শ্রীরামপুর মিশন প্রেস

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস (১৮০০-১৮৫৫)  উপযোগিতার মানদন্ডে নয়, পরিস্থিতির চাপেই শ্রীরামপুর প্রাচ্যে মুদ্রণ শিল্পে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৭৭৮ সালে চুঁচুড়ায় বাংলা মুদ্রণের সূচনা হয়। এর ২২ বছর পরে শ্রীরামপুরে শুরু হয় মুদ্রণ। ইতোমধ্যে  কলকাতায় মুদ্রণ শুরু হলেও এর প্রসার হয়েছে অতিমন্থর গতিতে। শ্রীরামপুরে এই শিল্প প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে আছে ইংল্যান্ডের ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটিরপ্রতিনিধিরূপে উইলিয়ম কেরীর ভারত আগমন ও ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা। খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে কেরী বাংলায় আসেন এবং বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৭৯৩ সালে এদেশে এসে তিনি নিজ অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক মাস লড়াই করেন। অতঃপর তিনি উত্তরবঙ্গের মদনাবতীতে স্থিত হন। বাংলায় বাইবেল ছাপার জন্য তিনি প্রেস, কাগজ, কালি ও হরফ (পঞ্চাননের তৈরি) সংগ্রহ করেন। কিন্তু মুদ্রকের অভাবে তিনি ছাপা শুরু করতে পারেন নি। ১৭৯৯ সালে কেরীর সঙ্গে যোগ দিতে আরও মিশনারি আসেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মুদ্রণ বিশারদ উইলিয়ম ওয়ার্ড। মিশনবিরোধী ইংরেজ সরকারের বিতাড়ন এড়াতে মিশনারিরা দিনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। ১৮০০ সালের ১৩ জানুয়ারি কেরী তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্চ মাসে ওয়ার্ডের নেতৃত্বে ছাপাখানার কাজ শুরু হয়।

প্রথমদিকে ওয়ার্ড নিজের হাতেই কম্পোজ করতেন। এভাবে আগস্ট মাসের মধ্যেই নিউটেস্টামেন্টের সেন্টম্যাথুজ ছাপা হয়। মথীয়ের রচনায় মঙ্গল সমাচার নামে এটি প্রকাশ করা হয়। এটি বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ। প্রেসের কাজ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষ দেশীয় কর্মীদের নিয়োগ করা হয়। মিশনারি ওয়ার্ড, ফেলিক্স, উইলিয়ম কেরী ছাড়াও একজন মুদ্রাক্ষরিক, পাঁচজন মুদ্রণকর্মী, একজন কাগজ ভাঁজ করার কাজে নিয়োজিত কর্মী ও একজন গ্রন্থবাঁধাইকার প্রেসের কাজে নিযুক্ত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রণে আশাতিরিক্ত উন্নতি হওয়ায় কেরী ও ওয়ার্ড এই শিল্পের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। দক্ষ হরফ শিল্পি পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুর প্রেসে যোগ দেন এবং হরফ প্রস্ত্ততের একটি কারখানা স্থাপন করেন। পঞ্চানন, তাঁর জামাতা মনোহর এবং নাতি কৃষ্ণচন্দ্র হরফ শিল্পের একটি বিরাট কারখানা গড়ে তোলেন, যেখান হতে তিরিশ বছরের মধ্যে ১৮টি বিভিন্ন ছাঁচের মুদ্রাক্ষরে ৪৫টি ভাষার বই মুদ্রিত হয়। এঁরা সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হরফ প্রস্ত্ততকারী ছিলেন। পঞ্চানন শ্রীরামপুরে একটি হরফ তৈরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে তোলেন। প্রাচ্যে যন্ত্রবিদ্যার এটিই হচ্ছে প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

সততা, নির্ভরশীলতা, ব্যয়ে স্বল্পতা, উন্নত মুদ্রণ প্রভৃতির জন্য অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীরামপুরের মুদ্রণ শিল্প সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এরূপ উন্নত মুদ্রণশালার অস্তিত্ব পছন্দ করে নি। তারা প্রেসটি বন্ধ করে দিতে বারবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দিনেমার সরকারের জন্য তা সম্ভব হয় নি।

মুদ্রণের প্রধান উপাদান কাগজ উৎপাদনেও মিশনারিগণ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। শুরু হয় দেশীয় প্রথায় কাগজ তৈরি। মুদ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে না পারায় ট্রেড মিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিশনারিরা মিল চালাতে ইঞ্জিন ব্যবহার করেন এবং এভাবে প্রাচ্য দেশে শিল্পায়নে নবযুগের সূচনা হয়। অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে শ্রীরামপুর মিশন আলাদা হয়ে যায় এবং কলকাতার ব্যাঙ্ক দেউলিয়া ঘোষণা করলে (১৮৩০) শ্রীরামপুর মিশন একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ১৮০০-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪৫টি ভাষায় ২,১২,০০০ বই ছাপা হয়। সমকালীন বিশ্বে খুব কমসংখ্যক প্রেসই এ ধরনের কৃতিত্বের অধিকারী ছিল।  [শীলা বন্দ্যোপাধ্যায়]