আবওয়াব

আবওয়াব  আবওয়াব আরবি ও ফারসি ‘বাব’ শব্দের বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ দরজা, বিভাগ, অধ্যায়, সম্মানী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত দেয় কর ইত্যাদি। মুগল শাসনামলে ভারতে নিয়মিত করের অতিরিক্ত সরকার কর্তৃক আরোপিত সকল সাময়িক ও আবস্থিককর এবং অন্যান্য ধার্যকৃত অর্থকে বলা হতো আবওয়াব। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, আবওয়াব হচ্ছে, কোনো রায়ত বা প্রজার ওপর ভূমির নির্ধারিত খাজনার অতিরিক্ত হিসেবে আরোপিত সকল অস্থায়ী কর। টোডরমল মাঠ পর্যায়ে জরিপ শেষে (১৫৮২) ভূমির খাজনার একটা মান নির্ধারণ করেন যাতে পরবর্তীকালে খুব কমই পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। জরুরি ও অপ্রত্যাশিত ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার সাময়িক কর, উপকর এবং আমদানি শুল্ক আরোপ করতেন যা যৌথভাবে আবওয়াব নামে পরিচিত ছিল। নবাবি আমলে এ ধরনের বহু আবওয়াব জমিদারদের ওপর আরোপিত হয়েছে যা তারা কৌশলে তাদের প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দিত। জমিদারগণ ছাড়াও কোতোয়াল এবং ফৌজদারগণ আরও অনেক ধরনের আবওয়াব আরোপ করতেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) অনুযায়ী সকল আবওয়াব খাজনার সঙ্গে একীভূত করা হয় এবং এরপর থেকে আর কোনো আবওয়াব আরোপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় জমিদার কর্তৃক প্রজার নিকট জমি পত্তন দেওয়ার সময় খাজনার সঠিক পরিমাণ লিপিবদ্ধ করার বিধান করা হয়। কোনো অজুহাতে পত্তনের দলিলে উল্লিখিত খাজনার অতিরিক্ত আবওয়াব আরোপকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থায় গ্রাম পর্যায়ে এ ধরনের বিধানের কার্যকারিতা ছিল খুবই কম। জমিদারদের প্রতিনিধিগণ বিবাহ, তীর্থযাত্রা, শ্রাদ্ধ, উৎসব, পুণ্যাহ, চাঁদা ইত্যাদি অজুহাতে বরাবরই আবওয়াব আদায় করত।

১৮৬০-এর দশকে পরিচালিত রাজস্ব জরিপ এবং ১৮৮০ সালের রেন্ট কমিশন প্রতিবেদনে দেখা যায়, অধিকাংশ জমিদারই তাদের প্রজাদের ওপর আবওয়াব আরোপ করেছেন এবং এর জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয় নি। রেন্ট কমিশন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, আবওয়াব একটি সাধারণ প্রথা হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রজাগণ এর বিরুদ্ধে খুব কমই আপত্তি উত্থাপন করেছে। বস্ত্তত আবওয়াব প্রদানকে তারা দায়িত্ব বলেই মনে করেছে। কিন্তু খাজনা বৃদ্ধি তাদের নিকট ছিল চরম অসন্তোষের বিষয়। প্রথা মোতাবেক পরগনায় প্রচলিত হারের অতিরিক্ত খাজনা দাবিকে তারা প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বিশ শতকের প্রজা অসন্তোষের কারণগুলির মূলে ছিল খাজনা বৃদ্ধি, আবওয়াব আদায় নয়।

১৯২০-এর দশক থেকে আবওয়াব আদায়ের রীতি কমতে শুরু করে। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, নির্বাচনী রাজনীতির শুরু, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, কৃষকদল গঠন ও কৃষকদের আন্দোলন ইত্যাদির কারণে জমিদারদের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে প্রজাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ জনগণের সমর্থন লাভের লক্ষ্যে জননেতাগণ অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করে। অপরদিকে কৃষকগণও তাদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য কোনো না কোনো দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ১৯৩৯ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সব ধরনের আবওয়াব ও সালামি আদায় বন্ধ করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]