ছয়দফা কর্মসূচি

ছয়দফা কর্মসূচি  পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচি। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা তাসখন্দ-উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর পৌঁছেন। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সম্বলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।

ছয় দফায় বিধৃত দাবিসমূহ নিম্নরূপ:

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে;
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;
৫. দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতারা মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচিকে পাকিস্তানের অখন্ডতা বিনষ্ট করার পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আইয়ুব সরকার তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে এবং অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার শুরু করে। এ মামলার বিরুদ্ধে সারা পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে এ বিক্ষোভ গণঅভুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে। গণদাবির মুখে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে বাধ্য হয়।

আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে গণরায়ের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব ছয়দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসার পূর্বে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে অসম্মতি জানান। শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় নেতৃবৃন্দ সহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ১৫ মার্চ (১৯৭১) থেকে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ফলে একদিকে ছয়দফা কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।  [আশফাক হোসেন]