ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ফোর্ট উইলিয়মের অভ্যন্তরভাগে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলী কর্তৃক ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাচ্যবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। নবনিযুক্ত ইউরোপীয় আমলাদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধনই ছিল এ কেন্দ্রের উদ্দেশ্য। সুশিক্ষিত ও কুসংস্কারমুক্ত আমলাতন্ত্রের সহায়তায় কার্যকরভাবে ব্রিটিশ ভারত শাসনের এক পরিকল্পনা করেন লর্ড ওয়েলেসলী। বিদ্যমান ব্যবস্থায় পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সী বেশির ভাগ তরুণ অফিসার জেলা প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। কিন্তু স্থানীয় ইতিহাস, ভাষা ও শাসন-শৈলী সম্পর্কে কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তাদের দেয়া হতো না। ওয়েলেসলী উপনিবেশিক প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নবাগত অফিসারদেরকে প্রস্ত্তত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এভাবে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীয়তা থেকেই লর্ড ওয়েলেসলী ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস এর কলকাতা মাদ্রাসা ও জোনাথন ডানকানের বেনারস হিন্দু কলেজের মতো ওয়েলেসলীর এ কলেজ পরিপূর্ণ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল না। ভারতবর্ষে কর্মরত সকল সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত চাঁদা এবং সরকারি ছাপাখানার আয়ের একটা অনির্ধারিত বরাদ্দ থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের পরিকল্পনা করা হয়।
ভারতের প্রধান প্রধান ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে কলেজে এক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি বিভাগে ছিলেন একজন অধ্যাপক ও কয়েকজন সহকারী শিক্ষক। তৎকালীন ভারতে আদালতের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ফারসি শিক্ষাদানের জন্য কলেজে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রধান ছিলেন সরকারের একজন ফারসি অনুবাদক নেইল বি. এডমনস্টোন। তাঁর সহকারী শিক্ষক দুজন ছিলেন সদর দীউয়ানি আদালতের বিচারক জন এইচ. হ্যারিংটন ও সৈনিক-কুটনীতিক ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন। ওয়েলেসলী আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য উইলিয়ম জোনস এর পরে সর্বোত্তম আরবি ভাষাবিশারদ হিসেবে বিবেচিত লেফটেন্যান্ট জন বেইলিকে নিযুক্ত করেন। হিন্দুস্থানি ভাষা বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় স্বনামধন্য ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যবিশারদ জন বি. গিলক্রাইস্টের উপর। সংস্কৃত বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হন বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ এইচ.টি কোলব্রুক। বাংলাসহ ভারতের অনেক ভাষা বিশেষজ্ঞ ও ধর্মপ্রচারক উইলিয়ম কেরীকে স্থানীয় ভাষা বিভাগের প্রধান নিয়োগ করা হয়। সব কয়টি বিভাগে কয়েকজন পন্ডিত ও মুন্সি ছিলেন। কলেজ কর্মচারীদের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন দেশীয়। এভাবে ১৮০৫ সালের মধ্যে কলেজে মোট ১২টি অনুষদ খোলা হয়। কলেজের কর্মচারীদের বেতন স্কেলে সমতা বিধান করা হয় নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউরোপীয় অনুষদ সদস্যরা যেখানে প্রতি মাসে ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা বেতন পেতেন, সেখানে তাঁদের এদেশীয় সহকর্মীরা (তাদের ভাষা শিক্ষক ও সহকারী) পেতেন মাত্র ৪০ থেকে ২০০ টাকা। অনুষদ প্রফেসরদের নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল কলেজ প্রশাসন পরিচালনা করত। শৃঙ্খলামূলক বিষয়গুলি দেখাশোনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল দুজন যাজক, প্রভোস্ট ও ভাইস-প্রভোস্টের উপর। কলেজ প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন স্বয়ং গভর্নর জেনারেল। এ কলেজের সকল ছাত্র ছিলেন সদ্য আগত কোম্পানির সনদ প্রাপ্ত কর্মকর্তা। চাকরিস্থলে নিয়োজিত হওয়ার আগে তাদেরকে পরপর দুবছর ভাষা ও প্রশাসন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতো। ওয়েলেসলী নিজে ছিলেন একজন উঁচুমানের বিদ্বান ব্যক্তি। তাঁর স্বপ্ন ছিল যে, তাঁর এ কলেজ কলা ও বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র হিসেবে এমনই বিকশিত হয়ে উঠবে যে একদিন তা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’-এর মর্যাদায় উন্নীত হবে। বস্ত্তত কলেজটি সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলছিল।
শ্রীরামপুর প্রেস ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর সহযোগিতায় গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। কলেজের শিক্ষকবর্গ প্রাচ্য সভ্যতার ব্যাখ্যাকার হিসেবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁদের রচনা ও ধ্যান-ধারণা ইউরোপীয় প্রাচ্যবিশারদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বহু ছাত্রও পরে প্রাচ্যবিশারদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকের মধ্যে এ কলেজ থেকে উত্তীর্ণ সর্বাপেক্ষা কৃতিত্বের অধিকারী ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা প্রাচ্যবিশারদ হিসেবে বিখ্যাত হন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: ডব্লিউ.ডব্লিউ বার্ড, আর. ব্রাউন, টি. ফোর্টেস্ক, এইচ.পি হগটন, এইচ. ম্যাকেঞ্জি, এম.বি মার্টিন, সি. মেটকাফে, এইচ.টি প্রিন্সেপ, এইচ. শেক্সপিয়ার ও এ. টড। কলেজের শিক্ষক ও প্রাক্তন বিদ্বান ব্যক্তিগণ বাংলাসহ ভারতের প্রায় সকল ভাষার সংস্কার ও আধুনিকায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কলেজের বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন রামরাম বসু, তারিণীচরণ মিত্র ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। এ সকল পন্ডিতের সাহায্যে কলেজের অধ্যাপকগণ বাংলা ভাষার মান উন্নয়ন ও বাংলা গদ্য রীতির প্রবর্তনের কাজে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের উৎসাহ ও সহযোগিতায় মুদ্রণ প্রযুক্তি ও বাংলায় গ্রন্থ প্রকাশনা শুরু হয় এবং জ্ঞান চর্চার কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। ১৮০১ সালে সুবিখ্যাত শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, পরের বছর হিন্দুস্তানি প্রেস, ১৮০৫ সালে ফারসি ছাপাখানা এবং ১৮০৭ সালে সংস্কৃত ছাপাখানার যাত্রা শুরু হয়। এ ছাপাখানাগুলিই ছিল বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের দ্রুত পরিবর্তনের গোটা কৃতিত্বই ছিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের। বস্ত্তত কলেজটি দ্রুত ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হয়ে উঠছিল।
কিন্তু কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স (পরিচালকসভা) পদ্ধতিগত কারণে এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রদান করে নি। তাঁদের যুক্তি ছিল, এ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পরিচালকসভার পূর্ব অনুমোদন নেওয়া হয়নি। পরিচালকসভা ওয়েলেসলীকে এ মর্মে অবহিত করেন যে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচিরেই ইংল্যান্ডে স্থাপন করা হবে। ফলত ১৮০৫ সালে ইংল্যান্ডের হেইলিবেরি নামক স্থানে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ স্থাপিত হয় যা সাধারণভাবে হেইলিবেরি কলেজ নামে পরিচিতি লাভ করে। অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজের কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিতকে অধ্যাপক নিয়োগ করে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে বাস্তব অবস্থার নিরিখে অবশ্য ফোর্ট উইলিয়ম কলেজকে দেশীয় ভাষা শিক্ষাদানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। হেইলিবেরি কলেজ থেকে যে সব তরুণ অফিসার সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতেন তাঁদেরকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে আরও ভাষাগত প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, প্রশিক্ষণার্থীদের অনেকেই দেশীয় ভাষায় অধিকতর প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করতেন এবং আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও কলেজের দেশীয় ও ইউরোপীয় শিক্ষকগণ দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে থাকেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক শিক্ষা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী পথ বর্জন করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি দেশীয় ভাষায় বই লেখা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কলেজের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পগুলির জন্য তহবিল প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। ১৮৩০ সালে বেন্টিঙ্ক ইংরেজিকে জনশিক্ষার মাধ্যম করে তাঁর শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। ঐ বছরই তিনি কলেজের অধ্যাপকদের পদগুলি বিলোপ করেন এবং ১৮৩১ সালে কলেজ কাউন্সিলও বিলোপ করা হয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বেন্টিঙ্ক কলেজের নামফলকটি অক্ষুণ্ণ রাখেন এবং কয়েকজন দেশীয় পন্ডিতকে তাদের পদে বহাল রেখে আমলাদের ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেন। ডালহৌসীর সরকার ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়মের এ ফ্যানট্যাম কলেজটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ করেন। [সিরাজুল ইসলাম]