বেগার

বেগার (বাধ্যতামূলক শ্রম, ‘কর্ভি’)  এক ধরনের বিনা পারিশ্রমিকের সামাজিক শ্রম। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থের প্রচলনের আগে শ্রমই বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। জমিতে স্বল্পমেয়াদি অধিকারের বিনিময়ে কৃষকগণ রাজা, রাজার সাঙ্গপাঙ্গ এবং পুরোহিতদের জমি চাষবাস করত। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় কাঠামো আরও ব্যাপক ও জটিল রূপ ধারণ করলে শাসকশ্রেণির, বিশেষ করে ভূস্বামীদের খাসজমির কাজ তাদের প্রজারা বা অধীনস্থ ব্যক্তিবর্গ বিনামূল্যে করে দিত। পুরোহিত শ্রেণির জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান পুণ্য হিসেবে গণ্য হতো। গ্রামবাসীরা মন্দিরের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করত। এরূপ বিনামূল্য শ্রমপ্রথা অবশ্য দাসপ্রথা বা চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা থেকে স্বতন্ত্র ছিল। বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম ছিল জমিতে প্রাপ্ত কোন অধিকার অথবা শাসকদের কাছ থেকে বা মন্দিরগুলি থেকে প্রাপ্ত  কোন অপ্রত্যক্ষ সুবিধার বিনিময়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় জমিদারগণ তাদের খাসজমিকে নিজ জোত বা খামার জমি হিসেবে রাখার অধিকার ভোগ করত। কৃষিশ্রমিক না থাকায় বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক, যথা: কৃষি কাজে নিয়োজিত দাস, পাইকাশ্ত বা অনাবাসিক রায়ত, এবং জমিদারের ভৃত্য জমিদারি খামার জমি চাষবাস করত। প্রতিটি সচ্ছল জমিদারিতে মেয়াদকালীন চাকরান ব্যবস্থা ছিল। তদনুযায়ী ভৃত্যদের পাওনা ছিল খাজনা ব্যতিরেকে জমি চাষের সুবিধা। সুযোগ প্রদান বা সাহায্য-সেবাও পাওনা পরিশোধের পদ্ধতি ছিল। তবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যখন বৃহদাকারে ফসল ভাগাভাগি বা বর্গাপ্রথার প্রচলন হয় তখন বেগার একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বর্গা দেওয়ার মতো জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় বর্গাচাষিরা সুবিধাজনক শর্ত আদায় করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেক ভূস্বামী এমন শর্তেও বর্গা দিত যে, বর্গাদারকে কেবল ফসলের অর্ধেক দিলেই চলবে না, বিনামূল্যে মালিকের ক্ষেতও চাষ করে দিতে দেবে। বর্গাদারকে বিনা পারিশ্রমিকে, বড়জোর এক পেট খেয়ে, নির্দিষ্টসংখ্যক দিনে মালিকের জন্য কাজ করতে হতো, আর তা কেবল ক্ষেতেই নয়, অন্যত্রও, যেমন: পুকুর ও খাল খনন, ফসল মাড়াইয়ের ব্যবস্থাকরণ, বাজারে মাল পরিবহণ, গবাদিপশুর দেখাশোনা করা, মাছ ধরা ইত্যাদি কাজেও শ্রম দিতে হতো। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব জেলাগুলিতে, যেখানে ভূস্বামীদের ক্ষেতে আদিবাসী বর্গাচাষিদের কাজ করতে বাধ্য করা হতো, বেগার শ্রম ছিল প্রায় সর্বজনীন। এ ধরনের শ্রমনিয়োগ পদ্ধতির বিরুদ্ধে বর্গাচাষিদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছিল। ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলন কেবল বর্গা প্রথারই নয়, বেগার পদ্ধতির বিরুদ্ধেও ছিল সোচ্চার। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বেগার পদ্ধতিরও আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। [সিরাজুল ইসলাম]