বখতিয়ার খলজী
বখতিয়ার খলজী ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে নদীয়া জয় করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। উত্তর আফগানিস্তানের গরমশির (আধুনিক দস্ত-ই-মার্গ) এলাকার বাসিন্দা ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী তুর্কি জাতির খলজী সম্প্রদায়র্ভুক্ত ছিলেন। গজনীতে তিনি তাঁকে সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য মুহম্মদ ঘুরীর নিকট আবেদন করেন। কিন্তু খর্বাকৃতি ও বাহুদ্বয় হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ভগ্নমনোরথ হয়ে বখতিয়ার অতঃপর দিল্লির দিকে অগ্রসর হন এবং কুতুবউদ্দীন আইবকের অধীনে চাকরি প্রার্থী হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। এরপর তিনি বদাউনে যান এবং সেখানে তিনি মালিক হিজবরউদ্দীন কর্তৃক একটি নিম্নপদে নিযুক্ত হন। অল্পকাল পরেই তিনি বদাউন পরিত্যাগ করে অযোধ্যায় উপস্থিত হন। বাদাউনের শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দীনের অধীনে তিনি মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলী নামে দুটি পরগণার জায়গির প্রাপ্ত হন এবং মুসলমান রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে সীমান্ত রক্ষীর কাজে নিয়োজিত হন। এখান থেকেই বখতিয়ার খলজী তাঁর ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টায় সফল হন। তিনি সীমন্তবর্তী ছোট ছোট হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করে সম্পদ বৃদ্ধি করেন এবং খলজী সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোক তাঁর দলভূক্ত হলে সৈন্যসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বিহার আক্রমণ করেন এবং তাঁর সৈন্যদল বৌদ্ধদের শিক্ষাকেন্দ্র ওদন্তপুরী বৌদ্ধবিহারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। অতঃপর তারা সে স্থান থেকে মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করে প্রত্যাবর্তন করে। তিনি কুতুবউদ্দীন আইবকের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে মূল্যবান উপহার প্রদান করেন। অপরপক্ষে কুতুবউদ্দীনও তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। অতঃপর ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে তিনি ঝাড়খন্ডের দুর্গম অরণ্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে লক্ষ্মণসেন এর অবকাসকালীন রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন। বলা হয়ে থাকে যে, মাত্র সতের জন ঘোড় সওয়ার সৈন্য লক্ষণসেনের সঙ্গে নগরে প্রবেশ করেছিল। নগরবাসীরা তাঁকে ঘোড়া ব্যবসায়ী বলে মনে করেছিল এবং সে কারণেই বখতিয়ার খলজী অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সহজেই রাজপ্রাসাদ দখল করতে পেরেছিলেন। রাজা লক্ষ্মণসেন নৌপথে তাঁর রাজধানী বিক্রমপুরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বখতিয়ার খলজীর মূল বাহিনীও এসে পড়েছিল। ফলে নদীয়া মুসলমানদের অধিকারে আসে।
বখতিয়ার খলজী স্বল্প সময়ের জন্য নদীয়ায় অবস্থান করেন এবং পরে তিনি গৌড়ের দিকে যাত্রা করেন। তিনি ৬০১ হিজরিতে (১২০৫ খ্রি.) বিনা বাধায় গৌড় জয় করেন এবং লখনৌতি নাম দিয়ে সেখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। পূর্বে গৌড়ের নাম ছিল লক্ষণাবতী। বখতিয়ার খলজীর রাজ্য উত্তরে বর্তমান পূর্ণিয়া শহর থেকে দেবকোট (দিনাজপুর) জেলা হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে সোজাসুজিভাবে রংপুর শহর পর্যন্ত, দক্ষিণে পদ্মা নদী, পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী এবং পশ্চিমে তাঁর পূর্ব অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বখতিয়ার খলজীর জীবনের শেষ উল্লেখযোগ্য কাজ তিববত অভিযান। তিনি লোক মারফত তিববতে যাওয়ার পথ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। আলী মেচ নামের মেচ উপজাতির এক ব্যক্তি পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে বখতিয়ার খলজীর পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তিববত অভিযান পরিচালনা করার পূর্বে বখতিয়ার খলজী তাঁর রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং রাজ্যের প্রতিরক্ষাকল্পে প্রয়োজনানুরূপ ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। তিনি তিনটি সীমান্ত প্রশাসকের পদ সৃষ্টি করেন এবং শিরাণ খলজী, আলী মর্দান খলজী এবং হুসামউদ্দীন ইওজ খলজীকে যথাক্রমে লখনৌর, ঘোড়াঘাট ও তান্ডায় নিযুক্ত করেন।
বখতিয়ার খলজী দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ৬০২ হিজরির (১২০৬ খ্রি.) প্রথম দিকে দেবকোট হতে বেগমতী নদী বরাবর যাত্রা করেন। তিনি প্রাচীন একটি সেতুর মাধ্যমে নদী অতিক্রম করে পার্বত্য এলাকার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে স্থানীয় লোকদের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তিনি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং অবশেষে প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর প্রত্যাগমন ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি একশত জনের কিছু বেশি সংখ্যক সহচর নিয়ে দেবকোটে পৌঁছেন। দেবকোটে বখতিয়ার খলজী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অসুস্থ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মিনহাজ ই সিরাজের বর্ণনানুসারে, তিনি আলী মর্দান খলজী কর্তৃক ছুরিকাঘাতে ৬০২ হিজরিতে (১২০৬ খ্রি.) নিহত হন।
বখতিয়ার খলজী একজন সুশাসক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন এবং সেগুলির শাসনভার তাঁর প্রধান অমাত্য ও সামরিক প্রধানদের ওপর ন্যস্ত করেন। তাঁদেরকে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা, রাজস্ব আদায় করা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং জনগণের পার্থিব ও নৈতিক উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপনের পর খুৎবা পাঠ করেন এবং দিল্লীর সুলতান মোহাম্মদ ঘুরীর নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনি দিনাজপুর ও রংপুরের নিকট দুটি ছাউনি শহর নির্মাণ করেন। তাঁর সময়ে প্রচলিত প্রশাসনিক বিভাগকে ইকতা এবং এর শাসনকর্তাকে মুকতা বলা হতো। তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]