দীউয়ানি
দীউয়ানি মুগল যুগের প্রাদেশিক রাজস্ব শাসন পদ্ধতি এবং বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে গৃহীত একটি প্রাথমিক কৌশল। মুগল প্রাদেশিক প্রশাসনের দুটি প্রধান শাখা ছিল নিজামত ও দীউয়ানি। ব্যাপক অর্থে নিজামত হচ্ছে সাধারণ প্রশাসন এবং দীউয়ানি হচ্ছে রাজস্ব প্রশাসন। প্রাদেশিক সুবাহদার ছিলেন নিজামতের প্রধান (এ জন্য তাকে নাজিমও বলা হতো) এবং দীউয়ান ছিলেন সাধারণ প্রশাসনের, বিশেষ করে রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান। সুবাহ প্রশাসনের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করার প্রয়োজনে মুগল সম্রাটগণ এ দুই প্রধান কর্মকর্তাকে সরাসরি নিয়োগ দান করতেন। তারা সাধারণত সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিয়োজিত হতেন এবং সম্রাটের নিকট দায়বদ্ধ থাকতেন। নাজিমের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না করেই কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট রাজস্ব প্রেরণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছিল দীউয়ানের। রাজস্ব প্রেরণের ব্যাপারে সুবাহদার আজিম-উস-শান ও দীউয়ান মুর্শিদকুলী খান এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব মুগল শাসনযুগে দীউয়ানি প্রতিষ্ঠানটির বাস্তব অবস্থার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কিন্তু ভারসাম্য সৃষ্টির লক্ষ্যে নাজিম ও দীউয়ানের মধ্যে এ ক্ষমতা পৃথকীকরণের পদ্ধতিটি নওয়াবি যুগে আর দেখা যায়নি। স্বাধীন নওয়াবি যুগে দীউয়ান এর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রয়োজন ছিল না। ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে দীউয়ানরা তখন নওয়াব কর্তৃক নিয়োগ লাভ করতেন এবং তাঁর নিকটই দায়বদ্ধ থাকতেন। এটি মুগল সাম্রাজ্যের শাসননীতির লঙ্ঘন ছিল, কিন্তু নওয়াবদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার জন্য কেন্দ্রের দুর্বল ও প্রায় নিঃস্ব সম্রাটের পক্ষে সরাসরি দীউয়ান নিয়োগ দান করা সম্ভব হয় নি। তবে অচল সাম্রাজ্যিক ব্যবস্থায়ও দীউয়ান পদটির অস্তিত্ব বজায় ছিল।
বাংলার সক্রিয় বণিক হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগকৃত দীউয়ানদের স্বাধীন ক্ষমতার দিনগুলিতে তাদের দাপট দেখেছে এবং সে সময় একজন দীউয়ানের নিয়োগের সময় তাঁর আনুকূল্য লাভের আশায় তাঁকে নজরানা প্রদান করেছে। তারা এটিও বুঝতে পেরেছিল যে, কেন্দ্রের দুর্বলতার কারণে স্বাধীন নওয়াবরা দীউয়ানির এ পদ্ধতিকে বিলুপ্ত করবে। রবার্ট ক্লাইভ কোম্পানির কার্যক্রমের নেতৃত্ব নিয়ে ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলায় আসেন। তিনি সমকালীন পরিস্থিতির ভেতর থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য আশ্রয়হীন সম্রাট শাহ আলমএর সঙ্গে এলাহাবাদে সাক্ষাৎ করেন এবং দুর্দশাগ্রস্ত সম্রাটকে কেন্দ্রীয়ভাবে দীউয়ান নিয়োগের রীতিটি পুনরায় চালু করার প্রস্তাব দেন ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দীউয়ান নিযুক্ত করার জন্য প্রলুব্ধ করেন। তিনি সম্রাটকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, পূর্বে দীউয়ানগণ যেমন নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব প্রদান করতেন কোম্পানিও তেমনি সম্রাটকে নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রেরণ করবে।
বাংলা থেকে বহুকাল যাবৎ রাজস্ব না পাওয়ায় সম্রাট শাহ আলম ক্লাইভের প্রস্তাবে সম্মত হন। ফলে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফরমান এর (১২ আগস্ট ১৭৬৫) মাধ্যমে সম্রাট কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দীউয়ান নিযুক্ত করেন। শর্ত থাকে যে, কোম্পানি বার্ষিক ছাবিবশ লক্ষ রুপি সম্রাটকে রাজস্ব হিসেবে প্রদান করবে। সুবাহর অপ্রাপ্তবয়স্ক নওয়াব নাজমুদ্দৌলার সঙ্গে কোম্পানি আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৭৬৫)। এতে বলা হয়, কোম্পানি নিজামত প্রশাসন পরিচালনা ও নওয়াব পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বার্ষিক তেপ্পান্ন লক্ষ রুপি প্রদান করবে। সুবাহ থেকে সংগৃহীত রাজস্বের ভেতর থেকেই এ সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করা হবে এবং নওয়াব ও সম্রাটকে প্রতিশ্রুত অর্থ দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত অর্থ কোম্পানির লাভ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ক্লাইভ কোম্পানিকে সরাসরি শাসকে পরিণত করতে চান নি। বেশ কিছু বাস্তব কারণে তিনি স্থানীয় এজেন্সিগুলির মাধ্যমে দীউয়ানি প্রশাসন পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সৈয়দ মুহম্মদ রেজা খানকে নায়েব দীউয়ান এবং নায়েব নাজিম পদে নিয়োগ দান করেন। নায়েব নাজিম হিসেবে তিনি নওয়াবের প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং নায়েব দীউয়ান হিসেবে কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতেন। এভাবে তিনি যে পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন তা দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত হয়। যে পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়ম এর গভর্নর হিসেবে ক্লাইভ সমর্থন দিয়েছিলেন সে পর্যন্ত রেজা খান বেশ সাফল্যের সঙ্গে দ্বৈতশাসন পরিচালনা করেছিলেন। ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ চূড়ান্তভাবে বিদায় নেয়ার পর রেজা খানের প্রভাব স্তিমিত হয়ে যায়। ব্যক্তিগত ব্যবসার নামে কোম্পানির কর্মচারীরা সারা দেশে লুণ্ঠন শুরু করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে এবং তা ১৭৬৯-৭০ খিস্টাব্দের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে।
সম্ভাব্য ধ্বংস থেকে এ নতুন রাজ্যকে এবং নানাবিধ ক্ষতির কারণে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে কোম্পানিকে রক্ষার জন্য কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ১৭৭২ খিস্টাব্দ দীউয়ানি দায়িত্ব সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে ক্লাইভের পদ্ধতিসমূহ বিলুপ্ত করার পরামর্শ দেয়। হেস্টিংস রেজা খানকে চাকুরিচ্যুত করেন এবং দীউয়ানি প্রশাসন সরাসরি নিজে গ্রহণ করেন। এভাবেই ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাজ্যের দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু হয়। [সিরাজুল ইসলাম]