ঋতু
ঋতু (Season) বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভূ-পৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানের জলবায়ুর ধরন। মহাকাশে সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন সংঘটিত হয়। নাতিশীতোষ্ণ অক্ষাংশসমূহে চারটি ঋতু শনাক্ত করা যায়: বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও শীত। ক্রান্তীয় অঞ্চলসমূহের রয়েছে দুটি ঋতু: শুষ্ক ও আর্দ্র। ভারত মহাসাগরের আশেপাশে অবস্থিত মৌসুমি এলাকাসমূহে রয়েছে তিনটি ঋতু: শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলি পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। ঋতুগুলির তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহ একটি থেকে অপরটিতে পৃথক। ভৌগোলিক অবস্থানের দরুণ এখানকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। যদিও বাংলাদেশের জলবায়ু প্রধানত উপক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির তথা উষ্ণ ও আর্দ্র, তথাপি প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বছরকে ছয়টি ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা: গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। প্রতি দু মাস অন্তর ঋতু বদল হয়। উল্লেখ্য যে, সব সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঋতুপরিবর্তন সীমাবদ্ধ থাকে না, কখনও কখনও কোনো কোনো ঋতুর শুরু ও শেষ কিংবা ব্যাপ্তিতে পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে সুস্পষ্ট তিনটি ঋতু বিদ্যমান: মার্চ মাস থেকে মে মাস (ফাল্গুন-চৈত্র থেকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) পর্যন্ত বিরাজমান প্রাক মৌসুমি গ্রীষ্মকাল, জুন থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে আশ্বিন-কার্তিক) পর্যন্ত বিরাজমান মৌসুমি বায়ুসৃষ্ট বর্ষাকাল এবং মধ্য-অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষভাগ (কার্তিক-অগ্রহায়ন থেকে মাঘ-ফাল্গুন) পর্যন্ত বিরাজমান শুষ্ক শীতকাল। বাস্তবিকভাবে, মার্চ মাসকে বসন্তকাল এবং মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে হেমন্তকাল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
অধিক তাপমাত্রা আর ঝড়ঝঞ্ঝা প্রাক মৌসুমি গ্রীষ্মকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাপমাত্রা এরূপ থাকে যে, কোনো একটি মাসকে উষ্ণতম মাস বলে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সাধারণত এপ্রিল মাসকেই উষ্ণতম মাস বলে গণ্য করা হয় এবং গড় তাপমাত্রা দেশের পূর্ব ও দক্ষিণভাগে ২৭°সে থেকে দেশের পশ্চিম-মধ্যভাগে ৩১°সে পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। এপ্রিল মাসের পরে আকাশে ক্রমাগত মেঘ জমতে থাকলে তাপমাত্রার সঙ্গে আর্দ্রতার যোগ ঘটে ফলে ভ্যাপসা গরম পড়তে শুরু করে। এ সময় বায়ুপ্রবাহের দিক স্থির থাকে না, বিশেষ করে শুরুর দিকে এমনটি হয়ে থাকে। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ১০ থেকে ২৫ ভাগ এসময় সংঘটিত হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে প্রায়শই বজ্রঝঞ্ঝা সংঘটিত হয়।
দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, অত্যধিক আর্দ্রতা, প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং লাগাতার কয়েকদিন অবিরাম বর্ষণ বর্ষা ঋতুর অনন্য বৈশিষ্ট্য। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৭০ থেকে ৮৫ ভাগই বর্ষাকালে সংঘটিত হয়। এ সময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে তাপমাত্রা কমতে থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে আগত ক্রান্তীয় নিম্নচাপ (Depression) দ্বারা এ বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে।
শীতঋতুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্ন তাপমাত্রা, পশ্চিম অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত শৈত্যপ্রবাহ, মুক্ত আকাশ আর বৃষ্টিহীনতা কিংবা যৎসামান্য বৃষ্টিপাত। জানুয়ারি মাসে গড় তাপমাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বভাগে ১৭°সে থেকে উপকূলীয় এলাকায় ২০°-২১°সে পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের একেবারে উত্তর-পশ্চিমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে এবং জানুয়ারি মাসের প্রথমভাগে, তাপমাত্রা ৩° থেকে ৪°সে-এ নেমে যায়।
গ্রীষ্মকাল বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে জুন মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) এ দুমাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের দিনগুলি উষ্ণ ও শুষ্ক। তবে সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি থেকেই গরম পড়তে শুরু করে। গ্রীষ্মের দাবদাহে নদীনালা, খালবিলসহ জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যায়। এ ঋতুতে দিন বড় আর রাত ছোট হয়। এ সময় পশ্চিমা মৌসুমি বায়ু দেশের উপর দিয়ে বইতে শুরু করে। আবার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শীতল ও শুষ্ক বায়ুও প্রবাহিত হয়। মহাসাগর থেকে আগত মেঘতাড়িত বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে শীতল ও শুষ্ক বায়ু মুখোমুখি পরস্পরের সংস্পর্শে এলে তা প্রবল ঝড়ের রূপ ধারণ করে। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এ দুটি বায়ুপুঞ্জসৃষ্ট ঝড়কে কালবৈশাখী নামে আখ্যায়িত করা হয় যার ধ্বংসাত্মক রূপ এ ভূখন্ডের অধিবাসীদের কাছে অতি পরিচিত।
গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু হয় বাংলা বর্ষ। গ্রীষ্মের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের-এর প্রথম দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। এ ঋতুতে হিন্দুরা জামাইষষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। গ্রীষ্মকাল ফলের ঋতু। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লিচু, তরমুজ, আমড়া প্রভৃতি সুস্বাদু ফল এ ঋতুতেই জন্মে। গোলাপ, বকুল, বেলি, টগর, জবা প্রভৃতি সুগন্ধি ফুলও এ সময়ে ফোটে।
বর্ষাকাল বাংলা বর্ষের দ্বিতীয় ঋতু এবং এর স্থিতি আষাঢ় ও শ্রাবণ (জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এ দু মাস। প্রকৃতপক্ষে বৈশাখের শেষ থেকে কার্তিকের প্রথম ভাগ (অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি) পর্যন্ত বর্ষার ব্যাপ্তি থাকে। শরৎ ও হেমন্ত ঋতু দুটি বর্ষা ঋতুর সামান্য পরিবর্তিত চেহারা মাত্র। বর্ষাকালে আবহাওয়া সর্বদা উষ্ণ থাকে। এ সময় দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প বহন করে আনে যার প্রভাবে বর্ষার আকাশ প্রায়ই মেঘাচ্ছন্ন থাকে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগেরও অধিক বর্ষাকালেই সংঘটিত হয়ে থাকে। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের দরুণ অধিকাংশ প্লাবনভূমিই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় উচ্চতা ভেদে বন্যার গভীরতা ও স্থায়িত্বকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিল, ঝিল ও হাওরসমূহ বছরে ছয় মাসেরও অধিককাল ধরে প্লাবিত থাকে। দেশের অন্যত্র বিশেষ করে, মধ্যভাগে বন্যার স্থায়িত্বকাল ৩ থেকে ৪ মাস। এ সময় গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য নৌকা হয়ে ওঠে প্রধান মাধ্যম।
গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে শুষ্ক ও মৃতপ্রায় বৃক্ষলতা, তৃণ প্রভৃতি বর্ষার শীতল জলধারায় নবজীবন লাভ করে। তখন পল্লী প্রকৃতির সর্বত্র সবুজের সমারোহ দেখা যায়। বর্ষায় চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা ও কলমিলতার সমারোহ দেখা যায়। আরও দেখা যায় জাতীয় ফুল শাপলা-র সমারোহ। বর্ষাকালে কেয়া, কদম, কামিনী, জুঁই, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি ফুল প্রস্ফুটিত হয় এবং পেয়ারা, আনারস, বাতাবি লেবু প্রভৃতি ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ সময় হাটে-বাজারে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।
বর্ষার শুরুতে কৃষককুল সোনালি অাঁশ পাট ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বন্যামুক্ত অথবা স্বল্প প্লাবিত এলাকায় ধানের নতুন চারা রোপণ করে। বর্ষার বারিধারা লোকালয়ের আবর্জনা ধুয়েমুছে দেয় এবং দূষিত বায়ু বিশুদ্ধ করে। বর্ষাই এ দেশকে সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা করেছে।
শরৎকাল বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল। এ সময় নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়, তবে তখনও মাটিতে থাকে বর্ষার সরসতা। ভাদ্র (সেপ্টেম্বর) মাসে তাপমাত্রা আবার বৃদ্ধি পায়, আর্দ্রতাও সর্বোচ্চে পৌঁছে। শরতে ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় শিশির জমে। শরতের শেষে রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময় তাল গাছে তাল পাকে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়।
হেমন্তকাল বাংলা বর্ষের চতুর্থ ঋতু। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এর ব্যাপ্তিকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) মাস জুড়ে। মূলত হেমন্তকাল হচ্ছে শরৎ ও শীতকালের মধ্যবর্তী একটি পরিবর্তনশীল পর্যায়। দিনের শেষে তাপমাত্রার ব্যাপক পতনের ফলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিকেলে হিম পড়তে শুরু করে আর ঘাসের ওপর জমে শিশির; কুয়াশাও দেখা যায় প্রায়ই। সাধারণভাবে সর্দি, কাশি, জ্বর প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। হেমন্তকালে মাঠে মাঠে থাকে সোনালি ধান। এ সময় চাষীরা ধান কেটে ঘরে তোলে এবং ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব শুরু হয়।
শীতকাল ষড়ঋতুর পঞ্চতম এবং উষ্ণতর গ্রীষ্মের বিপরীতে বছরের শীতলতর অংশ। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) এ দু মাস শীতকাল হলেও বাস্তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতের ঠান্ডা অনুভূত হয়। এ সময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করে বলে বাংলাদেশে সূর্যের রশ্মি তির্যকভাবে পতিত হয় এবং তাপমাত্রার পরিমাণ থাকে কম। জানুয়ারি মাসে গড় তাপমাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১১°সে থেকে শুরু করে উপকুলীয় অঞ্চলে ২০°-২১°সে পর্যন্ত বজায় থাকে। দেশের দক্ষিণাংশের তুলনায় উত্তরাংশে শীতের তীব্রতা বেশি থাকে। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে দেশের উত্তরাঞ্চলে অনেক সময় প্রাণহানিও ঘটে থাকে। শীতকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে উচ্চচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। এ উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে পূর্বমুখী শীতল বায়ুর একটি প্রবাহ গতিশীল হয় এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
শীতকাল প্রধানত শুষ্ক। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের মাত্র ৪ শতাংশ এ ঋতুতে সংঘটিত হয়ে থাকে। গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পশ্চিম ও দক্ষিণে ২ সেমি-এর কম থেকে উত্তর-পূর্বে ৪ সেমি-এর সামান্য কিছু বেশি হয়ে থাকে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আগত জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুর প্রভাবে শীতকালে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়। এ বায়ু ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মোটামুটিভাবে গঙ্গা অববাহিকা অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়। শীতের রাত্রি হয় দীর্ঘ।
শীতকাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। এ ঋতুতে গাছের পাতা ঝরতে থাকে। আমলকী, জলপাই, মাদার প্রভৃতি কোনো কোনো বৃক্ষ পত্রশূন্য হয়ে যায়। এ সময় শিশির পড়ে। সকালে ঘন কুয়াশায় পথঘাট ঢেকে যায়। এ সময় তরিতরকারির প্রাচুর্য দেখা যায়। কপি, মুলা, বেগুন, পালংশাক, মটরশুটি ইত্যাদিতে হাট-বাজার পূর্ণ থাকে। কৈ, মাগুর, শিংসহ অন্যান্য মাছ এ সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। শীতে গাঁদা ও সূর্যমুখী ফুল ফোটে। কমলালেবু এ ঋতুরই ফল। বরই শীতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফল। শীতকালে খেজুর রস পাওয়া যায়। এ রস থেকে তৈরি হয় বিখ্যাত খেজুরের গুড়। ঘরে ঘরে ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা, পুলি ইত্যাদি পিঠা তৈরি করা হয়।
বসন্তকাল বাংলা বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ ঋতু। শীতের পর বসন্তকাল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে রমণীয় শোভা বিস্তার করে আবির্ভূত হয়। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস (ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত) নিয়ে বসন্তকাল হলেও প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র মার্চ মাসেই ঋতুটির সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ ঋতুতে বায়ু নানা দিক থেকে প্রবাহিত হয়, কোনো নির্দিষ্ট দিকে স্থির থাকে না। শীতের উত্তুরে তথা উত্তর-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তে গ্রীষ্মের দক্ষিণা অথবা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করার এ ক্রান্তিকালে বায়ুপ্রবাহের দুরন্তপনা শুরু হয়। বসন্তের আবহাওয়া থাকে মনোরম, আকাশে কিছু কিছু মেঘ থাকলেও সার্বিক আবহাওয়া থাকে নির্মল। কদাচিত মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে অপরাহ্নে বিচ্ছিন্নভাবে বজ্রঝড় সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড়ই চমৎকার হয়ে ওঠে। তরুলতাসমূহ নতুন পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়। রক্তবর্ণের শিমুল, পলাশ ও কৃষ্ণচূড়া এ সময়েই ফোটে। আম্রবৃক্ষসকল নব মঞ্জরীতে শোভিত হয়। বৃক্ষের অন্তরালে থেকে কোকিল সুমধুর কুহু স্বরে দিক-দিগন্ত মুখরিত করে তোলে। ভ্রমর মনের আনন্দে গুঞ্জন করতে করতে সুগন্ধি পুষ্প ও আম্র মঞ্জরীর মধু পানে মত্ত হয়। যব, গম, সরিষা ইত্যাদি শস্যে মাঠগুলি রমণীয় শোভা ধারণ করে। এ ঋতুতে হিন্দুদের বাসন্তী পূজা, দোলযাত্রা প্রভৃতি উৎসব মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। এ সময়টি নাতিশীতোষ্ণ, তাই পরম সুখকর। মার্চ মাসে সারা দেশে গড় তাপমাত্রা ২২° থেকে ২৫° সে-এর মধ্যে উঠানামা করে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকে মাত্র ৫০ থেকে ৭০ ভাগ। এ সময় প্রভাতে ও সন্ধ্যাবেলায় ভ্রমণ স্বাস্থ্যপ্রদ। তবে কখনও কখনও কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মারাত্মক ব্যাধিরও আবির্ভাব ঘটে এ ঋতুতে।
দক্ষিণে সমুদ্র, উত্তরে হিমালয় পর্বত এবং বিশাল সমভূমির জন্য বাংলাদেশে শীত বা গ্রীষ্ম কোনোটিরই আধিক্য অনুভূত হয় না। বাংলাদেশের এ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু প্রকৃতির কিছু ব্যতিক্রম বৈরিতা ছাড়া অত্যন্ত আরামপ্রদ। বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনধারা ষড়ঋতুর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। [রফিক আহমদ এবং সমবারু চন্দ্র মহন্ত]