ঘোষ, রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন
ঘোষ, রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন (১৮৪৩-১৯১০) বাগ্মী, সাংবাদিক, লেখক, পন্ডিত। ১৮৪৩ সালের ২৩ জুলাই ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ভরাকর গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি মকতব, চতুষ্পাঠী ও ইংরেজি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। বাল্যকালেই তিনি সংস্কৃত, ফারসি ও বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে ইংরেজি ভাষাও আয়ত্ত করেন।
কালীপ্রসন্ন প্রথম জীবনেই বাগ্মিতার পরিচয় দেন। বিশ বছর বয়সে তিনি কলকাতার ভবানীপুরে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে এক বক্তৃতা দিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষীর প্রশংসা অর্জন করেন। এরপর থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তাঁর একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং এক সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন।
কালীপ্রসন্ন ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় ব্রাহ্মসমাজের একজন বিশিষ্ট সভ্য। তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা শুভসাধিনী সভার’ মুখপত্র শুভসাধিনী (১৮৭০) সম্পাদনার মাধ্যমে। ঢাকার ব্রাহ্মযুবকদের জন্য তিনি এটি প্রকাশ করেছিলেন। এক পয়সা মূল্যের এ পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। ৪ বছর পর ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্পাদনা করেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা বান্ধব। পত্রিকাটি ছিল বঙ্গদর্শনের আদর্শপুষ্ট।
বাইশ বছর বয়সে কালীপ্রসন্ন ঢাকার নিম্ন আদালতে পেশকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে এগারো বছর চাকরি করার পর ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি ভাওয়াল এস্টেটের প্রধান দেওয়ান ছিলেন। তাঁর সময়ে ভাওয়ালের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। এ সময় তিনি ‘সাহিত্য-সমালোচনী সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন এবং তার মাধ্যমে সমকালীন সাহিত্যিকদের নানাভাবে সাহায্য করেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সদস্য (১৮৯৪) এবং সহসভাপতির (১৮৯৭-১৯০০) পদ অলঙ্কৃত করেন। এ ছাড়া তিনি সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সদস্য এবং সদর লোকাল বোর্ডের সভাপতি হিসেবেও গুরু দায়িত্ব পালন করেন।
কালীপ্রসন্ন দর্শন ও সমাজ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেন। প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: প্রভাত-চিন্তা (১৮৭৭), নিভৃত-চিন্তা (১৮৮৩), নারীজাতিবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৯৬) ও নিশীথ-চিন্তা (১৮৯৬)। আর তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে: ভ্রান্তিবিনোদ (১৮৮১), প্রমোদলহরী (১৮৯৫), ভক্তির জয় (১৮৯৫), মা না মহাশক্তি (১৯০৫), জানকীর অগ্নিপরীক্ষা (১৯০৫), ছায়াদর্শন (১৯০৫) প্রভৃতি। এ ছাড়া সঙ্গীতমঞ্জরী (১৮৭২) নামে একখানা আধ্যাত্মিক সঙ্গীতসংগ্রহ এবং কোমল কবিতা (১৮৮৮) নামে একখানা শিশুপাঠ্য গ্রন্থও তিনি রচনা করেন।
কালীপ্রসন্নের রচনারীতি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এবং ইংরেজ পন্ডিত কার্লাইলের দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত। তাঁর রচনাসমূহ ভাবগাম্ভীর্য, ইতিহাসচেতনা ও গভীর জীবনবোধেপূর্ণ। পান্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বঙ্গের বিবুধমহল কর্তৃক ‘বিদ্যাসাগর’ এবং ইংরেজ সরকার কর্তৃক ‘রায়বাহাদুর’ ও ‘সি.আই.ই’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯১০ সালের ২৯ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। [দুলাল ভৌমিক]