সংবাদপত্র

সংবাদপত্র  বাংলায় সংবাদ ও সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে ইংরেজরা। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় প্রথম সংবাদপত্র  বেঙ্গল গেজেট রূপান্তরে ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাটাইজার। প্রথম দিকে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে মুদ্রণযন্ত্র, বর্ণের অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল প্রধান প্রতিবন্ধক। কারণ ওই সময় যাঁরা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা কেউ কোম্পানির চাকুরে ছিলেন না। কোম্পানির সঙ্গে ছিল তাঁদের স্বার্থগত এবং নীতিগত বিরোধ। এ কারণেই লর্ড ওয়েলেসলি প্রবর্তন করেন কঠোর সেন্সর ব্যবস্থার এবং হেস্টিংসের আমলেও এ নিয়মের পরিবর্তন হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ১৭৬৮ সালে ওলন্দাজ বংশোদ্ভূত ইউলিয়াম বোল্টস কলকাতায় একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের প্রস্তাব করলে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি তাঁকে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়। শুধু তাই নয়, উল্লিখিত বেঙ্গল গেজেট-এর মালিক ও সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকিকেও বারবার কোম্পানির রোষানলে পড়তে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে  কলকাতা থেকে বহিষ্কার করা হয়।

বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে মিশনের পক্ষে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র  দিগ্দর্শন। এর ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটিতে ইংরেজি প্রবন্ধও প্রকাশিত হতো। ১৮২১ সালের পরে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

দিগ্দর্শন প্রকাশিত হওয়ার একমাস পর (২৩ মে, ১৮১৮)  মার্শম্যান প্রকাশ করেন  সমাচার দর্পণ। এর সম্পাদনা কাজে সহায়তা করেন  জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, তারিণীচরণ শিরোমণি প্রমুখ। পত্রিকাটির ফারসি এবং ইংরেজি-বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৩২-৩৪ পর্যন্ত পত্রিকাটি ছিল দ্বি-সাপ্তাহিক এবং ১৮৪১ সাল পর্যন্ত এর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল।

বাঙালি সম্পাদিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বাঙ্গাল গেজেটিও প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে (মে/জুন)। সম্পাদক ও মালিক ছিলেন হরচন্দ্র রায়। বছর খানেক পত্রিকাটি চলেছিল। এর কোনো কপি পাওয়া যায়নি। এ ধরনের পত্রিকা/সাময়িকপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত সংবাদ পরিবেশন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনা করা; তবে এর মাধ্যমে বাংলা গদ্যেরও অনেক উন্নতি হয়।

১৮১৮ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত প্রধানত কলকাতাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়; যদিও সেগুলি তেমন উলে­খযোগ্য ছিল না। বলা যেতে পারে, বাঙালির কাছে সংবাদপত্র উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে ১৮৩১ সালে,  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক  সংবাদ প্রভাকর প্রকাশের ফলে। এটি বাংলা সাময়িকপত্রে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে, কারণ তখন থেকে সাময়িকপত্রগুলিকে অবলম্বন করে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস দেখা দেয়। এছাড়া তখন বাংলা গদ্যরীতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে এবং নতুন নতুন লেখকেরও আবির্ভাব ঘটে। ওই একই বছর প্রকাশিত হয় মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাপ্তাহিক সমাচার সভারাজেন্দ্র (৭ মার্চ, ১৮৩১)। পরে শুরু হয় কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বিষয়ে মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক সংবাদ-সাময়িকপত্রের প্রকাশ। বাংলার পাশাপাশি তখন যথেষ্ট ইংরেজি সংবাদপত্রও প্রকাশিত হয়; তবে ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র। প্রথমটির উদ্দেশ্য ছিল পাঠকের মনোরঞ্জন ও মুনাফা অর্জন এবং দ্বিতীয়টির সমাজ-সংস্কার ও জ্ঞানের প্রসার। ওই সময় বেশ কয়েকটি উর্দু ও ফারসি সংবাদপত্রও প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮৫৭ সালের আগে প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্র ব্যতীত ১৮৫৭ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল ৭৬টি সংবাদপত্র ও ১৬২টি সাময়িকপত্র (মোট ২৩৮টি; বিজ্ঞাপিত সংবাদ-সাময়িকপত্র এবং ১৮৫৭ সালের আগে প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্র ধরলে মোট সংখ্যা হয় ২৫২)। একই সময়ে অখন্ড বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল মোট ৯০৫টি বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র। এ পরিসংখ্যান পূর্ববঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতির অবস্থা তুলে ধরে। তবে নানা দিক থেকে পশ্চাৎপদ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা একেবারেই অকিঞ্চিৎকর নয়।

বাংলাদেশে প্রকাশিত ২৫২টি সংবাদ-সাময়িকপত্রের অনেকগুলিই ছিল সাপ্তাহিক ও নিয়মিত, যেমন  ঢাকা প্রকাশবেঙ্গল টাইমস, বান্ধব ইত্যাদি। প্রথম দুটি টিকে ছিল দীর্ঘদিন। ঢাকা প্রকাশের আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় একশ বছর।  কালীপ্রসন্ন ঘোষ সম্পাদিত সাহিত্য মাসিক বান্ধবকে তখন দ্বিতীয়  বঙ্গদর্শন বলে আখ্যায়িত করা হতো।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তীকাল শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক ইতিহাসের জন্যই নয়, বাংলা সাময়িকপত্রের জন্যও উল্লেখযোগ্য। এ সময় কলকাতা থেকে  সোমপ্রকাশ প্রকাশিত হতে থাকে (১৫ নভেম্বর, ১৮৫৮), যার প্রভাব পড়ে তৎকালীন প্রায় সকল পত্রিকার ওপর। সোমপ্রকাশের প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর আগে বাংলা সাময়িক সংবাদপত্রে রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না; সোমপ্রকাশেই ব্যাপকভাবে এ ধরনের আলোচনার সূত্রপাত হয়। কারণ ১৮৫৭ সালের পরে বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে দ্রুত রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয় এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

পূর্ববঙ্গের সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে উনিশ শতকের বাংলাদেশে মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা প্রয়োজন। পূর্ববঙ্গে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্রটি কোথায় এবং কখন স্থাপিত হয় তা সঠিক জানা যায় না; তবে অনুমান করা হয়, ১৮৪৭ সালে  রঙ্গপুর বার্তাবহ প্রকাশের জন্য রংপুরে স্থাপিত মুদ্রণযন্ত্রটিই পূর্ববঙ্গের প্রাচীনতম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র। এর এক বছর পর ১৮৪৮ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় একটি ইংরেজি মুদ্রণযন্ত্র এবং ১৮৫৬ সালে স্থাপিত হয় ঢাকা নিউজ প্রেস, যেখান থেকে  ঢাকা নিউজ প্রকাশিত হয়।

১৮৬০ সালে ঢাকার বাবু বাজারে স্থাপিত ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ শুধু ঢাকাতেই নয়, পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলেও মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এছাড়া বাঙ্গালা যন্ত্র ঢাকার সমাজজীবনে যতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা আর কোনো মুদ্রণযন্ত্র করতে পারেনি। এই যন্ত্র থেকেই মুদ্রিত হয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক। ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হতে থাকে।

বাংলাদেশে সংবাদ-সাময়িকপত্র বিকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ব্রাহ্ম আন্দোলনের। ব্রাহ্ম আন্দোলন যদিও এখানে শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশকে, কিন্তু ষাটের দশকের আগে তা পূর্ববঙ্গে তেমন গুরুত্ব পায়নি। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সহায়ক হিসেবে উনিশ শতকে বাংলাদেশে গঠিত হয় বেশ কিছু সভা-সমিতি, যেগুলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজ-সংস্কার। সভা-সমিতিগুলির কর্ণধাররা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন। উনিশ শতকের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ঢাকা প্রকাশ ব্রাহ্মরাই প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মবিরোধীরাও নিজেদের কথা জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার আশ্রয় নিয়েছিল। তখন ব্রাহ্ম, রক্ষণশীল হিন্দু, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক, উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী সকলের বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সংবাদ-সাময়িকপত্র; সারণি ১, ২ ও ৩-এ উলি­খিত ১৮৪৭-১৯০৫ সালের সংবাদ-সাময়িকপত্রের উপাত্তই এর প্রমাণ।

সারণি তিনটি থেকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সমাজ ও সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ের ধারণা নেওয়া যায়। ১৮৬১-৭০-এর উপাত্ত থেকে অনুমান করা যায় যে, পূর্ববঙ্গে তখন একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত  বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল এবং তাঁরা সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন; তবে সবকিছু আবর্তিত হয়েছিল ঢাকাকে কেন্দ্র করেই।

১৮৭১-৯০ এ বিশ বছরে দেখা যাচ্ছে সংবাদ-সাময়িকপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তা শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল মফস্বলে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রাম এলাকায়ও। ওই সময় প্রকাশিত সাময়িকপত্রগুলি ছিল বৈচিত্র্যময়; সেগুলিতে বিভিন্ন বিষয় প্রকাশিত হতো।  ঢাকা থেকে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কাব্যবিষয়ক সাময়িকী  কবিতাকুসুমাবলী। নারীমুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক বালারঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল আবদুর রহিমের সম্পাদনায়  বরিশাল থেকে।  চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল  আয়ুর্বেদ ও তন্ত্রমন্ত্র সম্পর্কিত মাসিক ঋষিতত্ত্ব।  ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল  সঙ্গীত বিষয়ক মাসিক কৌমুদী। শিল্প ও কৃষি বিষয়ক পত্রিকা বৈষয়িকতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল  রাজশাহী থেকে। কিশোরদের জন্য সুখীপাখী প্রকাশিত হয়েছিল  যশোর থেকে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বেরিয়েছিল মহাপাপ বাল্যবিবাহ। ঢাকার শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ক সাপ্তাহিক রামধনুও ছিল বেশ জনপ্রিয়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল তা বিকশিত হয়েছিল সত্তর থেকে নববই দশকের মধ্যে এবং পত্রিকার পাঠক যেহেতু ছিলেন পেশাজীবী/শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শ্রেণী, সেহেতু অনুমান করা যায় যে, পেশাজীবী/মধ্যশ্রেণীও ওই সময় বিকশিত হয়েছিল। নববই দশকের পরে অবশ্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশের হার হ্রাস পায়। এর কারণ সম্ভবত ব্রাহ্ম আন্দোলনের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়া এবং এক সময় এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণী তথা সমাজজীবনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে পড়া।

বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৭ সালে  রংপুর থেকে। প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র ঢাকা নিউজ প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে ১৮৫৬ সালে। প্রথম সাময়িকপত্র কবিতাকুসুমাবলী প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে। তবে যে দুটি পত্রিকা দীর্ঘকাল টিকেছিল এবং পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল সে দুটি হলো ঢাকা প্রকাশ ও বেঙ্গল টাইমস।

আলোচ্য সময়ে পূর্ববঙ্গে সাপ্তাহিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই কম। এর কারণ হয়তো এই যে, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য যে অবকাঠামো, যেমন প্রেস, দক্ষ কম্পোজিটর, সংবাদ সংগ্রহের সুবিধা ইত্যাদির প্রয়োজন, তার অভাব ছিল। ফলে সংবাদভিত্তিক পত্রিকার চাহিদা থাকলেও তার সংখ্যা যেমন বাড়েনি এবং যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেসবের অধিকাংশই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

এসময় মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই কম। এই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র পনেরোটি এবং এর অধিকাংশই ছিল মাসিক। এর কারণ সম্ভবত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা।

উনিশ শতকে বাংলা সংবাদপত্রের প্রচার ছিল সীমিত; এর কারণ বাঙালিদের আর্থিক অস্বচ্ছলতা। ধনীরা সংবাদপত্রকে সাহায্য করেছেন ঠিকই, কিন্তু এক্ষেত্রে পুঁজিগত লগ্নী করেননি; কারণ, ঔপনিবেশিক শাসনে অধস্তন শ্রেণী হিসেবে বাঙালি ধনীরা শিল্প বা ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করার চেয়ে জমিতে খাটানো অনেক নিরাপদ মনে করতেন। ১৮৭০-৮০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একুশটি পত্রিকার মধ্যে সতেরোটি ছিল একক উদ্যোগে প্রকাশিত এবং চারটি যৌথ উদ্যেগে।

পশ্চিমবঙ্গে ধনী ব্যবসায়ী ও সম্পন্ন মধ্যবিত্তশ্রেণী অনেক সংবাদপত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কিন্তু এ অঞ্চলের সংবাদপত্রগুলি ওভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। এর একটি কারণ হয়ত এই যে, পূর্ববঙ্গের জমিদাররা প্রায়শই অনুপস্থিত থাকতেন; নব্য ধনীরাও সময় কাটাতে ভালোবাসতেন রাজধানী কলকাতায়। ফলে উনিশ শতকে বাংলাদেশে অনেক পত্রিকা বেরিয়েছিল যৌথ উদ্যেগে বা বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দলের মুখপত্র হিসেবে। জমিদারদের অর্থানুকূল্যেও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা তা করেছিলেন নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। বাংলাদেশে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা যাঁরা প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা ছিলেন স্বল্প আয়ের উকিল, সমাজসেবী, ব্রাহ্ম প্রচারক বা শিক্ষক। একই ব্যক্তি একাধারে ছিলেন সম্পাদক, লেখক, সাংবাদিক সবকিছু। তাই দেখা যায়, যতদিন প্রতিষ্ঠান, সমিতি বা উদ্যম টিকে ছিল, পত্রিকাও ততদিন প্রকাশিত হয়েছিল।

ঢাকা বা মফস্বল থেকে প্রকাশিত প্রায় সব পত্রিকারই প্রচার সংখ্যা ছিল অস্বাভাবিক রকম কম। ১৮৬৩ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী ঢাকা নিউজ, ঢাকা প্রকাশ, ঢাকা দর্পণ এবং হিন্দু হিতৈষিণীর প্রচার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩০০, ২৫০, ৩৫০ এবং ৩০০ কপি। ১৮৬৭ সালের এক হিসাবে জানা যায়, ঢাকা প্রকাশের প্রচার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ১৯ কপি এবং হিন্দু হিতৈষিণীর ১০০ কপি। ১৮৮০ সালে পূর্ববঙ্গের দশটি পত্রিকার সম্মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল ৩২৭৭ কপি। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল রাজশাহী সমাচারের, মাত্র ৩১ কপি। ১৮৯০-এর অপর এক হিসাবে জানা যায়, ছয়টি পত্রিকার সম্মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল ২২৪০ কপি। এর মধ্যে ঢাকা প্রকাশেরই ১২০০ কপি। পত্রিকা প্রকাশের এই অন্তরায়ের প্রধান কারণ ছিল জনগণের নিরক্ষতা। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙ্গালীর নবজাগরণ (১৯৭৭) গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ে বাংলায় অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র শতকরা তিনভাগ। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, কোনো গ্রামে হয়ত একটিমাত্র খবরের কাগজ যেত এবং সেটি একজন পড়তেন, অন্যরা শুনত।

পত্রিকার প্রকাশ সংখ্যার স্বল্পতার আরেকটি কারণ ছিল ব্যয়বাহুল্য। ওই আমলে অন্যান্য খরচের তুলনায় মুদ্রণ ও কাগজ বাবদ খরচ খুব একটা কম ছিল না। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় তো ছিলই। ঢাকা প্রকাশে ১৮৬৩ সালের এক বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, পাইকা টাইপে প্রতি ফর্মার মুদ্রণ খরচ ছিল ছয় টাকা। পল্লী বিজ্ঞান পত্রিকার মুদ্রণ ও কাগজ বাবদ খরচ ছিল যথাক্রমে ৩৯ টাকা ও ২২ টাকা ৬ আনা। অন্য দিকে ডাকমাশুলের ব্যয় ছিল ৪০ টাকা।

সাধারণত একটি পত্রিকার আয়ের প্রধান উৎস তার প্রচার ও বিজ্ঞাপন। প্রচারের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। উনিশ শতকের বাংলাদেশের বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্রে বিজ্ঞাপন প্রায় থাকত না বললেই চলে (ব্যতিক্রম বেঙ্গল টাইমস)। এ থেকে বাংলাদেশের শহর ও শহরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে, এর কোনোটিরই তখন বিকাশ ঘটেনি। তবে অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকার দাম কম হলে কাটতি বাড়ত। যেমন ঢাকার এক পয়সার দুটি কাগজ শুভসাধিনী ও হিতকরীর প্রচার সংখ্যা ছিল গড়ে ৫০০/৬০০ কপি। কিন্তু গ্রাহক-স্বল্পতা, জনগণের নিরক্ষরতা ও ক্রয়ক্ষমতার কারণে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের পক্ষে সবসময় কাগজের দাম কমিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না।

সংবাদপত্রের নিরপেক্ষ নীতি বলে কিছু নেই। সংবাদ-সাময়িকপত্র সবসময় জনগণের একটি অংশের মত প্রকাশ করে মাত্র। উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় প্রতিটি সংবাদ-সাময়িকপত্রই বিশেষ একটি দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে সমর্থন করত। যেমন, ঢাকা নিউজ সমর্থন করত নীলকরদের; ঢাকা প্রকাশ  প্রথমে ব্রাহ্ম এবং পরে গোঁড়া হিন্দুদের মুখপত্র ছিল; বঙ্গবন্ধু ছিল ব্রাহ্মদের মুখপত্র;  গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বিরোধিতা করেছিল জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের; আবার বেঙ্গল টাইমস সমর্থন করত ইংরেজদের।

উনিশ শতকের সংবাদপত্রগুলি ছিল প্রধানত রচনাভিত্তিক। অর্থাৎ ছোটখাট সংবাদ ছাড়া প্রায় ক্ষেত্রেই যেকোনো একটি সংবাদ বা বিষয়কে কেন্দ্র করে বিস্তারিত আলোচনা ও মতামত ছাপা হতো। খবরের মধ্যে বেশির ভাগ থাকত স্থানীয় খবর, আর কিছু থাকত বিদেশী কাগজ থেকে সংগৃহীত খবর। মাঝে মাঝে ছাপা হতো মফস্বল থেকে প্রেরিত পত্রিকা-পাঠকদের সংবাদ; চিঠিপত্রের কলামও ছিল। সম্পাদকরা বিষয়ভিত্তিক রচনা বা কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরতেন।

প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পাদকদের নিজস্ব মতামত থাকত। তবে তাঁদের প্রধান সম্পাদকীয় বিষয় ছিল জমিদার-রায়ত, সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ও সমাজ-সংস্কার; ইংরেজ শাসন নিয়েও প্রায়শই মন্তব্য করা হতো। সম্প্রদায়, দল বা গোষ্ঠী সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো; কারণ তখন সমাজ বা রাজনীতি সম্পর্কে ব্রাহ্ম, হিন্দু বা মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

আলোচ্য সময়ে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকাগুলির মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল। ইংরেজি পত্রিকাগুলি ছিল সংস্কারমূলক, কিন্তু অধিকাংশ বাংলা পত্রিকাই ছিল রক্ষণশীল, যা সেই সময়কার সামাজিক প্রবণতাকে তুলে ধরে। রক্ষণশীল ও সংস্কারবাদীদের এই দ্বন্দ্বে শেষোক্তরা জয়লাভ করে, যদিও রক্ষণশীলদের পক্ষও কম শক্তিশালী ছিল না। এই পটভূমিকায়ই পূর্ববঙ্গের পত্রিকাগুলিও প্রকাশিত হয়েছিল। এখানকার পত্রপত্রিকাসমূহের প্রধান বিষয় ছিল আঞ্চলিকতা, কৃষক, জমিদার, নীলকর, চা-কর, সিভিল সার্ভিস, শিক্ষা, সমাজ-সংস্কার, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক। [মুনতাসীর মামুন]

গ্রন্থপঞ্জি বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (৫ খন্ড), কলকাতা, ১৯৬৩-১৯৭০; আনিসুজ্জামান, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, ঢাকা, ১৯৬৯; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাময়িকপত্র (২ খন্ড), কলকাতা, ১৯৭২ ও ১৯৭৭; পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙ্গালীর নবজাগরণ, কলকাতা, ১৯৭৭; মুনতাসীর মানুন, উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র (৮ খন্ড), ঢাকা, ১৯৮৫-১৯৯৮।