সিরাজউদ্দৌলা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''সিরাজউদ্দৌলা''' বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা বাংলার নওয়াবদেরকে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করে এবং নিজেরাই বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়। মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খানের দৌহিত্র এবং [[খান | '''সিরাজউদ্দৌলা''' বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা বাংলার নওয়াবদেরকে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করে এবং নিজেরাই বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়। মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খানের দৌহিত্র এবং [[জৈনুদ্দীন আহমদ খান|জৈনুদ্দীন আহমদ খান]] ও আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পরপরই আলীবর্দী খান বিহারের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এ কারণে পরিবারে সিরাজ ‘সৌভাগ্য সূচক সন্তান’ হিসেবে বিবেচিত হন। সিরাজের প্রতি তাঁর পিতামহের ছিল বিশেষ স্নেহ ও পক্ষপাত। | ||
[[Image:Sirajuddaula.jpg|thumb|right|400px|সিরাজউদ্দৌলা]] | [[Image:Sirajuddaula.jpg|thumb|right|400px|সিরাজউদ্দৌলা]] | ||
২৩ নং লাইন: | ২৩ নং লাইন: | ||
সমকালীন প্রতিকূল পরিবেশের সামগ্রিক বিবেচনায় সিরাজউদ্দৌলার দুর্বলতাসমূহ এবং তাঁর কর্ম ও ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে যে মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি আত্মোৎসর্গ করেন সে কথাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। বাংলার নওয়াব পদে আসীন হওয়ার পর তাঁর চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আলীবর্দী খানের শেষ উপদেশ সম্ভবত এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সিরাজের আর যাই দোষ থাক, এ কথা সত্য যে তিনি স্বদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা দেশ বিক্রি করেন নি। ইতিহাসের পাতায় সিরাজ নিঃসন্দেহে ক্লাইভ অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সেই রাজনৈতিক মঞ্চের প্রধান নায়কদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কখনও প্রতারণা বা শঠতার আশ্রয় নেননি। [কে.এম মোহসীন এবং সুশীল চৌধুরী] | সমকালীন প্রতিকূল পরিবেশের সামগ্রিক বিবেচনায় সিরাজউদ্দৌলার দুর্বলতাসমূহ এবং তাঁর কর্ম ও ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে যে মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি আত্মোৎসর্গ করেন সে কথাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। বাংলার নওয়াব পদে আসীন হওয়ার পর তাঁর চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আলীবর্দী খানের শেষ উপদেশ সম্ভবত এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সিরাজের আর যাই দোষ থাক, এ কথা সত্য যে তিনি স্বদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা দেশ বিক্রি করেন নি। ইতিহাসের পাতায় সিরাজ নিঃসন্দেহে ক্লাইভ অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সেই রাজনৈতিক মঞ্চের প্রধান নায়কদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কখনও প্রতারণা বা শঠতার আশ্রয় নেননি। [কে.এম মোহসীন এবং সুশীল চৌধুরী] | ||
'''গ্রন্থপঞ্জি''' BK Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962; Kalikankar Datta, Sirajuddaulah, Calcutta 1971; JN Sarkar (ed), The History of Bengal, II, Dhaka, 1972; AK Maitreya, Siraj-uddaula (in Bangla), Calcutta, 1304 BS; S Chaudhury, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000. | |||
[[en:Sirajuddaula]] | [[en:Sirajuddaula]] |
০৬:২৯, ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা বাংলার নওয়াবদেরকে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করে এবং নিজেরাই বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়। মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খানের দৌহিত্র এবং জৈনুদ্দীন আহমদ খান ও আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পরপরই আলীবর্দী খান বিহারের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এ কারণে পরিবারে সিরাজ ‘সৌভাগ্য সূচক সন্তান’ হিসেবে বিবেচিত হন। সিরাজের প্রতি তাঁর পিতামহের ছিল বিশেষ স্নেহ ও পক্ষপাত।
সিরাজের শিক্ষাজীবন কেটেছে তাঁর পিতামহের গৃহে। করম আলীর ‘মুজাফ্ফর নামা’ অনুসারে নওয়াব আলীবর্দী খান শাসনকার্য পরিচালনার কলাকৌশল এবং একজন যুবরাজের জন্য আবশ্যিক অন্যান্য গুণাবলিতে তাঁকে পারদর্শী করে তুলতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রচলিত শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব সম্ভবত তা যথোপযুক্ত ছিল না। বৃদ্ধ নওয়াবের অন্ধ স্নেহ এবং স্তাবকদের অতি প্রশংসার কারণে প্রথম জীবনে সিরাজ খুব সম্ভবত কিছু বাড়াবাড়ি করেন, এবং আলীবর্দী তা উপেক্ষা করেন। সিরাজকে ঢাকায় নৌ-বাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়, আর তাঁর ছোট ভাই ইকরামউদ্দৌলা ছিলেন সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে। ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযানে কিশোর সিরাজকে আলীবর্দী তাঁর সঙ্গে নেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে আলীবর্দী খান সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও তাঁকে অভিনন্দন জানায়।
তাঁর শাসনকালের শেষদিকে আলীবর্দী খান পরিবারের কয়েকজন সদস্যের অকাল মৃত্যুতে প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক আঘাত পান। এমতাবস্থায় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১০ এপ্রিল বৃদ্ধ নওয়াবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সিরাজকে রাজ্যের শত্রুদের দমন এবং প্রজা সাধারণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সকল অন্যায়-অবিচার দূর করার উপদেশ দেন।
জনগণের আনুগত্য অর্জন এবং তাঁর (আলীবর্দী খান) পদাঙ্ক অনুসরণ করার জন্য তিনি সিরাজকে বিশেষভাবে তাগিদ দেন। মাতামহের মৃত্যুশয্যায় সিরাজ পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি মদ্যপান থেকে বিরত থাকবেন। বাকিজীবন তিনি এ প্রতিজ্ঞা বজায় রেখে ছিলেন বলে লুক স্ক্র্যাপটন-এর বিবরণ হতে জানা যায়। সিরাজ অতি অল্প সময় (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুন পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক এক বছর) বাংলা শাসন করেন। এ সময় তাঁর জন্য বাংলার মসনদ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। এ স্বল্পকালীন শাসনে তরুণ নওয়াবকে পরিবারের ভেতরের এবং বাইরের শত্রুদের মোকাবিলা করতে হয়।
নওয়াব পদে সিরাজের মনোনয়ন প্রাপ্তিতে ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ, মীরজাফর আলী খান এবং শওকত জঙ্গ তাঁর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ঘসেটি বেগম ছিলেন বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তির অধিকারী, যা ছিল তাঁর প্রভাব ও শক্তির উৎস। ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতা অনুমান করে সিরাজ বেগমের মতিঝিল প্রাসাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। এছাড়াও নওয়াব বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে তাঁর আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নিযুক্তি দেন। মীরমর্দানকে তিনি ‘বকশী’ পদে মীরজাফরের স্থলাভিষিক্ত করেন। মোহনলাল তাঁর ‘দিওয়ানখানা’র ‘পেশকার’ পদে উন্নীত হন। প্রশাসনে মোহনলাল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেন। এক পর্যায়ে সিরাজ পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জংকে দমন করেন এবং এক সংঘর্ষে শওকত নিহত হন।
সিরাজের ক্ষমতারোহণ মুর্শিদাবাদের শাসক শ্রেণির প্রভাবশালী অংশের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। প্রথম দিককার নওয়াবদের সময়ে এই গোষ্ঠী ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করার কাজেই নিয়োজিত ছিল। সিরাজ শাসন ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে এ গোষ্ঠী আশঙ্কা করে যে, সম্পদ কুক্ষিগত করনে তাদের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তরুণ নওয়াব বিপদজনক হতে পারেন। কেননা ক্ষমতা জবরদখলকারী পুরানো গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ হিসেবে সিরাজ এক নতুন গোষ্ঠীর উত্থানে সাহায্য করছিলেন। সিরাজের সিংহাসন লাভ ইংরেজদের পক্ষেও ছিল হুমকিস্বরূপ। কেননা পূর্ববর্তী নওয়াবদের মতো সিরাজ ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও বণিক গোষ্ঠী কর্তৃক দস্তকএর অপব্যবহার মেনে নিতে অস্বীকার করেন। সিরাজ এ ঘোষণা দেন এমন এক সময়ে যখন ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে এক মারাত্মক সংকট চলছিল। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিরাজ বাস্তবিক পক্ষেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথমত তাঁর সিংহাসনারোহণের বিরুদ্ধে কোম্পানির চক্রান্ত সম্পর্কে তিনি সন্দেহ করছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর অসন্তোষও প্রকাশ করেন। কোম্পানির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগগুলির মধ্যে ছিল প্রথমত, নওয়াবের অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়ম নামক দুর্গ নির্মাণ; দ্বিতীয়ত, ইংরেজরা মুগল শাসকদের প্রদত্ত বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়; এবং তৃতীয়ত, ইংরেজরা সরকারি তহবিল তছরূপকারী কৃষ্ণদাসকে (রাজবলভের পুত্র) আশ্রয় প্রদান করে। ইংরেজরা যদি প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং মুর্শিদকুলী খান প্রদত্ত বিধি ও শর্তানুসারে বাণিজ্য করতে সম্মত হয়, তাহলে নওয়াব তাদের ক্ষমা করবেন বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু কোম্পানি এ ক্ষেত্রে নওয়াবের প্রতি কোনরূপ সম্মান প্রদর্শন করে নি। উপরন্তু কলকাতা কাউন্সিলের গভর্নর ড্রেক ফোর্ট উইলিয়মে প্রেরিত নওয়াবের বিশেষ দূত নারায়ণসিংহকে অপমান করেন।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ নওয়াব ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে কাসিমবাজার কুঠি অবরোধ করেন এবং পরবর্তীকালে কলকাতা অধিকার করে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় কয়েকজন ইংরেজ বন্দিকে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আটক রাখা হয়েছিল এবং এদের মধ্যে কয়েকজন মারা গিয়েছিল বলে জন জেফেনিয়াহ হলওয়েল (১৭১১-১৭৯৮) নামক ইংরেজ সিভিল সার্জন তাঁর Genuine Narrative of the Deaths… in the Black Hole গ্রন্থে ১৭৫৮ সালে প্রকাশ করেন। এ ঘটনা ইতিহাসে তথাকথিত অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। নওয়াবের কলকাতা আক্রমণ এবং মাদ্রাজ থেকে সৈন্যবাহিনী আসার ধারাবাহিকতায় নওয়াবের সঙ্গে ইংরেজদের আলীনগর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সন্ধি অনুসারে নওয়াব ইংরেজ পক্ষকে কলকাতার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ প্রদানে সম্মত হন। এরপর ইংরেজদের ঔদ্ধত্য আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কলকাতার পতনের পর বাংলায় ইংরেজদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল প্রকৃতপক্ষে দুটি উপায়ে - হয় নওয়াবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে অথবা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। ইংরেজরা দ্বিতীয় পন্থাটিই গ্রহণ করে। শান্তিচুক্তির আড়ালে তারা যুদ্ধ প্রস্ত্ততি চালিয়ে যেতে থাকে।
এখন থেকে ইংরেজরা বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ও গোপন কর্মকান্ডের মাধ্যমে ফরাসিদের প্রভাব চূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়। সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে তারা এমন একজন ব্যক্তিকে খুঁজতে থাকে যিনি তাদের প্রতি পুরোপুরি বন্ধুত্বপরায়ণ হবেন। শেষ পর্যন্ত নওয়াবের বিরুদ্ধে কোম্পানি সাফল্যের সঙ্গে একটি ষড়যন্ত্র সম্পন্ন করে এবং মীরজাফর, জগৎশেঠ ও অন্যান্য ক্ষুব্ধ অমাত্যের সমর্থন লাভ করে। সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পর ক্লাইভ ও ওয়াটসনএর অধীনে কোম্পানির শক্তি মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ যাত্রা করে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন নওয়াব পলাশীর প্রান্তরে ক্লাইভের মুখোমুখি হন। পলাশীর যুদ্ধে নওয়াব পরাজিত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। পাটনা যাওয়ার পথে মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই নওয়াব নিহত হন। ইতোমধ্যেই কোম্পানি মীর জাফরকে বাংলার নতুন নওয়াব মনোনীত করে। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হয়েছিল যতোটা না তাদের সামরিক শক্তির কারণে, তার চেয়ে বেশি ষড়যন্ত্রের শক্তিতে এবং সিরাজউদ্দৌলার সেনা ছাউনির অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতায়। নওয়াবের পরাজয় বাংলায় ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিতবাহী। এর পর ধীরে ধীরে সমগ্র উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার। আর ব্রিটিশরা ছিল এ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতা। ইংরেজরা তাদের ‘ক্যু’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরবারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে। একথা অনস্বীকার্য যে, নওয়াবের দরবারে তখন অসহিষ্ণু অবস্থা বিরাজমান ছিল। তবে নওয়াবের বিরুদ্ধে এ অসন্তোষই সাফল্যের মূল কারণ নয়। ইংরেজদের সহযোগিতায় পলাশীর চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ ষড়যন্ত্র অবশ্যই নওয়াবের পতনের মূল চালিকাশক্তি হতে পারতো না। ব্রিটিশ স্বার্থসিদ্ধি এবং স্থানীয় কুচক্রীদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত সিরাজের অপসারণ ছিল একান্তই অপরিহার্য। একারণেই সংঘটিত হয় পলাশী যুদ্ধ, যার মাধ্যমে সিরাজের পতন এবং মীরজাফরের উত্থান ঘটে।
এটি সম্ভবত সত্য যে, নওয়াব হিসেবে সিরাজ ছিলেন খানিকটা উদ্ধত এবং খুব সম্ভবত কিছুটা অসহিষ্ণু। এক কথায় তিনি সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অস্থির চিত্তের সিরাজের মধ্যে দৃঢ়তার অভাব ছিল। এছাড়া সংকটকালে সিদ্ধান্তহীনতাও তাঁর অন্যতম ত্রুটি। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সিরাজ তখন ছিলেন মাত্র চবিবশ বছরের এক অপরিণত যুবক। ক্ষমতা ও উচ্চাসন তাঁকে কিছুটা বেপরোয়াও করে তুলেছিল। সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এই যে, অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই সাথে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, তারা যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে সেরূপ কোন পদক্ষেপ তিনি নেন নি। এরূপ সাবধানতা অবলম্বনে তাঁর ব্যর্থতা এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার মতো মানসিক দৃঢ়তার অভাবের কারণেই তাঁর পতন হয়।
সমকালীন প্রতিকূল পরিবেশের সামগ্রিক বিবেচনায় সিরাজউদ্দৌলার দুর্বলতাসমূহ এবং তাঁর কর্ম ও ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে যে মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি আত্মোৎসর্গ করেন সে কথাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। বাংলার নওয়াব পদে আসীন হওয়ার পর তাঁর চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আলীবর্দী খানের শেষ উপদেশ সম্ভবত এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সিরাজের আর যাই দোষ থাক, এ কথা সত্য যে তিনি স্বদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা দেশ বিক্রি করেন নি। ইতিহাসের পাতায় সিরাজ নিঃসন্দেহে ক্লাইভ অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সেই রাজনৈতিক মঞ্চের প্রধান নায়কদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কখনও প্রতারণা বা শঠতার আশ্রয় নেননি। [কে.এম মোহসীন এবং সুশীল চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি BK Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962; Kalikankar Datta, Sirajuddaulah, Calcutta 1971; JN Sarkar (ed), The History of Bengal, II, Dhaka, 1972; AK Maitreya, Siraj-uddaula (in Bangla), Calcutta, 1304 BS; S Chaudhury, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000.