প্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠান আর্যদের প্রভাবে ব-দ্বীপ অঞ্চলের জনপদে যখন সুসংগঠিত রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই উদ্ভব ঘটে বাংলার জাতিসমূহের মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের জনপদ রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্রিটিশের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত আমরা বহুসংখ্যক রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ও সরকারের কথা জানতে পারি যা প্রত্যক্ষভাবে বাংলার জনগণের ধ্যান-ধারণাকে প্রভাবিত করে। মুসলিম ও ব্রিটিশ সহ অধিকাংশ শাসক বহিরাগত হওয়ার কারণে একথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, সে সময়ের সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠানের উপর বহিরাগত প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এ দেশিয় জনগণ এসব বাহ্যিক ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে।
বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল একই স্থানে বসবাস করলে তাদের নিজস্ব ভাবাদর্শ, চিন্তাচেতনা ও রীতি-নীতি আচার-ব্যবহার পরস্পরকে প্রভাবিত করে। একথা সত্য যে, শাসকশ্রেণী প্রত্যক্ষ ও বস্ত্তগতভাবে শাসিত শ্রেণীকে প্রভাবিত করে, কিন্তু দীর্ঘকাল শাসিত শ্রেণীর সঙ্গে সহাবস্থান ও নানা বিষয়ে সাদৃশ্য ও সম্পৃক্ততার কারণে শাসকশ্রেণীও পরিণামে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি বৌদ্ধ চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার সঙ্গে বৈদিকধর্মের উল্লেখযোগ্য কোনো সাদৃশ্য থেকে থাকে, তাহলে বৈদিক ধর্মের সঙ্গে সহাবস্থান ও নানা বিষয়ে সাদৃশ্য ও সম্পৃক্ততার কারণেই তা হয়েছে। বৈদিকধর্মের যখন পূর্ণ আধিপত্য তখনই বৌদ্ধ দর্শনের উদ্ভব ঘটে; সুতরাং আধিপত্যশীল ধর্ম দ্বারা তা প্রভাবিত না হয়ে পারে না।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চিন্তা-চেতনা
গাঙ্গেয় সমতল অঞ্চলে মৌর্যদের অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রসহ কোনো সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের আবির্ভাব ঘটে নি। সুতরাং, এ সময়কালের পূর্বের জনগণের চিন্তা-চেতনা ও ভাবাদর্শ শুধু প্রথমদিকের বৈদিক সাহিত্য থেকেই জানা যায়। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য-সাহিত্য খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের পূর্বে রচিত বলে অনুমান করা হয় এবং এ দুটি মহাকাব্যই বৈদিক সাহিত্যের বিখ্যাত উদাহরণ। অর্থ ও ঐতিহাসিক সত্যের দিক থেকে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে উল্লিখিত রাজত্ব ও রাজন্যবর্গ এবং সকল ধর্মীয় মত-পথ মূলত দুর্বোধ্য। রাষ্ট্রপূর্ব যুগের শ্রুতি,স্মৃতি ও পুরাণে উল্লিখিত ব্রাহ্মণ ঋষিদের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তা-চেতনার একটি সাধারণ লক্ষ্য ছিল: ব্রহ্মার (রামরাজত্ব) একটি উৎকৃষ্ট রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থেরও একই উদ্দেশ্য ছিল: একটি উৎকৃষ্ট শান্তিপূর্ণ ও প্রশান্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বৈদিক, জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবসত্তা ও বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি অনুসন্ধান করা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের চিন্তা-চেতনার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে ব্রাহ্মণদের বিশ্বতত্ত্ব ও বর্ণপ্রথা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা এবং জৈন ও বৌদ্ধদের ব্রাহ্মণ-বিরোধী চিন্তা-চেতনা।
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম অব্দের দিকে আর্যদের পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃতির কারণেই বাংলার জনপদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘটে। এ সময়ে বাংলার জনগণ গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে জনপদ রাষ্ট্র লাভ করেছে। আর্যদের ধারণা বেদ বা দিব্যজ্ঞান ঋষিদের নিকট প্রত্যাদিষ্ট হয়েছে এবং তারা বিশ্বাস করতেন যে, এই ঋষিরাই হচ্ছেন মানবরূপী ঐশ্বরিক অবতার। সত্য ঋষিদের নিকট প্রত্যাদিষ্ট হয়েছিল এবং ঋষিরা মন্ত্রের সাহায্যে প্রকৃতির গূঢ়তত্ত্ব মানুষের নিকট ব্যক্ত করেন। ঋষিরা মন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্টির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থা উন্মোচন করেন। ঋষিদের দ্বারা বর্ণিত বেদের সৃষ্টিধারা ও বিশ্বতত্ত্বের মধ্যে সে সময়ে বিদ্যমান উচ্চমানের অধিবিদ্যক ও বিবতর্নবাদী ধারণা লক্ষ্য করা যায় এবং এসব ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি রয়েছে।
বিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে ঋষিদের চিন্তা-চেতনা জরথুষ্ট্রবাদ, ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টীয় মতবাদ থেকে খুব একটা পৃথক নয়। অবশ্য ঋষিরা ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক সত্তা (spirit) সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। আধ্যাত্মিক সত্তা হচ্ছে এক ধরনের অ-সত্তা বা অ-অস্তিত্বশীল সত্তা (non entity) যদিও তা সত্তার জীবন ও দৈহিক রূপ প্রদান করে। তারা এই আধ্যাত্মিক সত্তাকে ব্রহ্ম নামে অভিহিত করেন যিনি নিজেকে জগতের মধ্যে পরিব্যাপ্ত বা বিক্ষিপ্ত করেন। সকল দেব দেবী, মানুষ এবং বস্ত্তসামগ্রী হচ্ছে ঐ আধ্যাত্মিক সত্তার প্রত্যংশ (modes)। সাধু-সন্ন্যাসীদের সৃজনী ক্ষমতা থেকে পরবর্তীকালে ত্রিমূর্তি পৌরাণিক কাহিনী জন্মলাভ করে। পরমসত্তা ব্রহ্মার তিনটি রূপ হচ্ছে: জগতের স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মা, পালক হিসেবে বিষ্ণু এবং সংহারক হিসেবে শিব।
বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলের জনপদের জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে ঋষি ও পূজারীদের সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার আরো বিস্তার ঘটে। তারা অসংখ্য উপদেবতা, অতিপ্রাকৃত সত্তা, উচু ও নীচু শ্রেণীর দেবদেবী সৃষ্টি করে নিজেদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে স্থানীয় দেবদেবীর ধারণাকে সমন্বিত করে নেন। এসব দেব-দেবতা ব্রহ্মালাভে তাদের সাহায্য করবেন বলে তারা বিশ্বাস করতেন। অধিকন্তু, ব্রহ্মের তিনটি রূপ: ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব মানবীয় রূপে অবতার হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন, তাদের স্ত্রী-সন্তানাদি আছে এবং তারা যুদ্ধ ও শান্তির জন্য পৃথিবীতে বিচরণ করেন। মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণ এবং রামায়ণের নায়ক রাম হচ্ছেন বিষ্ণুর অবতার। রামায়ণ ও মহাভারতে আমরা অসংখ্য উপদেবতা, অতিপ্রাকৃত সত্তা, উচু ও নীচু শ্রেণীর দেব-দেবতা লক্ষ্য করি। এরা প্রয়োজন অনুসারে কখনো দ্বন্দ্বে, আবার কখনো বা সহাবস্থান করেন। মানুষের উপর তাদের কর্তৃত্ব আছে এবং তারা আনুগত্য ও বশ্যতা দাবি করেন। কোনো কিছু বলি বা উৎসর্গ করে তাদের প্রসন্ন না করতে পারলে ছোট দেব-দেবতা অসহায় পূজারী ও ভক্তদের অনেক ক্ষতিসাধন করে। শুরুতে বলি (yajna) ছিল শুধুই একটি প্রতীকী উপহার, কিন্তু পরবর্তীকালে এটি একটি বিরাট প্রাতিষ্ঠানিক জটিল রূপ ধারণ করে এবং প্রাণী ও মানুষ বলি দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে থাকে। পুরোহিত নির্ধারণ করবেন কোন দেব-দেবতা মানুষের নিকট থেকে কি চায়, কখন চায় এবং কীভাবে চায়। পুরোহিতরাই নির্ধারণ করেন কি পরিমাণ বলি বা উৎসর্গ করতে হবে, কোথায় এবং কীভাবে করতে হবে। এটি কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরোহিত শ্রেণী সমাজের শক্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
অবশেষে আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদের আইনগত দিকটি লক্ষ্য করি। এই আইনগত দিকের মূল উৎস হচ্ছে মনু সংহিতা। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে অন্যান্য সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরামর্শ করে মনু (ব্রহ্মার পুত্র) ১৮ খন্ডে সংহিতা সংকলন করেন। এই সংহিতায় রয়েছে ঈশ্বরের পূজার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল প্রকার কর্তব্যের বিস্তৃত বর্ণনা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্ভাব্য সম্পর্ক স্থাপনের বর্ণনা এবং মানুষ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বর্ণনা। মনু সংহিতার উপর ভিত্তি করে বর্ণপ্রথা গড়ে উঠেছে, এবং এই বর্ণপ্রথা হিন্দুদের সামাজিক চিন্তা-চেতনা ও প্রতিষ্ঠানের মূল নির্ণায়ক উপাদান। মনুর মতানুসারে, ব্রহ্মা যেমন বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ক্রমস্তর সৃষ্টি করেছেন। মানুষের এই ক্রমস্তর হচ্ছে: ব্রাহ্মণ (পুরোহিত), ক্ষত্রিয় (সৈনিক), বৈশ্য (উৎপাদক), শূদ্র (শ্রমজীবী)। তারা অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবেন। মনুর মতে, আন্তঃজাতি বিভেদ যত কঠোরভাবে পালন করা যাবে সামাজিক শৃঙ্খলা তত নিঁখুত হবে।
কিন্তু অচিরেই এই মূল চতুবর্ণ-প্রথা শত শত উপশ্রেণীতে বিভক্ত হয়। মনুর সংহিতা ব্রাহ্মণকে অন্য তিন নীচুশ্রেণীর নারীদের বিবাহ করার অধিকার প্রদান করে। এ ধরনের বিবাহের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান-সন্ততিদের জাতিপ্রথার মধ্যেই অসংখ্য জাতিপ্রথার উদ্ভব ঘটে, এবং তারা প্রত্যেকেই নিজেদের পেশা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আচার-প্রথা ও রীতি-নীতির মধ্যেই জীবনযাপন করে। জাতি প্রথার নিয়ম অনুসারে, কোনো ব্যক্তিকেই নিজ জাতির বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করলে সে তার জাতিপ্রথা হারিয়ে জাতিচ্যুত হত। সকল জাতিচ্যুত ব্যক্তিরা আবার একটি জাতি গঠন করত। জাতিচ্যুত একজন ব্যক্তির সামাজিক শাস্তি এমন কঠোর ছিল যে কেউই বিবাহ বা পেশা পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতিপ্রথার বাঁধন ভাঙতে সাহস পেত না। সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতিপ্রথার ধারণা এবং এর বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিকতা একটি অসাধারণ রূপলাভ করে এবং পরবর্তী বৈদিক সাধু-সন্ন্যাসীরা এটিকে সামাজিক বিভাজনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন।
বেদের ব্যাখ্যা বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ গঠনে সাহায্য করে। এই দার্শনিক মতবাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হচ্ছে শংকরের (৭৮৮-৮২০) বেদান্তদর্শন। তাঁর প্রধান রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ব্রহ্ম-সূত্র-ভাষ্য ও গীতা ভাষ্য (ভগবদ্-গীতার ভাষ্য)। তিনি দেহ-মনের দ্বৈতবাদ, বহু মনের অস্তিত্ব, মন নিরপেক্ষ পদার্থিক বস্ত্তর অস্তিত্ব এবং একেশ্বরবাদের সপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করেন। শ্রুতি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তিনি দ্বৈতবাদ, বাস্তববাদ ও ঈশ্বরবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এগুলোকে মায়া বলে বর্ণনা করেন এবং অদ্বৈতবাদ বা একত্ববাদের পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে একমাত্র নির্গুন ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব আছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদ হচ্ছে মীমাংসা। এই মতবাদীদের মতে, আমরা প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিতজ্ঞান লাভ করি। জ্ঞান তখনই সত্য হয় যখন তা যৌক্তিক ও পরীক্ষিত প্রমাণযোগ্য হয়। বিকল্পভাবে একে ন্যায়দর্শনও বলে। এই মতানুসারে, জন্ম হচ্ছে মানুষের দুঃখভোগের পূর্বশর্ত, আর তাই জন্ম হচ্ছে দুঃখভোগের মৌলিক রূপ। প্রমাণ পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদ হচ্ছে সাংখ্য। সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী দর্শন এবং রূপকথার ব্যক্তি কপিলকে এই দর্শনের প্রবক্তা বলা হয়। এই দর্শন প্রকৃতিকে উপলব্ধি, আত্মসুখ পরিহার ও আত্ম-অস্বীকৃতির উপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে।
জৈন ও বৌদ্ধ চিন্তা-চেতনা প্রাচীন সমাজের ৩টি অনুধ্যানমূলক ধারা হচ্ছে: ব্রাহ্মণ্যবাদ, জৈনদর্শন ও বৌদ্ধদর্শন। এই ৩টি ধারাই শ্রমণিক সাংস্কৃতিক ধারার অন্তর্গত। শ্রমণিক সংস্কৃতির মূলবক্তব্য হচ্ছে: জীবনকে ক্রমবর্ধমান নৈর্ব্যাক্তিককরণ বা সন্ন্যাসবাদের অভিমুখী বিভিন্ন স্তর মনে করতে হবে। এই জীবনযাত্রায় সকলেই হচ্ছে তীর্থযাত্রী (শ্রমণ), সকলেরই একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সম্মুখে অগ্রসর হও’ এবং সকলেই জীবনসমুদ্র অতিক্রম করে তীরে পৌঁছুতে বদ্ধপরিকর। শ্রমণিক ধারা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও নতুনত্বহীন বাঁধাধরা প্রকৃতির। এই ধারা পার্থিব বস্ত্ত ও পার্থিব সুখ পরিত্যাগ এবং পার্থিব জীবন থেকে মুক্তির উপর গুরুত্ব প্রদান করে; অর্থাৎ, জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তির উপর গুরুত্ব প্রদান করে। শ্রমণরা এই মুক্তি (মোক্ষ/নির্বাণ/কৈবল্য) এবং আত্মত্যাগের (ত্যাগ/সংযম/বৈরাগ্য) ধারণাকেই অনুশীলন করে। শ্রমণিক ধারার মৌলিক প্রত্যয়টি হচ্ছে সন্ন্যাসবাদ। এই প্রত্যয়ের উপর ভিত্তি করেই জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মতো শ্রমণিক ধর্ম প্রাথমিক বৈদিক ধর্ম থেকে বিশেষভাবে পৃথক। প্রাথমিক বৈদিক ধর্ম সন্ন্যাসবাদ-বিরুদ্ধ এবং ব্যক্তি ও সমাজের বস্ত্তগত কল্যাণের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। জাতিপ্রথা একটি কল্যাণমূলক ও সুশৃঙ্খল সমাজের জন্য প্রযোজ্য এবং এরূপ সমাজব্যবস্থা বিশেষ করে উচ্চশ্রেণীর জাতির মধ্যেই রয়েছে। বৈদিক ঋষিরা যেখানে তাদের স্তোত্র বা মন্ত্রে পার্থিবজীবনের প্রশংসা করেছেন এবং নিজের সুস্বাস্থ্য ও সম্পদের জন্য প্রার্থনা করেছেন, সেখানে শ্রমণরা পার্থিব জীবনের নিন্দা করে এরূপ মতবাদের অবতারণা করেছেন: পার্থিবজীবন দুঃখময় এবং মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য হচ্ছে এই পার্থিবজীবন থেকে মুক্তিলাভ করা, অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তিলাভ করা। শ্রমণিক ঐতিহ্যের কতগুলো মৌলিক ধারণা হচ্ছে: কৃচ্ছসাধনা, ত্যাগ, মুক্তি, নিরীশ্বরবাদ, দেব-দেবতার উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, মানবেতর প্রাণী বলি বা উৎসর্গ ও নৈতিক মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপ। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা শ্রমণিক ধারণাকে ব্রাত্য বা অমার্জিত ও স্থানীয় হিসেবে অভিহিত করে। কৃচ্ছ্রসাধন, সন্ন্যাসবাদ, মুক্তি, ধ্যান, মানসিক প্রশান্তি ও অহিংসা ইত্যাদি শুরুতে বৈদিকধর্মে অনুপস্থিত ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে শ্রমণিক প্রভাবে এ ধারণাগুলো ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে স্থানলাভ করে। জৈন ভাবাদর্শ অন্যান্য জীনন্ত ধর্মের সঙ্গে একটি সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্থান তৈরি করে। জৈনধর্মে বিশ্বাসীরা উদ্ভিদ, পোকামাকড়সহ সকল জীবন্তসত্তাকে উৎপীড়ন করা থেকে বিরত থাকে। জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করার প্রচেষ্টা তাই বৃথা। এসব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে সংস্কারবাদী আন্দোলন, এবং তাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও স্থানীয় চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা থেকে এই আন্দোলনের উপাদান সংগ্রহ করেছেন।
জৈন, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে অনেক কেন্দ্রীয় ও মূলধারণার সাদৃশ্য রয়েছে। সংস্কৃত ভাষা ও উপ-ভাষা থেকে গৃহীত এসব ধারণা তাদের ধর্মীয় বিতর্ককে আরো শাণিত করতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এই তিন ধর্মেই কর্ম নামক ধারণার (অর্থাৎ, ব্যক্তির কর্ম তার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারণ করে) মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও প্রতিটি ধর্মই এই ধারণাতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রদান করেছে। ধর্ম (কর্তব্য, ন্যায়পরতা বা ধর্ম-পথ), ভোগ (সন্ন্যাস নিয়মানুবর্তিতা) ও যজ্ঞ (বলি/উৎসর্গ বা পূজা) ইত্যাদি ধারণার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। সংস্কৃত শাস্ত্রীয় চিন্তাধারা একদিকে যেমন এসব ধর্মের ধর্মীয় ও দার্শনিক অনুধ্যান গঠনে সাহায্য করেছে ঠিক তেমনি প্রতিটি ধর্মকে বিতর্ক করার শক্তিও প্রদান করেছে। বৌদ্ধ ত্রয়ী, অর্থাৎ বুদ্ধ, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং পৌরহিত্য, এগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি সমন্বিত ধারণা এবং এতে তারা তাদের সকল বিশ্বাস স্থাপন করে। বৌদ্ধদের সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ভিক্ষু সম্প্রদায়, সংঘ ও বিহার।
অশোকের যুগে মানবতাবাদী চিন্তাধারা মৌর্য রাজত্ব উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত আমরা প্রায় সন-তারিখ বিহীন দার্শনিক ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোককাহিনীর একটি দীর্ঘ তালিকা লক্ষ্য করি। কিন্তু সে সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং যে পরিবেশে এসব ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোককাহিনীর উদ্ভব ও প্রচার হয়েছিল সে সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। অবশ্য মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে শাসকগোষ্ঠী এসব ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল তা আমরা জানতে পারি। সে সময়ের বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও অনুমান-কল্পনা অশোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মনে করা হয়, অশোক সে সময়ের ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা উদারচিত্তে গ্রহণ করেন এবং সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে মূল বৌদ্ধধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং প্রতিটি সম্প্রদায় নিজেদের ধ্যান-ধারণাকে বৌদ্ধধর্মের নৈতিক উপদেশ ও অনুশাসন হিসেবে প্রচার করতে থাকে। অশোক এসব ধ্যান-ধারণাকে সমন্বিত করে ধম্ম (ধর্ম) সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতবাদ গড়ে তোলেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যে প্রচার করেন।
ধম্ম সম্পর্কে অশোকের ধারণা শিলায় খোদিত করে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করা হয়। অশোকের মতে, ধম্ম হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের সমষ্টি। শিলালিপিতে ধম্মকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সত্য (truth) ও করুণা (piety) হিসেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধম্ম নিছক কোনো সাম্প্রদায়িক মতবাদ নয়, বরং ধম্ম হচ্ছে সকল সম্প্রদায়ের চিরন্তন নৈতিক মূল্যবোধ নির্দেশিত মতবাদ যাতে মানুষ সুখী ও মোক্ষলাভ করতে পারে। অশোক নিজে ধম্মকে সংজ্ঞায়িত করেছেন নৈতিক জীবন হিসেবে। এই নৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: পাপ থেকে মুক্তি, অন্যের কল্যাণসাধন, করুণা, উদারতা, সত্যতা, নির্মলতা, পবিত্রতা ও বিনয়। এসব গুণ ব্রাহ্মণ্যবাদ, জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের নির্যাস। সংক্ষেপে, অশোকের ভাবাদর্শ হচ্ছে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শে ব্যক্ত মহৎ ধারণাসমূহকে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা এবং সেগুলোকে জনপ্রিয় করে প্রজাদের অনুশীলনের ব্যবস্থা করা। অশোকের ধম্ম শিলালিপির স্তম্ভে সমগ্র রাজ্যে প্রচার করা হয়। ধর্মীয় আদর্শে সামাজিক চরিত্র গঠনে অশোকের শিলালিপিগুলো অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। পূর্ব ভারতে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট-অবস্থার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য অশোক স্থানীয় শাসকদের নিকট রাষ্ট্রীয় শস্যভান্ডার থেকে দরিদ্রদের খাদ্যশস্য বিতরণের আদেশ জারি করেন। এই রাষ্ট্রীয় আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রনীতিতে ধম্মের প্রভাব পরিমাপ করা যায়।
সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শ খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ অব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্য স্থায়ী ছিল। শিলালিপি থেকে আমরা মৌর্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারি। মৌর্য সাম্রাজ্য পূর্বে পূর্ববাংলা পর্যন্ত বিস্তৃতিলাভ করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, প্রজাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের স্বার্থে মৌর্যগণ পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ব্যবস্থার বিকাশ ও তা কার্যকরের ব্যবস্থা করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩১ সালে আবিষ্কৃত মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, অভাব ও দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের সাহায্য করার জন্য মৌর্য শাসকগণ স্থানীয় প্রশাসনকে রাষ্ট্রীয় শস্যভান্ডার স্থাপন ও তা সর্বদা পরিপূর্ণ রাখার নির্দেশ দেন। একথা সত্য যে, রাজার দায়িত্বের ব্যাপারে অশোক ও তাঁর উত্তরসূরিগণ ব্রাহ্মণ, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অস্পষ্টভাবে হলেও মনু, নারদ, কাত্যায়ন ও প্রজাপতির স্মৃতিশাস্ত্রে রাজা ও মহারাজা এবং তাঁদের পারিষদবর্গ যেমন, অমাত্য, মন্ত্রী ও সচিবদের কর্তব্যের কথা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা সমৃদ্ধকরণের দ্বিতীয় গুরুত্বপর্ণ উৎস হচ্ছে সাবর, কুমারিল ও জৈমিনির মীমাংসা দর্শন। নীতিশাস্ত্র, বিশেষ করে কমন্ডকের নীতিসার রাজার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। কমন্ডকের মত অনুসারে, রাজার দায়িত্বের দ্বারাই তাঁর ক্ষমতা সীমিত হয়। অর্থশাস্ত্রের ধারণা পুনর্ব্যক্ত করে কমন্ডক বলেন যে, ‘রাজাকে অবশ্যই জ্ঞানের চারটি শাখা, যেমন, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক জ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ হতে হবে। আত্ম-শৃঙ্খলা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও উন্নত চরিত্র হবে রাজার গুণাবলি।’
সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র (৩০০ খ্রিস্টাব্দ), নীতিশাস্ত্র ও পুরাণ এবং কালিদাস, বানভট্ট, হর্ষবর্ধন ও অন্যান্যের রচনায় তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা বর্তমানে অর্থনীতি বলতে যা বুঝি প্রাচীনকালে তাকেই বর্ত নামে অভিহিত করা হত। বর্তের আওতাধীন ছিল কৃষি, বাণিজ্য ও পশু প্রজনন। কৌটিল্যের মতানুসারে, কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য নিয়েই বর্ত গঠিত। কুসীদ বা সুদ ব্যবসাও বর্তের অধীন ছিল। পরবর্তীকালে কারিগরী বিদ্যাও বর্তের আওতাধীন করা হয়। বর্ত শব্দটি এসেছে বৃত্তি (পেশা বা জীবিকা) শব্দ থেকে। ভগবদ্- পুরাণ বৃত্তি হিসেবে পশুপালনকে সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থান দিয়েছে এবং গুরুত্বের দিক থেকে এটি কৃষির পরেই স্থানলাভ করেছে। বাণিজ্য ও সুদে টাকা ধার দেওয়াকে তৃতীয় স্থানের মর্যাদা দেওয়া হলেও কুসীদ বা সুদখোরিকে বাণিজ্যের নীচে ও সবচেয়ে নিম্নমানের বৃত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। বর্ত পরিবারকে একটি প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক একক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্যক্তি নয়, পরিবারকেই পূর্ণাঙ্গতা নির্ধারণের একক ধরা হয়েছে। বস্ত্তগত সামগ্রী ও সেবার বিষয়টি ব্যক্তির জন্য নয়, পরিবারের জন্যই প্রয়োজন বলে ধরা হয়েছে। পরিবার হচ্ছে উৎপাদনের কেন্দ্র। পরিবারের সকল সদস্য অবশ্যই একই বৃত্তি অনুসরণ করবে। পছন্দ নয়, জন্মই বৃত্তি নির্ধারণ করবে। সুতরাং বর্ত বৈশ্য ও শূদ্র এ দুটি নীচু শ্রেণীর পেশা হিসেবে পরিণত হয়।
শুক্রের মতানুসারে, জমি হচ্ছে সকল সম্পদের উৎস। রাজনৈতিক অর্থনীতি আলোচনায় শুক্র নীতিশাস্ত্র অর্থশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রের ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। শুক্র নীতিশাস্ত্র ও রাষ্ট্রপরিচালন ক্ষমতার চেয়ে শাসক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের আদর্শ নিয়ে অধিকতর আলোচনা করেন। রাজা, রাষ্ট্র ও প্রজার মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের উপর শুক্র গুরুত্ব আরোপ করেন। শুক্রের নীতিশাস্ত্র মূলত শাসক ও শাসিতের জন্য একটি আচরণ বিধি। অধিকন্তু এটি রাষ্ট্রের কার্যাবলি, বলপূর্বক শাসনের কৌশল ও প্রতিকার, বিজয় অর্জন এবং একটি স্থায়ী শৃঙ্খলাপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য জনগণকে নিয়মানুবর্তী করে তোলার আলোচনা। ভূমি মালিকদের সম্পর্কে চিন্তাবিদদের দুই ধরনের মতবাদ ছিল। জৈমিনি ও শাবরের মতে, ভূমির মালিক কৃষক, কিন্তু রাজা কৃষকদের নিকট থেকে খাজনা পাওয়ার অধিকারী। খাজনা আদায় অধিকারের বিনিময়ে রাজা কৃষকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। অবশ্য মনুসহ অন্যান্য চিন্তাবিদের মতে, রাজা হচ্ছেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও ভূমির অধিপতি এবং ঐশ্বরিক রাজার করুণার মাধ্যমেই ভূমিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকদের রক্ষার জন্য শুক্র রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় শস্যভান্ডার স্থাপনের সুপারিশ করেন। মৌর্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সেন শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়।
মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান: তুর্কি-আফগান-মুগল আমল (১২০৪-১৭৭২)
উপরে যে মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক সীমার আলোচনা করা হয়েছে তা মূলত আর্য সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি অর্থাৎ গাঙ্গেয় অঞ্চলের (উত্তর ভারত, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল) মধ্যবর্তী ও নিম্নবর্তী এলাকার অধীন ছিল। তাই এরূপ ধারণা করা যায় যে, বাংলা ব-দ্বীপের কেন্দ্রীয় অঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্দো-আর্য সংস্কৃতির প্রভাব নিঃসন্দেহে অধিকতর কম অনুভূত হয়েছে। মুসলিম শাসকদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলের অনার্য উপজাতিসমূহ রাজনৈতিক ও উৎপাদন সম্পর্কের দিক থেকে অত্যন্ত প্রবল ও প্রভাবশালী ছিল। অবশ্য পূর্ব বাংলার কিছু কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতিও অত্যন্ত শক্ত ও নিরাপদ অবস্থানে ছিল। কিন্তু এরূপ ধারণা করা হয় যে, পূর্ব বাংলা আর্য মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাব থেকে কম-বেশি মুক্ত ছিল। ত্রয়োদশ শতকের শুরু থেকে মুসলিম শাসনামল এই এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করে। এই এলাকা আর্য-সংস্কৃতির চেয়ে তুর্কি-আফগান-মুগল সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিল।
চিন্তা-চেতনা ও ভাবাদর্শ এবং রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে মুহম্মদ বখতিয়ার খলজির উত্তর-পশ্চিম বাংলা বিজয় (১২০৪ খ্রিস্টাব্দ) ও রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে পরবর্তী উন্নতিসাধন বিদ্যমান ভাবাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক নতুন পরিবর্তনের সূচনা করে। রাজনৈতিক অবস্থা রক্ষার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়। যদি সুলতানি শাসনপূর্ব রাষ্ট্রের অধিকাংশ রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও ভাবাদর্শ রাজার কর্তব্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে তার কারণ হচ্ছে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে ‘রাজা’কে ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা। সুতরাং, রাষ্ট্রের জনগণের কাজ হচ্ছে রাজা ও রাজার ঐশ্বরিক নির্ধারিত কর্তব্য স্মরণ করে তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা প্রার্থণা করা। কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন একজন রক্ত-মাংসের মানুষ এবং তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল না। তার ক্ষমতার ভিত্তি ছিল শক্তি, দেবত্ব নয়। নতুন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শাসনের উপাদান আরব, পার্সি, তুর্কি ও মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যেখানে ‘শক্তি’ই শাসকশ্রেণীর বৈধতা প্রদান করে। এসব অঞ্চলে খিলাফতের ধর্মরাজতন্ত্র ঐক্যবদ্ধ খিলাফত গঠনের মতবাদ হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে পূবর্তন ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রের দেবত্ববাদের নিরীখে শরিয়া শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে কার্যকরি হয় নি।
দিল্লিতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা (১১৯৩ খ্রি) মুহম্মদ ঘোরি ব্যাপকভাবে শরিয়া আইন প্রচলন করেন নি। সংখ্যালঘিষ্ট মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে শরিয়া আইন প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। ঘোরির সেনাপতি বঙ্গবিজয়ী মুহম্মদ বখতিয়ারও একই নীতি অনুসরণ করেন। হেরাতের অধিবাসী ও ইরানের বিখ্যাত চিন্তাবিদ এবং পন্ডিত ফখরুদ্দীন রাযী (মৃত্যু ১২০৯খ্রি) সুলতানি আমলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি কেন্দ্রীয় এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে চাকরি করেন বলে জানা যায়। তিনি মুহম্মদ ঘোরি ও বখতিয়ারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। রাযী তাঁর জামিয়াল-উলুম গ্রন্থে ভারতে মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য নিম্নোক্ত সূত্র সংজ্ঞায়িত করেন:
পৃথিবী হচ্ছে একটি বাগান (দৌলত), যার মালি হচ্ছে রাষ্ট্র;
রাষ্ট্র হচ্ছে সুলতান, যার অভিভাবক হচ্ছে আইন (শরিয়া);
আইন হচ্ছে নীতি, যা রাজ্য (মূল্ক) কর্তৃক সংরক্ষিত হয়;
রাজ্য হচ্ছে একটি শহর, যা সেনাদল (লস্কর) কর্তৃক গঠিত হয়;
সম্পদ (মাল) দ্বারা সেনাবাহিনী সুরক্ষা করা হয়;
প্রজাদের (রায়ত বা কৃষক) কাছ থেকে সম্পদ আহরন করা হয়;
ন্যায়পরায়ণতা (আদল) দ্বারা প্রজাদের আজ্ঞাবহ করা হয়;
পৃথিবীর (আলম) সমৃদ্ধির মানদন্ড হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা।
রাযীর উপর্যুক্ত উক্তিসমূহ অত্যন্ত মামুলি হলেও এর মধ্য দিয়ে মুসলিম দেশ ও মুসলিম শাসকের জন্য করণীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ ও চিন্তানায়ক হিসেবে রাযী আল্লাহর প্রসঙ্গের অবতারণা করেন নি। তাঁর অনুমানমূলক প্রস্তাবসমূহ ধর্মনিরপেক্ষ যা রাজকীয় ন্যায়পরায়ণতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। শুধু তাই নয় রাজা ও প্রজার মধ্যে ঐক্যবন্ধনের শক্তি হিসেবেও এগুলো কাজ করে। তিনি শরিয়া আইনের কথা উল্লেখ করলেও সুলতানি শাসনের জন্য তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে খলিফার কথা আদৌ উল্লেখ করা হয় নি। রাযী সুলতানি শাসনামলের রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, এবং বস্ত্তত সুলতান ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে সমান সহায়তা প্রদান করবেন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, মধ্য এশিয়া ও স্পেনে মুসলিম শাসকগণ ন্যায়পরায়ণতা ও শক্তিকে বৈধতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। এভাবে বিচার ও সামরিক বিভাগকে মুসলমানদের হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য কার্য প্রজা সাধারণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়। সুলতানি ও পরবর্তী মুগল রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীকে বহিরাগত মুসলমানদের হাতেই ন্যস্ত করা হয়।
মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে ইসলামে ধর্মান্তর মূলত দরবেশ ও সুফিদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিল, এবং সুলতান ও মুগল বাংলায় একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলায় ইসলামের উন্নতিসাধনে রাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। খানকা পরিচালনার জন্য অনেক সুফি সরকারের নিকট থেকে জমি পান। একই ভাবে অনেক হিন্দু আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও শিক্ষক সরকারের নিকট থেকে অনুদান লাভ করেন। সংক্ষেপে, সুলতানি শাসনামল ও মুগল রাষ্ট্রে প্রজাদের ধর্মীয় অধিকারের ক্ষেত্রে একটি অবাধ ও মুক্ত রাজনৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল।
বিভিন্ন মতবাদ ও প্রতিষ্ঠানের উত্থান হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মে অনেক চিন্তা-চেতনার মধ্যে কর্ম, যোগ ও ধ্যানের মতো সদৃশ ধারণার প্রকাশ ঘটেছে। দুর্বোধ্য, রহস্যমূলক ও গূঢ় আচার-অনুষ্ঠানে স্বদেশজাত সংস্কৃতির উপরও প্রধান ধর্মসমূহের গভীর প্রভাব ছিল। এরূপ অবস্থায় ইসলাম ও বাংলার সারগ্রহী ধর্মগুলোর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যকার মিথষ্ক্রিয়া সুদূরপ্রসারি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। সুলতানি ও মুগল রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর ধর্ম হিসেবে ইসলাম ঐ অঞ্চলের বিদ্যমান ধর্মসমূহের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় ধর্মসমূহের ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকগণ একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন এবং কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই ঐসব ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ আচার-অনুষ্ঠান পালন করার সুযোগ লাভ করে। তথাপি মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার এক শতকের মধ্যেই কোনো সক্রিয় রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়াই ইসলাম বাংলায় দৃঢ়ভিত্তি স্থাপন করে।
সুলতানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আমরা হিন্দুধর্মের তান্ত্রিক উপাসনায় এক ধরনের সমন্বয়ী আন্দোলনের ধারা লক্ষ্য করি। এভাবে আমরা কমপক্ষে ৫টি হিন্দু সম্প্রদায়ে তান্ত্রিকতাবাদ লক্ষ্য করি: শৈব তান্ত্রিকবাদ, শাক্ত তান্ত্রিকবাদ, বৈষ্ণব তান্ত্রিকবাদ, সৌর তান্ত্রিকবাদ ও গণপত্য তান্ত্রিকবাদ। মন্ত্র, যন্ত্র, চক্র, নাস্য, মুদ্রা, দীক্ষা ভূতসিদ্ধি ও প্রতিমার উৎসর্গীকরণ ইত্যাদি তান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য পূজা পদ্ধতিতে প্রচলিত হয়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বিভিন্ন সামাজিক ধ্যান-ধারণায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য হ্রাস পায়। ইসলামসহ সকল ধর্মীয় মরমিবাদীদের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ আন্দোলনের পথ সুগম করে। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মরমিবাদীদের ঐশ্বরিক অন্তর্জ্ঞান লাভের জন্য যোগাচার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে পরিগণিত হয়। মরমি অনুধ্যানের ক্ষেত্রে হিন্দু সাধু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের নিকট সুফি-পথই উৎকৃষ্ট মনে হয়, কারণ তারা উভয়েই কোনো প্রকার গুরু বা পার্থিব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি অতীন্দ্রিয় সত্তার সঙ্গে মিলিত হতে চায়।
সুলতানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই সুফিদের বাংলায় আগমন ঘটে। তাঁরা জ্ঞান (ইল্ম) অর্জনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। তাঁরা শাসক শ্রেণীকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, তাঁদের রাজনৈতিক শক্তি ও নিরাপত্তা জ্ঞান অর্জনের উপর নির্ভরশীল। আলি মর্দান খলজির প্রধান কাজি রুকনউদ্দিন সমরখন্দি (মৃত্যু ১২১৮ খ্রি) একজন বিখ্যাত আইনবেত্তা ও সুফিসাধক ছিলেন। নতুন মুসলিম রাজ্যে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য তিনি সংস্কৃত শিক্ষালাভ করেন। তিনি সুফিদের মরমি দৃষ্টিভঙ্গি এবং হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের যোগী ও তান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের জন্য অত্যন্ত অনুকূল ছিল যা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে মুসলিম শাসকদের ধ্যান-ধারণা প্রসারের উপযোগীও ছিল।
রাজত্ব সম্পর্কে সুফি মতবাদ মুসলিম মরমিবাদী, বিশেষ করে সুলতানি আমলের প্রথমদিকের মুসলিম মরমিবাদীদের জীবন, ধর্ম ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নিজস্ব স্বাধীন ধারণা ছিল। তারা ইল্ম (জ্ঞান), ইশ্ক (প্রেম) ও আক্ল (বুদ্ধি)-কে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য গুণ বলে মনে করতেন। প্রত্যেক সুফিই তাদের খানকা প্রাঙ্গণে একটি করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন দক্ষ সৈনিক এবং তাদের সহায়ক সেনাদলও ছিল। শিক্ষা ও সশস্ত্র থাকার কারণে সুফি সাধকরা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও জনগণের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। বৈধতা, আইন, আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার অনুমোদন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানসহ নানা বিষয়ে রাজনৈতিক সরকার সব সময় তাদের অনুমোদন প্রত্যাশী ছিলেন। সুফিদের অনুমোদন ও সমর্থন ব্যতীত সুলতানের পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা কঠিন ছিল। এভাবে প্রত্যেক নতুন সুলতান ব্যক্তিগতভাবে তাদের খানকায় গিয়ে আশীর্বাদ কামনা করতেন। দ্বীন (ধর্ম) ও দুনিয়া (পার্থিব বিষয়) সম্পর্কে সুফিদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য থাকলেও তারা বিভিন্ন সিলসিলায় (আধ্যাত্মিক সম্প্রদায় বা তরিকায়) সংঘবদ্ধ থাকেন। সুলতানি ও মুগল আমলে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সিলসিলার মধ্যে রয়েছে চিশতি, সাত্তারি, সুহরাওয়ার্দি ও ফিরদাওসি তরিকা।
একই ভৌগোলিক এলাকায় একজন সুফি ও একজন সুলতানের অবস্থান পাশাপাশি দুই ধরনের কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি করে। সুলতান যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক সেখানে সুফিরা কতকটা অনুরূপ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। নিচে একই রাজ্যে একজন সুফি ও একজন সুলতানের ক্ষমতার সাদৃশ্যের এবং তাদের দুই ধরনের ক্ষমতার চিত্র তুলে ধরা হলো:
সুফিদের ব্যাখ্যায় সুলতানি রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তাত্ত্বিকভাবে সুফির রাজনৈতিক মর্যাদা সুলতানের উপরে, কারণ একজন শাহ বা সুফি প্রথানুসারে নতুন একজন সুলতানের ক্ষমতা লাভের বৈধতার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে পারেন। সকল প্রধান সুফি তরিকা এ ধারণাই পোষণ করেন। সুলতানের উপর সুফির শ্রেষ্ঠত্ব এই কারণে স্বীকার করা হয় যে, সুলতানরা সুফিদের খানকা পরিদর্শন (জিয়ারত) করে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। এই রাজকীয় পরিদর্শনের বিনিময়ে সুফিরা কদাচিত শাহী দরবার পরিদর্শনে যান। সুফি চিন্তাধারায় একটি মুসলিম রাষ্ট্রে কখনোই একজন অ-মুসলিমকে উচ্চ মর্যাদা দেয়ার সুযোগ নেই। জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম সম্প্রদায় নিতান্ত সংখ্যালঘু হলেও সুফিরা বাংলাকে মুসলিম রাষ্ট্র বলেই মনে করতেন, কারণ দেশের শাসকশ্রেণী ছিল মুসলিম।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে সুলতানগণ হিন্দুদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অনুপ্রাণিত হন। অধিকাংশ সামরিক ও বিচার বিভাগীয় পদে মুসলমানরা অধিষ্ঠিত থাকলেও বেশিরভাগ সরকারি পদ বিশেষ করে রাজস্ব প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ হিন্দুদের দেওয়া হত। গোঁড়া হিন্দুদের মতে, মুসলিম রাষ্ট্রে চাকরিতে যোগদান করে যারা মুসলিম শাসকদের সহযোগিতা করেছে তারা যবনদের (বিদেশি) সংস্পর্শে অপবিত্র হয়ে পড়েছে, এবং এসব অপবিত্র জনগণকে পির-আলি, শের-খানি, শ্রীমন্তখানি ইত্যাদি নতুন বর্ণ-অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রধান ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায় এদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। অবশ্য মুসলিম শাসকদের সংস্পর্শে এসে এরা অত্যন্ত ধনবান ও সমাজে প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয় এবং তাদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ধর্মীয়-সামাজিক চিন্তা-চেতনা ও ভাবধারায় একটি নতুন ধারার সূচনা করে। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সহযোগিতার একটি প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের উত্থান। পনের শতকের শেষের দিকে শ্রী চৈতন্যের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলন গোঁড়া হিন্দুদের দ্বারা নির্দেশিত জাতি, সম্প্রদায়, ধর্মীয় রীতি-নীতি-আচার-অনুষ্ঠান ও বলিদানের প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে। মানুষের জন্য ভালবাসা এবং প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি এই নব্য আন্দোলনের মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়। এই নব্য আন্দোলনের অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় অনুসারী যবনদোষে ‘অপবিত্র’ উচ্চ হিন্দুশ্রেণী থেকে আগত। যবনদের সংস্পর্শের কারণে তারা গোঁড়া হিন্দু সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে পড়ে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সুফি চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন এবং এদের প্রধান ছিলেন নবদ্বীপের আমূল সংস্কারবাদী পন্ডিত শ্রীচৈতন্য। চৈতন্যের চিন্তাধারার মর্মবস্ত্ত ছিল মানবজাতির ঐক্য ও একত্ব এবং প্রেমের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির ও বিষ্ণুর সকল রূপ, বিশেষ করে কৃষ্ণ প্রেমের মাধ্যমে মুক্তি। এই নব্যচিন্তার লক্ষ্য ছিল সমাজের সকল সম্প্রদায়কে একই পতাকা তলে সমবেত করা। সংশোধিত ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও নীতির উপর ভিত্তি করে একটি বিকল্প সামাজিক ভাবাদর্শ হিসেবে এই আন্দোলন উপস্থাপিত হয়। মুসলমান ম্লেচ্ছদের সংস্পর্শে ‘অপবিত্র’ এবং গোঁড়া হিন্দু সমাজ দ্বারা সমাজচ্যুত সকল হিন্দু এই নব্য আন্দোলনে যোগদান করে। তাদের অধিকাংশ সম্পদ, শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ও প্রভাবশালী হওয়ায় এই নব্য আন্দোলন নিপীড়িত শ্রেণীর দ্রুত সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ার (রাজকীয় বাংলা) প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়।
বৈষ্ণবদের ভক্তির মানবতাবাদী ধারণা, অর্থাৎ অনুরাগ ও প্রেমের মাধ্যমে মুক্তির কথাটি নারদ, সান্ডিল্য, রূপ গোস্বামী, জীব গোস্বামী ও বল্লভচারীর মতো বৈষ্ণব সাধু-সন্তদের চিন্তা-চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত। সকল বৈষ্ণব সম্প্রদায় নারদকে একজন মহান বৈষ্ণব সাধু হিসেবে সম্মান করে। সান্ডিল্য সূত্র নামে অভিহিত তাঁর বাণীকে ভক্তিতত্ত্বের মীমাংসা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। রূপ গোস্বামী ও জীব গোস্বামী চৈতন্য চিন্তাধারা ও ধর্মীয় আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির মৌলিক রূপ প্রদান করেন। তাঁরা সম্ভবত এই পার্থিব বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ব্যতীত শুধু বিমূর্ত চিন্তা সময়ের প্রয়োজনে টিকে নাও থাকতে পারে। মানসিক বিকাশের জন্য ভক্তদের শিক্ষালাভ ত্যাগ করে ভক্তিতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ভক্তির জন্য প্রয়োজন ধর্মের নামে সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা ও সকল প্রকার দৈহিক ও মানসিক অশুচিতা পরিহার। ভক্তিকে যৌন-যোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভক্তি মতবাদ অনুসারে জ্ঞান অর্জনের জন্য যোগ যথাযথ হলেও যোগের সর্বশেষ স্তর সমাধি লাভের জন্য যোগের চেয়ে ভক্তিই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।
মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়া ধারণা শাহ-ই-বাঙ্গালিয়া নামে সুলতানগণ যে এলাকা শাসন করতেন সেটি মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, আদিবাসী ও অন্যান্য জন অধ্যুষিত এলাকা ছিল। তথাপি উলেমা, সুফি ও সুলতানগণ সেই এলাকাকে মুসলিম শাসন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতেন। তাঁদের দাবি এই অর্থে যৌক্তিক ছিল যে, তখন শাসিত বা প্রজা নয় শাসকই তাঁর আওতাধীন অঞ্চলের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করতেন। মুসলিম আইন ও বিচারব্যবস্থা প্রজাদের নিজস্ব ধর্ম অনুসারে জীবনযাপন করার সুযোগ দিতেন, যদিও তারা জিজিয়া নামে এক প্রকার প্রতীকী কর প্রদান করতেন। জিজিয়া কর হচ্ছে এমন এক ধরনের কর যাতে যুদ্ধের সময় অ-মুসলিম সম্প্রদায়কে সামরিক বাহিনীতে যোগদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত। সমকালীন মানুষ জিজিয়াকে লজ্জার দৃষ্টিতে দেখেন নি, কারণ তারা বর্তমান সময়েও এ ধরনের প্রথা লক্ষ্য করেছেন। কর প্রদানকারীকে যুদ্ধে যাওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেওয়া হত। আরো বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, মুসলিম আইন অ-মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজস্ব ধর্ম ও আচার-প্রথা নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ প্রদান করত। এটি লক্ষ্য করার মতো যে, শুরুতে ইসলামি রাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত অ-মুসলিমদের এক প্রকার সহনশীলতা বা সহিষ্ণুতা দেখানো হত। বাংলায় এরূপ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনো ঘটে নি। অবশ্য উনিশ শতকের শেষের দিকে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলায় এই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়েছিল। আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের সূচনালগ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাদের উপর ইসলামী ঐতিহ্য প্রবর্তনের সময় সুলতানি ও মুগল রাষ্ট্র অ-মুসলিমদের সঙ্গে সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করে। ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিন্দু প্রজাদের জন্য হিন্দু আইন ও মুসলিম প্রজাদের জন্য মুসলিম আইন প্রয়োগ করে। বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী স্ব স্ব ধর্মীয় আইনকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।
বাংলায় মুগল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহুধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়কে একটি একক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা। হিন্দুদের প্রতি আক্রমণাত্মক সকল প্রকার কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপর কর ধার্য এবং সকল প্রকার বৈষম্যমূলক কর আরোপ প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। হিন্দুদের প্রসিদ্ধ উৎসবসমূহে রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের বিশেষ সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সকল প্রজাকে সমভাবে ও উদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার তত্ত্ব ও অনুশীলন ভারতীয় ও পারস্য-ইসলামী রাজত্বের ধারণা থেকে প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করা হয়। এই দুটি রাজত্বে রাজাকে ঐশ্বরিক প্রতিনিধি হিসেবে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে উচু-নিচু নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজাই রাজার নিকট থেকে সম ন্যায়পরায়ণতা ও দয়া পাওয়ার অধিকারী। ঝরোকা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল শাসক ও শাসিতকে একই পতাকাতলে সমবেত করা। শাসক ও শাসিত উভয়ে উভয়কে আর্শীবাদ করত। প্রাদেশিক স্তরেও ঝরোকা অনুসরণ করা হত। মুগল রাজনৈতিক ধারণায় রাজ্যের উচু-নিচু নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনগণকে নিমক (লবন)-এর ভাবাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে পারস্পরিক বাধ্যবাধকতার বন্ধনে আবদ্ধ করা হত। ফার্সি শব্দ নিমক-এর অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও নিরাপত্তা।
সুলতানি ও মুগল রাজত্বে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ধারণা ও প্রতিষ্ঠান ছিল সম্পদের একক উৎস হিসেবে ভূমি শণাক্তকরণ। ভূমি থেকে সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে মুসলিম শাসকগণ নিয়মিত ভূ-সম্পদ উন্নতি-বান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করতেন যার মধ্যে বন এবং মৎস সম্পদও ছিল। জমিদার ও তালুকদার শ্রেণী গঠনে মুগলদের চিন্তাধারা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তারা জনগণের নিকট সরকারের প্রতিনিধিত্ব এবং সরকারের নিকট জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতেন। মুগল রাজস্ব প্রথা এভাবেই স্থানীয় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ভার জমিদার ও তালুকদারদের উপর অর্পণ করে। জমিদার ও তালুকদার নামক রাষ্ট্র-সৃষ্ট মধ্যস্বত্ত্ব শ্রেণী মুগল-পূর্ব ধারা থেকে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী পরিবর্তন।
মুগল রাষ্ট্রচিন্তায় সম্রাটের সর্বব্যাপী আইনগত অধিকার ছিল। সম্রাটের দর্শন প্রার্থীদের প্রজা হিসেবে গণ্য করা হত, বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত বিদেশি হিসেবে নয়। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে আগত ইউরোপিয় নৌবনিকদের ক্ষেত্রেও এ ধারণা প্রযোজ্য ছিল। তারা কোনো বিশেষ অধিকার ভোগ করত না। এভাবে ইউরোপিয় নৌবনিকদের মাধ্যমে বাংলা বৈশ্বিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। সম্রাটের উদ্দেশ্য ছিল পর্যাপ্ত অর্থ অর্জন এবং সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও বৈশ্বিক রূপ দান।
জাতীয় ভাষা সম্পর্কে সুলতানি চিন্তাধারা চৌদ্দ ও পনের শতকে জাতীয় ভাষা ও জাতীয় পরিচিতিতে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উত্তরণ ছিল সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি সচেতন চিন্তার উপলব্ধির ফল। রাজকীয় ইতিহাসের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, বিদেশি শাসকগণ অধীনস্থ জনগণকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে নিয়মিত ও রীতিমাফিক তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ব্যবস্থা করেন। সুলতানি ও মুগল শাসকগণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁরা ফার্সিকে সালতানাতের সরকারি ভাষা করেন, এবং পরবর্তীতে মুগলরাও একই ধারা বজায় রাখেন। সুলতানি ও মুগল রাজত্বের সময় ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধিলাভ করে। স্থানীয় হিন্দু অভিজাত শ্রেণী বৈষয়িক সাফল্যলাভের জন্য ফার্সি ভাষা শিক্ষা করে মুসলিম শাসকদের অধীনে চাকরি লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।
অবশ্য সুলতান ও মুগল শাসকগণ রাষ্ট্রকে দ্বি-ভাষিক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন কি-না তা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। ফার্সি অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হবে, এবং বাংলা হবে আঞ্চলিক ভাষা। বাংলাকে স্থানীয়ভাবে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের ধারণা ছিল বিপ্লবাত্মক, যদিও এর পিছনে একটি ভিন্ন উদ্দেশ্য কার্যকর ছিল। উদ্দেশ্যটি ছিল মূলত রাজনৈতিক। সামাজিক ক্ষেত্রে সুলতানি রাজত্বের বিরোধী বিদ্যমান ব্রাহ্মণ শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাধান্যকে বিচক্ষণতার সঙ্গে বিবেচনায় রেখে কৌশলে দেশিয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে তার স্থলাভিসিক্ত করতে হবে। সুলতানি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান এবং একে শক্তিশালী করার স্বার্থে সংস্কৃতভাষার ভিত্তি দুর্বল করে বাংলাভাষাকে উচ্চস্তরে উন্নীত করার ভাষা নীতি তখন অত্যাবশ্যক ছিল।
বাংলাভাষায় ও দেশিয় বিষয়ে গ্রন্থ রচনার জন্য রাষ্ট্র দেশিয় বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এই নীতি একটি দেশিয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উত্থান, তাদের চিন্তা-চেতনা বাংলা ভাষায় প্রকাশ এবং দেশিয় সংস্কৃতিকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। যশোরাজ খান, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, শ্রীধর, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাসসহ অনেক বিখ্যাত মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের লেখক ছিলেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রত্যক্ষ ফসল। বাংলা গ্রন্থলেখকদের সাবলীল ভাষায় তাদের পৃষ্ঠপোষক সুলতানদের প্রশংসা করার মধ্য দিয়েই সুলতানের ভাষানীতির স্থানীয় সমর্থন লাভের প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রন্থের ভূমিকায় সুলতানি পৃষ্ঠপোষকদের অবদানের স্বীকৃতি লেখকদের একটি মানসম্মত প্রথায় পরিণত হয়। মাতৃভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে বাংলাকে বাঙালি লেখকদের বৌদ্ধিক প্রকাশ মাধ্যমে পরিণত করা ছিল একটি বিস্ময়কর সাফল্য। বাংলাভাষা স্বীকৃতি ও মর্যাদালাভের পর স্থানীয় ভাষা পরিচিতি লাভ করে বাংলা হিসেবে। বাংলা ভাষী জনগণের রাষ্ট্র শাহ-ই-বাঙ্গালিয়া নামে পরিচিত হয়।
মানব দাসত্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা বন্ধন-সম্পর্ক, বিশেষ করে দাসপ্রথার পরম্পরা প্রভাবশালী শ্রেণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় আর্যায়নের সময়কাল থেকে এই প্রথা শুরু হয়। বাংলায় আর্যায়নের সময় স্থানীয় পরাজিত জনগণকে দাস, ব্রাত্য (অস্পৃশ্য) হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শূদ্র নামে আখ্যায়িত করে সমাজের নিচুস্তরে স্থান দেওয়া হয়। আর্য সমাজব্যবস্থায় শূদ্র জাতির শ্রমকে একদিকে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত করা হয় এবং অন্যদিকে প্রতিবেশি উচ্চশ্রেণীর জন্য বিনাপারিশ্রমিকে শ্রম দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বে সকল ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সাধারণ যজমানি থেকে পিওন পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীর সামাজিক দাসত্ব প্রথার সংরক্ষণ ও লালন করেছে। ব্রাহ্মণ্য জাতি প্রথায় দাস ও শূদ্রদের সমাজের সবচেয়ে নিচুস্তরে স্থান দেয়ার কারণ হচ্ছে শ্রম মুক্ত উচ্চবর্ণের লোকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান এবং এদের অব্যাহত ধারা টিকিয়ে রাখা। নিঃসন্দেহে স্থায়ী শ্রমিক শ্রেণীর (শূদ্রজাতি) ধারণাটি উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত উচ্চজাতির কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল।
দাসত্ব বা সামাজিক দাসত্ব সম্পর্কে মুসলিম চিন্তাভাবনা হিন্দুদের চিন্তাভাবনা থেকে মূলত পৃথক ছিল। ব্রাহ্মণ্য প্রথায় দাস বা শূদ্রদের সামাজিক ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে সমাজের নিচুস্তরে রাখা হয় এবং উচু জাতিকে স্থায়ীভাবে সমাজের উচু স্তরে রাখা হয়। দাসত্ব সম্পর্কে মুসলিম চিন্তাভাবনা ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে বরং রাজনৈতিক বিবেচনায়ই উদ্ভূত হয়। মুসলমানেরা দাসত্ব প্রথাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে নি, তবে তারা দাসদের মুক্তি বা তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার জন্য দাস মালিকদের উৎসাহিত করেছে।
বাংলায় দাসত্ব সম্পর্কে মুসলমানদের চিন্তাভাবনা ছিল বর্তমানে শূদ্রদের নিয়ে গঠিত জাতিভিত্তিক প্রথার বাইরে একটি নতুন ধরনের দাসত্ব প্রথা সৃষ্টি করা। মুসলিম শাসক ও অভিজাত শ্রেণী প্রাথমিকভাবে দেশে একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তৈরি করে। তাঁদের প্রাসাদ, হেরেম ও জেনানা রক্ষা ও সেবার জন্য এবং সেনাবাহিনী ও অন্যান্য শ্রম-ঘনিষ্ট ক্ষেত্রের জন্য বিপুল সংখ্যক মানবশক্তির প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় তাঁরা পূর্ব আফ্রিকা, আরব বিশ্ব, মধ্য এশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে দাস আমদানি করে। বিদেশি দাস আমদানির পদ্ধতিটি প্রশান্ত মহাসাগর ও এর পাশ্ববর্তী সাগর দ্বীপপুঞ্জের আমেরিকা ও ইউরোপিয় ঔপনিবেশে যে ধরণের দাসত্ব প্রথা চালু ছিল তার থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিল না।
রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি বিষয়ে মুগলদের তাৎপর্যপূর্ণ ধারণাটি ছিল পাশ্চাত্য নৌবাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অর্থনীতিতে মুদ্রা প্রচলনের সিদ্ধান্ত। এই চিন্তা-ভাবনা সম্ভবত অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনার দ্বারাই বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। ইউরোপিয় নৌশক্তির বিপরীতে মনসবদার (সামরিক প্রাদেশিক শাসক) কর্তৃক প্রচলিত সৈন্য সরবরাহের বিষয়টি ফলপ্রসূ হয় নি। একটি দীর্ঘ নৌযুদ্ধে (১৬৮৬-১৬৯০) মুগল সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হলে তাদের এই বোধোদয় হয়। একটি আপসের মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং এতে করে কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের জমিদারি স্বত্ব কোম্পানিকে দেয়া হয়। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জলসীমায় ইউরোপিয় নৌশক্তিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য সরকার একটি স্থায়ী সামরিক বাহিনী সংরক্ষণ ও একটি দক্ষ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি উপলব্ধি করে।
ইউরোপীয় নৌবাণিজ্য কোম্পানিগুলো প্রাচ্যের পণ্যসামগ্রী কেনার জন্য সোনা-রূপার বাট নিয়ে আসত। মধ্যযুগে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সরকারি রাজস্বের ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ ঘটনা ছিল মুগলদের টাকশাল স্থাপন এবং বহিরাগত সোনা-রূপার বাটকে মুদ্রায় রূপান্তর করে অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলন। এ যাবৎ মুদ্রা তৈরি হয়েছে মূলত রাজকীয় কর্তৃত্বকে বৈধতা দান ও রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রদর্শনের জন্য। নগরের ব্যবসাকেন্দ্রে বড় ধরণের লেনদেনের ক্ষেত্রেই মুদ্রার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল।
অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলনের ফলে অপরিহার্যরূপে রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্বে দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের বিনিময়ে সাধারণত রাজস্ব আদায় করা হত বলে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। দ্রব্য সামগ্রীর বিনিময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্য শক্তিশালী গ্রাম-পঞ্চায়েত বা গ্রামপর্ষদ প্রচলিত ছিল। অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলনের দ্রুত উপলব্ধি মুগলদের রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতি কেন্দ্রীভূত করার একটি বড় সুযোগ এনে দেয় এবং এর ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণেরও সুবিধা হয়। এভাবে সরকার রাজস্ব ব্যবস্থাকে প্রচলিত রাজা, ভূঁইয়া, রায়দের মধ্যে বন্টন করার ধারণা লাভ করে, এবং রাষ্ট্র নিযুক্ত জমিদার শ্রেণীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরগণা স্তরে জমিদারগণ রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে আবিভূত হন। জমিদারি ব্যবস্থার ধারণা সরকারকে একদিকে রাজনৈতিকভাবে এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতিকে সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত করার জন্য জমিদার ও রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী একটি ক্রমস্তর বিশিষ্ট আমলাশ্রেণী সৃষ্টি করা হয়। জমিদারদের হস্তক্ষেপ ও উৎসাহে বিভিন্ন অর্থকরী শস্য উৎপাদন শুরু হয় এবং এর ফলে অর্থনীতিতে নগদ অর্থ প্রচলন সহজতর হয়।
ভাবাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান: ব্রিটিশ যুগ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত বাংলার প্রথম গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজনৈতিক ধারণা ছিল স্থানীয় জনগণের প্রচলিত ভাবাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার আলোকে দেশ শাসন করা। দীর্ঘকাল এ দেশে বসবাসের কারণে তিনি এখানকার জনগণের অভ্যাস, আচার, রীতিনীতি, প্রথা ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রাজনৈতিক মত ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও উন্নতিসাধন, দেশ শাসনের জন্য বিদেশি রাজনৈতিক ধারণা ও প্রতিষ্ঠান আমদানী করা নয়। দেশ শাসন ও পরিচালনার জন্য তিনি সুলতানি ও মুগল নীতি অনুসরণ করে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার নীতি অনুসরণ করেন। তাঁর মতে, বাংলা একটি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী যাকে ইউরোপিয় শাসন ব্যবস্থায় পরিচালনা করে এর স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত করা উচিত হবে না। ভাষা প্রসঙ্গে তাঁর নীতি ছিল পূর্বের মুসলিম শাসকদের মতো স্থানীয় ভাষা ও শিক্ষার সংরক্ষণ।
হেস্টিংসের ‘প্রাচ্যবাদী’ ধারণার কারণে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পরিচালনা সম্পর্কে অচিরেই সিভিলিয়ানদের মধ্যে দুটি দলের সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকের বিশের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী দলটি ছিল স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে নবজীবনের সঞ্চার করে দেশের পরিবর্তনের পক্ষপাতী। আর অন্য দলটি ‘ক্ষয়িষ্ণু’ প্রাচ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিত্যাগ করে তদস্থলে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান প্রবর্তন করে দেশের সামাজিক মানসিকতায় উদ্দীপনা আনয়নের পক্ষপাতী। প্রথমোক্ত ধারণাবাদীরা প্রাচ্যবিদ নামে এবং দ্বিতীয়োক্তরা ইংরেজপ্রেমী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
সংস্কৃত পন্ডিত, অক্সফোর্ডের আইনজ্ঞ, কোলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা (১৭৮৪) এবং কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক স্যার উইলিয়ম জোন্স (১৭৪৬-১৭৯৪) সর্বপ্রথম প্রাচ্যবাদী ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে পঠিত তাঁর বিখ্যাত ‘তৃতীয় বার্ষিক ভাষণ, ১৭৮৮ (Third Annual Discourse, 1788)-তে তিনি সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে অবিহিত করেন যে, দূর অতীতে (বৈদিক যুগ) ভারতবর্ষ এমন এক উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল যেখানে কলা, বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় চরমোৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। তিনি ভাষাতত্ত্ব বিভাগের উদ্বোধন করতে গিয়ে সন্তোষজনক প্রমাণাদি সহ ঘোষণা করেন যে, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ভাষার সঙ্গে আর্য ও ইউরোপের ভাষার সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। জোনসে্র অনুসারি অন্যান্য বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এইচ. টি কোলব্রুক, এস. ডেভিস, জে. ডানকান, এফ. গ্ল্যাডউইন, জে. এইচ হ্যারিংটন, উইলিয়ম কেরি এবং সি. উইলকিন্স। এঁরা ছিলেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বেসামরিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তা। তাঁদের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল কলকাতা মাদ্রাসা, বেনারস হিন্দু কলেজ, কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, কলকাতা স্কুল টেক্সটবুক সোসাইটি ও কলকাতা সংস্কৃত কলেজ। প্রাচ্যবাদীরা মনে করেন যে, ইউরোপিয় রেনেসাঁ যেমন প্রাচীন গ্রন্থসমূহ থেকে প্রেরণা লাভ করেছে, ঠিক তেমনি প্রাচীন সংস্কৃত জ্ঞানভান্ডার ও ভারতীয় পুনর্জাগরণের পথ দেখাতে পারে। এসব প্রাচ্যবাদীরা সম্মিলিতভাবে প্রাচ্য চিন্তাধারার সংমিশ্রণজাত প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ঘটনার পুনঃ আবিষ্কার, ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন এবং সমাজ-সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।
ইংরেজ জনগণ প্রাচ্যবাদীদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে প্রাথমিকভাবে এক ধরনের মানবতাবাদ, চিরায়ত ধারা (প্রাচীনকালের বিখ্যাত রচনাদি আদর্শরূপে গ্রহণ করার প্রবণতা), বিশ্বজনীনতার উদার আদর্শ ও ইউরোপিয় জ্ঞানালোকের সন্ধান পান। তাদের এরূপ মনোভাবে উৎসাহিত হয়ে সরকার উনিশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত প্রাচ্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ (১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। অবশ্য উনিশ শতকের বিশের দশক থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করে। এ সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিশ্বে অংশীদারিত্ব দাবি করে এবং সাম্রাজ্যবাদীরা প্রজাদের ‘সভ্যজাতে’ পরিণত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ব্রিটেনে বেন্থামিয় মতবাদ থেকে উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা গ্রহণকারী এই নতুন চিন্তাধারা ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পটভূমিতে প্রাচ্যবাদী চিন্তা-চেতনার উপকারিতা নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করে। তাঁরা ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের পক্ষপাতি ছিলেন। প্রাচ্যবাদীদের বিরুদ্ধবাদী এই দল ইংরেজ-প্রেমী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং এই দলের নেতৃত্ব দেন কাউন্সিল সদস্য লর্ড বি. মেকলে (১৮০০-১৮৫৯)। ভারতবর্ষকে পাশ্চাত্যকরণে ইংরেজ-প্রেমী চিন্তাধারার বাহকগণ প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে পাশ্চাত্যকরণের প্রাচ্যবাদী নীতি পরিত্যাগের পক্ষপাতি ছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে লর্ড আমহার্স্ট (১৮২৩-১৮২৮) পর্যন্ত সকল গভর্নর জেনারেল প্রাচ্যবাদী মতবাদের অনুসারী ছিলেন। গভর্নর জেনারেল উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-৩৫) ইংরেজবাদী চিন্তাধারা গ্রহণ করেন এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়কাল থেকে গৃহীত সকল প্রাচ্যবাদী মতাদর্শ ও অর্জনসমূহ বিনষ্ট করেন। বেন্টিঙ্কের শাসনকালে কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, এশিয়াটিক সোসাইটি মারাত্মক আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। কোলকাতা মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, কোলকাতা স্কুল ও স্কুল টেক্সটবুক সোসাইটি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। এক কথায় স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ সমূলে উৎপাটন না করে প্রাচ্যবাদী ধারণায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যে প্রগতি ও আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তা প্রায় অতীতের স্বপ্নে পরিণত হয়।
চার্লস ই. ট্রেভেলিয়ান (১৮০৭-১৮৮৬) সর্বপ্রথম গুরুত্বসহকারে ইংরেজবাদী যুক্তি তুলে ধরেন। একসময়ে একনিষ্ঠ প্রাচ্যবাদী এবং পরবর্তীকালে ইংরেজবাদে বিশ্বাসী ট্রেভেলিয়ন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ‘অসারতা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল এই যে, ওয়ারেন হেস্টিংস ও ওয়েলেসলির প্রাচ্যবাদী চিন্তা-চেতনার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপিয়দের স্থানীয় ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করে তোলা, কিন্তু তাঁদের এই চিন্তাধারা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রাচীন চিন্তা-চেতনা ও প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন ও এগুলোকে নবশক্তি দান করে ভারতকে আধুনিক করার স্বপ্নে পরিণত হয়। প্রাচ্য ভাবধারায় ভারতবর্ষকে আধুনিক করার প্রচেষ্টাকে ট্রেভেলিয়ন ব্যয়বহুল ও অবাস্তব মনে করেন। ট্রেভেলিয়ন প্রাচ্য ভাবাদর্শ পরিত্যাগের সুপারিশ করেন এবং পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষা দান ও পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠান প্রর্বতনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পক্ষে মত প্রদান করেন। বেন্টিঙ্ক ইংরেজবাদী দলকে উৎসাহিত করেন এবং তিনি নিজেও একজন ইংরেজবাদী হয়ে পড়েন। প্রাচ্যবাদী দলের নেতা এইচ. এইচ উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) অত্যন্ত হতাশ হয়ে তাঁর এক বন্ধুকে লেখেন যে, প্রাচ্য সভ্যতা সম্পর্কে শিক্ষার অভাব ও অজ্ঞতার কারণেই বেন্টিঙ্ক, ট্রেভেলিয়ন ও অন্যান্য ইংরেজবাদীদের সমর্থন করেন। প্রকৃতপক্ষে বেন্টিক বেন্থামিয় চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং উপযোগবাদী নীতির ভিত্তিতে ভারতবর্ষের পরিবর্তন সাধন করতে চান। একথা সুস্পষ্টভবে প্রমাণিত যে, কাউন্সিলের আইন-সদস্য টমাস বি. মেকলের অনুপ্রেরণায় অনেক বেসামরিক ব্যক্তি তাদের প্রাচ্যবাদী মনোভাব পরিবর্তন করে ইংরেজবাদী দলের অনুকূলে যোগদান করেন। পাশ্চাত্যে টমাস বি. মেকলে একজন বড়মাপের বুদ্ধিজীবী, জাতীয়তাবাদী ও সাহিত্যকর্মের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর সামান্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সম্ভবত ভারতের পরাধীন জনগণের প্রতি তাঁর আদৌ কোনো সহানুভূতি ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা ও প্রশাসনে ইংরেজি মাধ্যম প্রবর্তনের ফলে ভারতে আধুনিকতার পরিবর্তনের ধারা বয়ে আনবে এবং জনগণেরও মঙ্গল হবে। তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতির উপর প্রাচ্যবাদী ও ইংরেজবাদীদের চিন্তাধারা সম্পর্কে একটি দীর্ঘ আনুপুঙ্খিক প্রবন্ধ রচনা করেন। দীর্ঘ এই প্রবন্ধে মেকলে ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতি, কলা ও বিজ্ঞানের অন্তঃসারশূণ্যতা ও অসারতা নিয়ে কৌতুক করে মন্তব্য করেন যে, আধুনিক জীবনের জন্য এসব বিষয় অর্থহীন। অবশেষে গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলে প্রাচ্যবাদী নীতি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ইউরোপিয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো। এই লক্ষ্যে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বরাদ্দকৃত সকল অনুদান শুধু ইংরেজি শিক্ষার জন্য ব্যয় করাই উত্তম হবে।
উদারনৈতিক সংস্কার কার্যকর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কায়স্থ বংশীয় পন্ডিত রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩) ব্রাহ্মণশ্রেণীর নৈতিক শৈথিল্য ও মূর্তিপূজার উল্লেখ করে উদারনৈতিক মতবাদের চিন্তাধারা কার্যকরের সূচনা করেন। জ্ঞানোদয় শিরোনামে একটি নিবন্ধে রামরাম বসু হিন্দু পুরোহিত শ্রেণীর ত্রুটি-বিচ্যুতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন এবং এগুলো অর্থহীন ও সমাজের নিকট বিপজ্জনক হওয়ার পূর্বেই ধর্মীয় সংস্কারের আহবান জানান। নিবন্ধটির যুক্তি ও পুনর্চিন্তনের দিকটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উইলিয়ম কেরী ইউরোপের সংস্কার বিপ্লবের প্রাক্কালে রামরামের উক্ত নিবন্ধটিকে এরাসমুস ও মার্টিন লুথারের নিবন্ধের সঙ্গে তুলনা করেন।
কোলকাতা হিন্দু কলেজ পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ ও চিন্তাচেতনার প্রথমদিকের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হিন্দু কলেজের ইউরেশিয় যুব শিক্ষক হেনরি লুই ভিবিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) আলোকিত দার্শনিক, বিশেষ করে হিউম ও কান্টের উপর বক্তৃতা দেন। তিনি ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন কীভাবে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করা যায় এবং কীভাবে স্বাধীন উপায়ে চিন্তা করা যায়। ছাত্রদের এরূপ শিক্ষা দেওয়ার কারণে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য ডিরোজিওর শিক্ষা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যা রক্ষণশীল হিন্দুরা সহ্য করতে পারে নি। কিন্তু তাঁর অনেক ছাত্রই তাঁর চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং তারা হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি-আচার-অনুষ্ঠানের সমালোচকে পরিণত হন।
হিন্দু কলেজের এই উদারনৈতিক দলটি ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিতি লাভ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল যুক্তির উপর ভিত্তি করে বাংলার বৌদ্ধিক ধারার পুনর্নিমাণ। তারা সে সময়ের পাশ্চাত্য বৌদ্ধিক জাগরণ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত হন। পাশ্চাত্যমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রক্ষণশীল হিন্দুরা তাদের অপমাণিত ও অভিযুক্ত করেন। ইয়ং বেঙ্গলরা মনে করে যে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও অন্যান্য কারণে বাংলার সমাজ কুসংস্কারচ্ছন্ন, যুক্তিবিরোধী ও প্রতারকে পরিণত হয়। সুতরাং, অধঃপতনের হাত থেকে মুক্তির জন্য তাদের সঠিক জ্ঞানদান করা ও সঠিক পথে আনা প্রয়োজন। সাপ্তাহিক জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১-৪০) পত্রিকায় তারা তাদের ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করে।
উনিশ শতকের প্রথমদিকে মোটামুটি তিন ধরনের মতাদর্শের উদ্ভব ঘটে। প্রথমটি হলো আর্য সমাজ। এরাঁ রাজা রামমোহন ও তাঁর আত্মীয় সভা থেকে ধ্যান-ধারণা লাভ করে। এই গোষ্ঠী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বেদের একেশ্বরবাদের পুনর্জাগরণ ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগের পক্ষে যুক্তি প্রদান করে। আর্য সমাজ ব্রিটিশদের মুক্ত বাণিজ্য এবং ভারতের ঔপনিবেশীকরণ ও আবাদী উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে বাণিজ্যিক শস্যের প্রচলন সমর্থন করে। একথা সুস্পষ্ট যে, আর্য সমাজ ব্রিটিশ মুক্ত-ব্যবসায়ীদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল এবং এই মুক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবলুপ্তি আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। তারা ভারতে ব্রিটিশ পূঁজিপতিদের আবাদী অর্থনীতি প্রচলনের অনুমতি দেওয়ারও পক্ষে ছিল। আর্য সমাজের সামাজিক লক্ষ্য ছিল বৈদিক ভাবধারায় হিন্দু সমাজের সংস্কার ও জাতিভেদ মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। রাজা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন ও ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পরিচালিত ধর্মসভা (স্থাপিত ১৮৩১) এর মূল ভাবাদর্শ প্রচার করে। তাঁরা হিন্দুধর্মের মধ্যেই সীমিত আকারে সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা চালায়। সামাজিক ‘কুসংস্কার’ দূরীকরণের নামে তারা বেন্টিকের সংস্কার পরিকল্পনার প্রবল বিরোধিতা করেন। ১৯২৮ সালে সতীদাহ প্রথার আইনগত বিলোপ কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই তারা বিরোধিতা শুরু করেন। রাধাকান্ত দেব ও তাঁর অনুসারীরা সতীদাহ প্রথা বিলোপের বিরোধিতা করেন এই কারণে নয় যে তাঁরা এই প্রথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বরং তাঁরা উপলব্ধি করতে পেয়েছিলেন যে, এসব তথাকথিত সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দু সাংস্কৃতিক কাঠামোকে হীন প্রতিপন্ন করে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করে ফেলবে। ধর্মসভা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রচারিত ধ্যান-ধারণার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে কোম্পানি আমলে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রাগ্রসর চিন্তা-ভাবনা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ থেকে ভারতীয় উপাদান সম্পূর্ণ বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মসভা সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়করণ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলোপসাধন, ঔপনিবেশকরণের ধারণা পরিত্যাগ, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গ্রহণ ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের আহবান জানান। নিঃসন্দেহে এসব চিন্তা-চেতনা সময়ের অনেক অগ্রবর্তী চিন্তা-চেতনা ছিল। অর্ধ শতক পরে উনিশ শতকের আশির দশকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে এসব ধ্যান-ধারণা নিয়ে জনগণ আলাপ-আলোচনা শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে তা জনগণের চাহিদায় পরিণত হয়। তৃতীয় চিন্তাধারাটি ছিল ইয়ং বেঙ্গলের। ইয়ং বেঙ্গল পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্তি ও উপযোগিতার ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ধারণা প্রদান করে। কোলকাতার ক্ষুদ্র বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী থেকে এই উভয় প্রকার চিন্তা-চেতনার সূত্রপাত হয়। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামতনু লাহিড়ি, রামকৃষ্ণ এবং ১৯ শতকের অন্যান্য প্রথিত যশা ব্যক্তির হিন্দু সংস্কারবাদী চিন্তা-চেতনার উপলব্ধি ও অনুশীলন হিন্দুধর্মের প্রচলিত সামাজিক চিন্তার ভিত্তিতে আঘাত হানে। তাঁরা সতীদাহ প্রথা, বালিকাদের বাল্য বিবাহ এবং যৌতুক প্রথার কঠোর বিরোধিতা করে। তাঁদের চিন্তা-চেতনা জীবনের তাৎপর্য সম্পর্কে প্রচলিত হিন্দু ধারণা ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। রামমোহনের ব্রাহ্মসভা, রামকৃষ্ণের মঠ ও মিশন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, শ্রী নিকেতন ও বিশ্বভারতী তাদের কাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর বিশ্ব, মানবতার প্রতি তাদের অঙ্গীকার এবং একই সঙ্গে মায়াবাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব করে।
মুসলিম সমাজে সংস্কার-চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা ও দৈনন্দিন জীবনে যুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আঠারো শতকের হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা নিঃসন্দেহে অনেক প্রাগ্রসর ছিল। আঠারো শতকের মুসলমানদের পান্ডিত্য ও বিদ্যাবত্তার নির্যাসের স্বাক্ষর পাওয়া যায় এইচ. এম ইলিয়ট ও জে. ডাউসনের ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ইতিহাসতত্ত্বের বেশ কয়েক খন্ডে এবং সি.এ স্টোরি কর্তৃক ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত নিজের রচিত গ্রন্থপঞ্জিতে। গোলাম হুসাইন সলিম রচিত রিয়াজ উস সালাতিন, সাইয়্যিদ গোলাম হুসাইন খান তাবাতাবাই রচিত সিয়ার-ই-মুতাখ্খেরিন, মুনশি সলিমুল্লাহ রচিত তাওয়ারিখ-ই-বাংলা, মুহাম্মদ আলি খান রচিত তারিখ-ই-মুজাফ্ফরি, নওয়াব নুসরত জং রচিত তারিখ-ই-নুসরত জঙ্গি এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক রচনা সে সময়কার বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ার তথ্য সমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের উদাহরণ। এসব ঐতিহাসিক লেখক, বিশেষ করে সাইয়্যিদ গোলাম হুসাইন খান তাবাতাবাই ও গোলাম হুসাইন সলিম ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে গৌরবময় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। অবশ্য তাঁরা নওয়াব সুজাউদ্দিন খানের (১৭২৭-১৭৩৯) শাসনামলের পরবর্তী বাংলা শাসকগণের অনেক দুর্বলতা ও অবক্ষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ইউরোপিয়দের সঙ্গে বাণিজ্যিক মিথস্ক্রিয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা বলেন যে, মুসলিম রাজনৈতিক শ্রেণীর ব্যর্থতার কারণেই পলাশি ও তার পরবর্তী ঘটনা অবশ্যম্ভাবী ছিল। এসব শাসকগণ কোম্পানির শাসনভার গ্রহণকে অভিনন্দন জানান এবং আশা প্রকাশ করেন যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না। অষ্টাদশ শতকের সত্তুরের দশকে দিওয়ানি প্রথা বাতিল এবং আশি ও নববইয়ের দশকে শরিয়া আইনের পরিবর্তে স্থানীয় আমলাদের নিয়ে প্রশাসনে পাশ্চাত্যকরণ শুরু হলে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে পূর্ণ অসহযোগ ঘোষণা করেন। এই অসহযোগে আন্তঃসাংস্কৃতিক চুক্তির সুযোগ সুবিধাসহ সকল প্রকার পাশ্চাত্য দ্রব্য বর্জন অন্তর্ভুক্ত ছিল। কখনো কখনো অসহযোগ সহিংস রূপ ধারণ করত। সশস্ত্র প্রতিরোধ ও সিপাহি বিদ্রোহের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতেন।
ভারতে ইউরোপিয়দের অবস্থানের কারণে মুসলমানদের অধঃপতন ও রাজনৈতিক মর্যাদা সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য দিল্লীর শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-১৭৬২) এক ধরনের বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু করেন। সমন্বয়ী ধারণার ভিত্তিতে নয়, শরিয়ার ভিত্তিতে ইসলামের পুনর্জাগরণই ওয়ালিউল্লাহ প্রত্যাশা করেছিলেন। ওয়ালিউল্লাহর শিষ্য রায় বেরেলির সাইয়্যিদ আহমদ ব্রিটিশদের কাফের ও মুসলমানদের নিকট অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলায় তিতুমীর ও হাজি শরিয়তউল্লাহর মতো তেজস্বী ও সক্রিয় সংস্কারবাদী অনেকে তাঁর অনুসারী ছিলেন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিন ধরনের চিন্তক-গোষ্ঠী ছিল : ব্রাহ্মসমাজ, ধর্মসভা ও ইয়ং বেঙ্গল। তারা সকলেই সনাতনী সংস্কৃতিতে কমবেশি যুক্তির ভূমিকা ও এর আধুনিকীকরণ চেয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা (উলামা) ব্রিটিশ শাসনের বাস্তবতা উপেক্ষা করে আঠার শতকের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেই অটল থাকেন। তাদের স্মৃতিতে অভিজাত মুসলিম শাসকদের পদমর্যাদা সজীব থাকার কারণে বিজয়ী জনগণ ও তাদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সহাবস্থান ও খাপ খাইয়ে নেয়া এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় নতুন করে কিছু করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালের শেষ পর্যায়ে মুসলমানরা নতুন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে তাদের দূরে থাকার কোনো কারণ ছিল না, কারণ নতুন শাসকগোষ্ঠী স্থানীয় অভিজাত শ্রেণী ও প্রচলিত ভাবধারা দ্বারা স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করার সুযোগ প্রদান করে। ১৭৮৬ সাল থেকে প্রশাসন ব্যবস্থাকে ইউরোপিয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এই নীতি ব্রিটিশ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে অভিজাত মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এতে শাসকশ্রেণী আত্মতৃপ্তি বোধ করে এবং গুণাগুণ নির্বিশেষে সাবেক প্রতিষ্ঠানসমূহকে কোম্পানি সরকারের পরিহার করার নীতি মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে ইংরেজ শাসনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে। ফলে তারা ঔপনিবেশিক রাজত্বের সুফল ভোগ থেকে স্বেচ্ছায় দূরে সরে থাকে। এই পটভূমির আলোকেই আমরা উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ধ্যান-ধারণা বিবেচনা করব।
ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অব্যাহত অসহযোগিতার একটি পার্শ্ব ফল ছিল এই যে, তারা সচেতনভাবেই তাদের জ্ঞানভান্ডার ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্রিটিশ ভাবাদর্শ ও চিন্তা-চেতনার প্রভাব পড়তে দেয় নি। তারা তাদের অতীত গৌরবের আনন্দেই বিভোর ছিলেন। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামের ওহাবি চিন্তাধারা অবাধে বাংলার গ্রামীণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায়ও তিতুমির ও শরিয়তউল্লাহ এবং তাঁদের অনুসারীগণ শহরে বসবাসকারী অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন নি। গ্রামীণ মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সুফি ভাবধারার সমন্বয়ী ভাবাদর্শ ও চিন্তা-চেতনার প্রতি পূর্বাপর একই রকম আকর্ষণ বজায় রাখে। কিন্তু ইংরেজ নীতি রাজভক্ত শহুরে মুসলমানদেরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং গ্রামীণ বিদ্রোহী মুসলমানদের সঙ্গে বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়।
মুসলমান কর্তৃক ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্যকরণ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও বেশ কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী সনাতনী চিন্তা-চেতনা বজায় রাখার ভুল-ত্রুটি উল্লেখ করেন। অন্যদিকে আবার ইংরেজ সংস্কারের প্রভাবে প্রগতিশীল পরিবর্তনের হাওয়া বইতে থাকে। এদের মধ্যে বিশেষ করে আবদুর রহিমের (১৭৮৫-১৮৫৩) নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। রামমোহনের মতো রহিম মূলত সনাতনী মুসলিম যুক্তিবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর রচনাবলি ফার্সি ও উর্দু ভাষায় হওয়ার কারণে তাঁর চিন্তাধারা সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। গর্ব করার মতো রহিম কোনো উচ্চ বংশজাত ছিলেন না। তাঁর পিতা ছিলেন আর্থিকভাবে সচ্ছল এক তাঁতি। পনের বছর বয়সে রহিম ফার্সি ও আরবি ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন এবং এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে লক্ষ্ণৌ ও পরে দিল্লি গমন করেন। ১৮১০ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি কোলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কোলকাতায় তিনি ইউরোপিয় ও কোলকাতা ভদ্রলোক সমাজের সংস্পর্শে আসেন এবং অচিরেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা লাভ করেন। তিনি টেক্সট বুক সোসাইটির অনুবাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একজন অনুবাদক হিসেবে তিনি কোলকাতার ইংরেজ প্রেমীদের মধ্যে সুনাম অর্জন করেন। তিনি এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার একটি জ্যামিতি বিষয়ক প্রবন্ধ ফার্সি ভাষায়, হিউটনের কোর্স অন ম্যাথামেটিক্স গ্রন্থটি আরবি ভাষায় এবং ব্রিজের অ্যালজাবরা গ্রন্থটি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন।
রামমোহনের মতো আবদুর রহিম তৎকালীন মুসলমানদের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস সম্পর্কে, বিশেষ করে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং শরিয়া ও সুফি জীবনধারা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। অবশেষে রহিম শরিয়া নীতি পরিত্যাগ করে একজন বুদ্ধিবাদী ও মুক্তচিন্তক রূপে আর্বিভূত হন। তাঁর দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদ সকল শ্রেণীর মুসলিম সম্প্রদায়কে অসন্তুষ্ট করে, কারণ তিনি যুক্তি প্রদান করে বলেন যে, স্রষ্টা বা পরমসত্তার ধারণা ইমামদেরই (মুসলিম ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক নেতা) অবদান। তাঁর মতে, প্রকৃতির নিয়মানুসারেই বস্ত্তর অস্তিত্ব ও গতি নির্ধারিত হয়ে থাকে, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির ইচ্ছায় নয়। মুসলিম সমাজে তিনি আবদুর রহিম দহরী (বস্ত্তবাদী/নাস্তিক) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর চরম মতবাদের কারণে তিনি হিন্দু ও মুসলিম বুদ্ধিজীবী এমনকি খ্রিস্টান মিশনারিদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
রহিমের চিন্তাধারা এতোটাই চরম প্রগতিশীল ছিল যে তা সাধারণ জনগণকে মোটেও আকৃষ্ট করতে পারে নি। অবশ্য তাঁর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি দুজন প্রথিতযশা ছাত্র রেখে যান। এঁদের একজন হলেন বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ পন্ডিত, শিক্ষাবিদ ও সংস্কারক ওবায়দুল্লাহ আল-ওবায়দী (১৮৩৪-১৮৮৫) এবং অন্যজন হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মুসলিম স্নাতক ও বুদ্ধিবাদী দেলওয়ার হোসেন আহমেদ (১৮৪০-১৯১৩)। ওবায়দুল্লাহ আল-ওবায়দী যেখানে শরিয়া অনুসারে ইসলাম সংস্কারের পক্ষপাতি ছিলেন, সেখানে দেলওয়ার হোসেন আহমেদ যুক্তি প্রয়োগ এবং সময়ের পরিবর্তন ও চাহিদা অনুসারে ইসলাম ধর্মের আইন ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে আধুনিক করার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি যুক্তি প্রদান করেন যে, পরিবর্তন হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতার একটি অংশ এবং অস্তিত্বের জন্যই প্রকৃতির এই নির্দেশ স্বীকার করতে হবে। তিনি তাঁর সামাজিক চিন্তাধারা প্রবন্ধ আকারে কোলকাতার অধিকাংশ প্রগতিশীল সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। এসেস অন মোহামেডান সোস্যাল রিফর্মস শিরোনামে তাঁর ২ খন্ড রচনাবলি ১৮৮৯ সালে কোলকাতার থেকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে দেলওয়ার হোসেনের প্রধান ধারণা ছিল এই যে, রাষ্ট্র ও ধর্ম পরস্পর থেকে পৃথক থাকবে। রাষ্ট্র ধর্মের প্রতি সহনশীল হবে এবং ধর্মও রাষ্ট্রের আইন-কানুনের প্রতি সহনশীল হবে।
উনিশ শতকের মুসলিম মন-মানসিকতার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলী (১৮০০-১৮৭৩), আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩) ও সৈয়দ আমির আলীর মতো ঐতিহ্যবাদী (কিন্তু ইংরেজ শাসনের পক্ষীয়) মুসলিম পন্ডিতগণ। তাঁরা ঘোষণা করেন যে, ভারতবর্ষ খ্রিস্টীয় রাজত্বের অধীন হলেও এটি দারুল হরব নয়। তিতুমীর ও শরিয়তউল্লাহর মতো ওহাবি নেতাদের মতের বিরোধিতা করে তাঁরা সহযোগিতার ভিত্তিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন, কারণ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইসলাম বিপন্ন নয়। কোলকাতা মোহামেডান সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা আবদুল লতিফ মনে করেন, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ আইনবিরুদ্ধ হবে। এই উক্তি ওহাবি আন্দোলনের কর্মিদের সম্পূর্ণ বিরোধী মত। ওহাবি আন্দোলনের কর্মিরা মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা এবং এমনকি এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও সকল মুসলমানের জন্য ফরয বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ধারণা শাসন পরিচালন পদ্ধতি সম্পর্কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের মূলনীতি ছিল প্রশাসনে দেশীয়দের অংশগ্রহণ ব্যতীত যতদূর সম্ভব দেশি আইন ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা দেশ পরিচালনা করা। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকদের শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মনোভাবের পরিবর্তন সাধন করে। দেশ শাসনের ক্ষেত্রে দেশীয়দের অংশগ্রহণ, এমনকি যথাসময়ে ও পর্যায়ক্রমে দেশিয়দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পার্লামেন্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে নবপ্রবর্তিত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে শিক্ষিত দেশিয়দের যোগদান করানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। লেজিসলেটিভ কাউন্সিল, মিউনিসিপ্যাল সরকার ইত্যাদির মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে যোগ্য দেশিয়দের অন্তর্ভুক্ত করারও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়ের কাউন্সিল এবং প্রভিন্সিয়াল গভর্নর্স কাউন্সিলে সীমিত সংখ্যক মনোনীত সদস্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৮৬২ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। নগর ও গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রবর্তনের মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মর্লি-মিন্টো সংস্কারের (১৯০৯) মধ্য দিয়ে গভর্নর্স লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের জন্য সীমিত আকারে নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। মর্লি-মিন্টো সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলীর প্রবর্তন। স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও দ্বন্দ্বকে প্রকট করা, এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলাকে বিভক্ত করা।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯) দেশে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের ভিত্তি স্থাপন করে। এ আইনের অধীনে দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত সীমিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের ধারণা ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এই আইন স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী পদ্ধতির অধীনে দায়িত্বশীল প্রাদেশিক সরকার প্রবর্তন করে। এই আইন গভর্নর কর্তৃক সংরক্ষিত কিছু ক্ষমতা ব্যতীত দেশ পরিচালনার অধিকাংশ ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তর করে। তখন গভর্নরের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয়দের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা। এই আইনের অধীনে ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হয়।
মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান, ১৯৪৭-১৯৭১ বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) এবং বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে (১৯১১) মুসলমানদের মনে এই উপলব্ধি জন্মায় যে, তারা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানেরা ব্রিটিশ অভিভাকত্ব ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়, এবং তৎকালীন প্যান-ইসলামিক আন্দোলনে যোগদান করে। তারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে সম্মিলিত প্ল্যাটফরমও তৈরি করে। এরই ফলশ্রুতিতে লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬) সম্পাদিত হয়। ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার অনুসারে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলি পদ্ধতির স্বীকৃতি দেয়। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এবং চূড়ান্তরূপে বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই বেঙ্গল প্যাক্ট হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা প্রদান করে এবং চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যা নির্বিশেষে মুসলমানদের অধিক সংখ্যায় চাকরি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে। এভাবে প্যান-ইসলামবাদের রাজনৈতিক চিন্তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ সুগম করে।
কিন্তু উত্তর ভারতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের শুদ্ধি ও সংগঠন আন্দোলনের ফলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের আদর্শ অচিরেই ভেঙে যায়। উভয় আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পূর্বে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হিন্দুদের পুনরায় ধর্মান্তরিত করা। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুসলমানদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া বন্ধ করার জন্য দেওবন্দ থেকে তবলিগ আন্দোলন শুরু হয়। ইতোমধ্যে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই গান্ধী অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন বাতিল করে দেন। এসব ঘটনা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা পরিণামে ১৯২৫ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত কতগুলি ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। হিন্দু-মুসলিম বিবাদের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়।
ভারত বিভক্তির ধারণার উদ্ভব প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ (১৯৩২) ১৯৩৫ সালের আইনের ভিত্তিরূপে পরিণত হয় এবং তা মুসলমানদের দাবি-দাওয়া অধিকাংশ পূরণ করলেও কংগ্রেস এই রোয়েদাদ প্রত্যাখ্যান করে। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অচিরেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধারণায় পর্যবসিত হয়। চৌধুরী রহমত আলি নামক ক্যামব্রিজের এক যুবক ছাত্র এই ধারণা উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানের ধারণার অগ্রগতি সাধনের জন্য পাকিস্তান ন্যাশনাল মুভমেন্ট নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। রহমত আলির ধারণা অনুসারে, পাকিস্তান হবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে একটি ফেডারেশনের মতো। ‘পাকিস্তান’ ধারণা বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন আধ্যাত্মিক নেতা আগা খান ও পাঞ্জাবের রাজনৈতিক নেতা ফজলি-ই-হুসেন। ১৯৩৫ সালের মধ্যে রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে পাকিস্তান শব্দটি মুসলমানদের রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান লাভ করে। ১৯৩৭ সালের ২১ জুন কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল মুসলিম লীগ নেতা এম.এ জিন্নাহকে পাকিস্তানের ধারণা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক এক পত্র লিখেন। কিন্তু তখন পর্যন্তও পাকিস্তান ধারণার মধ্যে বাংলা অন্তর্ভুক্ত হয় নি। পাকিস্তান পরিকল্পনায় তখন পর্যন্ত ভারত বিভক্তি বোঝায় নি, বরং বোঝাত প্রকৃত স্বাধীন প্রদেশসমূহ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত যার মধ্যে ‘পাকিস্তান’ হবে একটি প্রদেশ। ১৯৩৩ সালের ১৪ এপ্রিল সংখ্যায় স্টার অব ইন্ডিয়া (কোলকাতা) সর্বপ্রথম পাকিস্তান ধারণাকে সমর্থন করে লেখা শুরু করে এবং এভাবে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত কমবেশি লেখালেখি হতে থাকে। রায়তদের অধিকার ও গ্রামীণ ঋণ নিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি) ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বেঙ্গল মুসলিম লীগ মূলত পুরাতন মুসলিম সংহতি ইস্যু নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের প্রতিবেদন হিসেবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের ধারণা বাংলার মানুষ জানতে পারে।
নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি) ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করে। এই নির্বাচনে দলটি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে আর্বিভূত হয় এবং ভারতীয় কংগ্রেস পরিণত হয় প্রথম দলে। ব্যক্তিগতভাবে এ.কে ফজলুল হক বাংলায় বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আর্বিভূত হন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি কৃষক প্রজা পার্টিকে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে ব্যর্থ হন। অচিরেই কেপিপি পরস্পর বিবাদমান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতার জন্য মুসলিম লিগের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাহোর অধিবেশনে যোগ দেন। মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশন বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্বলাভ করে এ কারণে যে মুসলিম লীগ ফজলুল হককে এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব বোঝাতে সক্ষম হন যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের উদ্ভব ঘটে। পাকিস্তানের উদ্ভবের সাথে সাথে কেপিপির বিলুপ্তি ঘটে।
১৯৩৫ সালের আইন এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে সমকালীন প্যান-ইসলামিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মূল লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশসমূহে মুসলিম লীগের ব্যাপক নির্বাচনী সাফল্য মুসলিম লীগের যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রের ধারণা মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি একক রাষ্ট্রের দাবিতে পরিণত হয়। এভাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
স্বাধীন বাংলার ধারণা ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে প্রাদেশিক সরকারগুলো দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নামমাত্র সম্পর্ক বজায় রেখে ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের ধরন বা পদ্ধতি সম্পর্কে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। ফলে অনেক প্রদেশে, বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। কংগ্রেস ও লীগের রাজনৈতিক বিবাদ মিটাতে ব্যর্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। কংগ্রেস ও লীগ যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে তাহলে ব্রিটিশরা প্রয়োজনে প্রাদেশিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেই ভারত ত্যাগ করবে। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি দিল্লিতে একটি ‘স্বাধীন, অবিভক্ত ও সার্বভৌম বাংলার’ ধারণা তুলে ধরেন (২৭ এপ্রিল ১৯৪৭)। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম, ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা শরৎচন্দ্র বসু, বঙ্গীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীন বাংলার ধারণার বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেন নি। ১৯৪৭ সালের ২০মে কলকাতায় শরৎ বসুর বাড়িতে যুক্ত স্বাধীন বাংলার শাসনতান্ত্রিক কাঠামো বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা এই ধারণার সাথে একমত হলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে সময় তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। অ্যাটলি ঘোষিত তারিখের এক বছর পূর্বেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। সফল ঐকমত্যে পৌঁছানোর সুযোগ আর হয়ে উঠে নি। কংগ্রেসের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা অখন্ড স্বাধীন বাংলার ধারণার বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে। ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সর্বোপরি, আইনসভায় বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ট সদস্য বাংলা বিভক্তির পক্ষে ভোট দেন। স্বাধীন বাংলার ধারণা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সময় ছিল খুবই কম এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট। ঘোষিত তারিখের এক বছর পূর্বে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ করা তাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো কঠিন কাজ ছিল না। তাছাড়া সোহরাওয়ার্দি যুক্ত স্বাধীন বাংলার ধারণা নিয়ে আরো আগেই সক্রিয় হতে পারতেন।
ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের প্রত্যেকটির নিজস্ব প্রধান ভাষা ছিল। এরূপ বহু ভাষার সোরগোলের মধ্যে বাংলাভাষা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৩ ভাগ লোকের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ১৯৪৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু পূর্ব বাংলায় উত্তর ভারতের উর্দুভাষার কোনো প্রচলন ছিল না। পূর্ব বাংলার জনগণের কথ্যভাষা ছিল বাংলা, তাই তারা সঙ্গত কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকায় কয়েকজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয় (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। এই ঘটনা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে, এবং সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার বাংলা ভাষার উন্নতিসাধনে বাংলা একাডেমী নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
বৈষম্য বিতর্ক: দুই অর্থনীতির ধারণা ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ.এস সোহরাওয়ার্দি তাঁর যুক্ত স্বাধীন বাংলার ধারণা নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। ফলে পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্তির শর্তাদি সম্পর্কে বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের আলোচনা করার কোনো সময়, বরং বলা চলে তাদের কোনো মানসিক প্রস্ত্ততিই ছিল না। তাই পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সবচেয়ে অবহেলিত প্রদেশই থেকে যায়। পূর্ব বাংলার সিভিল সার্ভিস, অর্থনীতি এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থেকে যায়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ থেকে দেখা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সংক্ষেপে, পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে- প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা তথ্যগতভাবেই এ বিষয়টি প্রমাণ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয়িত হচ্ছে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে প্রতীয়মান হয় পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৬০% পর্যন্ত। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের পাকিস্তানের জন্য দ্বৈত অর্থনীতি তত্ত্ব তৈরি করতে প্ররোচিত করে। অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ উপলব্ধি করেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের প্রসার কেন্দ্রীয় সরকারের অসম নীতি ও বরাদ্দ-সিদ্ধান্তেরই ফলশ্রুতি।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) বিচার বিশ্লেষণ করে সুস্পষ্টভাবে দেখান যে, দ্বৈত অর্থনীতির ভিত্তিতে আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করা না হলে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর অবস্থায় উপনীত হবে। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিযোগিতা করবে এবং দুই অংশের ভারসাম্যমূলক উন্নতির লক্ষ্যে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এরূপ চিন্তা-ভাবনাকে কোনোভাবে বিবেচনা না করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তুষ্টি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিবিদরা অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের অভিমত গ্রহণ করে তাদের দাবি আদায়ের জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে থাকেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা উপস্থাপিত দ্বৈত অর্থনীতিতত্ত্ব সমর্থন করেন।
ছয়দফা কর্মসূচি দ্বৈত অর্থনীতি তত্ত্বের ধারণায় প্রভাবিত হয়ে আওয়ামি লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে ছয়দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এই কর্মসূচিতে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, সবদিক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। শেখ মুজিব তাঁর কর্মসূচিতে উল্লেখ করেন যে, সবদিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমপর্যায়ে আনতে হলে পাকিস্তানকে একটি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে এবং প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া প্রদেশসমূহ অবশিষ্ট সকল ক্ষমতার অধিকারী হবে; পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্য বিনিমেয় মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে; কর ও রাজস্ব আদায় প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে; পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের এসব দাবি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে এবং এই দাবিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করে। তখনই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। আওয়ামি লীগ ছয়দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামি লীগকে জয়যুক্ত করে জনগণ ছয়দফা কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে এবং এভাবে দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানায়।
স্বাধীনতার ধারণা ও মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে তাঁর ছয়দফা কর্মসূচির পক্ষে গণআন্দোলন শুরু হয়। মূলত ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এগারো দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তারা একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচন করে এবং স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর চাপ প্রয়োগ করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল বস্ত্তত স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণার ফলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ সত্যকেই সপ্রমাণ করে যে, যুগ যুগ ধরে যে মহৎ মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান একটি সমাজের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে রূপায়িত ও পুনর্বিন্যাস করে চলেছে, কোনো সময়ের কোনো রাজনৈতিক সুবিধাভোগী শ্রেণীই তা নাকচ করতে পারে না। [সিরাজুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি Sirajul Islam (ed.), Cultural History, in Cultural Survey of Bangladesh Series-vol.4 (Asiatic Society of Bangladesh, 2007); Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, Delhi, 1994; Mohammad Mohar Ali, History of the Muslims in Bengal, Riadh, 1985; Asim Roy, The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal, Princeton, 1983; David Kopf, British Orientalism and the Bengal Renaissance: The Dynamics of Indian Modernization 1773-1835, University of California Press, Berkeley 1969; A.F Salahuddin Ahmed, Bangladesh: Tradition and Transformation, Dhaka 1987.