চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার ভূমি মালিকদের (সকল শ্রেণির জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি স্থায়ী চুক্তি। এ চুক্তির আওতায় জমিদার উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। চুক্তির আওতায় জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্ব-দাবি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও জমিদারদের তরফ থেকে প্রজাদের ওপর রাজস্বের দাবি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয় নি। জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি উপায়ে অবাধে হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও তাদের প্রজা বা রায়তদের সে অধিকার দেওয়া হয় নি। নিয়মিত খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে উত্তরাধিকারক্রমে জমির মালিক থাকার প্রথাগত অধিকার রায়তদের থাকলেও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। সরকারের বেলায় জমিদারদের অবশ্য একটি দায়দায়িত্ব কঠোরভাবে পালনীয় ছিল। সেটি হচ্ছে নিয়মিত সরকারের রাজস্ব দাবি পরিশোধ করা। জমিদারগণকে এ মর্মে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় যে, তাদের কেউ নির্ধারিত তারিখে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি ব্যক্তির সকল জমি বা বকেয়া দাবি পূরণের উপযোগী জমি নিলামে বিক্রয় করা হবে।
প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার পর প্রণীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে রাজস্ব সংগ্রহের নিছক ব্যবস্থা রূপে গণ্য করা যায় না। বরং এটি ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারই একটি প্রধান অংশ। প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরকরণের উপযুক্ত করে তোলা হয়। তবে এ ব্যবস্থা বজায় রাখার সকল সযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভূমি রাজস্ব আইনের প্রভাব, এ শতকের শেষের দিকে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের প্রচার-প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো নানা কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির চাপে এতে অবক্ষয়ের সূচনা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ হওয়ার পর থেকে এ ব্যবস্থার কয়েক দফা সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অবশেষে ১৯৫০ সালে সমগ্র ব্যবস্থাই করা হয়।
কলকাতায় জমিদারি (১৬৯৮) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কোম্পানি সর্বাপেক্ষা আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠার সত্যিকার প্রক্রিয়া শুরু হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানির (১৭৬৫) দায়িত্ব গ্রহণের পর। দীউয়ানি ব্যবস্থায় কোম্পানি বাংলার কার্যত অধীশ্বর হয়ে ওঠে।
নানা বাধাবিঘ্নের কারণে বাংলার এ নতুন অধীশ্বর গোড়া থেকেই রাজ্য শাসনের জন্য প্রস্ত্তত ছিল না। কোম্পানির বণিক ও হিসাবরক্ষক হিসেবে বাংলায় কোম্পানির কর্মকর্তারা পণ্যের কেনাবেচা, ব্যবসায়ের সুদীর্ঘ স্থিতিপত্র ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষ ছিল বটে, তবে শাসনকাজে তারা ছিল একেবারেই অজ্ঞ। জনবলের অভাব, ভাষার সমস্যা, দেশজ ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অজ্ঞতা, বাংলায় অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী বৈদেশিক সমুদ্রচারী জাতির উপস্থিতি ইত্যাদি কারণ বাংলায় উপনিবেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে তাদের শ্লথ গতিতে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। একেবারেই গোড়ার দিকে কোম্পানি তাই দেশিয় সহযোগীদের যোগসাজসে এ নতুন উপনিবেশ শাসনের পন্থা গ্রহণ করে। নব্য শাসকদের সমস্যাটি ছিল এই যে, এটি আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো নতুন বসতি স্থাপনের উপনিবেশ ছিল না, মূলদেশের (ইংল্যান্ডের) আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী এটির শাসন পরিচালনাও সম্ভব ছিল না। আবার বাংলার অধিবাসীরা আফ্রিকা বা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশগুলির আদিবাসীদের মতো কোনো অর্ধসভ্য জনসমাজও ছিল না, যে কারণে এখানে বেত্রশাসন ছিল অবাস্তব।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় আইন-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। কোম্পানি বাংলার নিজস্ব আইন-কানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশ শাসনের অবস্থায় ছিল না, কেননা তা হতো উপনিবেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যেরই পরিপন্থী। বলাবাহুল্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল, প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্য পরিচালনায় বাংলার রাজস্ব আয়কে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা। এ পরিস্থিতিতে পলাশী প্রান্তরের ঘটনার নায়ক ও দীউয়ানি চুক্তির (১৭৬৫) প্রণেতা রবার্ট ক্লাইভ-এর অন্তত সাময়িকভাবে হলেও পরিকল্পনা ছিল দেশটি দেশিয় লোকদের দ্বারাই শাসিত করার। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশি লোকেরা তাদের নিজস্ব আইন-কানুন ও রীতি অনুসারে দেশ শাসন করবে, আর কোম্পানির কাজ হবে শুধু এক উপরিশক্তি হিসেবে মুর্শিদাবাদে নওয়াবের দরবারে নিযুক্ত কোম্পানির একজন প্রতিনিধির মারফত উদ্বৃত্ত রাজস্ব সংগ্রহ করা। সৈয়দ মুহাম্মদ রেজা খান (১৭১৭ -১৭৯১) নামে ইরান থেকে ভাগ্যান্বেষণে আগত ও বাংলায় দীর্ঘকাল নিবাসী এক ব্যক্তিকে নায়েব দীউয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে তার ওপর দেশশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। রেজা খানকে নাবালক নওয়াবের (নাজমুদ-দৌলা) নায়েব নাজিম বা অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। নায়েব নাজিম রূপে মুহাম্মদ রেজা খান ছিলেন নিজামত বা অসামরিক প্রশাসন প্রধান আর নায়েব দীউয়ান হিসেবে তিনি ছিলেন দীউয়ানি বা রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান। তাকে দেশিয় আইন-কানুন ও প্রথা অনুযায়ী দেশ শাসন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
ক্লাইভ প্রণীত এ শাসনপদ্ধতিকে সাধারণত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এ ব্যবস্থা ১৭৬৭ সাল অবধি ভালভাবেই কার্যকর ছিল। ওই বছরেই ক্লাইভ এদেশ থেকে বিদায় নেন। ক্লাইভের সমর্থনে রেজা খান দক্ষতার সাথেই কোম্পানির রাজ্য শাসনে সক্ষম হন। তবে পৃষ্ঠপোষক ক্লাইভের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেজা খানকে ফোর্ট উইলিয়ামের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের চরম বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের এসব কর্মকর্তা রাতারাতি ধনী হবার বাসনায় রেজা খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসে বদ্ধপরিকর হন। তারা পর্যায়ক্রমে রেজা খানের হাত থেকে প্রশাসন নিজেদের হাতে তুলে নেন। তাদের এ হস্তক্ষেপের বিষয় প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভিন্ন জেলায় ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের মাধ্যমে। তাদেরকে আপাতদৃষ্টে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রেজা খান অভিযোগ করতে থাকেন যে, এ নবনিযুক্ত কর্মকর্তারা পল্লী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। সরাসরি দেশ শাসনের ক্ষেত্রে পরের ব্যবস্থাটি ছিল মুর্শিদাবাদে (বাংলার জন্য) ও পাটনায় (বিহার ও উড়িষ্যার জন্য) দুটি রাজস্ব পরিষদ (Revenue Councils) প্রতিষ্ঠা। ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়করা এ দুই পরিষদের আওতায় কাজ করতে থাকেন। রেজা খান ফোর্ট উইলিয়ম পরিষদের কাছে এ মর্মে অভিযোগ করতে থাকেন যে, অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে কোম্পানি কর্মকর্তারা দেশের পল্লী জনপদগুলিতে লুঠপাট চালাচ্ছে। কিন্ত প্রতিকারের পরিবর্তে এসব অভিযোগ ফোর্ট উইলিয়ম কর্তাদের তাঁর বিরুদ্ধে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর পরিণতিতে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেয়, এবং ফলে ১৭৬৯ সালের মহাদুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। এ দুর্ভিক্ষে বাংলার মোট জনসমষ্টির এক তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায়। বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ফসলি জমি লোকের অভাবে ঝোপ-জঙ্গলময় হয়ে ওঠে।
এ ধরনের ধ্বংসলীলার কারণে নতুন এ রাজ্যে প্রশাসনের ধরন সম্পর্কে শাসকদের আগের ধ্যানধারণা পুরোপুরি বদলে যায়। দেশিয় প্রতিনিধির মাধ্যমে কোম্পানির দীউয়ানি প্রশাসন পরিচালনার ধারণাটি পরিত্যক্ত হয়। কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ আগস্ট ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল দীউয়ানি প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে। নায়েব দীউয়ান রেজা খানকে পদচ্যুত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে কারারুদ্ধ করা হয়।
কোম্পানির আঞ্চলিক বিষয়াদি প্রশাসনের জন্য ১৭৭২ সালে কলকাতায় রাজস্ব কমিটি নামে এক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রেসিডেন্ট হন গভর্নর এবং বাংলার ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট। আর এভাবেই কলকাতা নীরবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী নগরীতে পরিণত হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ঘোষণা করেন যে, ক্লাইভের দীউয়ানি ও নিজামত দ্বৈত-প্রশাসন ব্যবস্থা এখন আবার ১৭৬৫-র আগের ব্যবস্থার মতোই সমন্বিত ব্যবস্থায় পরিণত হবে। এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ১৭৭২ সালে কয়েক দফা ইস্তাহার জারি হয়। এসব ইস্তাহার অনুযায়ী রাজস্ব চাষিদের প্রকাশ্য নিলামে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হয়। এ পাঁচসালা বন্দোবস্ত স্থির করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটিকে। এ কমিটির আরও দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ (চাষিদের) থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশিয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার, কানুনগো আর আমিলদের স্থলাভিষিক্ত হলো ব্রিটিশ কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়কর্তা।
পাঁচসালা রাজস্ব বন্দোবস্ত সবার জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়। রাজস্ব নিলামদাররা অত্যুচ্চ হারে খাজনা আদায় করতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে অনেক রায়ত জমি ছেড়ে পালিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে উভয় পন্থাই অবলম্বন করে এবং বহু জায়গায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে খোদ সরকারই যেখানে অধিক থেকে অধিকতর রাজস্ব আদায়ে অনমনীয় সেখানে নিপীড়িত রায়ত বা প্রজাকে স্বস্তি দেওয়ার মতো সদিচ্ছা যেমন তাদের ছিল না, তেমনি ছিল না প্রশাসনিক সামর্থ্য। ফলে, পল্লী জনপদে অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। বন্দোবস্ত সম্পাদনের পর থেকে ক্রমেই বর্ধিত হারে বকেয়া রাজস্বের জের পুঞ্জীভূত হতে থাকে। সরকারের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে যে, পাঁচসালা বন্দোবস্তের বিষয়টি ছিল এক মহা প্রমাদ। সরকার উপলব্ধি করে যে, জমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারভিত্তিক জমিদারদের একটা সামাজিক স্বার্থ জড়িত ছিল যা অস্থায়ী ইজারাদারদের বেলায় ছিল না। তাই ধরে নেওয়া হয় যে, জমিদারদের তাদের পুরানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিলে ও তালুকের সম্পদ অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করা হলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় সহজতর হবে অপরদিকে তা কৃষককুলকেও ইজারাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের শর্তাবলীর কারণে এক্ষেত্রে সরকারের হাত বাঁধা ছিল।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য একমাত্র বিকল্প ছিল এ ব্যবস্থার মেয়াদ ১৭৭৭ সালে শেষ হওয়ার পর রাজস্ব আদায়ের সর্বোত্তম পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে আগেভাগেই বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ বিষয়ে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়। ১৭৭৫ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য রিচার্ড বারওয়েল জমিদারদের দীর্ঘমেয়াদে ভূমি বন্দোবস্ত দানের প্রস্তাব করেন। ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি কাউন্সিলের আরেক সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস এক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যাকে তিনি ‘চিরস্থায়ী ভূমি রাজস্ব পরিকল্পনা ১৭৭৬’ বলে অভিহিত করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, জমিদারই জমির মালিক। অতএব তাদেরকে চিরস্থায়িভাবে জমির বন্দোবস্ত দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। জমিদারদের সাথে ভূমি বন্দোবস্তের ব্যাপারে ওয়ারেন হেস্টিংস বারওয়েলকে সমর্থন দেন। তাঁর মতে, ভূমি বন্দোবস্তের মেয়াদ নির্ধারণ করার আগে দেশের সম্পদের বিস্তারিত হিসাব নিরূপণ করা আবশ্যক। এসব অভিমতের ওপর কোম্পানির পরিচালক সভা যে নির্দেশ প্রদান করে তা হেস্টিংসের অভিমতের অত্যন্ত কাছাকাছি। পাঁচসালা বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবসানের প্রাক্কালে ১৭৭৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কোম্পানির পরিচালক-সভা নির্দেশ দেয় যে, নিলামে জমি ইজারা দানের রীতি পরিহার করে কেবল জমিদারদের জমির স্বল্পমেয়াদি বন্দোবস্ত দিতে হবে। সভা ভূমি বন্দোবস্তের লক্ষ্যে জমির সম্পদ সঠিকভাবে নিরূপণের জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ পরিচালনা করতে কাউন্সিলকে পরামর্শ দেয়। এভাবে কাউন্সিল ১৭৭৭ সাল ও পরবর্তী তিন বছরের জন্য বার্ষিক ভিত্তিতে জমিদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে নতুন ব্যবস্থাটি রাজস্ব আদায়ে অবক্ষয় প্রবণতা রোধ করতে পারে নি। রাজস্ব বকেয়া ক্রমেই পুঞ্জীভূত হতে থাকে। রাজস্ব শাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কালেক্টরকে জেলার সর্বেসর্বা প্রশাসকে পরিণত করা হয়। কালেক্টরকে সকল নির্বাহী ও বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কেন্দ্রায়ন ও হস্তক্ষেপের প্রতীক রাজস্ব কমিটিকে বিলুপ্ত করে স্থাপন করা হয় রাজস্ব বোর্ড, যার দায়িত্ব হলো রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়াবলির সাধারণ বা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। জমিদারগণকে তাদের জমির ন্যায্য রাজস্ব নির্ধারণের জন্য এ কালেক্টরের মুখাপেক্ষী হতে হয়। রাজস্ব বোর্ডও রাষ্ট্রের রাজস্বের জন্য কালেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হয়। ১৭৮৬ সালের সংস্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত প্রশাসনিক বুনিয়াদ রচনা করে। সরকার তখন থেকে আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সঙ্গে জমিদারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্ত্তত হয়। তবে সরকারের এ প্রস্ত্ততি রাজস্ব আদায়ে খুব বেশি নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ে আসেনি, কেননা রাজস্ব আদায়ে এর পরেও অনিশ্চয়তা বিরাজমান ছিল।
পিট-এর ভারত আইন ১৭৮৪-এর একটি দফায় কলকাতা সরকারকে অনতিবিলম্বে রাজস্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করা এবং সরকার ও জমিদার উভয় তরফের জন্য সুবিধাজনক শর্তের আওতায় জমিদারদের সাথে রাজস্ব প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে ১৭৮৬ সালে ব্রিটিশ ভূস্বামী শ্রেণির অন্যতম সদস্য লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা জন শোরের (রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি ও কাউন্সিল সদস্য) প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। উল্লেখ্য, জন শোর ছিলেন বাংলার রাজস্ব বিষয়ে সেরা বিশারদ। শোরের বিশ্বাস ছিল যে, অনতিবিলম্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদন করার মতো যথেষ্ট তথ্য তাদের হাতে নেই। অবশ্য নীতিগতভাবে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধারণার বিরোধী ছিলেন না। তাঁর কেবল আপত্তি ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় নিয়ে। তাঁর যুক্তি ছিল এ যে, একেকটি স্বতন্ত্র তালুকের প্রকৃত সম্পদ এবং জমিতে রায়তসহ যাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে তাদের প্রকৃত অধিকার ও দায়দায়িত্বের বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদন করা হলে তাতে এ চুক্তির সকল পক্ষেরই স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। শোর তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করা আরও দুই বা তিন বছর স্থগিত রাখার অনুকূলে ছিলেন, যাতে করে ইত্যবসরে জমির সম্পদ ও জমিতে অধিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত এহেন প্রশ্নে কর্নওয়ালিস ও শোরের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য দেখা দেয়। কর্নওয়ালিস যুক্তি দেন যে, গত বিশ বছরে সংগৃহীত তথ্যই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট। তাঁর আরও যুক্তি ছিল, কোনো এক বা একাধিক তরফের বেলায় কোনো গলদ-ত্রুটি ধরা পড়লে সেগুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সু-প্রভাবে অচিরেই দূর হয়ে যাবে। কর্নওয়ালিস বিশ্বাস করতেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা জমিদারদের নিজেদেরকে উন্নয়নকামী জমিদার ও কৃষি পুঁজিবাদী করে তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট প্রেরণা যোগাবে।
কর্নওয়ালিস ও শোর তাদের নিজ নিজ অভিমত ও এতদসংক্রান্ত অন্যান্য দলিলপত্র কোম্পানির পরিচালক সভার কাছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাতে সম্মত হন। তারা আরও একমত হন যে, ইত্যবসরে সরকারের উচিত হবে ১৭৯০ থেকে ১০ বছর মেয়াদের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যার সাথে এ মর্মেও বিজ্ঞপ্তি থাকবে যে, যদি পরিচালক সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে মত প্রকাশ করেন তাহলে এ দশসালা বন্দোবস্তই অবিলম্বে চিরস্থায়ী বলে ঘোষিত হবে। কাউন্সিলের সকল সদস্যের সভার কার্যবিবরণী সমীক্ষার পর কোম্পানির পরিচালক-সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে অভিমত প্রদান করে। ১৭৯৩ সালের ২৩ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিস ঘোষণা করেন যে, দশসালা বন্দোবস্তের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর জমিদারদের তাদের নিজ নিজ জমিদারির প্রদেয় যে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে কোনোপ্রকার রদবদল করা হবে না; উপরন্তু, তাদের ওয়ারিশ ও আইনগতভাবে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদেরকে এ পরিমাণ প্রদেয় রাজস্বের ভিত্তিতে চিরস্থায়িভাবে তালুকের ভোগদখল করার অনুমতি দেওয়া হবে (ইস্তাহার অনুচ্ছেদ ৩, ধারা ৪, প্রবিধান ১, ১৭৯৩)।
জমিদারদের প্রতিক্রিয়া সম্ভবত যুক্তিসিদ্ধ কারণেই কর্নওয়ালিস প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল যে, তাদের এ নতুন ভূমি ব্যবস্থাটিকে জমিদাররা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় স্বাগত জানাবে। এ কারণে যে, এ ব্যবস্থার আওতায় ভূ-সম্পত্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকানা সৃষ্টির এ সুযোগটি ইতঃপূর্বে আর কখনও ছিল না। এ নবসৃষ্ট ভূ-সম্পত্তি বিনামূল্যে জমিদারদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় জমিদারগণ চিরকালের মতো নির্ধারিত হারে সরকারি রাজস্ব পরিশোধের ব্যতিক্রমধর্মী সুবিধা লাভ করে। বস্ত্তত এ সিদ্ধান্তটি সরকারের দিক থেকে রাজস্বের নিরিখে নিশ্চিতভাবেই একটি ত্যাগ স্বীকার। আর তাই স্পষ্টতই সরকার গভীর আগ্রহে আশা করছিলেন যে, এক সুবিধাভোগী পক্ষ হিসেবে জমিদারগণ এ বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা সহকারে গ্রহণ করবে ও ব্রিটিশ সরকারের সুশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে। কিন্তু সরকার পরম বিস্ময়ে ও আশাহত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, জমিদাররা বরং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় অসন্তোষ ও ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করছে। এমনকি বহু হতাশ জমিদার এ ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে, অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিরোধও গড়ে তোলে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাদি সম্পর্কে জমিদারদের অসন্তোষের যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এ পদ্ধতিতে পূর্ববর্তী দশ বছরের প্রকৃত খাজনা আদায়ের এক স্থূল গড়পরতার ওপর ভিত্তি করে জমিদারদের ওপর রাজস্ব নিরূপণ করা হয়। এ ধরনের অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতির কারণে কোনো তালুকের ওপর করের হার যেমন খুব কম হতে পারে আবার কোনো তালুকের ওপর তা অত্যন্ত বেশিও হতে পারে। কাজেই যেসব তালুক-জমিদারি বিপুল করভারে ন্যুব্জ থাকবে তাদের জমি বকেয়া বাবদ প্রকাশ্য নিলামে উঠা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া, ভবিষ্যতে ‘খরা, প্লাবন, নদীভাঙন জনিত ক্ষয়ক্ষতি, রায়ত বা প্রজার মৃত্যু বা পলায়নের বেলায়’ কোনোরকম খাজনা মওকুফ করা হবে না বলে সরকারের দৃঢ় ঘোষণা জমিদারগণ একান্তই অবাস্তব বলে মত প্রকাশ করেন। তারা যুক্তি দেখান যে, বৃষ্টিনির্ভর যেকোন কৃষি অর্থনীতিতে মাঝে মাঝেই ফসলহানি ঘটা স্বাভাবিক, আর সে কারণে রাজস্ব বাকি পড়া অনিবার্য। তারা জোরালো যুক্তি দেখান যে, কর্তৃপক্ষ যদি একান্ত নিয়মিত ও রুটিনমাফিক বৃষ্টিপাতের নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারেন তাহলে তারা কেমন করে তাদের প্রজাদের যথাসময়ে ও নিয়মিতভাবে ভূমি রাজস্ব পরিশোধের জন্য চাপ দেবেন? জমির মালিকগণ ভূমি বন্দোবস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে তাদের বক্তব্যের সপক্ষে সনাতন ঐতিহ্যিক প্রথার বিষয় তুলে ধরেন, যার আওতায় প্রাকৃতিক কারণে ইতঃপূর্বে ফসলহানি ঘটলে তাদের সরকারি রাজস্ব মওকুফ করা হতো। ১৭৯০ সাল থেকে পরের তিন বছর রাজস্বের ক্রমবৃদ্ধি ছিল জমিদারদের আরও একটি অভিযোগের কারণ। জমিদারগণ কর্তৃক এ নীতিকে অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করার কারণ হচ্ছে, রাজস্ব ক্রমবৃদ্ধির প্রত্যাশাই ছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংশ্লিষ্ট তালুকের আয় বেড়ে যাবে, এ ধরনের অনুমান নিছক কল্পনাসুলভ ও অযৌক্তিক।
জমিদারদের আরও একটি অভিযোগ ছিল তালুক নীতির প্রশ্নে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধান অনুযায়ী, যেসব তালুক এ যাবৎ জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব প্রদান করে আসছে সেসব তালুকের প্রত্যেকটিকে একেকটি স্বতন্ত্র জমিদারি হিসেবে গণ্য করতে হবে। সকল বড় আকারের জমিদারির নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের বহু তালুক ছিল। এসব তালুককে কোনোরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়েই সংশ্লিষ্ট জমিদারি থেকে সেগুলিকে আলাদা করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তালুকগুলি এভাবে আলাদা করে ফেলার কারণে বহু জমিদারি, যেগুলি ব্যবস্থাপনা বা অন্য কারণে তালুকের সৃষ্টি করেছিল, কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জমিদারদের জন্য আরেকটি অসুবিধাজনক আইন ছিল পাট্টা রেগুলেশন। এ আইনের আওতায় জমিদারদের তাদের প্রজাদের পাট্টা প্রদানের নিয়ম করা হলো যাতে বন্দোবস্তের শর্তাবলী সংজ্ঞায়িত হয়। এ আইনটি এ মর্মে জমিদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে, তারা নির্ধারিত অঙ্কের খাজনার অতিরিক্ত আবওয়াব বা এ ধরনের কোনো কর আরোপ করতে পারবে না। জমিদারদের বিবেচনা ও দাবি অনুযায়ী, এ শর্তটি ছিল জমিদারি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানায় সরাসরি হস্তক্ষেপ।
জমিদারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ, সূর্যাস্ত আইন প্রয়োগের আওতায় বিপুল হারে জমি মালিকানার হস্তান্তর, সরকারি রাজস্বের ক্রমহ্রাস প্রবণতা, স্তূপাকারে জমে উঠা দীউয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে বিচার বিভাগীয় ব্যর্থতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি আর সে সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সকল বিষয় সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এমন আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে যে, এ প্রবণতাকে ঠেকাতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। তবে কর্তৃপক্ষের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল এই যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অপারেশন পুরানো ভূমধ্যধিকারী অভিজাত শ্রেণির ঐতিহ্যিক আর্থসামাজিক কাঠামোকে যথেষ্ট বিঘ্নিত করলেও, নয়া শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতে এক পাঁচমিশালি সামাজিক শ্রেণি গঠন করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে ছিল তালুকদার, জোতদার, স্বল্প রাজস্ব আরোপ করা হয়েছে এমন মালিক, নতুন জমিদার, উদীয়মান বেনিয়া, ইঙ্গ-ভারতীয় সওদাগর সম্প্রদায় ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেকে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা সামাজিকভাবে তখনও তেমন মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হয় নি যাতে তারা সঙ্কটকালে সরকারের সমর্থনে জনসমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
লর্ড ওয়েলেসলির শাসনামলে (১৭৯৭-১৮০৫) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পরবর্তী পট পরিবর্তনকে অত্যন্ত উদ্বেগের চোখে দেখা হয়। ওয়েলেসলি সরকার ছিল সাম্রাজ্য গড়ে তোলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সময়ে প্রতি মাসে শত শত জমিদারি নিলামে বিক্রয় করা হয়। ১৭৯৩ সালের পূর্বেকার মতো রাজস্ব আদায় অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যায়, রাজস্ব আয় কমে আসে, দেশের অভ্যন্তরভাগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। জমিদারি-হারা পুরানো ভূস্বামীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ ধরনের দৃশ্যপট সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলে।
ওয়েলেসলি তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত মূল বিধিগুলির কিছু সংশোধন করে জমিদার শ্রেণির সঙ্গে একটা আপসে উপনীত হবার সিদ্ধান্ত নেন। এরই প্রেক্ষাপটে প্রণীত হয় ১৭৯৯ সালের ৭ নং রেগুলেশন যা সাধারণত হফতম বা সপ্তম আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের লাগামহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমিদারগণ বকেয়া আদায়ের নামে প্রজাদের ফসল, গবাদি ও সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রয় করে বকেয়া আদায়ের অধিকার লাভ করে। স্বত্বাধিকারী হিসেবে তারা খেলাপি রায়তদের তাদের নিজ নিজ কাচারিতে তলব করার ও বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখার, কোনো খেলাপি রায়ত তার পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি নিয়ে অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলে ওই রায়তের গ্রামের সকলের ওপর পাইকারি জরিমানা আরোপের ক্ষমতা লাভ করে। পরগনাপ্রথা অগ্রাহ্য করে জমিদাররা যথেচ্ছভাবে খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতা লাভ করে। সংক্ষেপে, রায়তগণ এতকাল যাবৎ ঐতিহ্যগতভাবে যেসব প্রথাগত অধিকার ভোগ করে আসছিল হফতম সেসব অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে। রায়ত অসহায় কোর্ফা প্রজায় পরিণত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল আইনের পরবর্তী সংশোধন হয় ১৮১২ সালের ৫নং রেগুলেশনের অধীনে। আইনটি সাধারণ্যে পানজাম বা পঞ্চম নামে পরিচিত। এ রেগুলেশনের আওতায় জমিদারগণ যেকোন মেয়াদের জন্য তাদের জমি ইজারা দেওয়ার অধিকার লাভ করে। ইজারার মেয়াদ ১৭৯৩ সালের আইনে সর্বাধিক দশ বছরের মধ্যে সীমিত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বদলে দেয় ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলেশন যা সাধারণভাবে পত্তনি আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনবলে জমিদার ও রায়তের মধ্যবর্তী একটি বহুস্তরবিশিষ্ট মধ্যস্বত্ব শ্রেণি সৃষ্টি করার অধিকার লাভ করে। বাস্তবিকপক্ষে, এ ছিল জমিদারি ক্ষমতার চরম শিখর এবং একই সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা। এ আইনের আওতায় জমিদারগণ তাদের খেলাপি পত্তনিদারদের জমি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করার অধিকার লাভ করে, ঠিক যেভাবে সূর্যাস্ত আইনের আওতায় খেলাপি জমিদারের জমি নিলাম হয়ে যেতো।
উদ্দেশ্য ও ফলাফল জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের কিছু আশু উদ্দেশ্য ছিল। এগুলি হচ্ছে: ক. রাজস্ব প্রদায়ক শ্রেণিকে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি বা বুনিয়াদ দেওয়া এবং রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত করা; খ. সরকারকে প্রদেয় একটি ন্যূনতম রাজস্ব নিশ্চিত করা; গ. রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় থেকে কর্মকর্তাদের দায়মুক্ত করে তাদের প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা; এবং ঘ. জমিদার শ্রেণি ও উপনিবেশিক শাসকদের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তোলা।
সরকার পুরোপুরি না পারলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এ স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যগুলি অর্জনে সক্ষম হয়। রাজস্ব প্রদায়ক জমিদার শ্রেণী একটি নির্দিষ্ট ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যায়। সরকার এখন থেকে জানত জমি থেকে বছরে তাদের সঠিক কত রাজস্ব আসছে আর জমিদারও জানতেন সরকারের প্রতি তার চুক্তিগত কি দায়দায়িত্ব রয়েছে। এর আগে অবশ্য সরকার বা রাজস্ব প্রদানকারী কোনো তরফই জানত না রাজস্ব সংগ্রহ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে তাদের সঠিক অবস্থানটি কোথায়। রাজস্ব বিক্রয় আইন একটি ন্যূনতম পরিমাণ রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত করে যা ইতঃপূর্বে ছিল না।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জমিদারদের সাথে অাঁতাত গড়ার কাজে আশু সাফল্য আসেনি। এর কারণ, বন্দোবস্তের মূল শর্তাদি জমিদারদের তুষ্ট করতে পারে নি। তবে পরে তাদের অপরিসীম ক্ষমতা দেওয়ার পর এবং দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির আলোকে সরকারের রাজস্ব দাবি অনেক লঘু হয়ে আসায় ভূস্বামী শ্রেণি সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা পায়। এর ফলে সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। এর প্রমাণ সিপাহি বিপ্লব, স্বদেশী আন্দোলন ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকালে সরকারকে জমিদার শ্রেণির অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান।
তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দীর্ঘমেয়াদি মহত্তর উদ্দেশ্য ছিল। এ আইন পাস হওয়ার প্রাক্কালে কাউন্সিল সভার বিভিন্ন কার্যবিবরণী ও পত্রযোগাযোগ লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে। এ ব্যবস্থার প্রণেতারা অনুমান করেছিলেন, এ নতুন পদ্ধতি বলবৎ হলে তা প্রথমে কৃষিখাত ও কৃষিকাজ সংশ্লিষ্ট শিল্পে পুঁজিবাদী পরিবর্তনের সূচনা করবে এবং এর ফলে দেশে একটি শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হবে। আশা করা হয়েছিল, জমিতে স্বত্বাধিকার ও সরকারের চির অপরিবর্তনীয় রাজস্ব দাবির কারণে স্থানীয় জমিদারগণ ব্রিটেনের ভূস্বামীদের মতো উন্নয়নকামী ভূস্বামী হয়ে উঠবেন। মুনাফার প্রেষণা তাদেরকে তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি কৃষির বিভিন্ন খাতে যেমন, আবাদ বা বনজঙ্গল থেকে জমি উদ্ধার, সেচ, নিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ, যোগাযোগ খাত, কৃষিঋণ, উন্নততর বীজ, হাট-বাজার নির্মাণ, মাছ চাষ, গবাদি পালন ইত্যাদিতে বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাবে। প্রত্যাশা ছিল, কৃষিখাতে পরিবর্তন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে রূপান্তরের সূচনা করবে আর এভাবে এসব পরিবর্তন সম্মিলিতভাবে অভিশুল্ক ও করের আকারে সরকারের আয় বরাবর বাড়াতে থাকবে। মনে করা হয়েছিল, জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি চিরকালের মতো নির্দিষ্ট করে দিয়ে সরকার আগে দীর্ঘমেয়াদে যে ইচ্ছাকৃত ক্ষতি স্বীকার করেছিল এ ধরনের পরিস্থিতি তা বেশ ভালভাবে পুষিয়ে দেবে।
কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেপথ্যে শাসকদের যে দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যশা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন-পুরানো কোনো স্থানীয় জমিদারই কখনও ব্রিটেনের জমিদারদের মতো উন্নয়নমুখী জমিদার হয়ে উঠেনি। গ্রামবাংলার দৃশ্যপট বদলানোর ক্ষেত্রে জমিদারদের ব্যর্থতা সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তবে জমিদারগণ কেন এরকম আচরণ করলেন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে দারুণ মতপার্থক্য রয়েছে। পুঁজি সংগঠনমূলক উপকরণের সাহায্যে জমির উন্নতিবিধান না করে তারা বরং মহাজনি বিনিয়োগ, খাদ্যশস্যের ব্যবসায়, নতুন তালুক ক্রয়, বন্ড, উপ-কর (পবংং), শহরের বিষয়-সম্পত্তি, রায়তদের খাজনা বৃদ্ধি ও তাদের ওপর আবওয়াব বা অবৈধ উপ-কর আরোপ ইত্যাদিতে নিয়োজিত হন। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জমিদারদের এ ধরনের আচরণ যুক্তিসঙ্গত ছিল এ কারণে যে, পুঁজিবাদী বিনিয়োগের চেয়ে সামন্তবাদী শোষণ ছিল অধিকতর লাভজনক। জমিতে বিনিয়োগ কম মুনাফাজনক ও বেশি ঝুকিপূর্ণ ছিল বলে জমিদারদের তাদের পুঁজি জমিতে বিনিয়োগ করার কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি ছিল না। পক্ষান্তরে, ইংল্যান্ডে সে সময় কৃষিকে উৎসাহিত করার জন্য একটা শক্তিশালী শিল্পখাত গড়ে উঠেছিল। আর সে সাথে ওই দেশের সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা ও জমিমালিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাংলার উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে, জমিদারগণ সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। কৃষি খাতে উন্নতি বা প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্পায়নের প্রয়োজন অপরিহার্য। বাংলার কৃষি অর্থনীতি কোম্পানি শাসনে এ সুবিধা হারায়, কেননা এ দেশের শিল্পের ক্ষেত্রে যে বিরাট ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তাদের আমলে তা ধ্বংস হয়। ব্রিটিশ শাসনের আওতায় বারংবার দুর্ভিক্ষ, আকাল, দ্রব্যমূল্যের উঠানামা, স্থানীয় শিল্পের বিলুপ্তি, বিত্ত অপচয়মূলক বৈরী কারণ ইত্যাদি থেকে বাংলার কৃষি খাত কখনও মুক্ত থাকতে পারেনি। এ ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতি পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে অপচয়কারী ভোগবাদী সামন্ত মানসিকতা গড়ে উঠারই অনুকূল ছিল। বাংলার জমিদারশ্রেণী সে মানসিকতার বাস্তব প্রমাণও দিয়েছে।
সামন্ত মূল্যবোধের সবচেয়ে রেখাপাতযোগ্য যে বৈশিষ্ট্যটি জমিদারগণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরপরই অর্জন করেন তা হলো তাদের অনুপার্জিত আয়ে জীবন নির্বাহ করা। একটা বার্ষিক নির্ধারিত অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে তারা তাদের জমিদারির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ পাকাপাকিভাবে আরেক মধ্যস্বত্বাধিকারী শ্রেণির হাতে ছেড়ে দেন। অর্থাৎ, জমির নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র স্বত্বাধিকারী হিসেবে জমিদাররাও আরেকটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করলেন মধ্যস্বত্বাধিকারীর সঙ্গে। জমিতে কোনো মূলধন বিনিয়োগের দাবির ভিত্তিতে নয় বরং ওই জমিতে চিরস্থায়ী স্বত্বাধিকারের বলেই জমিদাররা চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করে। স্থায়ী অধিকার লাভের ফলে এ নতুন মধ্যস্বত্বাধিকারীরাও আবার উপবন্দোবস্ত দিতে থাকে। আর এভাবে ভূ-স্বত্বে একের নিচে আরেক পর্যায়ক্রমিক স্তর তৈরি হতে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কয়েক স্তরে পৌঁছায়। বাকেরগঞ্জে এরকম পনেরটি স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়।
এভাবে ভূমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সোপানক্রমিক মধ্যস্থ শ্রেণির আবির্ভাবের সুগভীর আর্থসামাজিক তাৎপর্য ছিল। রাজস্ব জরিপ (আনু. ১৮৬০-১৮৭০) এবং জরিপ ও বন্দোবস্ত কার্যক্রমের (আনু. ১৮৮৬) রেকর্ডপত্র থেকে দেখা যায়, যেসব জমিদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে তাদের পরবর্তী মধ্যস্বত্বশ্রেণী ভূমি ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পুরানো জমিদার। মধ্যস্বত্ব মানে প্রজার ওপর খাজনার অতিরিক্ত চাপ। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, জমিদার ও মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্তধারীর অধিকারের স্থিতি এবং খাজনার চড়াহার ও মধ্যস্বত্ব পরস্পর-সম্পর্কিত। মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্তের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এটি হলো, এ যাবৎকালের বনজঙ্গলময় এলাকায় আবাদি জমির সম্প্রসারণের প্রয়াসে এ ধরনের বন্দোবস্তধারীদের ইতিবাচক ভূমিকা।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে বিস্তীর্ণ এলাকার জলাজঙ্গলাকীর্ণ জমি আবাদ করে ফসল ফলানোর কাজটি ছিল প্রধানত এ মধ্যস্থ শ্রেণির বন্দোবস্তধারীর কৃতিত্ব। এরাই তাদের পুঁজি সংগঠন ও জনশক্তি খাটিয়ে এ জমির আবাদ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়। তবে মধ্যস্বত্বভোগীর উৎপাদনশীল ভূমিকা বিশ শতকের শুরুতে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তখন পরিস্কার ও পুনরুদ্ধারের জন্য আর কোনো খালি জমি অবশিষ্ট ছিল না। তাই এর সাথে সাথে রায়তদের ঠিক উপরের স্তরটি ছাড়া সকল শ্রেণির মধ্যস্থ বন্দোবস্তধারীর ভূমি ব্যবস্থাপনায় আর কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে এরা নিতান্তই চাষির ফসল ও অন্যান্য উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল এক পরজীবীতে পরিণত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করার অব্যবহিত পরেই জমিদারের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দেয়। এর পরে একটা সময়ের জন্য এ ব্যবস্থায় স্থিতি বিরাজ করে। এমনকি, জমিদার শ্রেণির একটা তুলনামূলক সমৃদ্ধিও দেখা দেয়। কয়েক দফা আইনে (১৭৯৫-এর ৩৫ নং প্রবিধান, ১৭৯৯-এর ৭ নং প্রবিধান, ১৮১২ সালের ৫ নং প্রবিধান এবং ১৮১৯-এর ৮ নং প্রবিধান) প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ক্ষমতাবলে জমিদারগণ তাদের খাজনা বৃদ্ধি ও দ্রুত আদায়ের অধিকার লাভ করেন। রাজস্ব বকেয়া থাকার কারণে জমিদারি তালুকের প্রকাশ্য বিক্রয় ১৮২০ সালের পর থেকে বিরল ঘটনা হয়ে ওঠে। ১৮১৩ সালে বাংলা অবাধ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর এখান থেকে প্রাথমিক পণ্যাদি আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানি হতে থাকে ও জমিদারি আয়ের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সে কারণে কৃষি সম্প্রসারণ, বাণিজ্যিক জাতের ফসলের আবাদ ও মূল্যের ঊর্ধ্ব গতি এ সবই জমিদারি অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব ফেলে।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জমিদার শ্রেণির সমৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের জীবনে অনুরূপ সমৃদ্ধি আসে নি। চাষির উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদা যেমন, আবওয়াব, তুহুরি, দস্তরি, ভেট, নজরানা, বেগার, সালামি ইত্যাদি রূপে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করে। ফলে চাষিরা শুধু খাজনা পরিশোধ ও জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সে পরিমাণ উৎপাদন করে যেতে থাকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্ব পর্যায়ের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে বাংলা সম্পর্কিত হবার পর, পল্লী জনপদের জীবনধারণ ও অর্থনীতি আরও প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে। বাংলার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গে ১৮৫০-এর দশকের শেষভাগ থেকে কয়েক দফা কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এ ছিল জমিদার ও রায়তদের মধ্যে ক্ষুণ্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে সাঁওতাল পরগনায় কৃষক গোলযোগ (১৮৫৫) দিয়ে এ সঙ্কটের সূচনা ঘটে। এরপর নীল চাষ হয় এমন সব জেলায় দেখা দেয় নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১)। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত নীল প্রতিরোধ আন্দোলন চলে। ১৮৭০-এর দশক ও ১৮৮০-র দশকের প্রথমভাগে কৃষক প্রতিরোধ উদ্বেগজনক মোড় নেয়। এ সময় বাংলার কোনো কোনো এলাকায় চাষিরা জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ও জমিদারদের উদ্বৃত্ত শোষণ ন্যূনতম করার লক্ষ্যে একত্রে জোট বাঁধে। এ আমলে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনগুলি হলো তুষখালি (বাকেরগঞ্জ) কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫), পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩), ময়মনসিংহ উপজাতীয় কৃষক আন্দোলন (১৮৭৪-১৮৮২), মুন্সীগঞ্জ (ঢাকা) কৃষক আন্দোলন (১৮৮০-৮১) ও মেহেন্দীগঞ্জ (বাকেরগঞ্জ) কৃষক বিদ্রোহ (১৮৮০-৮১)। ফরায়েজীরা (মুসলিম সংস্কারবাদী একটি সম্প্রদায়) কৃষক স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে এবং গোটা দেশজুড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় জমিদারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম গড়ে তোলে। এ প্রতিরোধ আন্দোলনরত চাষি জোটগুলির অভিন্ন দাবি ছিল জমিতে রায়তের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
এসব বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয় শুরু হয়। স্বত্বাধিকারী তথা জমির মালিক শ্রেণি রায়ত বা প্রজাদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। রায়তগণ জমিতে তাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়। জমিদারগণ বিদ্রোহী রায়তদের সামাল দিতে না পেরে তাদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের সাহায্য, এমনকি প্রয়োজনে বিদ্রোহ শান্ত করার জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য চায়। উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য রক্ষার কারণে এর প্রয়োজন দেখা দেয়। কৃষকদের প্রতিবাদ-আন্দোলন সম্পর্কিত প্রায় সকল সরকারি প্রতিবেদনে জমিদার শ্রেণির দুর্বল অবস্থার কথা, বিশেষ করে এর দারিদ্রাবস্থার উল্লেখ করা হয়। উত্তরাধিকার আইনের কারণে তালুকগুলির বিভক্তি ও পুনর্বিভাজন ঘটে। এ ছাড়াও পারিবারিক কলহ, বিবাদ-বিসম্বাদ, জমিদারিতে অনুপস্থিতির প্রবণতা, মধ্যস্থ বন্দোবস্ত সৃষ্টি, স্বত্বাধিকারীর অকাল মৃত্যু, ব্যয়বাহুল্য ও আরও নানাবিধ কারণে জমিদার শ্রেণি কাঠামোটি অবক্ষয়ের কবলে পড়ে। উনিশ শতকের প্রথম ২৫ বছরে মধ্যস্বত্ব বা মধ্যস্থ বন্দোবস্তধারী ব্যক্তিদের অবয়বে এক অবস্থাপন্ন ও প্রত্যয়ী আবাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, জোতদার, হাওলাদার ও অন্যান্য বিত্তবান কৃষকের আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
খাজনা আইন ১৮৫৯ পরিস্থিতি এগিয়ে চলার মুখে কৃষক সমাজকে, বিশেষ করে স্বত্বাধিকারী ধনী চাষিদের আর উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হলো না। সিপাহি বিপ্লব ও তার কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত নীলচাষিদের বিদ্রোহজনিত গোলযোগের কারণে পল্লী জনপদের স্বার্থ আরও উপেক্ষিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে সরকার সজাগ হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যিক প্রয়োজনে অনুগত জমিদারদের রক্ষার তাগিদ ছিল জরুরি। যুগপৎ প্রতিবাদী কৃষককুলকে রক্ষাও হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। এ উপলব্ধির স্থির প্রকাশ ঘটে ১৮৫৯ সালে খাজনা আইন পাশ হওয়ার মধ্যে। এ আইনে অন্তত কোনো কোনো শ্রেণির রায়তের অধিকারের স্বীকৃতি দানের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। রায়তদের ঐতিহ্যগত ধারায় খুদকশ্তস্ত ও পাইকাশতা নামে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। এখন এসবের পরিবর্তে চাষিসমাজকে আইনগতভাবে ও খাজনা আইনের আওতায় তিনটি বর্গে বা গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। এগুলি হলো: ক. পাইকাশতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ৩নং ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হারের খাজনায় জমিরক্ষক রায়ত; খ. ভূমি দখলে রাখার রায়ত অর্থাৎ ১২ বছরেরও বেশি সময় জমিতে দখলদার রায়ত (৬ নং ধারা), এবং গ. জমিতে দখলাধিকার নেই এমন রায়ত। এ রায়তদের নিয়ন্ত্রণের জন্য খাজনা পাট্টা পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। এখন থেকে খাজনা পরিশোধের বিষয়টি পাট্টার শর্তাবলি দ্বারা নির্ধারিত হতে থাকে। এতে বার্ষিক খাজনার পরিমাণ (নগদ বা বস্ত্ততে) নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় যার অতিরিক্ত কোনো আবওয়াব আরোপের অধিকার জমিদারদের রইল না। এ ধরনের আবওয়াব আরোপ এখন থেকে দন্ডযোগ্য অপরাধ (২নং ধারা) বলে গণ্য হয়। হফতম আইনে (১৭৯৯-এর ৭নং প্রবিধান) জমিদারগণ প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী যেকোন শ্রেণির রায়তকে কাচারিতে হাজির হতে বাধ্য করতে ও খাজনা খেলাপি হবার জন্য তাদের শারীরিকভাবে নিগৃহীত করতে পারতেন (১১ নং ধারা)। জমিদারগণ তাদের এ ক্ষমতা থেকেও বঞ্চিত হয়। খাজনা আইনের আওতায় জমিদার কর্তৃক প্রথম শ্রেণির (কায়েমি) রায়তদের যাদের খাজনা চিরস্থায়িভাবে নির্দিষ্ট তাদের খাজনা বৃদ্ধি নিষিদ্ধ করা হয়। জমিদারি বিনিয়োগ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণ প্রদর্শন না করে দখলদার রায়তের খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতাও জমিদাররা হারান। অ-দখলদার রায়তের জমির খাজনাও ঘন ঘন বৃদ্ধি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঐ সময় নাগাদ সরকারি সমর্থনের ওপর অতি নির্ভরশীল জমিদারদের এ খাজনা আইনের বিরোধিতা করার মতো সাহস ছিল না। তবে তারা এ আইন উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। তারা ভালো করেই জানত যে আইন মানেই তা সর্বদা বলবৎ-যোগ্য নয়। তারা আগের মতোই জমির খাজনা বাড়িয়ে যেতে থাকে। এরপরও খেলাপি রায়তদের আগের মতোই কাচারিতে ডেকে নিয়ে বকেয়া আদায়ের জন্য তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। দখলিস্বত্বও সচরাচর অস্বীকার করা হয়। ফলে জমিদার ও প্রজার সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটে, যার ব্যাপ্তি বোঝা যায় ১৮৭০ এবং ১৮৮০ দশকের ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ থেকে।
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ ১৮৭০-এর দশকের ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষ সরকারের জন্য আর্থরাজনৈতিক কারণে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ১৮৭৯ সালে জমিদার-প্রজার (রায়ত/চাষি) মধ্যকার উত্তেজনাকর সম্পর্কের বিষয়ে তদন্ত করে ও সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিকারমূলক সুপারিশমালা পেশ করার জন্য একটি খাজনা কমিশন গঠিত হয়। এ খাজনা কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রেই ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উদ্ভব ঘটে। এ আইনে প্রথমবারের মতো জমির সর্বোচ্চ স্বত্বাধিকারী থেকে শুরু করে সর্বনিম্নস্তরে জমিচাষি অর্থাৎ জমিতে স্বার্থধারী বিভিন্ন পক্ষের অধিকারগুলি সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নেওয়া হয়। বাস্তবিকপক্ষে, এ আইন জমিদারের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট ছাঁটাই করে দেয়।
বঙ্গীয় খাজনা আইন নিঃসন্দেহে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল কাঠামোতে যথেষ্ট পরিবর্তন আনয়ন করে। এখন থেকে জমিদার জমিতে অন্যতম স্বার্থগোষ্ঠী হয়ে ওঠেন মাত্র, যদিও তিনি সব স্বার্থধারীর চেয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নততর স্বার্থধারী হিসেবেই থেকে যান। তবে এবার আইন বাস্তবায়ন তথা বলবৎ করার বিষয়ে সরকার আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের বাস্তবায়ন নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা হয় এবং দেখা যায় যে, এ আইন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দেশের পল্লী অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে।
১৯২০-এর দশকে আবার কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯১৯ সালের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রার্থীদের গণসংযোগের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক ছিল। এ প্রয়োজনের তাগিদে সকল বড় রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ দলীয় সংগঠনের কৃষক শাখা প্রতিষ্ঠা করে। কৃষক শাখাসংগঠনগুলি কৃষি খাতে যেসব সমস্যা চাষিদের বিপর্যস্ত করছে সেগুলি সম্পর্কে তাদেরকে সজাগ ও সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করে। এভাবে রায়ত বা প্রজারা বামপন্থি সংগ্রামী-কর্মীদের দ্বারা সক্রিয় ও অধিকারসচেতন হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে যে, এখনও তারা জমির গাছ কাটা, একটা নির্ধারিত মেয়াদের বেশি সময়ের জন্য জমি বন্ধক রাখা, জমি স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া জমি হস্তান্তর, কোনো পাকা কাঠামো নির্মাণ, পুকুর খনন ইত্যাদির ব্যাপারে বঞ্চিত রয়ে গেছে। এ সমস্ত কাজের জন্য জমিদারের অনুমোদন প্রয়োজন হতো আর বলাবাহুল্য, সালামি পরিশোধ ছাড়া এতে জমিদারের অনুমোদন পাওয়া যেত না। ১৯২৮ সালে সংশোধনী এনে এসব ক্ষেত্রে প্রায় সকল বিধিনিষেধ দূর করা হয়। সংশোধিত আইনের আওতায় রায়তগণ জমিদারের অনুমতি ছাড়াই তাদের জমি হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে, তবে হস্তান্তরের জন্য জমিদারকে সালামি প্রদানের বিধান বহাল থেকে যায়। জমিদারের ওই জমি কেনার অগ্রাধিকারও বহাল থাকে। চাষিরা জমিদারের অনুমতি ছাড়াই তাদের জমিতে গাছ ও পুকুর কাটা এবং পাকা কাঠামো নির্মাণের অধিকার লাভ করে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস ও এ আইনের বাস্তবায়ন পর্যায়ে কৃষক রাজনীতি নতুন করে উদ্দীপিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চাষিদের সমস্যাগুলিকে শানিত করে তোলে। কৃষক প্রজা পার্টি নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এ দলের দৃঢ় অঙ্গীকার ছিল প্রধানত প্রজা শ্রেণির স্বার্থরক্ষা। এ দলের নেতা এ.কে ফজলুল হক অঙ্গীকার করেন, তিনি কখনও ক্ষমতায় গেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত করবেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলার সরকার গঠন করেন। অচিরেই হক মন্ত্রিসভা ভূমি রাজস্ব কমিশন নামে একটি কমিটি (সাধারণভাবে, ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত) গঠন করেন। এ কমিশনের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার অবসান ঘটানো। অবশ্য এ কমিশনের কাছ থেকে সুপারিশ পাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে হক মন্ত্রিসভা তাদের নির্বাচকমন্ডলীর ন্যূনতম সন্তুষ্টির জন্য ১৯৩৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে আরেকটি সংশোধনী (৬নং আইন) আনয়ন করে। এর আওতায় সালামি ব্যবস্থা ও রায়তি জমি হস্তান্তরের বেলায় জমিদারের ক্রয়াগ্রাধিকার বিলুপ্ত করা হয় এবং বর্গাদার বা ভাগচাষিদের কোনো কোনো অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালের ৬নং আইনবলে প্রজারা তাদের জমির কার্যত স্বত্বাধিকারী হয়ে ওঠেন।
ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০ সালে তার প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশন লক্ষ্য করে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে জমিদারি ব্যবস্থা আর বহাল রাখা যায় না। তারা এ জমিদারি ও সেইসাথে জমিতে খাজনা আদায়কারী সকল মধ্যস্থ স্বার্থধারী পক্ষের অস্তিত্ব বিলোপ করার সুপারিশ করে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রজাস্বার্থের প্রবক্তা ফজলুল হক রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এ সাহসিক কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। ফলে ফ্লাউড কমিশন রিপোর্ট অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
উত্তরবঙ্গের তেভাগা আন্দোলনএর (১৯৪৬-৪৭) ঘটনাপ্রবাহ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মহলের চেয়ে নিপীড়িত কৃষককুলই অনেক বেশি ভূমি সংস্কারের পক্ষপাতী ছিল। ব্যাপক তেভাগা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলা সরকারের তৎকালীন প্রধান হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী আইন হিসেবে অনুমোদন করানোর জন্য ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে দুটি বিল আইনসভায় আনয়ন করেন। বিল দুটি হলো জমিদারি (তালুক) অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব বিল এবং বঙ্গীয় বর্গাদার (বিধান) বিল। এর উদ্দেশ্য ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলুপ্তি ও বর্গাদারদের অবস্থানগত মর্যাদার উন্নতি বিধান করা। দেশ বিভাগের রাজনীতির কারণে বিল দুটি শেষ পর্যন্ত আইনে পরিণত করা যায় নি। অবশ্য দেশবিভাগের পর এ বিলগুলিই নতুন বিল আকারে পেশ করা হয়। এ বিলের নাম দেওয়া হয় পূর্ববঙ্গীয় জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব বিল, ১৯৪৮। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিলটি ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এ পরিণত হয়। এ আইনের আওতায় শেষ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার অবসান ঘটে। এখন থেকে রায়ত বা প্রজাগণ জমির মালিক বা স্বত্বাধিকারী হিসেবে অভিহিত হয়। আর সরকারের প্রজা হিসেবে সরকারকেই তারা সরাসরি খাজনা প্রদান করতে থাকে। [সিরাজুল ইসলাম]