রায়ত

রায়ত  মুগল ও ব্রিটিশ আমলে প্রথাগত ও আইনসম্মতভাবে বাংলার কৃষককুলকে বোঝানোর জন্য ‘রায়ত’ শব্দটি ব্যবহূত হতো। কিন্তু ব্যাপক অর্থে এটি রাষ্ট্রের প্রজাসাধারণ ও শাসকশ্রেণীর অধীনস্থদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হতো। সম্ভবত টোডরমলের বন্দোবস্তে (১৫৮২) শব্দটি প্রথম ব্যবহূত হয় এবং তখন থেকে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট একুইজিশন অ্যাক্ট ১৯৫০ প্রণয়নের মাধ্যমে আইনগত ও ব্যবহারিকভাবে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ শব্দটি প্রচলিত ছিল। এ আইনে রায়তদের নতুন নাম হয় ‘মালিক’। কিন্তু এ নামটি কখনই জনস্বীকৃতি পায়নি। বিভিন্ন শ্রেণির কৃষকদের বোঝানোর জন্য বর্তমানে জোতদার (অতি ধনাঢ্য চাষি), গৃহস্থ (মোটামুটি ধনাঢ্য চাষি), কৃষক (সাধারণ চাষি), চাষি (প্রান্তিক চাষি), বর্গাদার (ভাগচাষি), মজুর (কৃষি শ্রমিক) প্রভৃতি শব্দ ব্যবহূত হয়ে থাকে।

রায়ত শব্দটির উৎপত্তি আরবি রঈয়ৎ (রা’আ) থেকে। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে এর অর্থ ‘চারণভূমির পশুপাল’ এবং সমষ্টিগত অর্থে ‘প্রজা’। মুগল রাজস্ব ব্যবস্থায় রায়ত ছিল একজন চাষি, একজন রাজস্ব ইজারাদার। কৃষি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত যেসকল লোক জমির মালিকদের মাধ্যমে অথবা অন্যভাবে রাষ্ট্রের খাজনা পরিশোধ করত তারাই ছিল রায়ত। মুগল সংবিধানে রায়তদের জমির উপর অধিকার ছিল। এ অধিকার পরগনার প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি দ্বারা সংরক্ষিত ছিল। মুগলদের ভূমি ব্যবস্থায় দুধরনের রায়ত ছিল, খুদকাশত ও পইকাশত রায়ত। খুদকাশত রায়ত ছিল গ্রামের স্থায়ী আবাসিক চাষি। মুসলিম ও হিন্দু উত্তরাধিকার আইনানুযায়ী তাদের উত্তরাধিকারীরা ভূমিস্বত্ব লাভ করত। পইকাশত রায়তরা কোন নির্দিষ্ট মৌজায় স্থায়িভাবে জমি চাষ করত না। চাষযোগ্য জমির খোঁজে তারা এক মৌজা থেকে আরেক মৌজায় ঘুরে বেড়াতো এবং স্থানীয় জমির মালিক ও কৃষকদের সঙ্গে কোন একটি ফসল মৌসুমের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধাজনক শর্তে নিজেদের নিয়োজিত করত। পইকাশত রায়তগণ খুদকাশতদের তুলনায় সাধারণত অনেক নিম্নহারে কর দিতো। কড়া দরকষাকষির মাধ্যমে এ লভ্যাংশ আসত। কিন্তু পইকাশত রায়তদের সামাজিক মূল্য দিতে হতো অনেক বেশি, কারণ জমির ওপর তাদের অধিকার ছিল মাত্র একটি মরসুমের জন্য এবং এ কারণে উত্তরাধিকারসূত্রে তা হস্তান্তর হতো না। অনেক খুদকাশত রায়ত অধিক লাভের আশায় এবং একই সঙ্গে খুদকাশত অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তাদের জমি পইকাশত রায়তদের দ্বারা চাষ করাত। অন্য দিকে প্রতিযোগিতামূলক হারে ঠিকায় জমি চাষের জন্য নিজেরাই অন্য গ্রামে চলে যেতো।

যতদিন পর্যন্ত জমি ও কৃষকের সম্পর্ক মানুষের কল্যাণের পক্ষে ছিলো, ততদিন পর্যন্ত পইকাশত পদ্ধতির চাষাবাদই কৃষি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে আসছিলো। উনিশ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পইকাশত রায়তদের আর্থিক সুবিধাগুলি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে বিভিন্ন শ্রেণির রায়তদের অধিকার সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এ আইনে রায়তদের তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়- যেমন, আবাসিক রায়ত (পূর্বেকার খুদকাশত রায়ত), দখলি রায়ত (যারা ১২ বছর বা তারও অধিককাল জমিতে অব্যাহত দখলদার) এবং অদখলি বা অধীনস্থ রায়ত (ব্যাপকার্থে পইকাশত রায়তদের অবশিষ্টাংশ)। এ আইনানুসারে উচ্চতর দুই শ্রেণির রায়তরা জমিদারকে সেলামি প্রদান করে তাদের রায়তি জমি হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে। ১৯২৮ ও ১৯৩৮ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধনী) দ্বারা উচ্চতর রায়তদের অধিকার আরও সুরক্ষিত হয়। এ সংশোধিত আইনে জমিদারকে সেলামি প্রদান ব্যতিরেকে এবং তাদের পূর্বানুমতি ছাড়াই রায়তকে জমি হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের সাথে সাথে রায়তরা জমির প্রকৃত মালিকে পরিণত হয় এবং তখন থেকে তারা আইনত জমির মালিক হিসেবে পরিচিত হয়।

এটা অবশ্যই লক্ষণীয় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধানের আওতায় রায়তদের আইনত প্রজা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেও ভূমিতে অধিকারহীন প্রজা হওয়ার ধারণার সাথে তারা কখনোই আপস করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শুরু থেকে কৃষক সম্প্রদায়ের সচেতন অংশ যুক্তি দিয়ে আসছিল যে, প্রথা ও রীতিনীতি অনুযায়ী জমির ওপর তাদের অধিকার আছে এবং নিজস্ব খেয়ালখুশি মতো তাদের উৎপাদন কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন অধিকার জমিদারদের নেই। জমির ওপর নিজেদের অধিকার প্রমাণের জন্য রায়তরা প্রায়শই জমিদারদের মালিকানা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলত। উনিশ শতকের সত্তরের দশক ও আশির দশকের শুরুতে কয়েক দফা কৃষক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জমির ওপর সকল পক্ষের অধিকার ও দায়িত্ব নিরূপণ করে বঙ্গীয়  প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ প্রণয়ন করতে সম্মত হয়।

রায়ত ও প্রজার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। রায়তের ন্যায় প্রজাও একজন কৃষি উৎপাদক। ইতিহাসে দেখা যায় যে, প্রাচীন যুগে একজন প্রজা কখনো রাজার ‘ভাড়াটে’ ছিলো না। প্রজা ছিল সরাসরি রাজার অধীনে এবং জমির ওপর তার সুনির্দিষ্ট অধিকার ছিলো। রাজারা সর্বদা এ অধিকারকে মর্যাদা দিতেন। কিন্তু মুগল আমলে এসে ‘প্রজা’ শব্দটির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। কেননা এসময় একজন প্রজা জমিদারের ‘নিজ জোতে’ বা খাস জমিতে একজন পুরুষানুক্রমিক শ্রমিক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে জমিদারগণ রায়তদের সবসময় তাদের প্রজা বলতেন। পক্ষান্তরে প্রজারা তাদেরকে রায়ত নামে অভিহিত করার দাবি জানাত, কারণ প্রজা ও রায়তের সামাজিক অবস্থানও এক নয়, জমির ওপর অধিকারের বেলায়ও এক নয়। প্রজা অধীনস্ত যা রায়ত নয়। অবশ্য বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘প্রজা’ শব্দটি পুনরায় ব্যাপক ব্যবহারে চলে আসে এবং রায়তের পরিবর্তে প্রজা নামে কৃষক সংগঠনগুলির নামকরণ করা হয়- যেমন, নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি, ত্রিপুরা প্রজা সমিতি, কৃষক প্রজা পার্টি ইত্যাদি। এভাবে মুগল আমল ও ব্রিটিশ আমলের বেশির ভাগ সময়ে যে ‘রায়ত’ শব্দটির একটি মর্যাদাসম্পন্ন অভিধা ছিলো, বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এটি অর্থ ও গুরুত্বের দিক থেকে সেকেলে হতে থাকে এবং ১৯৫০ সালে সংবিধান থেকে আইনী দুর্বোধ্য শব্দ হিসেবে মুছে ফেলার পর এটি একসময় বিস্মৃত শব্দে পরিণত হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]

আরো দেখুন  কৃষক সমাজ; কৃষক আন্দোলন; চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত; |বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫; গ্রামীণ ঋণিতা

গ্রন্থপঞ্জি  Sunjeeb Chunder Chatterjee, Bengal Ryots: Their Rights and Liabilities (first published 1864), edited by Anil Chandra Banerjee and Bimal Kanti Ghose (Calcutta 1977); Chittabrata Palit, Tensions in Bengal Rural Society: Landholders, Planters and Clnial rule 1830-1860 (Calcutta 1975); Sirajul Islam, The Permanent Settlement in Bengal: A Study of its Operation 1790-1819; Akbar Ali Khan, Some Aspects of Peasant Behaviour in Bengal: A Neo   Classical Analysis, (Asiatic Society of Bangladesh 1982).