আবাদি বন

আবাদি বন (Plantation Forestry)  বীজবপন বা চারা রোপণের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা বন। বাংলাদেশে আবাদি বন সৃষ্টির ইতিহাসের শুরু ১৮৭১ সালে যখন বন বিভাগ বার্মা (মায়ানমার) থেকে সেগুনের বীজ এনে জুমচাষীদের দিয়ে প্রথম সেগুনবন আবাদের চেষ্টা শুরু করে। রামপাহাড়ে (কাপ্তাই) প্রায় ৮ একর জমিতে এ বন গড়ে তোলা হয়। ১৮৭১ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত সীতাপাহাড়ে এ বনায়নের ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়। ১৮৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এ এলাকায় কোনো নতুন বনসৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। ১৯১৭ সাল থেকে পুনরায় বনায়নের কাজ শুরু হয়। কাসালং ও রাংখিয়াং সংরক্ষিত এলাকায় ১৯১৯-২০ সালের মধ্যে বনায়নের জন্য নতুন নতুন কেন্দ্র খোলা হয়। রাংখিয়াং-এ বনায়নের জন্য গাছ কেটে জমি আবাদের কাজ পরীক্ষামূলকভাবে হাতে নেওয়া হয়েছিল। কাঠ বিক্রয়ের সুযোগ আসার এবং টাঙ্গুয়ায় বন গড়ে তোলার জন্য জুমচাষীদের সাহায্য পাওয়ার পরই কেবল বন আবাদ শুরু হয়েছিল। বহুজাতের দেশি গাছের বীজ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুনের সঙ্গে একত্রে বোনা হয়। উদ্দেশ্য ছিল অতঃপর বেশ বড় আকারের সেগুনবন গড়ে তোলা। মাঝে মধ্যে গামারি,  তুন, জারুল, চম্বল, নাগেশ্বর প্রভৃতি চাষের চেষ্টাও চলে। ১৯১৭ সালে নিম্নসমতলে লাগানো জারুল গাছের একটি ছোট বন বেশ ভালোই বেড়ে ওঠে।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বনায়ন কার্যক্রমের শুরু ১৯২৩ সালে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এখান থেকে বিপুল পরিমাণ কাঠ সংগৃহীত হয়েছিল। যুদ্ধের সময় স্থগিত রাখা বনায়ন কর্মসূচি ১৯৪৫-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনার অধীনে সম্প্রসারিত এবং বিশেষ উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশবিভাগের অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জন্য ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের পৃথক কার্যক্রম পরিকল্পনা প্রস্ত্তত করা হয়। কর্মপরিকল্পনা বনকে ৫টি উন্নয়ন এলাকায় বিভক্ত করে: কাঠ উন্নয়ন সার্কেল, নির্বাচন তথা উৎকর্ষতা উন্নয়ন সার্কেল, সাংগু উন্নয়ন সার্কেল, বাঁশ উন্নয়ন সার্কেল এবং সংরক্ষিত বন উন্নয়ন সার্কেল। যেসব এলাকায় নিম্নমানের গাছ ছিল এবং গাছের উৎপাদন পর্যাপ্ত ছিল না, সেসব এলাকাকে কাঠ কার্যক্রম সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়।

সিলেটে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ৩ বছর মেয়াদি একটি বনায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরে ২২০ একর জমিতে জারুল, গামারি, চম্বল, তুন ও গর্জন গাছ লাগানো শুরু হয়। বনায়ন মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী  পার্বত্য চট্টগ্রামচট্টগ্রামকক্সবাজার ও  সিলেট বিভাগে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৩,১১,৭৬৬ হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্পন্ন হয়। ১৯৮০ সালের আগে অধিকাংশ পার্বত্য বনে  সেগুন ও মিশ্র প্রজাতির, প্রধানত জারুল ও গামারি গাছ লাগানো হয়। অবশ্য কোথাও কোথাও গর্জন, ঢাকিজাম, মেহগনিও ছিল। গাছকাটার আবর্তনকাল ছিল ৬০ বছর, কিন্তু পরে কমিয়ে ৪৫ বছর করা হয়। গামারি,  ইউক্যালিপ্টাস ও মিনজিরি ছিল মধ্যম আবর্তনকালের প্রজাতি এবং মেয়াদ ছিল ১২ থেকে ২০ বছর। সাধারণত স্বল্প আবর্তকালের গাছ হলো মালাক্কা শিরীষ, আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাস।

সমভূমিতে বৃক্ষচাষ ও শালবন  বন বিভাগ ১৯৫০ ও ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে  ঢাকাটাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বনের বিস্তৃত এলাকায় শাল এবং দিনাজপুরে পরীক্ষামূলকভাবে টেন্ডু (Diospyros melanoxylon) চাষের আবাদ গড়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের দিকে পুনরুদ্ধারকৃত অনুর্বর শালবনের জমিতে মিনজিরি (Cassia siamea), চাকুয়া করই (Albizia chinensis) এবং শালের অনুষঙ্গী কিছু দ্রুতবর্ধনশীল দেশিয় প্রজাতির গাছ লাগানোর চেষ্টা চলে।  তুঁতগাছ আবাদের চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু গাছগুলির তেমন বৃদ্ধি দেখা যায় নি।

১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে বনবিভাগ উত্তরাঞ্চলের  দিনাজপুররংপুর ও  রাজশাহী জেলায় বৃক্ষচাষের সঙ্গে জড়িত লোকদের নিয়ে কমিউনিটি বনায়ন প্রকল্প শুরু করে। নির্বাচিত প্রজাতিগুলির অধিকাংশ ছিল ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি ও মিনজিরির মতো বিদেশি দ্রুতবর্ধনশীল প্রজাতির গাছ। কমিউনিটি বনায়ন প্রকল্পের পর থানা বনায়ন এবং নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলি ঢাকা, টাঙ্গাইল,  ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহী জেলার শালবন অঞ্চলের সমভূমিতে জনগণের শরিকানায় বৃক্ষের ব্যাপক আবাদ গড়ে তোলে। নির্বাচিত প্রজাতির মধ্যে ছিল আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস ও করই।

উপকূলীয় বনায়ন  উপকূলীয় অঞ্চল ও সংলগ্ন দ্বীপগুলির বাসিন্দাদের জানমাল রক্ষার জন্য বন বিভাগ ১৯৬০ সালের প্রচন্ড  ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের পর রক্ষাবাঁধের বাইরে বৃক্ষরোপণ শুরু করে। পরবর্তীকালে উপকূল অঞ্চলের জেগে ওঠা চর টিকিয়ে রাখা এবং বঙ্গোপসাগরে উপকূল বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য ম্যানগ্রোভ বনায়ন হাতে নেওয়া হয়। এজন্য প্রধানত বেছে নেওয়া হয়  কেওড়া ও বাইন গাছ। কোনো কোনো স্থানে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ভিন্নতর মিশ্রণ নিয়েও পরীক্ষা চলে।

অন্যান্য বনায়ন কার্যক্রম  ১৯৯০ সালে নিয়মিত বৃক্ষরোপণের অতিরিক্ত ৩,২৯৬ হেক্টর জমিতে  বাঁশবেত ও  মুরতা লাগানো হয়। সিলেটের বনে এককালে সহজলভ্য সুগন্ধি দারুবৃক্ষ আগর (Aquilaria malaccensis) প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে রোপণ করা হয়। সিলেটের নলখাগড়ার বনবৃদ্ধির জন্য প্রায় ২১০ একর জমিতে নলখাগড়া লাগানো হয়।

বনভূমির বাইরে বনায়ন কার্যক্রম  প্রান্তিক ও উপপ্রান্তিক জমির সর্বাধিক সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রেলপথ, খাল ও সড়কের দু’পাশের প্রায় ৯৪,০০০ কিলোমিটার জমিতে দ্রুতবর্ধনশীল দেশি ও বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগানো হয়।  [সৈয়দ সালামত আলী]

আরও দেখুন বন ও বনবিজ্ঞান