বুদ্ধিজীবী

বুদ্ধিজীবী সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সঙ্কটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিকনির্দেশকারী পন্ডিত। এই সম্প্রদায়ের লোকদের বোঝাতে রাশিয়ায় উনিশ শতকের ষাটের দশকে প্রথম intelligentsia শব্দটি ব্যবহূত হয়। তখন রাশিয়ার একটি গোষ্ঠী তাঁদের নিজেদের বিদ্বৎসমাজকে বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিপ্লব, নিরীশ্বরবাদ ও বস্ত্তবাদে বিশ্বাস করে তাঁরা নিজেদের একটি পৃথক ও প্রভাবশালী বৌদ্ধিক জনগোষ্ঠী মনে করতেন। তাঁদের এই স্বাতন্ত্র্যসূচক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি Nikolay Chemyshevsky-র কাল্পনিক উপন্যাস Chtodelat (১৮৬৩) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। উপন্যাসটির শিরোনামের অর্থ ‘কি করণীয়?’। এটি পড়ে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ঘোষণা করেন যে, সমাজতন্ত্রের প্রচারে সাহিত্য একটি কৌশল হওয়া উচিত। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ক্ষমতা দখলকারী লেনিন ও স্টালিনসহ বিখ্যাত বলশেভিক নেতাদের অনেকেই এই সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি এবং চেখভের মতো রাশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের অধিকাংশই ‘বৌদ্ধিক অসহিষ্ণুতা, অতিশয় তত্ত্বপ্রিয়তা এবং বিপ্লবের পক্ষে উপযোগিতা বিচারে নৈতিকতাকে মূল্যায়ন’ করার কারণে এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নিন্দা করতেন।

এরপর থেকে intelligentsia শব্দটি অত্যুগ্র ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিরোধী এক সমাজদর্শনের জন্ম দেয়। তবে উনিশ শতকের রাশিয়া থেকে শব্দটি যখন ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত হয় তখন তার অর্থের বিস্তার ঘটে। Oxford English Dictionary শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে: ‘The class consisting of the educated portion of the population and regarded as capable of forming public opinion.’ (এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত এবং যারা জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম)। শব্দটির এই আধুনিক ব্যাখ্যায় টলস্টয় এবং Chemyshevsky উভয়কেই একটি বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব এবং গোষ্ঠীভিত্তিক যে শ্রেণিবিশ্লেষণ তা সম্ভবত বুর্জোয়ার সঙ্গে এই intelligentsia-কে এক করে দিয়েছে।

বর্তমানে intelligentsia শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহূত হয় সাধারণত সমাজের সর্বোচ্চ বিদ্বান ও সর্বাপেক্ষা স্পষ্টবাদী গোষ্ঠীকে বোঝাতে, যাঁদেরকে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই ‘বাচাল শ্রেণি’ (chattering class) বলে আখ্যায়িত করা হয়। এঁরা ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় উভয় ঐতিহ্যকেই গ্রহণ করেছেন। মনে করা হয় যে, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় স্বসমাজের জনমত, রাজনীতি ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এঁদের এই প্রভাবশক্তির জন্য আন্তোনিও গ্রামশি সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বলে মনে করেন। তবে এ সম্প্রদায়ের সকলেই যে ব্যক্তিগতভাবে এরূপ প্রভাব খাটাতে সক্ষম তা নয়।

বাংলায় intelligentsia-র সন্ধান পাওয়া যায় উনিশ শতকের প্রথমভাগে। সে সময় রাজা  রামমোহন রায় এবং  ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি প্রগতিবাদী গোষ্ঠী এমন কিছু প্রশ্ন তোলে যা সমকালীন বাংলার সমাজকে বিস্মিত করে। তবে বাংলায় এই বুদ্ধিবাদী আন্দোলনের মূল নিহিত অতীতে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার বুদ্ধিজীবী হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের বাংলা ছিল প্রধানত যাজক-প্রভাবিত একটি রাষ্ট্র। তখন বুদ্ধিজীবী বলতে এই যাজকদেরই বোঝানো হতো এবং তাঁরাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁদের সামাজিক মর্যাদাই একটি বৃহত্তর সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় ও কৌশল আবিষ্কারে প্রেরণা জোগাত। সমাজে তাঁদের আধিপত্য বজায় রাখার প্রধান হতিয়ার ছিল বর্ণপ্রথা। হিন্দুদের এই বর্ণপ্রথা সমাজকে জন্মের ভিত্তিতে কয়েকটি পেশাগত সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে। এর ফলে বিদ্যাচর্চা কেবল হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জন্মগত কারণে জনসংখ্যার বৃহদংশ রয়ে যায় এই intelligentsia-র বৃত্তের বাইরে। অবর্ণবাদী বৌদ্ধদের সময় এই যাজক শ্রেণির বাইরের জনগণের জন্য বিদ্যার্জনের একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব অল্প সংখ্যক লোকের পক্ষেই সে সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়েছিল এবং আরও কম সংখ্যক লোক এ সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।

আফগান ও মুগল সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলা ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমান সুলতান ও সুবেদারদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। সে সময়ে এক বিরাট জনসংখ্যা হিন্দুধর্ম ও  বৌদ্ধধর্ম থেকে  ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই ধর্মান্তর প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছিল অধ্যাত্মবাদী ও বুদ্ধিজীবী সুফিদের দ্বারা, সেনাপতিদের দ্বারা নয়। উনিশ শতকে বাংলার নবাবরা আমির ও মুৎসুদ্দিদের সমন্বয়ে দরবার পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। মুৎসুদ্দিদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের শিক্ষিত ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ব্রাহ্মণ, আর বিচারকমন্ডলীতে ছিলেন শিক্ষিত মুসলিম মুফতিরা।

আঠারো শতকে অনেক ইউরোপীয়ান বাণিজ্য কোম্পানি বাংলায় এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। সেই কোম্পানিসমূহ এবং স্থানীয় সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য উভয় পক্ষই উকিল ও বেনিয়া নিয়োগ করত। ইউরোপীয়ানরা বেনিয়াদের চমৎকার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তখন চীনা বেনিয়ারাও একই ভূমিকা পালন করেছেন। চীনের ইতিহাসে এই বেনিয়ারা ছিলেন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সদস্য। বাংলার বেনিয়াদের সম্পর্কে ইউরোপীয়ানদের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, তাঁরাও এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। তাঁদের পরামর্শ জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যতই ক্ষতিকর বলে মনে করা হোক না কেন, তাঁরা যথার্থ সাফল্যের সঙ্গে মুগল সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, দেশে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যসুবিধা এবং কলকাতায় জমিদারি দিলে তা দেশের পক্ষে এবং দেশ শাসনের পক্ষেও উপকারী হবে। তাঁরা সরকারকে বাংলার সব ব্যবসাকেন্দ্রে সুবিধাজনক শর্তে ইংরেজ ও ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলিকে কারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে দেওয়ার যৌক্তিকতা বোঝাতেও সক্ষম হন। এভাবে একটি উপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনের কাজে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আঠারো শতকের শেষভাগের মরমি কবি জয়নারায়ণ ঘোষাল ছিলেন ইংরেজদের একজন বেনিয়া বা মধ্যস্থতাকারী। রাজা রামমোহন রায়ও ছিলেন তেমনি একজন। তিনি ১৮১৫ সালে কলকাতায় বসতি স্থাপন করার পূর্ব পর্যন্ত কোম্পানি কর্মকর্তাদের একজন মুৎসুদ্দি ও দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন।

উপনিবেশপূর্ব যুগের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। তখন রাজকীয় ভাষা ফারসি এবং ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃত ও পালিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হতো। সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাগুলি সব সময় যাজক ও শাসক সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে লেখা হতো। গোলাম হোসেন সেলিম, গোলাম হোসেন তাবাতাবাই, মীর্জা নাথন, শিহাবুদ্দীন তালীশ প্রমুখের মতো আঠারো শতকের বিখ্যাত লেখক ও রাজনৈতিক কর্মীরা লিখেছেন ফারসিতে। তাঁদের লেখার বিষয়বস্ত্তও ছিল আভিজাত্যপূর্ণ। তাঁরা সকলেই শাসকদের সম্পর্কে ভেবেছেন এবং তাঁদের সম্পর্কেই লিখেছেন; এমনকি বাংলার প্রথম আধুনিক ব্যক্তিত্ব বলে কথিত রামমোহন রায়ও তাঁর প্রথম গ্রন্থ তুহফাত-উল-মুউয়াহহিদ্দীন রচনা করেছেন আরবি মিশ্রিত ফারসিতে। অন্যান্য হিন্দু পন্ডিতও চিকিৎসাবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, অলঙ্কার,  জ্যোতিষ, ধর্ম, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের গবেষণামূলক লেখাগুলি লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়। তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, উপনিবেশপূর্ব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নিজস্ব ভাষায় কিছু লেখেননি। আসলে তাঁরা লিখেছেন শাসক শ্রেণির জন্য, যাঁদের নিকট মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার কোনো মর্যাদা ছিল না।

উপনিবেশিক যুগ উপনিবেশিক শাসনের কারণে দেশের সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি সচেতন গোষ্ঠী উনিশ শতকের প্রারম্ভে আবির্ভূত হতে শুরু করে। এ শতকের প্রথম দিককার বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের মৌল প্রেরণা লাভ করেন তিনটি প্রধান উৎস থেকে: উপনিবেশিক শাসন,  এশিয়াটিক সোসাইটি ও  ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এসব ক্ষেত্রে প্রাচ্যতত্ত্বের যে নতুন বিকাশ ঘটেছিল এবং যে নব্য পাশ্চাত্য শিক্ষার চর্চা করা হতো তাতে তাঁরা উৎসাহিত হন। তখন  কলকাতা ছিল নব্য বুদ্ধিবাদের কেন্দ্রস্থল এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনকে তাঁদের হিতকারী বিবেচনা করেছেন। রামমোহন রায়, রাজা  রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর,  ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিভিন্ন বিষয়ে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা তার প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন।

ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে নব্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি তত্ত্ব ছিল ‘বৈষম্যমূলক’ মুগল শাসন থেকে মুক্তি। এ ধারণাটি তাঁরা লাভ করেছিলেন সমকালীন ব্রিটিশ লেখকদের কাছ থেকে, যাঁরা সবসময় মুগল শাসনের চেয়ে ব্রিটিশ শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। অবশ্য বাকেরগঞ্জের  ফকির মজনু শাহ্ও বলাকি শাহ্, সিলেটের আগা মুহম্মদ রেজা বেগ, ঢাকার নবাবশামসুদ্দৌলা এবং বারাসাতের তিতুমীরের মতো সনাতনপন্থী মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশ শাসনকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং এ ব্যাপারে কঠিন গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন; উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা জঙ্গী প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিলেন।

উনিশ শতকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ঢাকা তথা পূর্ববাংলার পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করে। ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌর কর্পোরেশনের সৃষ্টি, ১৮৮৫-৮৬ সালে রেলযোগাযোগ স্থাপন এবং অনেক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে এখানে একটি বৃহত্তর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিশ শতকের প্রথম দশকগুলিতে দুটি ঘটনা এই উন্নয়নকে সংহত করে। প্রথম ঘটনাটি হলো ঢাকাকে ১৯০৫-১৯১১ পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য পূর্ববাংলা ও আসামের রাজধানী করা। এর ফলে ঢাকা একটি আধুনিক প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা ও অবকাঠামো লাভ করে। অন্যদিকে ১৯১১ সালে কেন্দ্রীয় রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের ফলে কলকাতা তার পূর্বমর্যাদা হারায় এবং এর ফলে বাংলার এই দুই প্রধান নগরীর মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। ছাত্র-শিক্ষক এবং পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা তখন এটাই প্রমাণ করেছে যে, ঢাকা কলকাতার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিপরীতে পূর্ববাংলা কেন্দ্রিক তার নিজস্ব বৌদ্ধিক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম।

তবে কলকাতার হিন্দুদের মতো অভিজাত মুসলমানরাও ঢাকাকে অনুন্নত মনে করতেন। তখন কলকাতা ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র, বাংলার আইন ও রাজনীতির কর্মকেন্দ্র এবং হাইকোর্ট ও আইনসভার ভিত্তিভূমি। সেখানে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা তুখোর সদস্যরা তাঁদের পেশাগত জীবন গড়ে তুলেছিলেন। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলি কয়েক দশক ধরে তাঁদের খ্যাতিমান করে তুলেছে এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং বিদ্বান ও সাহিত্যসমাজগুলি তাঁদের প্রাণবন্ত বৌদ্ধিক জীবনকে আরও সঞ্জীবনী দান করেছে। ১৯৩০-৪০ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানরাও কলকাতা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণের প্রবণতা দেখিয়েছেন; হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মতো তাঁরাও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভাষায় কথা বলতেন।

ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাতদের মধ্যে পূর্ববাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ছিল একেবারেই অনানুপাতিক।  মকতব ও  মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি তাঁদের ঝোঁক ছিল অত্যধিক এবং তাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্যও ছিল প্রত্যক্ষভাবে  ইসলাম কেন্দ্রিক। এ কথা বলা নিষ্প্রোয়জন যে, তখন ইংরেজি শিক্ষিত ও ইসলামি শিক্ষিতদের মধ্যে আদর্শগত একটা পার্থক্য ছিল। তাঁরা সমাজ ও রাজনীতির প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব ও বক্তব্য নিয়ে বিরাট মুসলিম মঞ্চ ব্যবহার করেছেন। হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবী শ্রেণি, যেমন ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক প্রমুখের প্রতি সাধারণ মুসলিম মনোভাব কতগুলি কারণে অপ্রসন্ন ছিল। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হলো: অতীতে ভারত ও পূর্ববাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতি স্মৃতিবিধুর অনুভূতি, অনাবাসিক হিন্দু জমিদারদের প্রতি অনীহা এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা। সাধারণভাবে সকল মুসলমান এবং বিশেষভাবে পূর্ববাংলার মুসলমানরা উপনিবেশিক শাসনকে প্রায়শই তাদের পক্ষে শত্রুতাপূর্ণ, আর হিন্দুদের পক্ষে সৌহার্দ্যপূর্ণ বলে মনে করেছে।

বিশ শতকে মুসলমান ও হিন্দুদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পার্থক্য যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন ঢাকা তথা পূর্ববাংলার মুসলমানরা বুদ্ধিজীবীদের দলে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে এগিয়ে আসেন। ১৯০৫ সালের  বঙ্গভঙ্গ উভয় পক্ষের চিন্তাবিদদের নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং তাঁদের কথাবার্তায় প্রায়শই মুসলমানদের প্রতি বদ্ধমূল সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রকাশ পেত। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো প্রবীণ নেতারা যেখানে মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছিলেন এবং  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলমানদের আক্রমণ করার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, সেখানে  বিপিনচন্দ্র পালঅশ্বিনীকুমার দত্ত এবং অরবিন্দ ঘোষের মতো কলকাতাভিত্তিক বিভাজনবিরোধীদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি বিরোধিতাসহ সংস্কারবাদিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পূর্ববাংলায় পুলিনবিহারী দাস এবং ভূপেশচন্দ্র নাগ এই বিভাজন বাতিল করার উদ্দেশ্যে  অনুশীলন সমিতি নামে একটি সন্ত্রাসী দল গঠন করেন।

অন্যদিকে পূর্ববাংলার অধিকাংশ মুসলমানই বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানান। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আইনগতভাবে কার্যকর হয় এবং ওই দিনই ঢাকার নবাব  খাজা স্যার সলিমুল্লাহ্ নতুন প্রদেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলা ও আসাম মুসলমান প্রাদেশিক সমিতি (পরে প্রাদেশিক মুসলমান সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর  সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি তাঁর সংগঠন আরও ব্যাপক করেন। নতুন প্রদেশে মুসলিম রাজনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৮ সালে গঠন করেন পূর্ববাংলা ও আসাম মুসলিম লীগ। এই সংগঠনগুলি ছিল তখন প্রধানত অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায়ের কর্মক্ষেত্র, সাধারণ লোকের প্রবেশ এখানে প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রাদেশিক মুসলমান সমিতির সদস্য হতে পারতেন কেবল সমাজের উঁচুতলার মর্যাদাশীল ব্যক্তিরাই। একইভাবে তখন মুসলিম লীগও সারা ভারতের অভিজাত মুসলমানদেরই সদস্য করত এবং এভাবে তাঁরা ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা লাভের চেষ্টা করেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন রদ করার ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, উপনিবেশিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে হিন্দুদের গণআন্দোলনের কৌশল মুসলমান অভিজাতদের আনুগত্যের রাজনীতির চেয়ে অধিকতর কার্যকর ছিল।

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ভরকেন্দ্র আবার কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। তবে বঙ্গবিভাগের ছয় বছর পূর্ববাংলাকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছিল বলা যায়। এ সময় ঢাকার নবাব পরিবার প্রাদেশিক রাজনীতিতে অভূতপূর্ব উৎসাহ দেখিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এ পরিবারের অনেক সদস্য, বিশেষত  খাজা নাজিমউদ্দীন ও  খাজা শাহাবুদ্দীন ৩০ ও ৪০-এর দশকে রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। পূর্ববাংলার অন্যান্য মুসলমান ব্যক্তিত্বও, বিশেষত ধনবাড়ির সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী  এবং সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব  .কে ফজলুল হক এ ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।

আপাতত বিরোধী মনে হলেও এ কথা সত্য যে, বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার কারণে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট এক ধাপ অগ্রগতি সাধিত হয় ১৯২১ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রথম সভায় স্যার সলিমুল্লাহ্ প্রথম এ বিষয়টি উত্থাপন করেন। পরে ১৯১১ সালে সর্বভারতীয় মুসলমান শিক্ষা সম্মেলনের পূর্ববাংলা ও আসাম শাখা আনুষ্ঠানিকভাবে আলীগড়ে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদর্শে ঢাকায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। পরের বছর স্যার সলিমুল্লাহ্, নওয়াব আলী ও ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভাইসরয়ের নিকট এ দাবিটি উত্থাপন করেন। তিনি তাঁদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, বঙ্গভঙ্গ রদের পর সরকার এই বঙ্গের মুসলমানদের উন্নতি সাধনের চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু যেহেতু ব্রিটিশরা হিন্দুদেরও পক্ষে রাখতে চাইত, সেহেতু ঢাকায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং শুরুতে ষাটজনের শিক্ষকমন্ডলীতে মুসলমান শিক্ষক ছিলেন মাত্র আটজন। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তখন মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের হার কত নিম্নস্তরে ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। পশ্চিম বাংলার অধিকাংশ হিন্দুই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন  সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল,  রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার  আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তবে এর সমর্থকদের মধ্যে পূর্ববাংলার কয়েকজন হিন্দুও ছিলেন, যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বলধা এস্টেটের জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়। তখন বলধার পরিচালনা পরিষদের তালিকায় ছিলেন ফজলুল হক, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, খানবাহাদুর আমিরুল ইসলাম, আলতাফ আলী, পন্ডিত হরিপ্রসন্ন গোস্বামী, টি.সি ব্যানার্জী, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী এবং কেশবচন্দ্র ব্যানার্জীর মতো পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীগণ।

বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা কখনওই স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক ছিল না, বরং তা অনেকাংশেই ছিল সংস্কৃতি বা ধর্মের মতোই ভোগবাদী। উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সিংহভাগই ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। তাঁরা শঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি তাঁদের পেশা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সঙ্কটের সৃষ্টি করবে। একইভাবে তাঁরা নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং হরিজনদের উন্নতিতেও আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলার দুই মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও  কাজী নজরুল ইসলাম এই পুরো সময় ছিলেন সৃজনশীল এবং তাঁরা ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।

মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। কলকাতার  হিন্দু কলেজ থেকে উদ্ভূত ইয়ং বেঙ্গলদের অনুকরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে একটি প্রগতিশীল মুসলমান লেখকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল। ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে মুসলমান ছাত্র-শিক্ষকদের একটি দল মিলিত হয়ে  বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমাজ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের সমাজচিন্তা ও সমাজগঠনে উদারনীতি প্রতিষ্ঠা করা। তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্যরা হলেন: আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, তাসাদ্দাক হোসেন এবং আবদুল কাদির। তাঁরা সংগঠনের পক্ষ থেকে  শিখা নামে একটি বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, যাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও অবদান রেখেছেন। এই পুনর্জাগরণবাদী লেখকরা শিখাগোষ্ঠী নামে পরিচিত হন। মুসলমান সমাজকে পশ্চাৎপদ করে রাখার মতো অনেক সংস্কারকে তাঁরা দূর করার চেষ্টা করেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজ ও ঢাকার নবাব পরিবারের দমননীতি সত্ত্বেও শিখাগোষ্ঠীর সদস্যরা তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

হিন্দু ও মুসলমান রাজনীতিকদের মধ্যে মেরুকরণ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায় বিশ শতকের ৩০ ও ৪০-এর দশকে। এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। তখন ভারতে পূর্বাপর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা শোষিত ও শাসিত হওয়ার একটা ভয় ছিল মুসলমানদের মধ্যে, যা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কয়েকজন নেতার সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলিম এই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। বাংলার ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় গণবক্তৃতায় সচেতনভাবে নিজেদের অধিকতর মুসলমান হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, পূর্ববঙ্গে যে তাঁদের মূল প্রোথিত সে ব্যাপারে তাঁরা আরও সজাগ হন এবং পাকিস্তান নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন মুসলিম লীগ দেখছিল, তা সাধারণ মুসলমানদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। ফজলুল হকের  কৃষক প্রজা পার্টি, যা ছিল মূলত হিন্দু-মুসলিম জমিদারদের বিরুদ্ধে উভয় সম্প্রদায়ের একটি সম্মিলিত আন্দোলন, ১৯৪৩ সালে হুসেন শহীদ সুহ্রাওয়ার্দীর মুসলিম লীগের সঙ্গে একটি অাঁতাত গড়ে তোলে। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলার রাজনীতিতে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ আর বেশিদিন টিকে থাকবে না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভারতবর্ষের বৃহত্তর বিভাজন এবং বাংলার দ্বিতীয়বার বিভাজনের ফলে পূর্ববাংলা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে আবির্ভূত হয়।

উপনিবেশোত্তর যুগ  পূর্ব পাকিস্তান এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যান-ধারণায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। ৬০-এর দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়কার বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বিকাশে ভারাক্রান্ত ছিল। তাতে দেখা যায় উপনিবেশিক যুগে বাঙালি মুসলমানদের বঞ্চনার কথা, আর মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের চিন্তা ও কর্মকান্ডের পরিচয়। এই প্রবণতা  ভাষা আন্দোলন সত্ত্বেও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সচেতনতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রভাবিত করে।

কিন্তু ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি পাকিস্তানের সংহতির ওপর একটি নিশ্চিত প্রভাব ফেলে। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ইতোমধ্যে দ্বি-জাতিতত্ত্ব সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন, যদিও তা কেবল একটি  অন্তঃস্রোতের মতোই কাজ করছিল। অবশ্য এ ধরনের সংশয় বিশেষভাবে উচ্চারিত হচ্ছিল বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই, যাঁরা ভাষা আন্দোলনকে পরিচালিত করেছিলেন এবং যাঁদের কর্মীরা মুসলিম লীগ বিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন।

তবে পাকিস্তান সম্পর্কে সংশয় থাকলেও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানের ধারণাকে একেবারে বর্জন করেননি। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কতগুলি শর্তের অধীনে পাকিস্তান বিষয়টিকে গ্রহণ করেছিলেন, যার একটি হলো সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সামরিক শাসন (১৯৫৮) এবং আইয়ুব আমলের এক দশকে মানুষ পাকিস্তান ধারণার অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করেছে। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, বিশেষত বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী ধারার প্রবক্তারা দ্বি-মুখী অর্থনীতিতত্ত্ব সামনে নিয়ে আসেন, যা প্রকৃত অর্থে দ্বি-জাতিতত্ত্বের অযৌক্তিকতাকেই প্রমাণ করেছে।

বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সার্থকভাবেই এই দ্বি-মুখী অর্থনীতির বিষয়টি রাজনীতিবিদদের নিকট তুলে ধরতে পেরেছিলেন এবং তাঁরা পরবর্তীকালে এই নীতি কার্যকর করার ব্যাপারে  ছয়দফা আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যে আলোচনা হয় তা এই ছয়দফা আন্দোলন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় কেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বিশেষ লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত হয়েছিলেন, যার পরিণতিতে হাজার হাজার বুদ্ধিজীবী হয় নিহত হয়েছেন, বা পঙ্গু হয়েছেন। তবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ ছয়দফার কর্মসূচিকে সমর্থন করার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। তাঁরা পাকিস্তানি ধারণার প্রতিই আস্থাশীল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা পাকিস্তানের অনুকূলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের আশায় দখলদারি সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

রাষ্ট্রের গঠনপদ্ধতি ও সংবিধান রচনায় বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রভাব খুবই স্পষ্ট। শুরুতে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার নীতিসমূহ সরাসরি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিল।

রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রভাব সর্বোচ্চ মাত্রায় উপনীত হয় ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সময়পর্বে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি  শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রের চরিত্র এবং সরকার ব্যবস্থার ধরন উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে যায়। মুজিবোত্তর যুগে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বামপন্থী অংশ তার প্রভাব হারায়। সমাজতান্ত্রিক ব্লকের বিভাজন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তির (১৯৯১) পরে বাংলাদেশের বাম বুদ্ধিজীবীরা শেকড়চ্যুত হয়ে পড়েন। তাঁরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং এক বা একাধিক দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হন। স্বাধীনতার পরে দক্ষিণপন্থী যেসব বুদ্ধিজীবী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন, ১৯৭৫ সালের পরে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠায় প্রভাবিত করে। ইতোমধ্যে বিশ্বের আর্থরাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তিত পট বদলে দেয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। কমিউনিস্ট রাশিয়ার পতন, লেট ক্যাপিটালিজম, বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। বিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও সিভিল সোসাইটির ওপর যেমন তাঁদের আধিপত্য বেড়েছে, তেমনি তথ্যমাধ্যম সংবাদপত্রের জগৎও তাঁদের নানাভাবে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে নৈতিক সঙ্কট ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। এর মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মতাদর্শ ও চিন্তাধারায় দলীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রদত্ত স্বাধিকারচর্চার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যদিও এই অধ্যাদেশ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করেছে। এই অধ্যাদেশের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দিক হলো একটি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ এবং পরিষদসমূহ (উপাচার্য, একাডেমিক পরিষদ, সিন্ডিকেট, ডীন) নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর অনেক উপযোগিতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এ ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনেনি। এ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অনুষদভুক্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত করে ফেলেছে। তার ফল হচ্ছে এই যে, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে এখন আর জনগণ দেশের ‘চিন্তাশালা’ হিসেবে মনে করে না, যদিও স্বতন্ত্রভাবে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি এখনও গণমূল্যায়নে একটি উচ্চ ভাবমূর্তি রক্ষা করে চলছেন। একটি বিশেষ শ্রেণি হিসেবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এই অবক্ষয় রাজনীতির সঙ্গে গভীর সংশ্লিষ্টতারই পরিণাম। [নাজিয়া খানম]