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাস কাল কাবুলে অবস্থান করেন। তাঁর সুবাহদারির শেষ দিকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে দুবার তিনি রাজধানী দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন।

শাহ সুজার নিযুক্তির সময় ঢাকা সুবাহ-বাংলার রাজধানী ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন (তারিখ জানা নেই)। শাহ সুজার শাসনকালে বাংলা ও ঊড়িষ্যা প্রদেশ দুটিতে মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছিল; কোন অংশেই কোন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি। প্রকৃত পক্ষে জমিদার ও দুষ্কৃতিকারীরা সুবাহদার হিসেবে রাজকুমারকে দেখে হতবিহবল হয়ে পড়ে। তদুপরি সুজার উপর কেবল দুই প্রদেশের (বাংলা ও ঊড়িষ্যা) সুবাদারির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে নি, তিনি কামরূপ ও আশ্রিত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন, যা তৃতীয় আর এক প্রদেশের সমতুল্য ছিল এবং এটিও তাঁর অধীনে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সুজা পূর্ব ভারতের ভাইসরয় ছিলেন।

শাহ সুজা ব্যাপক রাজ্য বিজয়ের জন্য খ্যাত ছিলেন না, তবে মনে হয় তিনি হিজলি ও ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত হিজলি অঞ্চলে বাহাদুর খান নামক এক স্বভাবগত বিদ্রোহী শাসন করতেন (পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর জেলা)। সুজার সময়ে বাহাদুর রাজস্ব পরিশোধে বিলম্ব করেন, এই বিলম্বের জন্য সুজা তড়িৎ ব্যবস্থা নেন। বাহাদুর খান পরাজিত হন এবং আগের চেয়ে আরও বেশি রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ক্ষমা লাভ করেন। ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস রাজমালায় ওই রাজ্যের সাথে সুজার যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা যুদ্ধে পরাজিত হন এবং বর্তমান কুমিল্লার সীমান্ত সংলগ্ন অংশবিশেষ ছেড়ে দিয়ে শান্তি স্থাপন করেন। একটি মসজিদ তৈরির মধ্যদিয়ে সুজা এই বিজয় স্মরণীয় করে তোলেন। মসজিদটি এখনও ভাল অবস্থায় আছে এবং সুজার নাম মনে করিয়ে দেয়। এটি কুমিল্লা শহরের অদূরে গোমতি নদীর তীরে অবস্থিত।

শাহ সুজা জ্ঞানী, সংস্কৃতিবান ও কেতাদুরস্ত আদর্শ মুগল রাজকুমার ছিলেন। যে সকল ফারসি কবি ও পন্ডিত তাঁর দরবার অলংকৃত করতেন তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ সকল ব্যক্তি প্রধানত ইরান থেকে আসেন এবং শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। তাঁর প্রধান পারিষদগণ ছিলেন শিয়া এবং এমন কি অধস্তন কর্মচারীদেরও বেশির ভাগ শিয়া ছিল। তাঁর মা ছিলেন শিয়া মহিলা, তাঁর দুই স্ত্রীও (একজনের পর অন্য আর একজন তিনি বিয়ে করেন) ছিলেন শিয়া। ঢাকায় প্রচলিত গল্প অনুসারে শাহ সুজা বাংলায় আসার সময় সঙ্গে করে তিন শত শিয়া নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। দিল্লিতে গুজব রটে যে সুজা নিজেই শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর ভাই আওরঙ্গজেবের সমর্থকগণ বিষয়টিকে আরও অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেন। কিন্তু এ অভিযোগ সত্য ছিল না। তিনি অবশ্য স্বীয় পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের ন্যায় ফারসি পন্ডিত, সুফী ও প্রশাসকদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল পছন্দ করতেন।

সুজা বড় নির্মাতা ছিলেন। ঢাকার প্রাচীন মুগল দালানগুলি তাঁর সময়েই নির্মিত হয়। দালানগুলি হলো বড় কাটরা, ঈদগাহ, হোসেনী দালান এবং চুড়িহাট্টা মসজিদ। চকবাজারের একটু দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে বড় কাটরা তৈরি করা হয়।  মনোমুগ্ধকর স্থাপনাটি মূলত যুবরাজের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয়, কিন্তু থাকার জন্য তিনি রাজমহল পছন্দ করায় বড়কাটরা ভ্রাম্যমাণ বণিকদের বাসের জন্য দেওয়া হয়, অর্থাৎ এটি কাটরা বা সরাইখানা হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। ঈদগাহ উঁচু ভিতের চারদিকে ঘেরা দিয়ে বানানো হয়। বছরে দুই ঈদে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য এটি ব্যবহার করা হতো। সৈয়দ মুরাদ ১৬৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। এখানে শিয়া সম্প্রদায় জামাতে নামাজ আদায় করতেন, আর চুড়িহাট্টা মসজিদ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা হয়। রাজমহলে শাহ সুজা ‘সাঙ্গ-ই-দালান’ (পাথরের প্রাসাদ) নামে এক প্রাসাদ এবং মার্বেল পাথরের এক মসজিদ তৈরি করেন। ‘আনন্দ-সরোবর’ নামে এক দিঘি এখনও শাহ সুজার স্মৃতি বহন করে। পুকুরের চারদিকে তৈরি করা হয় দীউয়ান-ই-আম, দীউয়ান-ই-খাস, হাম্মাম (গোছল খানা), হাউজ (জলাধার) এবং ফোয়ারা (ঝর্ণা)।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়ে শাহ সুজা সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি বিদেশি বণিক ও ইউরোপীয় কোম্পানিদের সাদর আমন্ত্রণ জানান এবং অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ-সুবিধা করে দেন। তিনি  পর্তুগিজদের এক ‘নিশান’ (যুবরাজের দেওয়া অনুমতি পত্র) প্রদান করেন, যার মাধ্যমে সম্রাটের ‘ফরমানে’ দেওয়া বাণিজ্যিক সুবিধাদি স্বীকার করা হয়। তিনি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ডাচ কোম্পানিকেও অনুরূপ সুবিধাদি দেন। সুজা অবৈধভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাতেন বলে জানা যায়। তিনি ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে পারস্যদেশীয়দের মাধ্যমে বা নিজে জাহাজ ভাড়া করে এই দুই উপায়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা করতেন। রাজকুমারদের বা রাজকীয় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা দেশের স্বার্থ বিরোধী ছিল। শাহ সুজা তাঁর অধীনস্থ প্রদেশসমূহে নতুনভাবে রাজস্ব বন্দোবস্তের উদ্যোগ নেন। এর ফলে  আকবরের আমলে টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থার চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ রাজস্ব বৃদ্ধি পায়।

১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সমগ্র সাম্রাজ্যে গুজব রটে যে সম্রাট মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর বড় পুত্র দারাশিকো সিংহাসনে তাঁর অবস্থান দৃঢ়করণের জন্য তা গোপন রেখেছেন। বাকি তিন যুবরাজ সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী অভিমুখে যাত্রার প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন। সুজা রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন ও রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন। গঙ্গা নদীতে বহু সংখ্যক যুদ্ধের নৌকা সজ্জিত করে বিরাট বাহিনী নিয়ে তিনি রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। বাহাদুরপুরের তুমুল যুদ্ধে (আধুনিক উত্তর প্রদেশ, ভারত) দারার বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে আবার প্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য সুজা রাজমহলে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব দুবার (ধর্মাট ও সামগড়ে) দারাকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে বন্দি ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুজা আবারও রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। এবার তাঁর অভিযান ছিল আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি খাজোয়াতে (ফতেহপুর জেলা, উত্তর প্রদেশ, ভারত) যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও সুজা পরাজিত হন। তিনি বাংলার দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। মীরজুমলার অধীন রাজকীয় বাহিনী দ্বারা ভীষণভাবে তাড়িত হলেও সুজা প্রতিটি জায়গায় তাদেরকে বাধা দিতে থাকেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনি পরাজয় বরণ করেন। প্রতিটি পরাজয়ের পর স্বীয় বাহিনীর সেনারা তাঁকে ছেড়ে যেতে থাকে কিন্তু তিনি তাতে হতোদ্যম হন নি। তিনি বরং নতুন উদ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। কিন্তু  তান্ডাতে যখন চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সৈন্য পুনর্গঠিত করা আর সম্ভব নয় মনে করলেন তখন চিরকালের জন্য তিনি বাংলা (এবং ভারতবর্ষ) ত্যাগ করে আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সপরিবারে এবং দলবল নিয়ে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তান্ডা ত্যাগ করে এপ্রিলের ১২ তারিখে ঢাকা পৌঁছেন। ৬ মে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ১২ মে ভুলুয়াতে দলবল নিয়ে আরাকানের পথে জাহাজে ওঠেন।

বাংলা ত্যাগের পূর্বেই সুজা আরাকানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল প্রথমে মক্কা যাওয়া এবং সেখান থেকে পারস্য বা তুরস্কে। কিন্তু মে মাসে সমুদ্র উত্তাল থাকায় এবং বর্ষা মৌসুম হওয়ায় তিনি কয়েক মাসের জন্য আরাকানে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং জাহাজ জোগাড় করার জন্য রাজার সাহায্য চান। আরাকানের রাজধানী ম্রোহং (ম্রৌকউ) পৌঁছলে রাজা তাঁর মন্ত্রিমন্ডলীর মাধ্যমে সুজাকে সাদরে গ্রহণ করেন। শহরের উপকণ্ঠে থাকার জন্য তাঁকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই অতিথির প্রতি রাজার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে থাকে। সুজার সঙ্গে নীত সম্পদ হস্তগত করা বা সুজার সুন্দরী ও সংস্কৃতিবান মেয়েদের একজনকে পত্নী হিসেবে পাওয়ার অভিলাষ থেকে সুজার সঙ্গে রাজার বিরোধ বাধে। সুজাকে তাঁর পরিবার ও দলবলসহ নিপীড়ন করে মারা হয়। শুধু সামান্য কয়েকজন গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ থেকে নিস্তার পায়। কিন্তু কোন মুগল রাজকুমার বা রাজকুমারী জীবিত ছিলেন না।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  JN Sarkar, ed, History of Bengal, vol. II, Dacca University, Dhaka, 1948; JN Sarkar, History of Aurangzib, vol. II, Orient Langman Reprint, New Delhi, 1972-74; Abdul Karim, History of Bengal, Mughal Period, vol. II, Rajshahi University, Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi, 1995.