ক্ষতিকর প্রাণী

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:১০, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

ক্ষতিকর প্রাণী (Pest)  মানুষ, ফসল, পশুপাখি বা কৃষি সম্পদের ক্ষতিকর প্রাণী। সাধারণভাবে, এসব প্রাণী উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ বা আমাদের দ্রব্য-সামগ্রী আক্রমণ করে, খেয়ে নষ্ট করে অথবা অন্য কোনোভাবে ক্ষতি করে অর্থনৈতিক মূল্যহ্রাস ঘটায়। সমস্যা, বিরক্তি বা ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী জীবরাও এ দলভুক্ত। ক্ষতিকর প্রাণী বলতে প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় ক্ষতিকর  কীটপতঙ্গ ও সংশ্লিষ্ট স্থলচর সকল সন্ধিপদকেই বোঝায়। বস্ত্ততপক্ষে, শব্দটি সচরাচর এসব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, তবে কিছু মেরুদন্ডী ও অন্যতর অমেরুদন্ডী প্রাণীও এ দলভুক্ত হতে পারে।

ক্ষতিকর প্রাণীদের বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়। যে কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশ পদ্ধতি ক্ষতিসাধনের পরিমাণের ভিত্তিতে সাধারণভাবে এগুলি মুখ্য ও গৌণ হয়ে থাকে। খাদ্যভ্যাস অনুযায়ীও শ্রেণিভুক্ত হতে পারে, যেমন পাতাভুক, রসচোষক, ফল ও কান্ড ছিদ্রকারী, মূলভুক ইত্যাদি।

ফলনের ৫-১০% নষ্ট করলেই একটি পোকা অর্থনৈতিকভাবে সাধারণত ক্ষতিকর বিবেচ্য হতে পারে। স্থানীয় ক্ষতিকর প্রাণীকুলে সাধারণত কয়েকটি প্রধান প্রজাতি থাকে যেগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলিই অধিকাংশ ক্ষতির কারণ এবং সেগুলির জরুরি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। প্রধান দলভুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকরটিকে সচরাচর মূল বালাই (key pest) হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

সারণি বাংলাদেশে গুদামজাত দানাশস্য ও শস্যজাত সামগ্রীর পোকামাকড় ও সেগুলির খাদ্যবস্ত্তর তালিকা।

পতঙ্গের বৈজ্ঞানিক নাম সাধারণ নাম বর্গ/গোত্র পোষক
Sitophilus oryzae ধানের শুঁড়পোকা  Coleoptera Curculionidae চাল, ধান, ধানের তুষ, গম, ময়দা, ভুট্টা, মটর, ছোলা,  খেসারি, মুগ
S. zeamais  ধানের শুঁড়পোকা/ ভুট্টার শুঁড়পোকা Coleoptera Curculionidae   চাল, ধান, গম, ময়দা, ভুট্টা, মটর, ছোলা, খেসারি, মুগ
Tribolium confusum গুলানো শুসরি পোকা  Coleoptera Tenebrionidae ময়দা, গম, ভাঙা চাল, সুজি, দানা মিশ্র খাদ্য
T. castaneum  লাল শুসরি পোকা Coleoptera Tenebrionidae ময়দা, গম, ভাঙা চাল, সুজি, ছোলা, মিশ্রখাদ্য
Latheticus oryzae লম্বা-মাথা শুসরি পোকা  Coleoptera Tenebrionidae  ময়দা, গুঁড়ো শস্য, মিশ্র খাদ্য
Palorus subdepressus  চ্যাপ্টাদেহী শুসরি পোকা  Coleoptera Tenebrionidae   ধান, গম, ময়দা, সুজি, মিশ্রখাদ্য
Alphitobius diaperinum  ছোট কেরিপোকা Coleoptera Tenebrionidae  গম, মিশ্রখাদ্য, ময়দা
A. laevigatus কালো ফাঙ্গাস বিটল Coleoptera Tenebrionidae গমের ভুসি, গম
Tenebroides mauritanicus কাডেল পোকা    Coleoptera Ostomatidae ময়দা, গম, চাল, মিশ্রখাদ্য
Attagenus piceus কালো কার্পেট বিটল Coleoptera Dermestidae ময়দা, গম, মিশ্রখাদ্য
Trogoderma granarium খাপরা বিটল Coleoptera Dermestidae ধান, চাল, গম, ময়দা, মটর
Dermestes maculatus শুঁটকি মাছের পোকা Coleoptera Dermestidae নানা জাতের শুঁটকি
Lophocateres pusillus --- Coleoptera Lophocateridae    ধান, চাল, গম, মটর, হলদি
Necrobia rufipes  --- Coleoptera Cleridae ধান, গম, মিশ্রখাদ্য, শুঁটকিমাছ
Carpophilus dimidiatus ---   Coleoptera Nitidulidae চাল, ভুট্টা, ময়দা
Laemophloeus pusillus চ্যাপ্টা বিটল Coleoptera Cucujiidae চাল, গম, ধান, সুজি, মটর, মুগ, মিশ্রখাদ
Oryzaephilus surinamensis শুমরি পোকা Coleoptera Silvanidae ময়দা, চাল, মটর, গম, ভুসি, মিশ্র খাদ্য
O. mercator --- Coleoptera Silvanidae চাল, গম, ময়দা
Ahaserus advena --- Coleoptera Silvanidae গম, মিশ্রখাদ্য
Rhizopertha dominica কেরিপোকা  Coleoptera Bostrichidae  চাল, গম, ময়দা, সুজি, ভুট্টা
Dinoderous ocellaris ঘুণপোকা Coleoptera Bostrichidae চাল, গম, সুজি
Lasioderma serricorne সিগারেটের বিটল  Coleoptera Anobiidae  চালের গুঁড়া, হলদি
Stegobium paniceum --- Coleoptera Anobiidae বিস্কুট, মরিচ
Callosobruchus  chinensis ডালের পোকা  Coleoptera Bruchidae  মটর, ছোলা, খেসারি, মুগ
C. analis ডালের পোকা Coleoptera Bruchidae মটর, ছোলা, খেসারি, মুগ
Bruchus pisorum  মটরশুঁটির শুঁড়পোকা Coleoptera Bruchidae মটর
Sitotroga cerealella ধানের সরুই পোকা  Lepidoptera Gelechiidae ধান, ভুট্টা, ময়দা, গম
Phthorimaea operculella আলুর সুতলি পোকা Lepidoptera Gelechiidae  আলু
Plodia interpunctella সুরুই পোকা  Lepidoptera Phycitidae ভুট্টা, মটর, চাল, গম
Ephestia (=Anagasta) kuhniella ভূমধ্যসাগরীয় ময়দার মথ Lepidoptera Phycitidae গম
E. cautella উষ্ণমন্ডলের গুদামের মথ  Lepidoptera Phycitidae গম
E. elutella গুদামের মথ Lepidoptera Phycitidae গম, চাল
Corcyra cephalonica চালের মথ  Lepidoptera Phycitidae চাল, সুজি
Glycyphagus destructor শস্যের মাইট  Acarina Glycyphagidae বিভিন্ন গুদামজাত শস্য
Acarus siro ময়দার মাইট Acarina Glycyphagidae গম

প্রতিটি কৃষি-পরিবেশে সাধারণত মাত্র একটি অথবা দুটি প্রধান ক্ষতিকর প্রজাতি থাকে যাদের বংশবৃদ্ধি ও টিকে থাকার ক্ষমতা অধিক। ফসল মৌসুমে ওগুলিকে সাধারণত ব্যাপক সংখ্যায় দেখা যায় (নিয়মিত বালাই), আর কিছু কিছু প্রজাতি কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় ক্ষতিকর হয়ে ওঠে (অনিয়মিত বালাই)। কোনো কোনোটি স্বাভাবিকভাবে সামান্য ক্ষতি করে, কিন্তু পরিবেশ অনুকূল হলে ব্যাপক ক্ষতি ঘটায় (সম্ভাব্য বালাই)।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ফসল, ফলগাছ ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতিকর প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত সাত শতাধিক কীটপতঙ্গ ও মাইট-এর মধ্যে দু শতাধিক প্রজাতি প্রধান ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবশ্য তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ নয়। বিভিন্ন ফসল ও পণ্যের ক্ষতিকর প্রাণীদের উপযুক্ত শিরোনামে পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।  [এস.এম হুমায়ূন কবির]

বস্ত্রের পেস্ট (Pests of fabrics)  হিসেবে বাংলাদেশে ডারমেস্টিড বিটল (dermestid beetles) এবং বস্ত্র মথ (clothes moths) গুরুত্বপূর্ণ। Dermestidae গোত্রের অন্তর্গত কালো কার্পেট বিটল, Attagenus megatoma, কার্পেট বিটল, Anthrenus scrophulariae এবং A. fasciatus কখনও কখনও বাড়ির কার্পেট, গদি কিংবা অন্য কাপড়-চোপড়ের মারাত্মক ক্ষতি করে। কালো কার্পেট বিটল দেখতে ছাই-রঙা কালো। অন্য কার্পেট বিটল দুটির রং সাদা-কালোয় মেশানো। এসব  বিটল তাদের লার্ভা দশাতেই বেশি ক্ষতি করে থাকে। বস্ত্র মথ Lepidoptera বর্গের Tineidae গোত্রের ছোট মথ। কাপড় এবং পশমজাত দ্রব্যের এরা ক্ষতি করে। এদের মধ্যে Tineola bisselliella প্রজাতিটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক T. bisselliella মথের রং ফ্যাকাশে হলুদ এবং এদের পাখনায় গাঢ় দাগ অনুপস্থিত। এর লার্ভা, অাঁশ, পশম, রেশম কিংবা অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। দেহের চারপাশে এরা কোনো আবরণ তৈরি করে না। কিন্তু লার্ভা দশা শেষ হলে T. bisselliella তার খাবারের টুকরাগুলিকে নিজ দেহ নিঃসৃত সিল্ক দিয়ে জড়িয়ে শরীরের চারধারে একটি কোকুন (cocoon) তৈরি করে। T. pellionella প্রজাতিটিও গুরুত্বপূর্ণ। এরা লার্ভা দশাতেই খাবারের টুকরো নিজ দেহ নিঃসৃত সিল্ক দিয়ে জড়িয়ে শরীরের চারধারে একটি দুপ্রান্ত খোলা নলাকৃতি আবরণ তৈরি করে নেয়। লার্ভা এ আবরণের মধ্যে থেকেই খাদ্য খায় এবং তার ভেতরেই পিউপাতে (pupa) পরিণত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক T. pellionella-এর দেহ খয়েরি রঙের এবং এদের প্রতিটি অগ্রডানায় তিনটি গাঢ় দাগ থাকে।

চামড়ার পেস্ট (Pests of leather)  চামড়া অথবা চামড়া জাতদ্রব্য কোনো কোনো সময় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর মধ্যে Coleoptera বর্গের অন্তর্গত Dermestidae গোত্রের সদস্যরাই চামড়ার পেস্ট হিসেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এরা প্রায় সবাই মৃতভোজী এবং চামড়া, পশম প্রভৃতি দ্রব্য খায়। তবে লার্ভা অবস্থায় এরা চামড়াজাত দ্রব্যের বেশি ক্ষতি করে। প্রাপ্তবয়স্ক ডারমেসটিডস (dermestids) আকারে ছোট, ২-১২ মিমি লম্বা, ডিম্বাকৃতি কিংবা লম্বাটে-ডিম্বাকার, দেহের উপরিভাগ উত্তল। এদের শুঙ্গ খাটো এবং গদাকৃতির। দেহ সাধারণত রোমযুক্ত অথবা অাঁশ দিয়ে ঢাকা। বাংলাদেশে সাধারণত Dermestes vulpinus এবং D. lardarius এ দুটি প্রজাতি চামড়ার পেস্ট হিসেবে বেশি দেখা যায়। [এ.জে হাওলাদার]

গুদামজাত শস্যের ক্ষতিকর পোকামাকড়  গোলাঘরে রাখা শস্য বা শস্যজাত সামগ্রী ধ্বংসকারী বা অবনমনকারী সন্ধীপদী বা অন্যান্য প্রাণী। সঞ্চিত খাদ্যসামগ্রী বা বীজের পোকামাকড় নিয়ে বাংলাদেশে তেমন ব্যাপক জরিপ করা হয় নি। এ দেশে গুদামজাত শস্যের প্রায় ৪০ প্রজাতির পতঙ্গ তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে তালিকাটিকে পূর্ণাঙ্গ বলা যায় না।

কেবল গুদামের পোকামাকড় দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ দিয়েই খাদ্য বা বীজের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না। খাদ্যদ্রব্যে পোকামাকড়ের বিষ্ঠা বা কণামাত্র থাকলেও তা ভোক্তার কাছে আপত্তিকর হবে। তাই পোকামাকড় খাদ্যদ্রব্যের খুব সামান্য পরিমাণ নষ্ট করলেও তাতে আসলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রচুর। মোট ২৯ বর্গের কীটপতঙ্গের মধ্যে মাত্র ৯ বর্গের পোকামাকড় বাংলাদেশে গুদামজাত দ্রব্য-সামগ্রীর ক্ষতিসাধন করে এবং তন্মধ্যে আবার কিছু কিছু পোকার যোগসাজশ নিতান্তই আকস্মিক। অনেক পোকা যেমন, সিলভার ফিস, ফায়ার ব্রাট, তেলাপোকা, উরচুঙ্গা, ইয়ারউইগ (earwigs) ও সসিড (psocid) সর্বদাই বসতবাড়িতে এবং প্রায়ই গুদামজাত দানাশস্যে দেখা যায়। কিন্তু এগুলি বালাই হিসেবে গণ্য হয় না। সঠিক হিসাবে গুদামজাত সামগ্রীর কীটপতঙ্গ ৫ বর্গের অন্তর্ভুক্ত, তন্মধ্যে Coleoptera ও Lepidoptera সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাকি ৩ বর্গের মধ্যে Hymenoptera বর্গভুক্ত পোকাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি আর Diptera ও Hemiptera বর্গগুলি গুরুত্বহীন। এ শেষোক্ত ৩ বর্গের পোকাগুলি প্রকৃতপক্ষে আপদ নয়, এরা অন্য পোকার পরজীবী। বাংলাদেশে আরশোলার কমপক্ষে চারটি প্রজাতি আছে এবং সেগুলি গুদামজাত প্রায় সকল খাবারেই ভাগ বসায়।

অনুমান করা হয় যে, বিভিন্ন গোত্রভুক্ত প্রায় ৬০০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুদামজাত সামগ্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তবে এদের সবগুলিই ক্ষতিকর নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধান ও ডাল ফসল উৎপাদক দেশ। এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর জন্য গুদামজাত সামগ্রীতে পোকার আক্রমণ অপেক্ষাকৃত বেশি। এদেশে প্রায় সারাবছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করা হয় এবং সেগুলির সঙ্গে সম্ভবত প্রায়ই নতুন নতুন কীটপতঙ্গের আগমন ঘটে। এখানে শস্য গুদামজাতকরণে ব্যবহূত বিভিন্ন পদ্ধতির বেশির ভাগই অবৈজ্ঞানিক এবং শস্যে পোকা আক্রমণের ঝুঁকি ও পরিষ্কার-পরিছন্নতার ব্যাপার প্রায়শই উপেক্ষিত। নিয়মানুযায়ী ছোট ছোট ভাগে স্তূপীকৃত শস্যের চেয়ে একই পরিমাণ শস্য একত্রে একটি গুদামে রাখলে বেশি ভাল থাকে। বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক বৃহৎ শস্যগোলা বা গুদাম অপ্রতুল। গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে শস্য গুদামজাত করা হয় এবং একই শস্যগোলা বা গুদাম ভালভাবে পরিষ্কার না করেই বছরের পর বছর তা ব্যবহূত হওয়ার ফলে সেগুলিতে খুব তাড়াতাড়ি পোকার আক্রমণ ঘটে। গুদামজাত শস্যভুক কীটপতঙ্গের মধ্যে Coleoptera বর্গের পোকাই সর্বাধিক এবং তারপরই Lepidoptera বর্গ (সারণি)। এ ধরনের পোকার মধ্যে আছে দু প্রজাতির শুঁড়পোকা ও সাত প্রজাতির শুসরিজাতীয় পোকা। ভুট্টার শুঁড়পোকা (Sitophilus zeamais) প্রজাতিটি বাংলাদেশে নবাগত মনে হয়। ইতঃপূর্বে বিশ্বের এতদঞ্চলে এ পোকার কোনো হদিস ছিল না। ১৯৭৬ সালে তেজগাঁও সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে সংগৃহীত গমের তিনটি গাদার নমুনায় এ প্রজাতিটি দেখা যায়। উৎপত্তি স্থান সঠিক না জানা গেলেও এটি উত্তর আমেরিকা থেকে আগত বলে ধারণা করা হয়।

শুসরি জাতীয় পতঙ্গরা সরাসরি ক্ষতিকর না হলেও অবশ্যই দূষণীয়। এগুলি প্রায়ই ভাঙা ও বিনষ্ট  দানাশস্য, আটা, সুজি, ময়দা বা ডালের গুঁড়িতে পাওয়া যায়। Dermestes maculatus মূলত শুঁটকিমাছের একটি পোকা আর খাপরা বিটল (Trogoderma granarium) প্রায় সবসময়ই শস্যগোলায় দেখা যায়। সাধারণভাবে ডালের বিটল ও মটরশুঁটির শুঁড়পোকা নামে পরিচিত Bruchidae গোত্রভুক্ত পোকা বাংলাদেশের অধিকাংশ ডাল শস্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ডালের পোকা Callosobruchus chinensis ও C. analis অনেকগুলি পোষকে আসক্ত থাকলেও Bruchus pisorum থাকে শুধুই মটরশুঁটিতে।

Hymenoptera বর্গের কয়েকটি পরজীবী প্রজাতি গুদামজাত শস্যে থাকে এবং প্রায়শই অজস্র পরিমাণে। পরজীবীতার মাধ্যমে এগুলি অনেক ক্ষতিকর পোকাকে দমন করলেও শস্যে তাদের উপস্থিতি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের নিকট সর্বদাই আপত্তিকর।

Acarus siro বাংলাদেশে সম্ভবত দানাশস্য ও ময়দার সর্বাধিক পরিচিত মাইটজাতীয় ক্ষতিকর পতঙ্গ। গ্রীষ্মকালে এগুলি দ্রুত বংশবিস্তার করে। মাঝেমধ্যে এদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যায় বিদ্যমান আরেকটি মাইটও (Glycyphagus destructor) দেখা যায়।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

ক্ষতিকর মেরুদন্ডী (Vertebrate pest)  ফসল, ফসলজাত সামগ্রী ও অন্যান্য সামগ্রীর জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর মেরুদন্ডী প্রাণী। এগুলির মধ্যে ইঁদুরজাতীয় প্রাণীগুলিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছু  পাখি, খরগোশ এবং বন্য স্তন্যপায়ীর কিছু প্রজাতি প্রায়শ অর্থনৈতিক লোকসান ঘটায়।

বাংলাদেশে চারটি গোত্রভুক্ত প্রায় ২৪টি প্রজাতির ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর বাস। এদের দ্বারা ফসলহানির পরিমাণ গমের ৮-১২%, আমন ধানের প্রায় ৪%, এবং আনারসের ৮-৯%। ইঁদুররা বাঁধ, সড়ক, পানিসেচ খাল, বাড়িঘর এবং অন্যান্য কাঠামোরও ক্ষতি করে। বাংলাদেশে কৃষি ফসল ও বাড়িঘরের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর ইঁদুর হলো মোল র‌্যাট, ধাড়ি ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, এবং খাটো-লেজ মোল র‌্যাট।

ইংরেজি.স্থানীয় নাম  বৈজ্ঞানিক নাম বিস্তৃতি ও ক্ষতি
Lesser Bandicoot Rat/Black Field Rat (মোল র‌্যাট) Bandicota bengalensis সারাদেশে; সকল ধানক্ষেত, গুদাম, সড়ক ও পানিসেচ প্রণালীতে, বসতি অঞ্চলে।
Greater Bandicoot Rat/Big Black Field Rat (ধাড়ি ইঁদুর) B.  indica গোটা ভাটি এলাকায়; নিম্নাঞ্চলের ফসলক্ষেতে, আমনক্ষেতে।
Short-tailed Mole Rat (খাটো-লেজ মোল র‌্যাট)  Nesokia indica দেশের পশ্চিমাঞ্চলে; আখ, মূলজ ফসল ও মাঠের ফসলে।
House Rat/Roof Rat/Black Rat Rattus rattus  সারা দেশে; খামারবাড়িতে, ভাঁড়ারে, ঘরে, সবজিক্ষেত ও ফলবাগানে।
Polynesian Rat R. exulans দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায়; গুদামে, সবজিক্ষেতে ও ফলের গাছে (নারিকেল)।
Brown Rat/Norway Rat R. norvegicus বন্দর ও শহরে; শস্য গুদামে।
Soft-furred Field Rat Millardia meltada উত্তর ও পশ্চিম অংশে; প্রধানত গম ও ধানক্ষেতে; পানিসেচিত ক্ষেতের লাগোয়া অন্যান্য ফসলে।
House Mouse (নেংটি ইঁদুর) Mus musculus সারা দেশে; বাড়িঘরে, বসতিতে, শস্যভাঁড়ারে।
Field Mouse M. booduga সারা দেশে; শস্যমাঠে (ডাল) ও ভাঁড়ারে।
Field Mouse  M. cervicolor সারা দেশে; মাঠের শস্যফসলে, ভাঁড়ারে।
Bamboo Rat Cannomys badius পাহাড় ও বনাঞ্চলে; বাঁশের কচি মূল ও কান্ডে, মাঠের ফসলে, বুনো গাছ, চা গাছের শিকড় ও রবার গাছে।
Rose-ringed Parakeet (টিয়া)  Psittacula krameri সারা দেশে; পাকা ধান, গম, সূর্যমুখী ক্ষেতে ও ফল বাগানে।
Baya Weaver (বাবুই)  Ploceus philippinus সারা দেশে; পাকা ধান ও গমক্ষেতে।
Golden Jackaষ (শিয়াল)  Canis aureus সারা দেশে; আখ, তরমুজ, আনারস, ভুট্টা, কাঁঠাল, চীনাবাদাম, মিষ্টি আলু ইত্যাদির ক্ষেত ও বাগানে।

বাংলাদেশে Chiroptera বর্গের আটটি গোত্রভুক্ত প্রায় ৩০ প্রজাতির বাদুড়ের বাস। ফলখেকো বাদুড়রা  কলাপেয়ারালিচুআম ও অন্যান্য ফলের ব্যাপক ক্ষতি করে। দালানকোঠায়  বাদুড় ও চামচিকার আনাগোনা এবং বারান্দা ও দেয়ালে এদের ঝুলে থাকা অত্যন্ত বিরক্তিকর। অনেক সময়ে শূকর ও  হাতি শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলাফেরার দরুন ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফসল তোলার আগে ফসলের গাছ ও শস্য খেয়ে এরা ক্ষতি করে।  [সন্তোষ কুমার সরকার]

ক্ষতিকর প্রাণী দমন (pest control) যে কোনো ধরনের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে অনিষ্টকারী প্রাণীর নিয়ন্ত্রণ বা দমন পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিকর প্রাণীকে মারা, তাদের সংখ্যা ও ক্ষতির মাত্রা কমানো এবং বিস্তারে বাধা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই ক্ষতিকর প্রাণী দমন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। যদিও প্রাকৃতিক কিছু নিয়ামক যেমন পরভুক প্রাণী, পরজীবী, রোগজীবাণু, বন্যা, ঝড়ঝঞ্ঝাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ক্ষতিকর প্রাণী দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তথাপি এ কাজের জন্য কতিপয় প্রায়োগিক ব্যবস্থা মানুষ দীর্ঘদিন হলো গ্রহণ করে আসছে।

রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (chemical control)  বালাইয়ের সংখ্যা হ্রাস বা ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে তাদের মধ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি বা তাদের বিশেষ স্থানসমূহ থেকে বিতাড়িত করতে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। ১৯৫১ সাল থেকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে বালাইনাশক (pesticide) ব্যবহূত হচ্ছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১১,০০০ মে টন বিভিন্ন বালাইনাশক ব্যবহূত হয়। এদের মধ্যে রয়েছে কীটনাশক (insecticide), অ্যাকারিসাইড (acaricide), ছত্রাকনাশক (fungicide),  আগাছানাশক, ক্রিমিনাশক, ইঁদুরনাশক, প্রভৃতি। প্রায় ২৪৫টি কীটনাশক সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জানা গেছে যে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২০% কৃষক কীটনাশক ব্যবহার করছে। কীটনাশকসমূহ কদাচিৎ পূর্ণঘনমাত্রায় ব্যবহূত হয়, তাই মাত্রা হ্রাস, পরিমাণ বৃদ্ধি, এবং সেগুলির প্রয়োগ সহজতর করার মতো করে ফর্মুলেটেড করা থাকে। সাধারণ ফর্মুলেশনগুলি হচ্ছে গুড়া, দানাদার, কীটনাশক সার মিশ্রণ, দ্রবণীয় পাউডার, দ্রবণ, ইমালশানযোগ্য কীটনাশক (emulsifiable concentrates), এরোসল ও ফিউমিগ্যান্ট (fumigants)। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র ও নিরক্ষর, বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলি বিস্তারিতভাবে তারা জানে না, বরং সর্বদা দ্রুত ও সহজ সমাধান চায়। বালাইনাশকসমূহের বাজারে সহজপ্রাপ্যতা, কার্যকর প্রতিষেধক ক্রিয়া, অধিকাংশ পরিবেশে প্রয়োগযোগ্যতা, পরিবর্তিত কৃষিতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতির চাহিদা মেটানোর নমনীয়তা ও অর্থনৈতিক সুবিধাসমূহ রয়েছে বলে বাংলাদেশী কৃষকদের জন্য বালাই নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার এখনও অত্যন্ত উপযোগী পদ্ধতি। সাধারণত ধান,  পাটতুলাআখশাকসবজি ও সরিষার বালাইসমূহ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক ব্যবহূত হয়। Bangladesh Pesticide Association-এর এক তথ্য থেকে জানা যায় ২০০৬ সালে মোট প্রায় ২৫,৪৬৮ মে টন বালাইনাশক এদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৪,০৬২ মে টন দানাদার কীটনাশক, ২,৫১১ মে টন তরল কীটনাশক, ৩২৪ মে টন গুড়া কীটনাশক, ৫,৭৭২ মে টন ছত্রাকনাশক, ২,৭৭৫ মে টন আগাছানাশক এবং ২৪ মে টন ইঁদুরনাশক।

পরিচর্যামূলক দমন (cultural control)  উন্নত কৃষিপদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণীর সংখ্যা বা ক্ষতির মাত্রা কমানো। এতে রয়েছে নির্দিষ্ট ফসলের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট চাষপ্রণালী অনুশীলন যা আনুষঙ্গিকভাবে কীটপতঙ্গের সম্ভাব্য সংখ্যা ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। গভীর চাষ হলো একটি ব্যবস্থা যাতে প্রায়শ কীটপতঙ্গ মাটি চাপা পড়ে মারা যায়। আরেকটি ব্যবস্থা হলো কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থল, আগাছা ও ফসলের অবশিষ্টাংশ অপসারণ ও পোড়ানো। বিভিন্ন ফসলের পর্যায়িক চাষ (crop rotation) ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনের সহায়ক। সতর্কভাবে বাছাই করা একাধিক ফসল পাশ্ববর্তী জমিতে চাষ করলে তাতে কীটপতঙ্গঘটিত ক্ষতি হ্রাস পায়। প্রধান ফসলের কাছাকাছি জমিতে ফাঁদ হিসেবে ছোটখাটো ক্ষেতে কীটপ্রবণ বা পতঙ্গকুলের পছন্দসই ফসলের আবাদ বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া ফসলে কীটপতঙ্গের বালাই দমনে বাংলাদেশে প্রচলিত আরও কিছু পদ্ধতি আছে যেমন, ভাল বীজ ও ফসলের উন্নত জাত নির্বাচন, যথাযথ বীজতলা প্রস্ত্তত, সঠিক সারপ্রয়োগ ও মৃত্তিকা সংরক্ষণ অনুশীলন ইত্যাদি।

যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ (mechanical control)  খামারে সচরাচর অনুসৃত ‘ধরো ও মারো’ এবং ‘উপড়াও ও পোড়াও’ নীতির পরিবর্তে বিশেষ যান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের সংখ্যাহ্রাস। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবস্থাবলীর মধ্যে রয়েছে কীটপতঙ্গের ডিম, লার্ভা ও দুর্বল পতঙ্গদের হাতে ধরা ও ধ্বংস করা। উড়ন্ত ও পরিযায়ী কীটপতঙ্গ সংগ্রহের জন্য ব্যবহূত হয় হস্তচালিত জাল ও ব্যাগ এবং উল্টোমুখী ছাতা। বসতবাড়ির, ফসলের ও ফলের অনেক কীটপতঙ্গ সংগ্রহ করা যায় আলোর ফাঁদের সাহায্যে। তুলার পোকা ও ঝোপঝাড়ের কিছু পতঙ্গ গাছ ঝাঁকিয়ে নিচে ফেলে ধরা ও মারা যায়। ফাঁদ-ফসল ফলানো, আলো ও চোষণ ফাঁদ ব্যবহার, শস্যের মাঠে খড়কুটো পোড়ানো বহুলব্যবহূত পদ্ধতি। আরও আছে জানালা ও দরজায় জাল বসানো, মশারি ব্যবহার, গাছে আঠালো পট্টি লাগানো, এবং ছোট গাছ ঘিরে জালি-কাপড়ের ঢাকনি ও কাগজের কলার ব্যবহার।

আইনগত নিয়ন্ত্রণ (legal control)  ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের অনুপ্রবেশ বা বিস্তার প্রতিরোধের জন্য বলবৎ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা সঙ্গনিরোধের (quarantine) মতো বিধিনিষেধ আরোপকারী আইন কার্যকর করার মাধ্যমে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ। খাদ্যে বিষাক্ত অবস্থা নির্ণয়, প্রতারণা থেকে ক্রেতাদের রক্ষার জন্য কীটনাশক বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ, কীটপতঙ্গ নিধন অভিযান অনুমোদন ও তাতে সহায়তা, নিয়ন্ত্রণ-কৌশল উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদানও এ আইনের এখতিয়ারভুক্ত। বাংলাদেশে যে ১২টি সঙ্গনিরোধ তদন্ত কেন্দ্র রয়েছে সেগুলির অবস্থান জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এবং স্থলসীমান্ত ঘাটিগুলি বেনাপোল (যশোর), বুড়িমারি (লালমনিরহাট), তামাবিল (সিলেট), দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা), হিলি (দিনাজপুর) ও সোনা মসজিদ (নবাবগঞ্জ)। কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই সম্পর্কিত সর্বশেষ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে উদ্ভিদ আমদানির বিধিবিধান প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা ও সংশোধন করা হচ্ছে।  [মনোয়ার আহমদ এবং মাসুম আহমদ]

জীবজ দমন (biological control) ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনের জন্য পরজীবী, পরভুক ও রোগজীবাণু ব্যবহার। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, স্থায়ী ও কম ব্যয়সাপেক্ষ বিধায় নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে এর কতকগুলি সুবিধা রয়েছে। তবে ছোটখাটো অসুবিধাও আছে আর তা হলো জীবজ দমন কর্মসূচি বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ, এতে গবেষণা ও স্থাপনার প্রাথমিক উদ্যোগ লাগে। এ ছাড়া ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের অনেকগুলি প্রাকৃতিক শত্রু সুনির্দিষ্ট শিকারকে বা তাদের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রজাতিকেই শুধু আক্রমণ করে, তাতে লক্ষ্যবহির্ভূতরা টিকে থাকে।

সফল প্রাকৃতিক শত্রুর উল্লেখ্য গুণাবলী ক. অনুসন্ধান ও বংশবৃদ্ধির উচ্চক্ষমতা; খ. শিকারের সুনির্দিষ্টতার উচ্চমাত্রা; গ. পোষকের সঙ্গে সুসমন্বয় (synchronization); এবং ঘ. বাস্তব্য-জলবায়ুগত ব্যাপক পরিসরের সঙ্গে উচ্চমানের অভিযোজন দক্ষতা।

বাংলাদেশের অন্তত ১৫১টি প্রজাতির প্রধান ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের মধ্যে অধিকাংশের প্রাকৃতিক শত্রু রয়েছে। প্রাকৃতিক শত্রুদের মধ্যে hymenopterous (parasitoid) প্রজাতিগুলির প্রাধান্য রয়েছে, অতঃপর আছে coccinellid পরভুকেরা। মোটামুটি parasitoid প্রজাতিদের মধ্যে chalcidoid আছে প্রথম স্থানে, তারপর ক্রমান্বয়ে ichneumonid, pteromalid ও tachinid প্রজাতিগুলির অবস্থান। মাঠ জরিপ ও তালিকা প্রণয়ন ছাড়া জৈব-নিয়ন্ত্রক হিসেবে এদের অধিকাংশ প্রজাতির ওপর কোনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হয় নি। Coccinellid-এর কতক প্রজাতির  জাবপোকা খাওয়ার হার নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ দেখা গেছে। কিন্তু জাবপোকার সংখ্যা নিয়ন্ত্রক হিসেবে এদের ফলপ্রসূতা সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা হয়েছে খুবই সামান্য। ওকুমা ও তাঁর সঙ্গীরা ১৯৯৩ সালে IPSA,  বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাপানের Kyushu বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে ধানক্ষেতের মাকড়সার একটি সচিত্র মনোগ্রাফ প্রস্ত্তত করেছেন।

বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে রোগজীবাণু ব্যবহারের ওপর বিশদ কোনো গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয় নি। ধানের শিষ কাটা লেদাপোকা ও অন্যান্য লেদাপোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে জীবাণুঘটিত কীটনাশক হিসেবে Bacillus thuringiensis নিয়ে পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষণে সাফল্য দেখা গিয়েছে।  [মোঃ জিন্নাতুল আলম]

বিকিরণের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ  তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ (ionizing radiation) প্রয়োগে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমন। এ বিকিরণ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। এ প্রভাব যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় ব্যবহূত হতে পারে। বাংলাদেশে বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে ১২টি খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণ অনুমোদন করা হয়েছে। বিকিরণ বিশেষভাবে ফলমূল, শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজতর করে। বিকিরণ ব্যবহারের সম্ভাব্য তৃতীয় ক্ষেত্রটি হলো বন্ধ্যা পুরুষ পতঙ্গের মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি যা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় যেমন, গবাদিপশুর মাছি (screwworm flies), ফলের মাছি, সেটসি মাছি, কডলিং মথ (codling moth), তুলার বোলওয়ার্ম, পিঁয়াজের মাছি (onion fly) ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যবহূত হচ্ছে।  [রেজা মোঃ শাহজাহান]