আর্মেনীয়

আর্মেনীয়  সতেরো ও আঠারো শতকে আর্মেনীয়রা বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকে তাদের ব্যবসায়িক প্রাধান্যের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এমনকি এখনও ঢাকায় আর্মেনীয়রা রয়েছেন, কিন্তু সংখ্যা ও প্রভাবের দিক থেকে সম্প্রদায়টি নিতান্তই নগণ্য। ষোল শতকে পারস্যের সাফাভি শাসকগণ মধ্য এশিয়ায় তাদের আবাসভূমি আর্মেনিয়া জয় করে নিলে আর্মেনীয়রা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শাহ আববাস ইস্পাহান ও নিউজালফায় আন্তঃএশীয় বাণিজ্যে দক্ষ প্রায় চল্লিশ হাজার বণিককে পুনর্বাসিত করেন। এ দুটি বাণিজ্য-নগরী থেকেই আর্মেনীয়রা পারস্যদেশীয় ভাগ্যান্বেষীদের অনুসরণ করে প্রথম বাংলায় আসেন। প্রথমদিকে তারা তাদের পারস্যদেশীয় মনিবদের পক্ষে বাংলায় ব্যবসা করতেন এবং কালক্রমে তারা বাংলায় তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলি স্থানীয়ভাবে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল। কারণ তাদের বাণিজ্যিক দক্ষতা ও পুঁজি দুইই ছিল। তবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল শাসকশ্রেণীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সবকটি ইউরোপীয় কোম্পানি রাজদরবারে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য প্রতিনিধি হিসেবে আর্মেনীয় ‘ওয়াকিল’ নিযুক্ত করতেন। অন্তত সতেরো শতকের প্রথমদিক থেকেই তারা বাংলার ব্যবসা ও রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাণিজ্য ও উৎপাদনের সকল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, নগর ও বন্দরে তাদের উপস্থিতি ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। বাংলায় বাণিজ্যরত অপরাপর বণিকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের পার্থক্য ছিল এ যে, লাভের সম্ভাবনা দেখলে তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যে কোনো পণ্যের কায়কারবার করত। তাদের বাণিজ্যিক প্রজ্ঞা, বাজার ও উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞান, উৎপাদন ও বিক্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে যোগসূত্র স্থাপন, তাদের আনুষঙ্গিক ব্যয়স্বল্পতা এবং স্বল্প লভ্যাংশে পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ফলে আর্মেনীয়রা শুধু ভারতীয় ও এশীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই নয়, বাংলায় বাণিজ্যরত ইউরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমূহের সঙ্গেও সাফল্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়।

সায়েদাবাদ (রাজধানী মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠে একটি শহরতলি), হুগলি, কলকাতা, কাসিমবাজার, ঢাকা ও পাটনায় সমৃদ্ধ বসতিগুলিতে তাদের নিজস্ব আবাসস্থল ও গির্জা ছিল এবং সেখানে বহু আর্মেনীয় বণিক ও ব্যবসায়ী ছিলেন। কলকাতায় এখনও আর্মেনীয়দের নামে আর্মানিটোলা এলাকা, একটি আর্মেনীয় গির্জা এবং আর্মেনীঘাট নামে গঙ্গার কূলে একটি স্থান রয়েছে যেখানে আর্মেনীয়দের মালামাল নৌকায় বোঝাই ও খালাশ করা হতো। ঢাকায়ও আর্মানিটোলা নামে একটি এলাকা রয়েছে, যার নামকরণ স্পষ্টতই আর্মেনীয়দের নামে করা হয়েছিল এবং সেখানে এখনও একটি আর্মেনীয় গির্জা রয়েছে।

ইউরোপীদের সঙ্গে বড় ধরনের ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত ঢাকার প্রথম সুপরিচিত আর্মেনীয় ছিলেন খোজা ফানুস কলন্দর। ১৬৮৮ সালে তিনি নিজের ও তার সম্প্রদায়ের অন্যান্য বণিকের মালামাল ইংরেজদের জাহাজে করে বহন করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র খোজা ইসরায়েল সারহন্দ সুবাহদার আজিম-উস-শানের নিকট থেকে ১৬৯৮ সালে কলকাতায় জমিদারি লাভের জন্য কোম্পানিকে সহায়তা করেন। এর পরেও সারহন্দ মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের দরবারে কোম্পানির সুরম্যান প্রতিনিধি দলের ‘ওয়াকিল’ ছিলেন। ১৭১৭ সালের রাজকীয় ফরমানে কোম্পানিকে যে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয় তা কোম্পানির পক্ষে সম্রাটের সঙ্গে সারহন্দের আলোচনারই ফসল। সতেরো শতকের শেষদিক হতে মুগল সরকার আর্মেনীয়দের বাংলায় ব্যবসারত একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়রূপে বিবেচনা করতে থাকে। তারা মূলত রপ্তানি বাণিজ্যে রত ছিলেন যার জন্য সরকারকে তাদের ৩.৫% শুল্ক প্রদান করতে হতো। জানা মতে, সকল নওয়াবই তাদের গোপন বা প্রকাশ্য ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক আর্মেনীয় বণিককে নিয়োগ করেছিলেন। আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের নেতা খোজা পেত্রাস নিকোলাস ছিলেন আলীবর্দী খানের অর্থ যোগানদার ও দরবারের উপদেষ্টা।

আঠারো শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বাংলার আর্মেনীয়দের মধ্যে খোজা ওয়াজিদ বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক জীবনে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করেন। সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলের দুর্যোগময় দিনগুলিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সকল আলাপ আলোচনা তারই মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তিনি ছিলেন তখন সর্বোচ্চ লাভজনক শোরা ব্যবসায়ের একচেটিয়া অধিকারী। ওয়াজিদ ছিলেন তিন বণিকপতির একজন (অপর দুজন হলেন জগৎ শেঠউমিচাঁদ) যাঁরা যৌথভাবে বাংলার বাণিজ্যিক জীবনকে প্রভাবিত করতেন এবং ফলত আঠারো শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলার অর্থনীতিকে। তৎকালীন বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী হুগলি থেকে তিনি তাঁর বিস্তৃত বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। বাংলার অন্যান্য আর্মেনীয়দের মতো খুব সম্ভবত তারও নিউ জুলফার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ওয়াজিদের প্রাথমিক জীবন ও কার্যকলাপ এখনও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। তিনি ছিলেন আঠারো শতকের ত্রিশের দশক ও চল্লিশের দশকের প্রথম দিকের প্রভাবশালী আর্মেনীয় বণিক খোজা মাহমেত ফাজেলের পুত্র। এ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি আর্মেনীয় বণিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে হুগলির ফৌজদারের দরবারে প্রতিপত্তি লাভ করেন। তখন থেকে ওয়াজিদকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। চল্লিশের দশক জুড়ে তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন শুধু একজন সেরা ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, এ দশকের শেষের দিকে বাংলার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

সূক্ষ্ম কূটনীতি ও নওয়াব আলীবর্দী খানকে অর্থ যোগানের মাধ্যমে তিনি দরবারে একটি শক্তিশালী অবস্থান লাভ করেন। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে তিনি দরবারি সম্পর্কের ফসল তুলতে শুরু করেন এবং বিহারের অর্থনীতির ওপর স্বীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর মূল ব্যবসাকেন্দ্র হুগলি থেকে তাঁর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি তার নিজস্ব ব্যবসায়ে এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিতে পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত ছিলেন। ফরাসি, ওলন্দাজ ও ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর ব্যাপক ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। একজন অতি ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যে কোনো মূল্যে বাণিজ্যিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন এবং বাণিজ্যিক সুবিধা প্রাপ্তির সামান্যতম সুযোগের বিনিময়ে তিনি আনুগত্য পরিবর্তন করতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। রাজদরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তিনি বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন।

বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে খোজা ওয়াজিদের ব্যাপক কায়কারবারের মূল ভিত্তি ছিল শোরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা। বাংলার প্রশাসনকে প্রভাবিত করে অন্তত চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকে তিনি কার্যত বিহারের বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করেন। ১৭৫৩ সালে তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রপ্তানি পণ্য তালিকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের অন্যতম শোরার একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার লাভ করেন। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি শোরা ব্যবসার ওপর ওয়াজিদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এমনকি পলাশীর যুদ্ধের পর তিনি নতুন নওয়াব মীরজাফর এর নিকট থেকে পাটনায় শোরার ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার সম্বলিত একটি পরওয়ানা লাভ করেন। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে ইংরেজরা বাংলা জয় করে প্রকৃত শাসকে পরিণত হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁর পক্ষে শোরার একচেটিয়া বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া যে প্রায় অসম্ভব হবে তা তিনি জানতেন। কাজেই তড়িঘড়ি করে তিনি মুর্শিদাবাদে ইংরেজ প্রতিনিধিকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, যদি তারা তাঁর কাছ থেকে শোরা ক্রয়ে ওলন্দাজদের বাধ্য করার কাজে সহায়তা করে তাহলে তিনি সবচেয়ে কম দামে শোরা সংগ্রহে ইংরেজদের সাহায্য করতে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। এটাই ছিল তাঁর জন্য শেষ অবলম্বন যা মরিয়া হয়ে অাঁকড়ে ধরে তিনি তার বাণিজ্যিক আধিপত্যের অংশবিশেষ হলেও রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়ে ওঠে নি। ১৭৫৮ সালে শোরার একচেটিয়া বাণিজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায় এবং ইংরেজ কোম্পানি তা দখল করে নেয়। অবশ্য ওয়াজিদের ব্যবসায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি ছিল অধিকতর লাভজনক লবণের একচেটিয়া বাণিজ্য যা তিনি ১৭৫২ সালে বার্ষিক মাত্র পঁচিশ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার টাকায় বন্দোবস্ত নেন। ১৭৭৩ সালের একটি প্রাক্কলনে বাংলায় লবণ উৎপাদন ও বিক্রির বার্ষিক আয় দেখানো হয় দশ লক্ষ টাকা। এ থেকে সহজেই যে কেউ অনুমান করতে পারেন যে, পঞ্চাশের দশকে লবণের একচেটিয়া ব্যবসা হতে ওয়াজিদ কি পরিমাণ আয় করেছিলেন।

শুধু বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে্ই নয় গোটা সতেরো ও আঠারো শতকের প্রথমার্ধে অসংখ্য উৎপাদনকেন্দ্রে বিশেষ করে বস্ত্র ও রেশম উৎপাদনকেন্দ্রে আর্মেনীয়দের লক্ষণীয় উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় ওই সময়ের ইউরোপীয় দলিলপত্রে। বস্ত্র ও রেশম ব্যবসায়ে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যে তাদের ব্যবসার পরিমাণ নির্ধারণ করা না গেলেও গুণগত দিক দিয়ে বাংলার রেশম ও বস্ত্র ব্যবসায়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র ঢাকা থেকে ১৭৪৭ সালে বস্ত্র রপ্তানির একটি প্রাক্কলনে দেখা যায় যে, এশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আর্মেনীয়দের হিস্যা ছিল শতকরা ২৭ ভাগ। রেশম বাজার থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, অপরাপর এশীয় ব্যবসায়ীদের (প্রধানত গুজরাটি এবং লাহোর, মুলতান, দিল্লি, আগ্রা, বেনারস প্রভৃতি স্থানের উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ী) সঙ্গে আর্মেনীয়রা ছিলেন মুখ্যক্রেতা। বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তারা ব্যাপক হারে পণ্য ক্রয়ের দ্বারা মূল্য বৃদ্ধি ঘটাত এবং বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বিরক্তি উৎপাদন করত। আঠারো শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশরা পলাশীতে জয়লাভ করে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভুত্ব বিস্তার করে বাংলার বাণিজ্য থেকে আর্মেনীয়সহ এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিতাড়িত করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা বহাল ছিল।

ওয়াজিদ স্বভাবতই হুগলিতে বসবাস করতেন। বাংলার নৌবাণিজ্যের বিশাল ঐতিহ্যের অধিকারী হুগলি থেকে তখন আন্তঃএশীয় ও উপকূলীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঠারো শতকের প্রথমার্ধে আর্মেনীয় বণিকগণ বাংলার মূল্যবান পণ্য বোঝাই বাণিজ্যতরী ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করতেন এবং ওই সকল অঞ্চল থেকে সোনা-রূপা ও অন্যান্য পণ্য আনয়ন করতেন এরূপ বহু উদাহরণ হেগে রক্ষিত Algemeen Rijksarchief গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ওলন্দাজ নথিপত্রের নৌপরিবহন তালিকায় পাওয়া যায়। কলকাতা দ্রুত বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও হুগলিই তখন ছিল ঐতিহ্যবাহী এশীয় বন্দর যেখানে ওলন্দাজ, ফরাসি ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাহাজ (ইংরেজ জাহাজ ব্যতীত) ছাড়াও অধিকাংশ এশীয় জাহাজ যাতায়াত করত। মনে হয় যে, বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তার অবস্থান সুদৃঢ় করার পর ওয়াজিদ বহির্বাণিজ্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমদিকে তিনি হুগলির অন্যান্য বণিকদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমুদ্র-বাণিজ্যে নিয়োজিত হন। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহ যে, পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকেই ওয়াজিদ কয়েকটি বাণিজ্য-জাহাজের মালিক হন যেগুলি তখন হুগলির এশীয় নৌবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। ওয়াজিদ কম করে হলেও ছয়টি জাহাজের মালিক ছিলেন। এগুলির নাম ছিল সালামত রেসান, সালামত মঞ্জিল, মুবারক, জেনসামার, মদিনা বখ্শ ও মোবারক মঞ্জিল। এ জাহাজগুলি হুগলি থেকে জেদ্দা, মক্কা, বসরা, সুরাট ও মসুলিপট্টমে যাতায়াত করত।

আঠারো শতকের প্রথম দিক থেকেই ওয়াজিদ খুবই ক্ষমতাবান এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। মনে হয় তিনি তার ভাগ্যকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ওলন্দাজদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হলেও, ফরাসি ও ওলন্দাজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ইংরেজদের তুলনায় তেমন ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল (Jean Law) বলেছেন যে, ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই সদ্ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। যে কোনো উপায়ে বাণিজ্যিক অগ্রগতি লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তিনি সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে তাঁর ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলেন, কেননা তিনি জানতেন যে, দরবারের পৃষ্ঠপোষকতাই তাঁর বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির প্রধান অবলম্বন। এরূপে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সিরাজউদ্দৌলার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন।

ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (মার্চ ১৭৫৭) পর ওয়াজিদ তার ব্যবসায়িক অগ্রগতির সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে পরামর্শ দেন। তা সত্ত্বেও নওয়াবের পতন ঘটানোর জন্য ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দলে তিনিই সর্বশেষে যোগদান করেন যার ফলে ১৭৫৭ সালের জুন মাসে ইংরেজরা বাংলা অধিকার করে। বস্ত্তত ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সাফল্যের পথে ওয়াজিদ ছিলেন বিরাট বাধা। নওয়াবের টিকে থাকার কোনো আশা না দেখে ওয়াজিদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তার বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তিনি বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং মুর্শিদাবাদ দরবার হতে জ্যাঁ ল-এর বহিষ্কারের ফলে নওয়াবের পক্ষে ফরাসি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত ১৭৫৭ সালের মে মাসে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। একই সময়ে ফরাসিদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য নওয়াবের প্রতি তার পরামর্শের অসারতা প্রতিপন্ন হলে নওয়াব তাঁর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁকে একটি ভাঙা খেলনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। মে মাসের গোড়ার দিকেই দরবারে তাঁর মর্যাদার এতটা অবনতি ঘটে যে তিনি কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর দুর্ভাগ্য এবং সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর বণিকপতিদেরও দুর্ভাগ্য যে, ওয়াজিদের পলাশী ষড়যন্ত্রে যোগ দেওয়ার জুয়াখেলা ব্যর্থতায় পর্ববসিত হয়। আগে হোক আর পরেই হোক, পলাশীর যুদ্ধ ওয়াজিদসহ তিন বণিকপতিরই পতন ঘটায়।

সাধারণভাবে বলতে গেলে ওয়াজিদের পতন ছিল পলাশীতে ইংরেজ বিজয়ের একটি স্বাভাবিক পরিণতি। অতএব জ্যাঁ ল-এর মত মেনে নেওয়া কঠিন যে, ওয়াজিদ ‘শেষ পর্যন্ত তাঁর কূটনীতি এবং সম্ভবত তার হঠকারিতার শিকারে পরিণত হন। যদি কোনো একক কারণ তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করে থাকে তাহলে সেটা ছিল লর্ড ক্লাইভের ক্রোধ, যিনি ফরাসিদের সমর্থন দানের জন্য আর্মেনীয় বণিকপতিকে খলনায়ক বলে বিবেচনা করতেন। ১৭৫৭ সালে বাংলায় ফরাসিদের হস্তক্ষেপের পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদ সম্পৃক্ত ছিলেন বলে ক্লাইভ গভীর সন্দেহ পোষণ করতেন। ওয়াজিদের চূড়ান্ত ধ্বংস সাধনের সুযোগ ইংরেজদের হাতে আসে ১৭৫৯ সালে। ওই সময়ের মধ্যে ওয়াজিদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলায় ইংরেজরা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় তাঁর বিধ্বস্তপ্রায় বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের সামান্যতম সুযোগও আর নেই। চরম হতাশায় তিনি আবারও জুয়ার গুটি চালেন। তিনি ওলন্দাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং বাংলা আক্রমণ করে তাদেরকে ইংরেজদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করেন। পলাশীর ন্যায় তাঁর এ দ্বিতীয় জুয়াখেলায় তিনি হেরে যান এবং তাও অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে। ওলন্দাজদের অভিযান ব্যর্থ হলে ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানোর আর কোনো পথ রইল না। তাকে আটক করে কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

ওয়াজিদের মৃত্যুর পর চল্লিশের দশকে তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রথমদিকের পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম খাজা পেট্ট্রস আরাতুন তার স্থলে বাংলায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সাধারণ্যে গুরগিন খান নামে পরিচিত এবং খাজা পেট্ট্রসের ভাই বলে কথিত খাজা গ্রেগরি বাংলার রাজনীতিতে এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন শুরু করে নওয়াব মীর কাসিম এর অধীনে গুরগিন খ্যাতি ও দক্ষতার শীর্ষে উন্নীত হন। তিনি শুধু নওয়াবের প্রধান সেনাপতিই ছিলেন না, তাঁর মন্ত্রী ও উপদেষ্টাও ছিলেন। সিয়ার-উল-মুতাখ্খেরীন প্রণেতা গোলাম হোসেন খানের বর্ণনায় গুরগিন ছিলেন মীর কাসিমের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান এবং নওয়াবের চাকরিতে একজন মুখ্য ব্যক্তি। গিরিয়ার যুদ্ধের (আগষ্ট ১৭৬৩) কয়েকদিন পর রহস্যজনকভাবে জনৈক আততায়ী কর্তৃক তিনি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার বাণিজ্য ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এমন কোনো উল্লেখযোগ্য আর্মেনীয় ব্যক্তির কথা জানা যায় না। অবশ্য বাংলায় আর্মেনীয় সম্প্রদায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে যদিও তা পলাশী পূর্ব যুগের মতো ব্যাপক ও জোরদার ছিল না।

হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিসএর যুগে বহু আর্মেনীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে ভূসম্পত্তির মালিকানা লাভের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এদের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন আগা বারশিক, খাজা কায়োর্কি ও খাজা মাইকেল। সন্দ্বীপে এদের লবণ কারখানা এবং পূর্ব বঙ্গ পরগণায় রাজস্ব ইজারাদারি ছিল। খাজা কায়োর্কি (কার্কুন নামে সমধিক পরিচিত), খাজা মাইকেল ও জর্জ প্যানিয়াটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে পূর্ববঙ্গে বিস্তৃত জমিদারি ক্রয় করেন।

উনিশ শতকে বাংলায় আর্মেনীয় সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বাংলায় সঞ্চিত বিশাল অর্থসম্পদসহ তারা মধ্য এশিয়া ও ইরানে ফিরে যেতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইউরোপে পাড়ি জমায় এবং সেখানে অন্যান্য আর্মেনীয়দের সঙ্গে অংশদারিত্বের ভিত্তিতে চাষাবাদে পুঁজি লগ্নি করে। ফলে বাংলায় তাদের সংখ্যা কমে গেলেও পূর্ব বঙ্গে বিশেষত পাট, চামড়া ও কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ে এ শতকের শেষ নাগাদও তাদের অবস্থান সুদৃঢ় ছিল। যে সকল আর্মেনীয় পরিবার জমিদারি ক্রয় ও পরিচালনায় লিপ্ত ছিল তারাও ধীরে ধীরে অন্যান্য ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করতে থাকে। এসব ব্যবসা ছিল ব্যাংকিং, রপ্তানি বাণিজ্য এবং রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা।

আর্মেনীয়গণ হুগলি, চুঁচুড়া, সায়দাবাদ, মুর্শিদাবাদ ও কাসিমবাজার এবং বাংলার আরও কিছু বাণিজ্যকেন্দ্রে তাদের বসতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তাদের মূল বসতি ছিল ঢাকায়। তারা তাদের ঢাকার বসতির নামকরণ করেছিল আর্মানিটোলা। এ স্থান তাদের ঘটনাবহুল উপস্থিতির স্মারক হিসেবে এখনও ওই নামে বর্তমান রয়েছে। তারা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিকোলাস পোগোজ ঢাকায় পোগোজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮১ সালে তারা আর্মানিটোলায় ‘চার্চ অব হলি রিজারেকশন’ (Church of Holy Resurection) নির্মাণ করে। এ গির্জা নির্মাণের পূর্বে তারা আর্মানিটোলার এক ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় গির্জায় (চ্যাপেল) উপাসনা করত। ১৮৩৭ সালে তারা গির্জার পশ্চিম পার্শ্বে একটি ক্লক টাওয়ার নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে। চার্চের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু আর্মেনীয়দের সমাধি রয়েছে। এ গির্জা নির্মাণের পূর্বে তেজগাঁয়ে অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চের পার্শ্বে আর্মেনীয়দের সমাধিস্থ করা হতো। এসব সমাধির কিছু কিছু শিলালিপি ঢাকায় আর্মেনীয়দের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে। পগোজ, আগাসি, মাইকেল, স্টিফেনস, জোয়াকিমস, সারকিয়েস মানুকস প্রভৃতি ছিল কয়েকটি নেতৃস্থানীয় আর্মেনীয় পরিবার। পি. আরাথন, মার্গার ডেভিড, ম্যাকার্টিচ আব্রাহাম জর্জ, মাইকেল সারকিয়েস, আব্রাহাম লুকাস, এম. হাইকাজোনি, এ.এস. ম্যাকার্টিচ, টিগ্রন নাহাপিত, ছাদিউস নাহাপিত, এম.জে. কাছাতুর, যোসেফ ল্যাজারাস প্রমুখ ছিলেন সুপরিচিত আর্মেনীয় ব্যক্তিত্ব।

ধর্মবিশ্বাসে আর্মেনীয়রা ছিলেন গ্রিক বা অর্থডক্স চার্চের অনুসারী খ্রিস্টান। যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্মেনীয় বসতি স্থাপন করেছেন, সেখানেই তারা গির্জা নির্মাণ করেছেন। চুঁচুড়া, সায়দাবাদ, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় আর্মেনীয়দের গির্জা এবং সেক্যুলার দালানকোঠা এখনও টিকে আছে। [আনসার আলী, সুশীল চৈাধুরী এবং সিরাজুল ইসলাম]

গ্রন্থপঞ্জি  MJ Seth, Armenians in India, Reprint, Calcutta, 1973; S Chaudhury, From Prosperity to Decline - Eighteenth Century Bengal, New Delhi, 1995; Kumkum Chatterjee, Merchants, Politics and Society in Early Modem India, Bihar: 1733-1820, Leiden, 1996; S Chaudhury, The Prelude to Empire; Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000।