মহাস্থান: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''মহাস্থান '''বা মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ নগর পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। স্থানটি বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে (২৪°৫৭´ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯°৯১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থিত। আয়তাকার ধ্বংসস্তূপটি উত্তর-দক্ষিণে ১৫০০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৪০০ মিটার বিস্তৃত এবং এর চারপাশ নদী সমতল থেকে গড়ে ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সর্বোচ্চ স্থানটি জুড়ে রয়েছে শাহ সুলতান মাহীসওয়ারের মাযার ও মুগল সম্রাট [[ফররুখ সিয়ার|ফররুখ সিয়ার ]]এর একটি মসজিদ। এই মসজিদ ঘিরে একটি আধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং সম্প্রতি এটি সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কারণে ভবিষ্যতে এখানে কোন খননকাজ পরিচালনার সুযোগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুরক্ষিত নগরটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক একটি গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উত্তর ও পশ্চিম দিকে এই পরিখা পুরোপুরি এবং দক্ষিণ দিকে আংশিক চিহ্ন পরিদৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে তখন করতোয়া নদী প্রবাহিত ছিল। পরিখা ও নদীটি সম্ভবত নগর-দুর্গের পরিপূরক প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকবে। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ৮ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বহু ঢিবি দেখা যায়। এগুলি প্রাচীন প্রাদেশিক রাজধানীর শহরতলির সাক্ষ্য বহন করে। অনেক পর্যটক ও পন্ডিত ব্যক্তি, বিশেষত বুকানন হ্যামিলটন, ও’ডোনেল, ওয়েস্টম্যাকট, [[বেভারীজ, হেনরী|বেভারীজ]] ও স্যার আলেকজান্ডার [[কানিংহাম, স্যার আলেকজান্ডার|কানিংহাম]] এই শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রূপে শনাক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্যার আলেকজান্ডার [[কানিংহাম, স্যার আলেকজান্ডার|কানিংহাম]] এর। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি [[শিলালিপি|শিলালিপি]]তে ‘পুন্ডনগল’ ([[পুন্ড্রনগর|পুন্ড্রনগর]]) উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল। | '''মহাস্থান''' বা মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ নগর পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। স্থানটি বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে (২৪°৫৭´ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯°৯১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থিত। আয়তাকার ধ্বংসস্তূপটি উত্তর-দক্ষিণে ১৫০০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৪০০ মিটার বিস্তৃত এবং এর চারপাশ নদী সমতল থেকে গড়ে ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সর্বোচ্চ স্থানটি জুড়ে রয়েছে শাহ সুলতান মাহীসওয়ারের মাযার ও মুগল সম্রাট [[ফররুখ সিয়ার|ফররুখ সিয়ার ]]এর একটি মসজিদ। এই মসজিদ ঘিরে একটি আধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং সম্প্রতি এটি সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কারণে ভবিষ্যতে এখানে কোন খননকাজ পরিচালনার সুযোগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুরক্ষিত নগরটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক একটি গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উত্তর ও পশ্চিম দিকে এই পরিখা পুরোপুরি এবং দক্ষিণ দিকে আংশিক চিহ্ন পরিদৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে তখন করতোয়া নদী প্রবাহিত ছিল। পরিখা ও নদীটি সম্ভবত নগর-দুর্গের পরিপূরক প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকবে। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ৮ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বহু ঢিবি দেখা যায়। এগুলি প্রাচীন প্রাদেশিক রাজধানীর শহরতলির সাক্ষ্য বহন করে। অনেক পর্যটক ও পন্ডিত ব্যক্তি, বিশেষত বুকানন হ্যামিলটন, ও’ডোনেল, ওয়েস্টম্যাকট, [[বেভারীজ, হেনরী|বেভারীজ]] ও স্যার আলেকজান্ডার [[কানিংহাম, স্যার আলেকজান্ডার|কানিংহাম]] এই শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রূপে শনাক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্যার আলেকজান্ডার [[কানিংহাম, স্যার আলেকজান্ডার|কানিংহাম]] এর। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি [[শিলালিপি|শিলালিপি]]তে ‘পুন্ডনগল’ ([[পুন্ড্রনগর|পুন্ড্রনগর]]) উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল। | ||
[[Image:Mahasthangarh.jpg|thumb|right|400px]] | |||
১৯২৮-২৯ সালে [[দীক্ষিত, কে.এন|কে]][[দীক্ষিত, কে.এন|.এন দীক্ষিত ]]এর তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক এ স্থানে প্রথম নিয়মানুগ উৎখনন পরিচালিত হয় এবং তা তিনটি ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ঢিবিগুলি হলো স্থানীয়ভাবে পরিচিত [[বৈরাগীর ভিটা|বৈরাগীর ভিটা]], [[গোবিন্দ ভিটা|গোবিন্দ ভিটা]] এবং [[মুনির ঘুন|মুনির ঘুন]] নামে পরিচিত একটি বুরুজসহ পূর্ব প্রাচীরের কিছু অংশ। অতঃপর খননকার্য তিন দশকের জন্য বন্ধ থাকে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে পুনরায় খননকার্য শুরু হয় এবং তা উত্তর দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এলাকা, [[পরশুরামের প্রাসাদ|পরশুরামের প্রাসাদ]], মাযার এলাকা, [[খোদার পাথর ভিটা|খোদার পাথর ভিটা]], [[মানকালীর কুন্ডধাপ|মানকালীর কুন্ড ধাপ]] এবং অন্যান্য স্থানে পরিচালিত হয়। | ১৯২৮-২৯ সালে [[দীক্ষিত, কে.এন|কে]][[দীক্ষিত, কে.এন|.এন দীক্ষিত ]]এর তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক এ স্থানে প্রথম নিয়মানুগ উৎখনন পরিচালিত হয় এবং তা তিনটি ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ঢিবিগুলি হলো স্থানীয়ভাবে পরিচিত [[বৈরাগীর ভিটা|বৈরাগীর ভিটা]], [[গোবিন্দ ভিটা|গোবিন্দ ভিটা]] এবং [[মুনির ঘুন|মুনির ঘুন]] নামে পরিচিত একটি বুরুজসহ পূর্ব প্রাচীরের কিছু অংশ। অতঃপর খননকার্য তিন দশকের জন্য বন্ধ থাকে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে পুনরায় খননকার্য শুরু হয় এবং তা উত্তর দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এলাকা, [[পরশুরামের প্রাসাদ|পরশুরামের প্রাসাদ]], মাযার এলাকা, [[খোদার পাথর ভিটা|খোদার পাথর ভিটা]], [[মানকালীর কুন্ডধাপ|মানকালীর কুন্ড ধাপ]] এবং অন্যান্য স্থানে পরিচালিত হয়। | ||
এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় দু’দশক পর ১৯৮৮ সালে খননকাজ পুনরায় শুরু করা হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একাজ চলতে থাকে। এ সময় খননকাজ মাযারের নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীর সংলগ্ন অংশে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ পর্যায়ে সম্পন্ন কাজের পরিমাণ এলাকাটির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য ছিল। এ স্থানটির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুক্রম এখনও অজ্ঞাত। এ প্রত্নস্থল ও অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন এবং প্রাচীন নগরটির সংগঠন সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটা ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘকাল ধরে অনুভূত হচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (১৯৯২) অধীনে ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশী ও ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকবিদগণ একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে পূর্ব দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ পরিচালিত হতে থাকে। ইতঃপূর্বে সুরক্ষিত নগরের বাইরে [[ভাসু বিহার|ভাসুবিহার]], [[বিহার ধাপ|বিহার ধাপ]], [[মঙ্গলকোট১|মঙ্গলকোট]] ও গোদাইবাড়ির ন্যায় কয়েকটি স্থানেও বাংলাদেশের [[প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর|প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর]] কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়েছে। নগরটিতে উৎখননকালে কয়েকটি স্থানে প্রত্নস্থলের মূল মাটি পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স-বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক উৎখনন ১৮টি নির্মাণ স্তর উন্মোচন করেছে। ১৯২৯ সাল থেকে অদ্যাবধি (ফ্রান্স-বাংলাদেশ উদ্যোগসহ) বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত উৎখননের ফলে নিম্নবর্ণিত সাংস্কৃতিক অনুক্রম উদ্ঘাটিত হয়েছে: | এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় দু’দশক পর ১৯৮৮ সালে খননকাজ পুনরায় শুরু করা হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একাজ চলতে থাকে। এ সময় খননকাজ মাযারের নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীর সংলগ্ন অংশে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ পর্যায়ে সম্পন্ন কাজের পরিমাণ এলাকাটির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য ছিল। এ স্থানটির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুক্রম এখনও অজ্ঞাত। এ প্রত্নস্থল ও অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন এবং প্রাচীন নগরটির সংগঠন সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটা ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘকাল ধরে অনুভূত হচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (১৯৯২) অধীনে ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশী ও ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকবিদগণ একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে পূর্ব দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ পরিচালিত হতে থাকে। ইতঃপূর্বে সুরক্ষিত নগরের বাইরে [[ভাসু বিহার|ভাসুবিহার]], [[বিহার ধাপ|বিহার ধাপ]], [[মঙ্গলকোট১|মঙ্গলকোট]] ও গোদাইবাড়ির ন্যায় কয়েকটি স্থানেও বাংলাদেশের [[প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর|প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর]] কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়েছে। নগরটিতে উৎখননকালে কয়েকটি স্থানে প্রত্নস্থলের মূল মাটি পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স-বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক উৎখনন ১৮টি নির্মাণ স্তর উন্মোচন করেছে। ১৯২৯ সাল থেকে অদ্যাবধি (ফ্রান্স-বাংলাদেশ উদ্যোগসহ) বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত উৎখননের ফলে নিম্নবর্ণিত সাংস্কৃতিক অনুক্রম উদ্ঘাটিত হয়েছে: | ||
[[Image: | [[Image:MahasthanBairagirBhita.jpg|thumb|left|বৈরাগীর ভিটা]] | ||
''প্রথম যুগ'' এ পর্যায়ে রয়েছে প্রাক-মৌর্য সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে খ পর্যায়ের বিপুল পরিমাণ উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্র, রুলেটেড পাত্র, কালো ও লাল রঙের পাত্র, কালো প্রলেপযুক্ত পাত্র, ধূসর বর্ণের পাত্র, পাথরের যাতা, মাটির তৈরি মেঝেসহ মাটির ঘর (রান্নাঘর), চুলা এবং খুটির গর্ত। উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র সর্বনিম্ন স্তরে অধিক পরিমাণে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে থালা, কাপ, গ্লাস এবং গামলা প্রধান। এ স্তরে অত্যন্ত সীমিত এলাকায় একটি ইট বিছানো মেঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মেঝের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দেয়াল পাওয়া যায়নি। সম্ভবত প্লাইস্টোসিন ভূভাগের উপর এখানে সর্বপ্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। এর উপরের বসতি স্তরের তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকের শেষ ভাগ। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ স্তরের বসতি প্রাক-মৌর্য যুগের। এই আদি বসতি স্তর নন্দ বা প্রায় ঐতিহাসিক সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা নির্ণয় করা প্রয়োজন। | |||
[[ | ''দ্বিতীয় যুগ'' এ যুগে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে ভাঙ্গাঁ টালি (জানামতে এ ধরনের ছাদের জন্য ব্যবহূত টালির প্রাচীনতম নিদর্শন), মাটির দেয়াল নির্মাণে মিশ্রণ বা বন্ধনের জন্য ব্যবহূত ইটের টুকরা (মাঝে মাঝে গৃহস্থালি কাজেও যেমন চুলার স্থান, পোড়ামাটির পাতকূয়া), উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণপাত্র, ঈষৎ লাল বা ঈষৎ হলুদ রঙের সাধারণ পাত্র, রিং স্টোন, ব্রোঞ্জের আয়না, ব্রোঞ্জের প্রদীপ, ছাuঁচ ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পোড়ামাটির জীবজন্তু, অর্ধমূল্যবান পাথরের গুটিকা বা [[পুঁতি|পুঁতি]] এবং পাথরের যাতা। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৬-১৬২, ৩৭১-১৭৩ অব্দ) এবং সাংস্কৃতিক দ্রব্য এ পর্যায়কে মৌর্য যুগের অন্তর্ভুক্ত করে। | ||
]] | |||
[[Image:Mahasthan.jpg|thumb|right|মহাস্থান প্রত্নস্থলের একাংশ, বগুড়া]] | |||
''তৃতীয় যুগ'' এ যুগ মৌর্যোত্তর (শূঙ্গ-কুষাণ) পর্বের অন্তর্ভুক্ত। এ যুগে বৃহদায়তনের ও অপেক্ষাকৃত ভালভাবে সংরক্ষিত ইটের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ, ইট বিছানো মেঝে, খুঁটির গর্ত, পোড়ামাটির পাতকূয়া, শূঙ্গ বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রচুর পোড়ামাটির ফলক, অর্ধমূল্যবান পাথরের (এ্যাগেট কার্নেলিয়ন, কোয়ার্টজ) পুঁতি, সুর্মা লাগানোর দন্ড, ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, রূপার বালা, ঢালাই করা তাম্র মুদ্রা, পোড়ামাটির মন্দির চূড়া, ঈষৎ লাল বা হলুদ রঙের প্রচুর পরিমাণ সাধারণ পাত্র (বিশেষত থালা, কাপ, গামলা) এবং ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মোটা বুননের উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র মৌর্যস্তরের তুলনায় এ স্তরে কম। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বনের ক্রমাঙ্ক স্তর হলো খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭-৪৭ অব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দ-১৭২ খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৪০ অব্দ-১২২ খ্রিস্টাব্দ। | |||
[[Image: | [[Image:MahasthanGlazedPottery.jpg|thumb|left|গ্লেজড মৃৎপাত্র]] | ||
''চতুর্থ যুগ'' এ সময়ে কুষাণ-গুপ্ত যুগের নিদর্শনাদি উন্মোচিত হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ কুষাণ মৃৎপাত্রের টুকরা এবং সমসাময়িক কালের সুনির্দিষ্ট শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রচুর পোড়ামাটির ফলকচিত্র এ যুগের আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ। মৃৎপাত্রের প্রধান ধরন হলো খোদাই করা নকশাসহ হাতলওয়ালা রান্নার পাত্র, পিরিচ, গামলা, পিচকারি এবং ঢাকনি। উপরের এবং নিচের স্তরের তুলনায় স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ এ অংশে কম। স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে ভাঙ্গা ইটের টুকরা। অন্যান্য সাংস্কৃতিক সামগ্রী হলো পোড়ামাটির [[গুটিকা|গুটিকা]] বা পুঁতি, গামলা, পাথর এবং কাঁচের গুটিকা বা পুঁতি, কাঁচের চুড়ি এবং পোড়ামাটির সিলমোহর। | |||
''পঞ্চম যুগ'' এ যুগ গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের পরিচয় বহন করে। তেজস্ক্রিয় কার্বন পদ্ধতিতে ৩৬১ থেকে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ক্রমাঙ্কিত তারিখ নির্দেশিত হয়েছে। এ পর্যায়ে দুর্গ-নগরীর সন্নিকটে পরবর্তী গুপ্তযুগের গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত মন্দিরের ইটনির্মিত বিশাল কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এবং নগরে ইটের তৈরী ঘরবাড়ি, মেঝে ও রাস্তার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও রয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রীতির পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, কাঁচ ও প্রায়-মূল্যবান পাথরের গুটিকা বা পুঁতি, পোড়ামাটির গোলক ও চাকতি, তামা ও লোহার দ্রব্য এবং ছাপ দিয়ে নকশা করা পাত্রসহ বিপুলসংখ্যক প্রত্নসম্পদ। | |||
[[Image: | [[Image:MahasthanNorthernBlackPolishedCeramics.jpg|thumb|right|কালো প্রলেপযুক্ত পাত্র]] | ||
''ষষ্ঠ যুগ'' এ যুগটি নগরের পূর্ব দিকে খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ ও বৈরাগীর ভিটার ন্যায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দ্বারা পাল যুগের পরিচয় বহন করে। এ পর্যায়টি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং এ যুগে নগরের বাইরে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ ইমারত নির্মিত হয়েছিল। | |||
''সপ্তম যুগ'' মানকালীর কুন্ডে পূর্ববর্তী যুগের ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ফররুখ সিয়ার কর্তৃক নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এবং চীনা সেলাডন ও এ যুগের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চকচকে মাটির পাত্রের ন্যায় অপরাপর প্রত্ননিদর্শন দ্বারা মুসলিম যুগের পরিচয় বহন করে। | |||
[[Image:JahajghataMahasthangarh.jpg|thumb|left|মহাস্থান প্রত্নস্থল]] | |||
নগরের অভ্যন্তরভাগে বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ঢিবি, পরশুরামের প্রাসাদ ঢিবি ও জীয়ত কুন্ড প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নস্থল ছাড়াও ১৯৮৮-৯১ সালে খননকার্যের ফলে নগরটির তিনটি প্রবেশদ্বার, উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মাযার এলাকার নিকটে একটি মন্দির-স্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে। | নগরের অভ্যন্তরভাগে বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ঢিবি, পরশুরামের প্রাসাদ ঢিবি ও জীয়ত কুন্ড প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নস্থল ছাড়াও ১৯৮৮-৯১ সালে খননকার্যের ফলে নগরটির তিনটি প্রবেশদ্বার, উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মাযার এলাকার নিকটে একটি মন্দির-স্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে। | ||
মহাস্থান প্রত্নস্থলের তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটি উত্তর দিকের রক্ষা-প্রাচীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের ৪৪২ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রবেশদ্বার ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যটি ৬.৫ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ১.৬ মিটার প্রশস্ত। প্রবেশদ্বার দুটি প্রাথমিক ও পরবর্তী পালযুগ দুপর্যায়ে ব্যবহূত হয়েছিল। পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি প্রায় এর মধ্যস্থলে এবং পরশুরামের প্রাসাদের ১০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এবং প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত। পাল যুগের শেষের দিকে একটি পুরানো প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষের উপর এটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ প্রবেশদ্বারটি এখনও সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা যায়নি। সবগুলি প্রবেশদ্বার-স্থাপনায় ভেতর দিকে প্রহরি-কক্ষ এবং রক্ষা-প্রাচীরের বাইরে সম্প্রসারিত বুরুজ রয়েছে। | মহাস্থান প্রত্নস্থলের তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটি উত্তর দিকের রক্ষা-প্রাচীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের ৪৪২ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রবেশদ্বার ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যটি ৬.৫ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ১.৬ মিটার প্রশস্ত। প্রবেশদ্বার দুটি প্রাথমিক ও পরবর্তী পালযুগ দুপর্যায়ে ব্যবহূত হয়েছিল। পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি প্রায় এর মধ্যস্থলে এবং পরশুরামের প্রাসাদের ১০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এবং প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত। পাল যুগের শেষের দিকে একটি পুরানো প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষের উপর এটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ প্রবেশদ্বারটি এখনও সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা যায়নি। সবগুলি প্রবেশদ্বার-স্থাপনায় ভেতর দিকে প্রহরি-কক্ষ এবং রক্ষা-প্রাচীরের বাইরে সম্প্রসারিত বুরুজ রয়েছে। | ||
<gallery> | |||
Image:MahasthanNBPWPieces.jpg|উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্রের টুকরা | |||
Image:MahasthanSurya.jpg|সূর্য | |||
Image:MahasthanHorseRider.jpg|অশ্বোরোহী, পোড়ামাটির ভাস্কর্য | |||
Image:MahasthanSilverPunchmarkedCoin.jpg|রৌপ্যনির্মিত পাঞ্চমার্কড মুদ্রা | |||
Image:MahasthanBeads.jpg|স্বল্প মুল্য প্রস্তর পুঁতি | |||
Image:MahasthanStone.jpg|প্রস্তর পুঁতি | |||
Image:MahasthanGoldCoins.jpg|স্বর্ণ মুদ্রা | |||
Image:MahasthanGlassBeads.jpg|কাঁচের পুঁতি | |||
</gallery> | |||
মাযার এলাকায় উন্মোচিত মন্দির-স্থাপনায় কোন সুসঙ্গত নির্মাণ পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না। পাল শাসনামলে এটি পাঁচটি পর্যায়ে নির্মিত ও পুননির্মিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বড় আকারের পোড়ামাটির ফলক, খেলনা ও গোলক এবং অলঙ্কৃত ইট ও মাটির পাত্র। | মাযার এলাকায় উন্মোচিত মন্দির-স্থাপনায় কোন সুসঙ্গত নির্মাণ পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না। পাল শাসনামলে এটি পাঁচটি পর্যায়ে নির্মিত ও পুননির্মিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বড় আকারের পোড়ামাটির ফলক, খেলনা ও গোলক এবং অলঙ্কৃত ইট ও মাটির পাত্র। |
০৬:৩৪, ৩ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
মহাস্থান বা মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ নগর পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। স্থানটি বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে (২৪°৫৭´ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯°৯১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থিত। আয়তাকার ধ্বংসস্তূপটি উত্তর-দক্ষিণে ১৫০০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৪০০ মিটার বিস্তৃত এবং এর চারপাশ নদী সমতল থেকে গড়ে ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সর্বোচ্চ স্থানটি জুড়ে রয়েছে শাহ সুলতান মাহীসওয়ারের মাযার ও মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ার এর একটি মসজিদ। এই মসজিদ ঘিরে একটি আধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং সম্প্রতি এটি সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কারণে ভবিষ্যতে এখানে কোন খননকাজ পরিচালনার সুযোগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুরক্ষিত নগরটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক একটি গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উত্তর ও পশ্চিম দিকে এই পরিখা পুরোপুরি এবং দক্ষিণ দিকে আংশিক চিহ্ন পরিদৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে তখন করতোয়া নদী প্রবাহিত ছিল। পরিখা ও নদীটি সম্ভবত নগর-দুর্গের পরিপূরক প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকবে। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ৮ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বহু ঢিবি দেখা যায়। এগুলি প্রাচীন প্রাদেশিক রাজধানীর শহরতলির সাক্ষ্য বহন করে। অনেক পর্যটক ও পন্ডিত ব্যক্তি, বিশেষত বুকানন হ্যামিলটন, ও’ডোনেল, ওয়েস্টম্যাকট, বেভারীজ ও স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রূপে শনাক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এর। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপিতে ‘পুন্ডনগল’ (পুন্ড্রনগর) উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল।
১৯২৮-২৯ সালে কে.এন দীক্ষিত এর তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক এ স্থানে প্রথম নিয়মানুগ উৎখনন পরিচালিত হয় এবং তা তিনটি ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ঢিবিগুলি হলো স্থানীয়ভাবে পরিচিত বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা এবং মুনির ঘুন নামে পরিচিত একটি বুরুজসহ পূর্ব প্রাচীরের কিছু অংশ। অতঃপর খননকার্য তিন দশকের জন্য বন্ধ থাকে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে পুনরায় খননকার্য শুরু হয় এবং তা উত্তর দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এলাকা, পরশুরামের প্রাসাদ, মাযার এলাকা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ধাপ এবং অন্যান্য স্থানে পরিচালিত হয়।
এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় দু’দশক পর ১৯৮৮ সালে খননকাজ পুনরায় শুরু করা হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একাজ চলতে থাকে। এ সময় খননকাজ মাযারের নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীর সংলগ্ন অংশে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ পর্যায়ে সম্পন্ন কাজের পরিমাণ এলাকাটির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য ছিল। এ স্থানটির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুক্রম এখনও অজ্ঞাত। এ প্রত্নস্থল ও অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন এবং প্রাচীন নগরটির সংগঠন সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটা ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘকাল ধরে অনুভূত হচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (১৯৯২) অধীনে ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশী ও ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকবিদগণ একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে পূর্ব দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ পরিচালিত হতে থাকে। ইতঃপূর্বে সুরক্ষিত নগরের বাইরে ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়ির ন্যায় কয়েকটি স্থানেও বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়েছে। নগরটিতে উৎখননকালে কয়েকটি স্থানে প্রত্নস্থলের মূল মাটি পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স-বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক উৎখনন ১৮টি নির্মাণ স্তর উন্মোচন করেছে। ১৯২৯ সাল থেকে অদ্যাবধি (ফ্রান্স-বাংলাদেশ উদ্যোগসহ) বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত উৎখননের ফলে নিম্নবর্ণিত সাংস্কৃতিক অনুক্রম উদ্ঘাটিত হয়েছে:
প্রথম যুগ এ পর্যায়ে রয়েছে প্রাক-মৌর্য সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে খ পর্যায়ের বিপুল পরিমাণ উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্র, রুলেটেড পাত্র, কালো ও লাল রঙের পাত্র, কালো প্রলেপযুক্ত পাত্র, ধূসর বর্ণের পাত্র, পাথরের যাতা, মাটির তৈরি মেঝেসহ মাটির ঘর (রান্নাঘর), চুলা এবং খুটির গর্ত। উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র সর্বনিম্ন স্তরে অধিক পরিমাণে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে থালা, কাপ, গ্লাস এবং গামলা প্রধান। এ স্তরে অত্যন্ত সীমিত এলাকায় একটি ইট বিছানো মেঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মেঝের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দেয়াল পাওয়া যায়নি। সম্ভবত প্লাইস্টোসিন ভূভাগের উপর এখানে সর্বপ্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। এর উপরের বসতি স্তরের তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকের শেষ ভাগ। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ স্তরের বসতি প্রাক-মৌর্য যুগের। এই আদি বসতি স্তর নন্দ বা প্রায় ঐতিহাসিক সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা নির্ণয় করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় যুগ এ যুগে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে ভাঙ্গাঁ টালি (জানামতে এ ধরনের ছাদের জন্য ব্যবহূত টালির প্রাচীনতম নিদর্শন), মাটির দেয়াল নির্মাণে মিশ্রণ বা বন্ধনের জন্য ব্যবহূত ইটের টুকরা (মাঝে মাঝে গৃহস্থালি কাজেও যেমন চুলার স্থান, পোড়ামাটির পাতকূয়া), উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণপাত্র, ঈষৎ লাল বা ঈষৎ হলুদ রঙের সাধারণ পাত্র, রিং স্টোন, ব্রোঞ্জের আয়না, ব্রোঞ্জের প্রদীপ, ছাuঁচ ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পোড়ামাটির জীবজন্তু, অর্ধমূল্যবান পাথরের গুটিকা বা পুঁতি এবং পাথরের যাতা। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৬-১৬২, ৩৭১-১৭৩ অব্দ) এবং সাংস্কৃতিক দ্রব্য এ পর্যায়কে মৌর্য যুগের অন্তর্ভুক্ত করে।
তৃতীয় যুগ এ যুগ মৌর্যোত্তর (শূঙ্গ-কুষাণ) পর্বের অন্তর্ভুক্ত। এ যুগে বৃহদায়তনের ও অপেক্ষাকৃত ভালভাবে সংরক্ষিত ইটের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ, ইট বিছানো মেঝে, খুঁটির গর্ত, পোড়ামাটির পাতকূয়া, শূঙ্গ বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রচুর পোড়ামাটির ফলক, অর্ধমূল্যবান পাথরের (এ্যাগেট কার্নেলিয়ন, কোয়ার্টজ) পুঁতি, সুর্মা লাগানোর দন্ড, ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, রূপার বালা, ঢালাই করা তাম্র মুদ্রা, পোড়ামাটির মন্দির চূড়া, ঈষৎ লাল বা হলুদ রঙের প্রচুর পরিমাণ সাধারণ পাত্র (বিশেষত থালা, কাপ, গামলা) এবং ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মোটা বুননের উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র মৌর্যস্তরের তুলনায় এ স্তরে কম। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বনের ক্রমাঙ্ক স্তর হলো খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭-৪৭ অব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দ-১৭২ খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৪০ অব্দ-১২২ খ্রিস্টাব্দ।
চতুর্থ যুগ এ সময়ে কুষাণ-গুপ্ত যুগের নিদর্শনাদি উন্মোচিত হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ কুষাণ মৃৎপাত্রের টুকরা এবং সমসাময়িক কালের সুনির্দিষ্ট শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রচুর পোড়ামাটির ফলকচিত্র এ যুগের আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ। মৃৎপাত্রের প্রধান ধরন হলো খোদাই করা নকশাসহ হাতলওয়ালা রান্নার পাত্র, পিরিচ, গামলা, পিচকারি এবং ঢাকনি। উপরের এবং নিচের স্তরের তুলনায় স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ এ অংশে কম। স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে ভাঙ্গা ইটের টুকরা। অন্যান্য সাংস্কৃতিক সামগ্রী হলো পোড়ামাটির গুটিকা বা পুঁতি, গামলা, পাথর এবং কাঁচের গুটিকা বা পুঁতি, কাঁচের চুড়ি এবং পোড়ামাটির সিলমোহর।
পঞ্চম যুগ এ যুগ গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের পরিচয় বহন করে। তেজস্ক্রিয় কার্বন পদ্ধতিতে ৩৬১ থেকে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ক্রমাঙ্কিত তারিখ নির্দেশিত হয়েছে। এ পর্যায়ে দুর্গ-নগরীর সন্নিকটে পরবর্তী গুপ্তযুগের গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত মন্দিরের ইটনির্মিত বিশাল কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এবং নগরে ইটের তৈরী ঘরবাড়ি, মেঝে ও রাস্তার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও রয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রীতির পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, কাঁচ ও প্রায়-মূল্যবান পাথরের গুটিকা বা পুঁতি, পোড়ামাটির গোলক ও চাকতি, তামা ও লোহার দ্রব্য এবং ছাপ দিয়ে নকশা করা পাত্রসহ বিপুলসংখ্যক প্রত্নসম্পদ।
ষষ্ঠ যুগ এ যুগটি নগরের পূর্ব দিকে খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ ও বৈরাগীর ভিটার ন্যায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দ্বারা পাল যুগের পরিচয় বহন করে। এ পর্যায়টি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং এ যুগে নগরের বাইরে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ ইমারত নির্মিত হয়েছিল।
সপ্তম যুগ মানকালীর কুন্ডে পূর্ববর্তী যুগের ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ফররুখ সিয়ার কর্তৃক নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এবং চীনা সেলাডন ও এ যুগের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চকচকে মাটির পাত্রের ন্যায় অপরাপর প্রত্ননিদর্শন দ্বারা মুসলিম যুগের পরিচয় বহন করে।
নগরের অভ্যন্তরভাগে বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ঢিবি, পরশুরামের প্রাসাদ ঢিবি ও জীয়ত কুন্ড প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নস্থল ছাড়াও ১৯৮৮-৯১ সালে খননকার্যের ফলে নগরটির তিনটি প্রবেশদ্বার, উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মাযার এলাকার নিকটে একটি মন্দির-স্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে।
মহাস্থান প্রত্নস্থলের তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটি উত্তর দিকের রক্ষা-প্রাচীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের ৪৪২ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রবেশদ্বার ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যটি ৬.৫ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ১.৬ মিটার প্রশস্ত। প্রবেশদ্বার দুটি প্রাথমিক ও পরবর্তী পালযুগ দুপর্যায়ে ব্যবহূত হয়েছিল। পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি প্রায় এর মধ্যস্থলে এবং পরশুরামের প্রাসাদের ১০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এবং প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত। পাল যুগের শেষের দিকে একটি পুরানো প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষের উপর এটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ প্রবেশদ্বারটি এখনও সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা যায়নি। সবগুলি প্রবেশদ্বার-স্থাপনায় ভেতর দিকে প্রহরি-কক্ষ এবং রক্ষা-প্রাচীরের বাইরে সম্প্রসারিত বুরুজ রয়েছে।
-
উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্রের টুকরা
-
সূর্য
-
অশ্বোরোহী, পোড়ামাটির ভাস্কর্য
-
রৌপ্যনির্মিত পাঞ্চমার্কড মুদ্রা
-
স্বল্প মুল্য প্রস্তর পুঁতি
-
প্রস্তর পুঁতি
-
স্বর্ণ মুদ্রা
-
কাঁচের পুঁতি
মাযার এলাকায় উন্মোচিত মন্দির-স্থাপনায় কোন সুসঙ্গত নির্মাণ পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না। পাল শাসনামলে এটি পাঁচটি পর্যায়ে নির্মিত ও পুননির্মিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বড় আকারের পোড়ামাটির ফলক, খেলনা ও গোলক এবং অলঙ্কৃত ইট ও মাটির পাত্র।
নগরের রক্ষা-প্রাচীরটি ছয়টি পর্যায়ে নির্মিত। সর্বপ্রাচীন পর্যায়ে সম্ভবত মৌর্যযুগ এবং পরবর্তী পর্যায় শূঙ্গ-কুষাণ, গুপ্ত, প্রাথমিক পাল, পরবর্তী পাল ও সুলতানি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। এই প্রাচীরগুলি পর্যায়ক্রমে একটির উপর অন্যটি নির্মিত হয়েছে। কাজেই নগরের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমিক সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা প্রাচীরেও নির্মাণের পর্যায়ক্রমিক স্তর পরিদৃষ্ট হয়। অবশ্য প্রাচীনতম স্তরে নগরটির সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীনতম রক্ষা-প্রাচীরের পারস্পরিক সম্পর্ক এখনও নির্ণয়সাপেক্ষ।
গোবিন্দ ভিটা, লক্ষ্মীন্দরের মেধ, ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়ি ধাপ নগরটির বাইরে সন্নিহিত এলাকায় খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা। কিন্তু সন্নিহিত গ্রামসমূহে আরও অনেক স্তূপ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যেখানে প্রাচীন সুরক্ষিত পুন্ড্রনগরের উপকণ্ঠের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ নিহিত আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। [শফিকুল আলম]