ইয়ং বেঙ্গল
ইয়ং বেঙ্গল হিন্দু কলেজের ছাত্রদেরকে সমসাময়িক কলকাতা সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সামাজিক বুদ্ধিবাদী একটি অভিধা বিশেষ। এঁরা সবাই হিন্দু কলেজ-এর মুক্তবুদ্ধি যুক্তিবাদী শিক্ষক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র অনুসারী ছিলেন। ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদেরকে জীবন ও সমাজ-প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন কি করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে ওঠে ও বিকশিত হয় এবং কি করে মানুষ মৃত ও সেকেলে ধ্যান-ধারণা ও সমাজ-সংগঠনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ছাত্রদেরকে জ্ঞানানুরাগী হতে এবং যে কোন অন্ধবিশ্বাস পরিত্যাগ করতে দীক্ষা দিয়েছিলেন ডিরোজিও। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত ছিল ইতিহাস আর দর্শন। তাঁর পুনরাবৃত্ত উপদেশ ছিল ‘সত্যের জন্য বাঁচা, সত্যের জন্য মরা’।ডিরোজিও-র প্রিয় ছিলেন হিন্দু কলেজের একদল বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্র। এঁদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, মহেশচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, অমৃতলাল মিত্র উল্লেখযোগ্য। এঁরা সবাই ছিলেন মুক্ত চিন্তা দ্বারা উজ্জীবিত। হিন্দু সমাজের বিদ্যমান সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামো এঁদেরকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
প্রাচীন ও ক্ষয়িষ্ণু প্রথা তথা ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক শৃঙ্খলমুক্তির উল্লেখযোগ্য প্রয়াস হিসেবে ইয়ং বেঙ্গল-এর সদস্যগণ গো-মাংস ভক্ষণ ও মদ্যপানে আনন্দবোধ করতেন। হিন্দুদের কুসংস্কার আর কতিপয় নিষ্ঠুর সামাজিক ও ধর্মীয় আচারের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান মিশনারিগণ যে সকল যুক্তি ব্যবহার করতেন, ইয়ং বেঙ্গল-এর অনেক সদস্য সেসব যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতেন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও কৃষ্ণমোহন বন্দোপ্যাধ্যায়ের মতো এঁদের অনেকই হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।
১৮২৮ সালে ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রেরা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। এ অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান করত। ডিরোজিও-র ছাত্রেরা ভলতেয়ার, হিউম, লক, টমাস পেইন প্রমুখের রচনাবলি অধ্যয়ন করতেন এবং বিতর্ককালে এঁদের রচনা প্রায়শ উদ্ধৃত করতেন। ১৮৩৮ সালে এঁদেরই স্থাপিত আরেকটি সংগঠনের নাম ‘সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অব ‘জেনারেল নলেজ’। তারাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন এ সোসাইটি-র সভাপতি এবং প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী ছিলেন এর সম্পাদক।
ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক ১৮২৮ এবং ১৮৪৩ সালের মধ্যে বেশ কিছু সাময়িকী প্রকাশ করেন। এসব পত্র-পত্রিকার মধ্যে ছিল Parthenon, Hesperus,জ্ঞানান্বেষণ, Enquirer, Hindu Pioneer, Quill এবং The Bengal Spectator। Parthenon-এর একমাত্র সংখ্যা ১৮৩০ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। মিশনারিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী তাঁদের ধ্যান-ধারণা প্রচারের উদ্দেশ্যে জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল দীর্ঘতর হয়েছিল; ১৮৩১ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়। দ্বিবার্ষিক এ পত্রিকার সংগঠক ছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক। এর উদ্দেশ্যে ছিল শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারশাস্ত্রে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। ১৮৩১ সালে কৃষ্ণমোহন এনকোয়েরার পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন; এতে নব্য চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে একত্রিত রক্ষণশীল সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে সমালোচনা করা হয়। ইয়ং বেঙ্গলদের অনেককেই সমাজচ্যুত করার প্রচেষ্টা এবং চরমপন্থা পরিহার করার জন্য তাদের ওপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করা হয়। হিন্দু পাইওনিয়ার (১৮৩৮ সালে শুরু) পত্রিকায় প্রকাশিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর রচনাবলি থেকে বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটছে। তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রকাশিত কুইল পত্রিকাটিও সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল। ইয়ং বেঙ্গল-এর লেখায় ইউরোপীয় ও ভারতবাসীর মধ্যেকার রাজনৈতিক বৈষম্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ পায়। ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মধ্যে সম্ভবত বেঙ্গল স্পেক্টেটর ছিল সর্বশেষ। ১৮৪২ সাল থেকে প্রকাশিত এ প্রগতিবাদী মাসিক পত্রিকাটি সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলির ওপর বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করে। এমনকি নারীশিক্ষা তথা হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বিষয়ক আলোচনাও এতে স্থান পায়। পত্রিকাটি শেষাবধি দৈনিকে রূপান্তরিত হয়।
হিন্দু ধর্মের ওপর আক্রমণের পাশাপাশি ইয়ং বেঙ্গল উপনিবেশিক সরকার সূচিত পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়াকেও জোরালোভাবে সমর্থন করে। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনকে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নিন্দা ও প্রশংসা দুই-ই ইয়ং বেঙ্গল-এর সদস্যরা পেয়েছিলেন। এদেশে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রচলনের পেছনে যে উদ্যোগ কাজ করে তাতে ইয়ং বেঙ্গল সরাসরি জড়িত ছিল। এ প্রয়াস থেকেই ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইয়ং বেঙ্গল শবব্যবচ্ছেদ বিষয়ে প্রচলিত সংস্কার ভেঙে ফেলার জন্য মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের উৎসাহিত করে। কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, ইয়ং বেঙ্গল-এর বিদ্রোহীরাই বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত। এ জাগরণে ইয়ং বেঙ্গল-এর অবদান সংশয়াতীত। ইয়ং বেঙ্গল ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের সমর্থক ছিল। কলকাতায় কতিপয় গণপাঠাগার স্থাপনের বিষয়টিকে তারা স্বাগত জানায়।
পাশ্চাত্যের প্রতি অন্ধ আনুগত্যই ছিল ইয়ং বেঙ্গল-এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। প্রাচ্য জীবনচর্চাকে তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করত। এ বিশ্বাস থেকে তারা পাশ্চাত্য রীতি-নীতি অভ্যাসকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে, যদিও এ-ক্ষেত্রে তারা সর্বাংশে সফল হতে পারে নি। সবচেয়ে বড় কথা, পাশ্চাত্য প্রীতির ফলে তারা এদেশের সাধারণ মানুষের চোখে, সর্বোপরি তাদের অভিভাবকদের চোখে ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়ে।
মুক্তচিন্তা ও নৈর্ব্যক্তিক জিজ্ঞাসার তাৎপর্য অনুধাবন করার মতো পরিপক্বতা ইয়ং বেঙ্গল-এর ছিল না। পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ জ্ঞান এবং প্রাচ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তারা বাংলার কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে হেয় প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে সমসাময়িক জীবনের অনেক ভঙ্গুর দিকের বিরুদ্ধে ধারালো যুক্তি প্রয়োগ করেও তারা শিক্ষিত বাঙালির সমর্থন আদায় করতে পারে নি। এ-কারণে তাদের ভাবাদর্শের অকাল মৃত্যু ঘটে। যে চেতনা ইয়ং বেঙ্গলকে অনুপ্রাণিত করেছিল তা শেষাবধি ক্ষণিক ও অগভীর প্রতীয়মান হয়; যত দ্রুত তার আবির্ভাব ঘটেছিল, ঠিক ততটাই দ্রুত তার পরিসমাপ্তি ঘটে। ঊনিশ শতকের শেষদিকে এসে ইয়ং বেঙ্গল সামাজিক গল্প-গুজবের বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয়। [সিরাজুল ইসলাম]