অন্ধকূপ হত্যা

অন্ধকূপ হত্যা  ১৭৫৬ সালের ২০ জুন বাংলার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা দখলের সময় সংঘটিত হওয়া কথিত ঘটনা। এ কাহিনী মূলত কলকাতা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ইংরেজ সেনাপতি জে.জেড হলওয়েলের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে রচিত। সে সময় থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। পরবর্তীকালে হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (১৮৫৮) গ্রন্থের প্রণেতা ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিলের লেখাতেই বিষয়টি প্রথম গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। তারপর থেকে এর ওপর এত বেশি আলোকপাত করা হতে থাকে যে পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং সিপাহি বিপ্লব (১৮৫৭) এর পাশাপাশি এ কাহিনীও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ইংল্যান্ডের স্কুল ছাত্রদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে বর্তমানে অন্ধকূপ হত্যা কাহিনীর বেশির ভাগই অসত্য এবং অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়।

১৭৫৬ সালের ১৬ জুন ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের হাত থেকে কলকাতা জয়ের লক্ষ্যে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট উইলিয়মের প্রবেশদ্বারে উপনীত হন। দুদিন যুদ্ধের পর ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক নিশ্চিত হন যে, নওয়াবের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি ১৯ জুন দুর্গের ইংরেজ বাসিন্দাদের বড় অংশ নিয়ে ফুলতা পালিয়ে যান। হলওয়েল ইউরোপীয় এবং আর্মেনীয় সেনা ছাড়াও প্রায় ১৭০ জন শ্বেতাঙ্গ সৈন্যের একটি দল নিয়ে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে থেকে যান। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি বহাল রেখে ড্রেকের নেতৃত্বে ফুলতাগামী ইংরেজ বাহিনীকে ফুলতায় প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করা এবং পরের দিন ফুলতা থেকে তাদের জন্য যে নির্দেশ আসবে তা কার্যকর করা। কিন্তু ইংরেজদের এ ক্ষুদ্র বাহিনী ফোর্ট উইলিয়ম এবং এর পাশ্ববর্তী এলাকার মধ্যে নিজেদের অবস্থান সরিয়ে আনে। হলওয়েল সিরাজের বাহিনীকে রুখে দাঁড়াতে সচেষ্ট হন, কিন্তু সিরাজের বন্দুকধারী সৈন্যবাহিনী তাকে সফল হতে দেয় নি। ক্ষুদ্র শ্বেতাঙ্গ ক্লাইভ বাহিনীর ৫৩ জন সৈন্য (যার অধিকাংশ ছিল ওলন্দাজ) রাতের অাঁধারে পালিয়ে সিরাজ বাহিনীতে যোগ দেয়। ২০ জুনের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধে ২৫ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। ইংরেজদের পক্ষে কামান ব্যবহারে সমর্থ আর মাত্র ১৪ জন সৈন্য অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তাদের মালামাল পরিবহণের জন্য কাউকে পাওয়া যায় নি। ২০ জুনের সন্ধ্যায় নওয়াবের সৈন্যরা সব দিক থেকে দুর্গের দেয়ালসমূহে সরাসরি আঘাত হানতে থাকলে একজন বিশ্বাসঘাতক ওলন্দাজ সার্জেন্ট নদীর মুখের দিকের দুর্গ তোরণটিকে নওয়াব বাহিনীর জন্য খুলে দেয়। নওয়াব বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে তখন কিছু ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ইংরেজ বাহিনীর নেতা হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন। সিরাজের সৈন্যরা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে। হলওয়েল নওয়াবের সাথে তিনবার সাক্ষাৎকার করেন এবং নওয়াবের কাছ থেকে তাঁর নিরাপত্তার আশ্বাস লাভ করেন। নওয়াবের বিজয়ী সৈন্যরা ইউরোপীয়দের মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করল বটে, কিন্তু তাদের সাথে খারাপ আচরণ করে নি। তবে রাতের দিকে কিছু বন্দি ইউরোপীয় সৈন্য নওয়াব বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে বসলে তাদের ঔদ্ধত্যমূলক আচরণ সম্পর্কে নওয়াবের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়। নওয়াব হলওয়েলের পক্ষের যে সকল ইউরোপীয় সৈন্য স্থানীয় প্রহরীদের আক্রমণ করেছিল তাদের আটক রাখতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে হলওয়েল অভিযোগ করেন যে, নওয়াব ইউরোপীয় বন্দিদের একটিমাত্র ক্ষুদ্র জানালাবিশিষ্ট ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে আটকে রাখেন। ইউরোপীয় ও ইংরেজদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, জুনের প্রচন্ড গরমের সে রাতে ইউরোপীয় ও ইংরেজ বন্দিদের ওই অন্ধকূপে ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য করা হয়। ফলে সকাল পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এবং যুদ্ধাহত অবস্থায় অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ১৪৬ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১২৩ জন বলে ইউরোপে প্রচার করা হয় এবং স্বীকৃত হয়। চন্দননগরে পলাতক কিছু ইংরেজের গল্পকাহিনীতে মৃতের সংখ্যা ১২৩ থেকে বাড়িয়ে ২০০ পর্যন্ত বলা হয়।

এ ঘটনায় নওয়াবের আচরণ কতটা যথার্থ ছিল তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বন্দিরা তাদের প্রহরীদের ওপর সহিংস আচরণ করলে আন্তর্জাতিক আইনে তাদের গুলি করার বিধান আছে। তারপরও নওয়াব ইংরেজ সৈন্যবাহিনীতে কতিপয় বিশৃঙ্খল সৈন্যদের থামিয়ে দিতে তাদের আটকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রাণপণ যুদ্ধ ও রক্তপাতের বিনিময়ে দখলকৃত দুর্গের তখনকার দুর্বিষহ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নওয়াবের পক্ষে নিরপরাধীদের আইন ভঙ্গকারী অপরাধী সৈন্যদল থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া সম্ভব হয় নি। যুদ্ধ- পরবর্তী সে রাতে বন্দিশালার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল নওয়াব বাহিনীর সাধারণ সৈনিকরা। পরদিন হলওয়েল ও ইংরেজ কোম্পানির অপর তিন জন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছাড়া সকল আটকাধীন ইংরেজ সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া হয়। নওয়াব হলওয়েল ও এ তিন জন শীর্ষস্থানীয় ইংরেজ কর্মকর্তাকে মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দি রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েকদিন পর নওয়াব তাদের মুক্তি দেন এবং তারা ফুলতায় ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। অন্ধকূপে তখন শুধু মিসেস কেরী নাম্নী এক শ্বেতাঙ্গিনী কারাবন্দি ছিল। তাকেও অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনিও ফুলতায় ইংরেজ বাহিনীতে যোগ দেন। ১৭৫৬ সালের ২৬ জুনের মধ্যে সকল জীবিত ইংরেজ ফুলতায় পাড়ি দেয়। যুদ্ধ শেষে রাজধানীতে ফিরে এসে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট সেন্ট জর্জ-এর গভর্নর জর্জ পিগটকে লেখা পত্রে (৩০ জুন ১৭৫৬) ইংরেজদের বাংলায় অবস্থান এবং যুক্তিসঙ্গত শর্তে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার দিতে তাঁর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। ইউরোপীয় বা ইংরেজ মহল থেকে মৃতের যে সংখ্যা দাবি করা হয়েছে তা স্পষ্টতই অতিরঞ্জিত। ইংরেজ বাহিনীর আত্মসমর্পণের তিন ঘণ্টা পরও ১৪৬ জনের মতো ইউরোপীয় যুদ্ধবন্দি যে নওয়াবের হাতে ছিল সে বিষয়ে মুর্শিদাবাদের ইংলিশ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক লিটল সন্দেহ পোষণ করেন। ১৪৬ জন ইউরোপীয় সৈন্য নওয়াব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কোনো দলিল বা বন্দিদের মাথা গুণে নির্ণয়কৃত মোট সংখ্যার কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও আত্মসমর্পণের সময় থেকে ইউরোপীয় এসব যুদ্ধবন্দিদের অন্ধকূপে স্থানান্তরের সময় পর্যন্ত কিছু কিছু ইউরোপীয় বা ইংরেজ সৈন্য পালিয়ে যায় বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেন। এমনও বলা হয় যে, সে সময় হলওয়েলকেও তার এক বন্ধু পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, কিন্তু সে সুযোগ তিনি গ্রহণ করেন নি।

অন্ধকূপে বন্দি ইউরোপীয় বা ইংরেজ সৈন্যদের সংখ্যার দাবিতে যে অতিরঞ্জন পরিলক্ষিত হয় তা পন্ডিত ভোলানাথ চন্দ্রের বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিনির্ভর পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। ভোলানাথ প্রমাণ করেছিলেন যে, অন্ধকূপের ২৬৭ বর্গফুট আয়তন ১৪৬ জন পূর্ণবয়স্ক ইউরোপীয় সৈন্যের ধারণ ক্ষমতার বাইরে ছিলো। তিনি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ইউরোপীয় বা ইংরেজদের অভিযোগের অসারতা প্রমাণ করেন। ১৮ ফুট × ১৫ ফুট আয়তনবিশিষ্ট একটি স্থানকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে ইউরোপীয়দের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ১৪৬ জন বাঙালি কৃষককে ঠাসাঠাসি করেও ঢোকাতে তিনি ব্যর্থ হন। ইউরোপীয় বা ইংরেজদের তুলনায় শারীরিক দিক থেকে খর্বকায় সমসংখ্যক বাঙালিকেও তথাকথিত অন্ধকূপের নির্দিষ্ট আয়তনে প্রবেশ করানো সম্ভব ছিলো না। অতএব একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তথাকথিত অন্ধকূপে ইউরোপীয়দের মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ১৪৬ জনের চেয়ে বেশ কম ছিলো।

অধুনা হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (১৯৫৮) গ্রন্থের লেখক পার্সিভাল স্পিয়ারও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে হলওয়েলের দাবি সমর্থন করেন নি; তবে তিনি মনে করেন যে, অন্ধকূপ হত্যার কাহিনীতে কিছুটা সত্য আছে, এবং পুরোপুরি সঠিক না হলেও সে ধরনের কিছু একটা ঘটেছে। স্পিয়ার বলেন যে, হলওয়েলের যুক্তিতে অতিরঞ্জন থাকলেও কলকাতা রক্ষার জন্য নিয়োজিত ১২৩ জন ইউরোপীয় সৈন্যের হিসাবতো দেখাতেই হয়। সে কারণেই এ সকল সৈন্যের অন্ধকূপে মৃত্যুর চেয়ে যুদ্ধে নিহত হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ।  [মোহাম্মদ শাহ]