চট্টগ্রাম নগরী

চট্টগ্রাম নগরী  শুধু চট্টগ্রাম জেলারই প্রধান নগর নয়, বাংলাদেশেরও দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। কর্ণফুলী নদীর ডান তীরবর্তী এ নগরী  ২২°-১৪´ ও ২২°-২৪´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°-৪৬´ ও ৯১°-৫৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। বারনলি তাঁর Description Historique et Geographic del ‘Inde’ (১৭৮৬) গ্রন্থে মত প্রকাশ করেছেন যে, চট্টগ্রাম নামটি আরবি ‘শাত্’ (বদ্বীপ) ও ‘গঙ্গা’ শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং এর দ্বারা গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত নগরকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ নগরীর নাম থেকেই জেলার নামকরণ হয় চট্টগ্রাম।

অধিবাসী ও ভাষা  বন্দরনগরী বিধায় চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের আকৃষ্ট করেছে। এ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নগরীর ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে। আল-ইদ্রিসি ১১৫৪ সালে তাঁর গ্রন্থ রচনাকালে লিখেছেন যে, বাগদাদ ও বসরার আরব বণিকগণ মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি এলাকা প্রায়ই সফর করতেন যা বর্তমানে সাধারণত চট্টগ্রাম বলে বিশ্বাস করা হয়। অপরাপর পর্যটক ও ঐতিহাসিকগণ নয় শতক থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। বণিক ছাড়াও বহু সুফি দরবেশ চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করেন। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর মুসলমান অভিবাসন আরও বেড়ে যায়। ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও বহিরাগতদের বসতি স্থাপনের সূত্রে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকদের সঙ্গে পারস্পরিক মেলামেশা চট্টগ্রামের অধিবাসীদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, স্থানীয় ভাষা ও ধর্মের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে।

চট্টগ্রামের আধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুসলমান; নগরীতে স্বল্পসংখ্যক হিন্দু ও খ্রিস্টান বসবাস করে। এখানকার আঞ্চলিক ভাষায় বহু আরবি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়; এ ছাড়া বহু স্থান ও লোকের আরবি নাম রয়েছে। আলকরন (আল-কর্ণ), সুলেক বহর (সুলুকুল বাকুলিয়া) প্রভৃতি স্থানের নামে আরবি প্রভাব রয়েছে। আরবি শব্দ ছাড়াও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কিছু আরাকানি, পর্তুগিজ, পালি ও হিন্দি শব্দ পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে বলা হয় ‘চাটগাঁইয়া বুলি’।

বিদেশিদের আগমনের ফলে চট্টগ্রাম বিভিন্ন জাতির মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এর ফলে সংখ্যায় কম হলেও এখানে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের লোক দেখা যায়। বিদেশিদের মধ্যে কিছু কিছু দৈহিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। উঁচু গন্ডস্থি, চাপা মুখমন্ডল ও আকশি সদৃশ বক্র নাসিকা আরব বংশধারার পরিচায়ক। পেশিবহুল দেহ, বৃষ-স্কন্ধ, সুগঠিত দেহ ও ঘন শ্মশ্রুবিশিষ্টরা হলেন আফগান ও মুগল সৈনিকদের বংশধর।

ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজদের বংশধরদের এখনও চট্টগ্রামে দেখা যায়। তাদের অধিকাংশই স্থানীয় নারীদের বিয়ে করেছে এবং তারা ‘কালা ফিরিঙ্গি’ বা ‘মাটিয়া ফিরিঙ্গি’ নামে পরিচিত। এরা প্রধানত রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ব্রিটিশ আমলে তারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করত এবং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন বন্দর, রেলওয়ে ও সরকারি দপ্তরে করণিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পেত। ফিরিঙ্গি বাজার নামে পরিচিত নগরীর একটি এলাকা তাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে বলে কথিত আছে। পর্তুগিজদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বাংলা ভাষায় এমন বহু পর্তুগিজ শব্দের সংযোজন যেগুলি এখনও দৈনন্দিন কাজে প্রচলিত আছে। এসব শব্দের মধ্যে রয়েছে আনারস, পেঁপে, পাদ্রি, ফিতা, আলপিন, বোতাম, চাবি ইত্যাদি।

চট্টগ্রামের অধিবাসীগণ অত্যন্ত উদ্যোগী এবং দেখা যায় যে, বহুকাল আগে থেকেই তারা বাড়িঘর ছেড়ে উন্নততর সুযোগ সুবিধার সন্ধানে বের হতো। অনেকেই সমুদ্রযাত্রীর জীবন বেছে নিত এবং অন্যরা প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে চলে যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং ভারত থেকে বার্মার পৃথকীকরণের ফলে এ অভিবাসন বাধাগ্রস্ত হয়। জাপানিদের বার্মা দখলের অব্যবহিত পরে চট্টগ্রামবাসীদের অনেকে দেশে ফেরার চেষ্টা করে। হিংস্র বন্য প্রাণী অধ্যুষিত বিপদসঙ্কুল এলাকা অতিক্রম কালে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারায়। এ সময়ে বর্মীদের মধ্যে অ-বর্মীয় সবকিছুর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান দেখা দিলে চট্টগ্রামবাসীদের মধ্যে বার্মা ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। চট্টগ্রামবাসীদের অনেকেই বার্মায় কাঠ ও চালের লাভজনক ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে  কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই বন্দরে কর্মরত চট্টগ্রামবাসীদের ভাগ্যে অনুরূপ বিপর্যয় নেমে আসে; চাকরি ছেড়ে তাদের চট্টগ্রামে এসে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। তাদের প্রত্যাবর্তনের ফলে নগরীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে একদল অত্যন্ত দক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল ব্যবসায়িক উদ্যোগ, পুঁজি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান যা নগরীর অর্থনীতিকে বেশ চাঙ্গা করে তোলে।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ বার্মা ও ভারত হতে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বিতাড়িত করলেও তা ভারত ও পাকিস্তানের মুসলিমদের বহু সুযোগ করে দেয়। দেখা যায় যে, ১৯৫১-১৯৬১ সালের এ এক দশকে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু মুসলিম উদ্বাস্ত্তর চট্টগ্রামে আগমন ঘটে। এরা প্রধানত ছিল বণিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও শ্রমিকশ্রেণীর লোক। ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মুসলিম উদ্বাস্ত্তদের স্পষ্টত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বৈষম্যমূলকভাবে রাষ্ট্রীয় সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়। এর ফলে চট্টগ্রাম পৌর এলাকায় জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। ১৯৪৭ সালের পরে বোম্বাই ও সুরাট থেকে চট্টগ্রামে আগত আগা খানী, কুচী মেমন, বোহরা ও নাখোদা জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামে নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছিল। অবশ্য সত্তরের দশকে এদের অনেকেই ব্যবসা ত্যাগ করে এবং চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য পুনরায় চট্টগ্রামের স্থানীয় লোকদের হাতে ফিরে আসে।

ভূ-বিবরণ  হিমালয় থেকে বিচ্ছিন্ন পার্বত্য অঞ্চলের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ভূ-প্রকৃতিগতভাবে সিলেট ও উত্তর দিনাজপুর ব্যতীত বাংলাদেশের বাকি অংশ হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিমালয়ের এ পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্ন অংশ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব দিকে ঘুরে আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে ফেনী নদীর অপর তীর হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিশেছে। চট্টগ্রাম শহরের কাছে এসে এ পর্বতসারির উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে এবং সারা শহরে বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ পর্বতসারি পুনরায় কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আবির্ভূত হয়ে জেলার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। চন্দ্রনাথ বা সীতাকুন্ড হচ্ছে জেলার সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১১৫২ ফুট। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে নঙ্গরখানা ২৯৮ ফুট উঁচু। শহরের মধ্যেই বাটালি হিল নামে পরিচিত একটি পর্বত চূড়া রয়েছে। এটি ছিল ২৮০ ফুট উঁচু এবং শহরের সর্বোচ্চ স্থল। দূর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের দিক নির্দেশনার জন্য বাটালি হিলের উপর একটি বাতিঘর ছিল। চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য সুন্দর পাহাড় ও টিলাগুলির মতো এ বিখ্যাত পাহাড়টিও বাড়িঘর নির্মাণের জন্য দিনে দিনে কেটে সমান করে উচ্চতা হ্রাস করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলায় কোনো প্রাকৃতিক হ্রদ নেই। ফলে বেশ কিছু কৃত্রিম হ্রদ ও পুকুর বা দিঘি জেলার সর্বত্রই দেখা যায়। মুসলিম শাসনামলে এখানে ছোটবড় বহু দিঘি খনন করা হয়েছিল। বিশাল সংখ্যক পুকুরের অবস্থিতির কারণ হচ্ছে মুসলিম শাসনামলে শহরের নারীদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে পুকুর খননের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। কাজেই প্রায় প্রত্যেক স্বচ্ছল পরিবারের বাড়িতেই একটি পুকুর বা দিঘি ছিল। চট্টগ্রাম নগরীর বৃহৎ পুকুরগুলির মধ্যে লালদিঘি, কমলদহ দিঘি, আসকর খানের দিঘি, বেলোয়া দিঘির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সকল দিঘির অনেকগুলিই ভরাট হয়ে গেছে। লালদিঘি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পুরো দিঘিটিকে ঘিরে রয়েছে একটি সীমানা প্রাচীর।

ট্টগ্রামের বৃহৎ জনসভাগুলির প্রায় সব লালদিঘি সন্নিহিত মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মাঠটি লালদিঘি ময়দান নামে পরিচিত। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ১৯২০ ও ১৯২৪ সালে পাহাড়তলি রেল স্টেশনের কাছে দুটি কৃত্রিম হ্রদ খনন করে। রেলওয়ের পানি সরবরাহের জন্য সংরক্ষণাগার হিসেবে এ হ্রদ দুটি খনন করা হয়েছিল। ১৯২৪ সালে ফয়’জ লেকটি খনন করে রেলওয়ে প্রকৌশলী ফয় (Foy)-এর নামে নামকরণ করা হয়। এদের চমৎকার অবস্থানের জন্য উভয়  হ্রদই আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

সমগ্র জেলার ন্যায় চট্টগ্রাম নগরীতেও বহু প্রাকৃতিক ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলির অধিকাংশেরই উৎস হচ্ছে পর্বতশ্রেণী। এ সকল ঝরনার জল জমিতে সেচকর্ম ও পানীয় জল সরবরাহের কাজে ব্যবহূত হয়ে থাকে। খোদ নগরীতেই বেশ কয়েকটি ঝরনা রয়েছে। পানীয় জল সরবরাহের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ এ ঝরনাগুলিকে কংক্রিট প্রাচীর দ্বারা বাঁধিয়ে রেখেছে।

ইতিহাস  সুপ্রাচীনকাল হতেই চট্টগ্রাম নগরী বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খ্রিস্টীয় নয় শতক থেকেই আরবগণ চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পরিচিত ছিল। এশিয়ার ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন এমন বিখ্যাত পর্তুগিজদের মধ্যে প্রথম ঐতিহাসিক ডি বারোস ১৫৫২ সালে চট্টগ্রামকে এর বন্দরের জন্য বাংলারাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও সম্পদশালী নগরী বলে বর্ণনা করেছেন যেখানে পূর্বাঞ্চলের সকল বাণিজ্য জাহাজ সমবেত হতো।

চট্টগ্রামের প্রাথমিক ইতিহাস খুব সুস্পষ্ট নয়। বর্মি ঘটনাপঞ্জিতে আরাকান অঞ্চলের নরপতিদের এক দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায়। ছয় ও সাত শতকে চট্টগ্রাম এ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসকল নরপতির নামের শেষে চন্দ্র পদবি যুক্ত ছিল। ঐতিহাসিক লামা তারনাথ গোপিচন্দ্র নামে এক বৌদ্ধ রাজার নাম উল্লেখ করেছেন, দশ শতকে যার রাজধানী ছিল চট্টগ্রামে। তিববতি জনশ্রুতি মতে চট্টগ্রাম ছিল দশ শতকে কর্মরত বৌদ্ধ তান্ত্রিক তিলাযোগীর জন্মস্থান। এর আদি ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের সময় হতে চট্টগ্রামের ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চেরাগীর পাহাড়, চট্টগ্রাম নগরী

গিয়াসউদ্দীন তুগলক বাংলাকে লখনৌতি, সাতগাঁওসোনারগাঁও এ তিনটি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত করেন। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁও-এ ক্ষমতা দখল করেন এবং অচিরেই চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তিনি চাঁদপুর হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি মহাসড়ক এবং চট্টগ্রামে কয়েকটি মসজিদ ও সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।  শেরশাহর হাতে সুলতান  গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ-এর পতনের পর ১৫৩৮ সালে আরাকানিরা পুনরায় চট্টগ্রাম অধিকার করে। ১৬৬৬ সালে মুগলরা চট্টগ্রাম দখল করে। ১৫৩৮ হতে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত সময় পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে ঘন ঘন আক্রমণ চালায় এবং প্রকৃতপক্ষে এ সময়ে চট্টগ্রাম তাদেরই শাসনাধীন ছিল। এ ১২৮ বছর চট্টগ্রাম পর্তুগিজ ও  মগ জলদস্যুদের আবাসস্থলে পরিণত হয়। মুগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ফলে সার্বিকভাবে এ জেলায় এবং বিশেষ করে নগরীতে শান্তি শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য পর্তুগিজদের অধিকারে থাকাকালে চট্টগ্রাম নগরী ও বন্দর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করে। আঠারো ও ঊনিশ শতকে প্রধানত  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধিতে দিনে দিনে কলকাতার উত্থান ও উন্নয়নের ফলে এতদঞ্চলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব হ্রাস পায়।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম পুনরায় প্রাধান্য লাভ করে। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণের ফলে এর প্রাকৃতিক পশ্চাদভূমির সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সাধিত হয় এবং সার্বিকভাবে চট্টগ্রাম ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বিশ শতকের প্রথম পাদে চট্টগ্রাম নগরীর যে উন্নয়ন সাধিত হয় তার অনেকখানিই সম্ভব হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার এ উন্নতির জন্য।

চট্টগ্রামের ইতিহাসে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন হতে নিজেদের মুক্ত করার পুনঃপুনঃ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব-এর সময় ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানিগুলি চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং জেল থেকে সকল বন্দি মুক্ত করে সিপাহিরা ৩টি সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও ধনসম্পদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। তারা পার্বত্য ত্রিপুরার সীমান্ত পথ ধরে এগিয়ে সিলেট ও কাছাড়ে পৌঁছে। দুর্ভাগ্যবশত তাদের সকলেই কুকি স্কাউট্স এবং পরবর্তীকালে দশম  ’গোর্খা রাইফেল’ নামে পরিচিত সিলেট লাইট ইনফ্যান্ট্রির হাতে নিহত বা বন্দি হয়।

চট্টগ্রামের অধিবাসীগণ খিলাফতঅসহযোগ আন্দোলন-এ জোরালো সমর্থন জানায়। ১৯২৫ সালে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম নিধনের ফলে চট্টগ্রামের অধিবাসীগণ অবশ্য মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে রত বাংলার মুসলিম নেতাদের প্রতি সমর্থন জানায়।

বিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন যখন দানা বেঁধে ওঠে সেসময়  মাস্টারদা সূর্যসেন-এর নেতৃত্বে একদল হিন্দু যুবক রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি গোপন দল গঠন করে। শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গোপন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে যুবকগণ শরীরচর্চার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিপ্লবে দীক্ষা নিত। কয়েক বছর ধরে তারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে ৭০০ যুবক কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অক্সিলারী কোরের অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের ভান্ডার আক্রমণ করে, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস দখল করে এবং ধুম নামক স্থানে রেলপথের ফিসপ্লেট উপড়ে ফেলে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে সূর্যসেনকে গ্রেপ্তার করে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ফাঁসি দেওয়ার পর চট্টগ্রামে বিপ্লবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশগণ চট্টগ্রামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে চট্টগ্রাম জাপানি আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। ১৯৪২ সালের এপ্রিলে পতেঙ্গার বিমানঘাটিতে পর পর দুদিন এবং ওই  বছর ২০ ও ২৪ ডিসেম্বর পুনরায় বোমাবর্ষণ করা হয়। এর ফলে চট্টগ্রামে সপরিবারে বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং বিভাগীয় কমিশনারের সদর দপ্তর কুমিল্লায় এবং আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সরকারি সকল মূল্যবান দলিলপত্র ময়মনসিংহে সরিয়ে নেওয়া হয়। যুদ্ধের ফলে অনেকটা নিষ্প্রাণ ছোট শহর চট্টগ্রাম কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে ওঠে। প্রধানত ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে আগত মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ব্যাপক সমাবেশ ঘটেছিল চট্টগ্রামের সড়কগুলিতে। জাপানি যুদ্ধবিমানের ঘনঘন হামলা, রাতে নিষ্প্রদীপ মহড়া, জাপানিদের অধিকৃত এলাকা থেকে দলে দলে উদ্বাস্ত্তদের আগমন সবকিছু মিলিয়ে চট্টগ্রামের নাগরিক জীবনধারা পাল্টে যায়। এ যুদ্ধ কিছু লোককে সামরিক ঠিকাদার হিসেবে প্রচুর বিত্ত অর্জনে সহায়তা করলেও, যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের ফলে জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে আসে। অনেকের বিশ্বাস দুর্ভিক্ষটি ছিল মনুষ্য-সৃষ্ট এবং প্রয়োজনীয় জনশক্তি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে সেনাবাহিনীর নিয়োগকেন্দ্রে যেতে বাধ্য করার জন্য এটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের কারসাজি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চট্টগ্রাম থেকেই বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ঘোষণা প্রদান করা হয়। চট্টগ্রামের জনসাধারণ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমুদ্রে্ প্রবেশের এবং নতুন সৈন্য সংগ্রহ ও অস্ত্র যোগানের সুযোগ বলিষ্ঠভাবে প্রতিহত করে। মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলে বেশ কিছুসংখ্যক জাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং এভাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর জন্য বন্দর ব্যবহারের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দেয়। পরিণামে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর চট্টগ্রামের জন্য ব্যাপক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কর্মসূচি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সমুদ্র যোগাযোগের প্রধান পথ দীর্ঘকাল ব্যবহারের অনুপযোগী রাখা সম্ভব নয় বলে এ কর্মসূচি খুবই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হয়। স্বাধীনতার পর কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরী ও বন্দরকে স্বাভাবিকভাবে কর্মচঞ্চল করে তোলা হয়।

নগরীর সম্প্রসারণ ও বিকাশ  ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ছিল মাত্র সাড়ে চার বর্গমাইল এবং সারা শহরে বিক্ষিপ্ত নিচু ও ছোট  টিলাগুলির চারপাশ ঘিরে শহরটি গড়ে ওঠে। শহরের উত্তর সীমায় রয়েছে দামপাড়া, নাসিরাবাদ, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা ও শোলকবহর; দক্ষিণে কর্ণফুলী, পূর্বে চাকতাই খাল এবং পশ্চিমে মাদারবাড়ি, পাঠানটুলি ও দেওয়ানহাট। প্রথমে শহরটি এ চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্রুত শিল্পায়ন ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শহরটি পুরাতন পৌরসভার সীমা ছাড়িয়ে নগরীতে পরিণত হয়। নগরটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে যেখানে বর্তমানে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। পশ্চিম দিকে এর সম্প্রসারণ হালিশহর, আসকারাবাদ ও আগ্রাবাদ গ্রামগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য সরকার এ গ্রামগুলির ভূমি অধিগ্রহণ করেছে। উত্তর দিকে এর সম্প্রসারণ ঘটেছে ফৌজদার হাট ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এলাকা এবং উত্তর-পূর্ব দিকে কালুরঘাট পর্যন্ত।

নগরীর সম্প্রসারণের সমন্বয় সাধন ও পরিকল্পিতভাবে নগরটি গড়ে ওঠার কাজে সহায়তার জন্য পাকিস্তান সরকার ১৯৫৯ সালে ৫১ নং অধ্যাদেশ বলে স্বশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে। এ অধ্যাদেশ অনুসারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্বগুলি হচ্ছে: (১) চট্টগ্রাম ও এর সন্নিহিত এলাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এ মহাপরিকল্পনা পুনর্নিরীক্ষণ করা; (২) চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা; (৩) ১৯৫২ সালের পূর্ববাংলা গৃহনির্মাণ আইন প্রয়োগ করা। চট্টগ্রামে ইমারত নির্মাণের নকশা পরীক্ষণ ও অনুমোদন এ সংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগরীকে কয়েকটি ব্লকে বিভক্ত করে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিসের ব্যবস্থাসহ বন্দর উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকা ছিল সদরঘাট, মাদারবাড়ি, ডবলমুরিং ও হালিশহর। সরকারি দপ্তর এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকা ছিল আগ্রাবাদ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পাহাড়তলি পর্যন্ত নিচু পর্বতসারির পশ্চিম ঢালের উন্নয়ন সাধন করে। শিল্পোন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন শিল্পের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল নির্দিষ্ট করে। এ অঞ্চলগুলি ছিল প্রধানত নাসিরাবাদ, পাঁচলাইশ, ফৌজদারহাট, কালুরঘাট এবং ঢাকা ট্রাংক রোডের সন্নিহিত এলাকা।

১৯৬১ সালের মধ্যে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২১২ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিকল্পনা এবং ১০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। UNDP ও UNCHS কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থে ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর জন্য নিম্নবর্ণিত মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়: (ক) চট্টগ্রাম নগরী ও পার্শতবর্তী এলাকায় ১১৫৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি নির্মাণ পরিকল্পনা; (খ) চট্টগ্রাম নগরীর শহর এলাকার জন্য মহাপরিকল্পনা; (গ) পরিকল্পিতভাবে ও সমতা রক্ষা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়নের জন্য বহুমুখী সেক্টরে বিনিয়োগ পরিকল্পনা; (ঘ) চট্টগ্রাম নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ও বন্যা নিরোধের জন্য মহাপরিকল্পনা; (ঙ) চট্টগ্রামে যানজট নিরসন ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা; (চ) নগর উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনা; (ছ) উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জনবল উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির হস্তান্তর।

প্রশাসন  চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কার্যক্রম বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন একমাত্র নির্বাচিত সংস্থা। মেয়র ও ওয়ার্ড কমিশনারগণ নগরবাসীদের ভোটে নির্বাচিত হন। সরকার কর্তৃক প্রেষণে নিয়োজিত একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহি কর্মকতার দায়িত্ব পালন করেন। নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের জন্য নগর পর্যায়ে কোনো আইনানুগ কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই। বিভিন্ন সংগঠনের স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয়, নীতি নির্ধারণ এবং আর্থিক সংস্থান রয়েছে যার চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকে ঢাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের এক্তিয়ারে। নগর পর্যায়ে সর্বজ্যেষ্ঠ নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবে মেয়র মাঝেমধ্যে কোনো কোনো বাস্তবায়নাধীন কার্যক্রমে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন।

রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ, পয়ঃনিষ্কাশন, নগরীর সৌন্দর্য বিধান, নগরীর রাস্তাঘাট সংরক্ষণ এবং মশক নিধন প্রভৃতি মৌলিক নাগরিক সেবা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের সীমিত ক্ষমতা ও বাজেট রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন পৌরকর ও পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ কর আদায় করে এবং এসব  করই কর্পোরেশনের আয়ের প্রধান উৎস।

নগরীতে আইন শৃঙ্খলা বিধান মেট্রোপলিটন পুলিশ ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দুটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও এদের কাজে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে।

ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় জমির পরচা ও আনুষঙ্গিক দস্তাবেজ সংরক্ষণ করে এবং ভূমিরাজস্ব আদায় করে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় পদ্ধতিগত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ভবন

নগর পর্যায়ে জেলা ও সেশন জজ হচ্ছে বিচার বিভাগীয় প্রধান। গুরুতর অপরাধের এবং সকল দীউয়ানি মামলার বিচারকার্য জেলা ও সেশন জজের আদালতে সম্পন্ন হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, তিতাস গ্যাস লিমিটেড এবং তেল কোম্পানিগুলি যথাক্রমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ করে থাকে। এ সকল প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণাধীন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালসমূহ প্রধানত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও হাসপাতাল রয়েছে। এগুলি সরকারি ও এনজিও প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবার সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিকগুলি ছাড়াও এনজিও পরিচালিত বেশ কিছু ক্লিনিক রয়েছে।

নগরীর শিক্ষা-সুবিধা প্রধানত শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রদান করে থাকে। সিটি কর্পোরেশন,  এনজিও ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় প্রায় সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থায়নেই পরিচালিত হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর চট্টগ্রাম নগরীর আওতার মধ্যেই অবস্থিত। এ অবস্থায় বন্দরের যাবতীয় মৌলিক নাগরিক সেবা প্রদান সিটি কর্পোরেশন ও এখানে কর্মরত অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলির দায়িত্ব।

একজন চেয়ারম্যান ও পাঁচ জন সদস্য (স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তা বা বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত) সমন্বয়ে গঠিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রধানত নগরীর উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এলাকা উন্নয়ন (যথা, বাণিজ্যিক এলাকা, আবাসিক এলাকা, বিনোদন এলাকা প্রভৃতি) এবং নগরীর রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য নগরীর অনুমোদিত মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। নগরীর নির্মাণবিধি কার্যকর করাও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নকশার পূর্বানুমোদন ছাড়া নগর এলাকায় কোনো স্থায়ী ভবন নির্মাণ করা যায় না। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণাধীন। সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে এর সমন্বয় অনেকটা অস্থায়ী ধরনের এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ের।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ নগরীতে অগ্নি নির্বাপণ ও জরুরি উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত। ডাক তার ও টোলফোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগ টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান করে থাকে। কিছুসংখ্যক ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিফোন কোম্পানি এখানে সেবা দান করছে।

সার্কিট হাউস (বর্তমানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর)

দর্শনীয় স্থান  চট্টগ্রামের সুদৃশ্য দালানকোঠা, মসজিদ ও পবিত্র সৌধসমূহ অতীতকাল হতে বর্তমান পর্যন্ত এর ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। নগরীর পুরানো ও নতুন অধিকাংশ ইমারত নিচু পাহাড় ও টিলার উপরে এবং উপত্যকা ও সমভূমিতে নির্মিত। দীউয়ানি আদালত, ফৌজদারি আদালত এবং বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, জেলা ও দায়রা জজের কার্যালয় সম্বলিত বিশাল কোর্ট বিল্ডিং পরীর পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। এ পাহাড়ের শীর্ষদেশ হতে নিচে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। যে কেউ মোহনা পর্যন্ত কর্ণফুলি নদী এবং এর তীর ধরে বন্দর এলাকা, দক্ষিণ দিকে দিয়াঙ ও বাঁশখালী পর্বতশ্রেণী এবং পূর্ব দিকে পার্বত্য অঞ্চল দেখতে পারে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে জেনারেল পোষ্টঅফিস, মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল, নিউমার্কেট এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন অবস্থিত। রংমহল পাহাড় শীর্ষে জেনারেল হাসপাতাল অবস্থিত। টেমপেস্ট হিলস নামে পরিচিত এক পর্বতশ্রেণীর শীর্ষে টেলিগ্রাফ অফিস, বিভাগীয় বন কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের বাসভবন অবস্থিত।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সদর দফতর চট্টগ্রামে অবস্থিত। ১৮৯১ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ রেলপথ পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলা রেলওয়ে এবং ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে নামে পরিচিত হয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাহাড়তলি পর্যন্ত এলাকা এবং পাহাড়ের পাদদেশ ধরে রেলপথ উত্তর দিকে চলে গেছে; রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ পুরো এলাকার উন্নয়ন সাধন করেছে। এ এলাকা রেলওয়ে কলোনি নামে পরিচিত এবং নগরীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় এলাকার অন্যতম। পাহাড়ের উপরে সুবিধাজনক স্থানে সুদৃশ্য বাংলোগুলি নির্মিত হয়েছে। রেলওয়ে ক্লাব, কর্মচারীদের আবাসিক ভবনসমূহ, রেলওয়ের প্রধান অফিস, রেলওয়ে হাসপাতাল, পাহাড়তলি ওয়ার্কশপ এবং  অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি এ এলাকাতে অবস্থিত।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

নগরীর এক মনোরম স্থানে ১৯১৩ সালে ইংরেজরা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস নির্মাণ করে। পরবর্তী সময়ে এটিকে এক প্রাসাদোপম অট্টালিকার রূপ দিয়ে ভ্রমণরত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অস্থায়ী নিবাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সার্কিট হাউসের ৪নং কক্ষে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর সার্কিট হাউসটিকে ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’-এ রূপান্তরিত করা হয়।

বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি অপর একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্দো-বার্মা রণাঙ্গনে আত্মদানকারী মিত্রবাহিনীর ৭৫৫ জন সৈনিকের সমাধি রয়েছে। এখানে সমাধিস্থ সৈনিকদের অধিকাংশই ছিলেন অষ্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, ব্রিটিশ ভারত ও নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী। মোট আট একর জায়গার উপর বিস্তৃত সমাধিস্থলটির রক্ষণাবেক্ষণ করে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন।

চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং

নগরীর কেন্দ্রস্থলে একটি ঢিবির উপর ‘অন্দরকিল্লা’ নামে পরিচিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ ছিল। দুর্গটির বর্ণনা দিয়ে শিহাবুদ্দীন তালিশ লিখেছেন, দুর্ভেদ্যতার দিক থেকে এটি আলেকজান্ডারের দুর্গের সমকক্ষ এবং এর বুরুজগুলি ফল্ক-উল-বুরুজের ন্যায় সুউচ্চ। মুগলদের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত এ দুর্গের নাম ছাড়া এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্দরকিল্লা নামে একটি বিপণি কেন্দ্র একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু কাচারি পাহাড়ের পশ্চিম দিকে রিয়াজুদ্দীন বাজার ও নিকটবর্তী নিউমার্কেট গড়ে ওঠার পর এর গুরুত্ব বহুলাংশে  হ্রাস পেয়েছে।

চট্টগ্রামে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার জন্য অপর একটি প্রসিদ্ধ স্থান হচ্ছে চাকতাই। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে কর্নফুলী নদীর তলদেশ থেকে জেগে ওঠা একটি পুরাতন ও পরিত্যক্ত স্থলভাগ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাকতাই খাল নামে পরিচিতি একটি খালপথে নৌকা ও সাম্পান যোগে তাদের মালামাল এখানে নিয়ে আসে। ধনী ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসগুলি এখানে অবস্থিত।

মসজিদ ও দরগাহ  চট্টগ্রাম সুফি দরবেশ ও ফকিরদের মিলনক্ষেত্ররূপে পরিচিত। বেশ কিছু মসজিদ ও দরগাহ একসময় এ শহরে তাদের অবস্থানের সাক্ষ্য বহন করে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে মর্যাদার স্থান হচ্ছে প্রখ্যাত দরবেশ বায়েজীদ বোস্তামীর দরগাহ। তিনি ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইরানের বোস্তামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন এরূপ বিশ্বাস সাধারণ্যে প্রচলিত আছে। যে পাহাড়ের উপর দরগাহটি অবস্থিত তার পাদদেশে এক বিশাল পুকুরের পাড়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। পুকুরটিতে কয়েকশ কচ্ছপ রয়েছে। এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, কচ্ছপগুলি দুষ্ট জিনদের বংশধর। এ দুষ্ট জিনেরা দরবেশের কোপানলে পড়ে তারই অভিশাপে কচ্ছপে পরিণত হয়েছে।

বায়েজীদ বোস্তামী দরগাহ

দরবেশ বদর আউলিয়া ছিলেন একজন বড় মাপের দরবেশ ও প্রচারক। কথিত আছে যে, তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। অবশ্য এ দরবেশের পরিচয় নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যে সকল নামে তিনি পরিচিত তার কয়েকটি হচ্ছে বদর আলম, বদর পীর ও বদর আউলিয়া। প্রচলিত মতানুযায়ী তিনি একটি প্রদীপ (চাটি) জ্বালিয়ে দুষ্ট জিনদের বিতাড়িত করেছিলেন এবং এ প্রদীপ বা চাটি থেকেই এ স্থানের নামকরণ হয় চাটিগ্রাম। যে পাহাড়ের চূড়ায় ‘চাটি’ জ্বালানো হয়েছিল সেটি ‘চেরাগি পাহাড়’ অর্থাৎ প্রদীপের পাহাড় নামে পরিচিত। পাহাড়টি নগরীর জামাল খান এলাকায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সম্প্রতি এ পাহাড়ের উপরে একটি সুদৃশ্য গম্বুজ নির্মাণ করেছে। বখশীহাটে বদরপট্টিতে বদর আউলিয়ার দরগাহ অবস্থিত।

দরবেশ শাহ আমানত-এর (কুদ্দুছ সররাহুল আজিজ) দরগাহ শরিফ চট্টগ্রামের বিখ্যাত দরগাহগুলির অন্যতম। সেন্ট্রাল জেলের উত্তর ও লালদিঘির পূর্ব দিকে এর অবস্থান। দরবেশ আমানত শাহের জন্মের সঠিক তারিখ জানা যায় নি। এরূপ বিশ্বাস করা হয় যে, তিনি আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

উপরোক্ত দরগাহগুলি ছাড়াও নগরীতে অসংখ্য দরগাহ ও মাজার ছড়িয়ে আছে। এগুলির মধ্যে ষোলশহর রেলস্টেশনের কাছে নাসিরাবাদে চশমা-ই-হজরত শেখ ফরিদ এবং কলেজ রোডে মাদ্রাসা হিলের পূর্ব ঢালে অবস্থিত দরবেশ মোল্লা মিসকিনের দরগাহর উল্লেখ করা যেতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা  সড়ক, রেলপথ, বিমান ও জলপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ রয়েছে।

সড়কপথ  আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, বাংলায় শেরশাহই ষোল শতকের প্রথমার্ধে দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। শেরশাহের  গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড গাঙ্গেয় উপত্যকা ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করেছে। এ দুটি নগরীর মধ্যে এটাই হচ্ছে প্রথম বড় ধরনের সড়ক সংযোগ যার সুস্পষ্ট লেখ্য প্রমাণ রয়েছে। অবশ্য চট্টগ্রামকে মধ্যবাংলার সঙ্গে সড়ক পথে সংযু্ক্ত করার উদ্যোগ  শেরশাহ এর প্রায় দুশতক কালের আগেই নেওয়া হয়েছিল। এ মর্মে প্রমাণ রয়েছে যে, সোনারগাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম বিজয়ের পর চট্টগ্রামকে চাঁদপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করে একটি সামরিক সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম অধিকারের পর ব্রিটিশরা একটি অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা, মূলত চট্টগ্রাম হতে ঢাকা পর্যন্ত ট্রাংক রোডটির উত্তরাধিকার লাভ করে। ১৮৯৮-৯৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার মোট ৫৭৭ মাইল দীর্ঘ রাস্তার মধ্যে মাত্র এক মাইল ছিল পাকা, আর সেটা হলো বন্দরের সম্মুখ দিকে নদীর তীর ধরে মহেশখালী স্ট্রান্ড রোড। ১৯৬২ সাল থেকে সরকার সড়ক নির্মাণের প্রতি মনোযোগ দেন এবং পাকা রাস্তার দূরত্ব বাড়ানো হয়। চট্টগ্রাম হতে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রধান সড়কগুলি সম্প্রসারিত হয়।

বিশ শতকের বিশের দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটে শুধু ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ি দেখা যেত। এ সময়ের দিকে কোনো কোনো জমিদার ও ইউরোপীয়দের আনা মোটরযান শহরে দেখা যেত। ১৯২৪-২৫ সালের দিকে চট্টগ্রাম হতে নিকটবর্তী এলাকায়, যেমন চট্টগ্রাম হতে ১২ মাইল দূরবর্তী হাটহাজারী এবং ২৩ মাইল দূরে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রথম ট্যাক্সি চালু হয়। ট্যাক্সিগুলি শহর থেকে উত্তর-পূর্বদিকে জেলার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত রামগড় সড়কেও চলাচল করত। কয়েক বছর পর ট্যাক্সির বদলে অর্ধটনী বাস চালু করা হয়। ১৯৪৭ সালে শহরে সর্বপ্রথম রিক্শা চালু হয়। একই বছরে শহরে বাস চলাচলও শুরু হয়।  ক্রমান্বয়ে এ বাস সার্ভিস বৃহত্তর নগর এলাকায় সম্প্রসারিত হয়। ১৯৬২ সালে ক্রমবর্ধমান শহর এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য অটোরিক্সা চালু করা হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামের সঙ্গে  বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে একসময়ের নৌপথ নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্য সড়কপথ ও রেলপথে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিদিন সব ধরনের পণ্যবোঝাই শত শত ট্রাক রাস্তায় চলাচল করতে দেখা যায়।

কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন, চট্টগ্রাম

রেলপথ  আসামের চা বাগানগুলির সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে চট্টগ্রামে রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। ১৮৯১ সালে ১,৫০,০০০ পাউন্ড মূলধন নিয়ে লন্ডনে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি গঠিত হয়। ৩র্-৩ ৩/৮ মিটারগেজ রেলপথ নির্মিত হয়। বন্দরকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রথম রেললাইন ১৮৯৫ সালে চালু করা হয়। এর পর বাংলাদেশের অবশিষ্ট অংশকে নগরী ও জেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে অন্যান্য রেললাইন নির্মিত হয়। নিউ মার্কেট নামে পরিচিত বিপণি বিতান এবং রেয়াজউদ্দীন বাজারের কাছে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত। আন্ত-জেলা ট্রেন ছাড়াও দোহাজারী, নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সঙ্গে নগরীর সংযোগকারী লোকাল ট্রেনও চলাচল করে।

বিমানপথ  চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নগরকেন্দ্র হতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদীর তীরে পতেঙ্গায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বিমানবন্দর। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ জেলার সঙ্গেই চট্টগ্রামের বিমান যোগাযোগ রয়েছে। নগরকেন্দ্র এবং বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত সড়ক সংযোগ রয়েছে এবং যাত্রীগণ মোটর, বাস ও অটোরিক্সায় করে বিমানবন্দরে পৌঁছতে পারে।

জলপথ চট্টগ্রাম নগরী বাংলাদেশের অপরাপর অংশের সঙ্গে উপকূলীয় নৌপথ নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত। উপকূলীয় জলযানসমূহ চট্টগ্রাম হতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য-কেন্দ্রগুলিতে বেশিরভাগ পণ্য পরিবহন করে থাকে। উপকূলীয় জলযানগুলি অপরাপর প্রচুর পণ্যের মধ্যে জ্বালানি তেল, সিমেন্ট, খাদ্যশস্য ও লবণ পরিবহন করে। উপকূলীয় নৌপথে যাত্রী পরিবহন কখনই খুব জনপ্রিয় ও নিরাপদ ছিল না। বর্তমানে এ পথে বলতে গেলে কোনো যাত্রী পরিবহন নেই। চট্টগ্রামে দুটি লঞ্চ ও স্টিমার টার্মিনাল রয়েছে। এগুলি মাঝির ঘাট ও সদরঘাট নামে পরিচিত। এ দুটির মধ্যে মাঝির ঘাট বেশি পুরাতন। যদিও একসময় ব্যবসায়ী ও বণিকগণ নৌকা ও সাম্পান বোঝাই করে এখানে তাদের পণ্যদ্রব্য নিয়ে আসত, এটি এখন আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র নয়। মাঝির ঘাটের কাছে অবস্থিত সদরঘাট এখন নগরীর জনপ্রিয় লঞ্চ ও স্টিমার টার্মিনাল। প্রতিদিন সন্দীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী প্রভৃতি নিকটবর্তী দ্বীপ হতে লঞ্চ ও স্টীমারগুলি নিয়মিত যাত্রী ও পণ্য নিয়ে এখানে আসা যাওয়া করে। [শিরীন হাসান ওসমানী]