নিবর্তনমূলক আটক আইন
নিবর্তনমূলক আটক আইন নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক যেকোন ব্যক্তিকে কোনো অভিযোগ গঠন ব্যতীত ও বিনাবিচারে আটক রাখার বিশেষ আইন। আপাত দৃষ্টিতে এসব আইন প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মতোই। ফৌজদারি আইনে আটক রাখার যেসব বিধান রয়েছে, আটক আইন সাধারণত সেসব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়। নিবর্তনমূলক আটক আইনের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, এটি শুধুই আটক, কারাদন্ড নয়; দ্বিতীয়ত, এটি আদালত কর্তৃক বিচার বা তদন্ত ব্যতিরেকে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক আটক, এবং তৃতীয়ত, এটি নিবর্তনমূলক, কোনো দন্ড নয়। অর্থাৎ এ আইন হচ্ছে বিনা শাস্তিতে কাউকে আটক রাখার ক্ষমতা। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিক থেকেই ব্যবহারিক অর্থে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারণাটি প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় ব্রিটিশ আমলের কতিপয় অমীমাংসিত সমস্যা থেকে যায়, যেজন্য ভারত ও পাকিস্তান নিবর্তনমূলক আটক আইন বলবৎ রাখে। পাকিস্তান নিজ সংবিধান প্রণয়নের অনেক আগেই এ আইন বলবৎ করে। পাকিস্তানে গৃহীত নিবর্তনমূলক আটক আইনের অধিকাংশই বাংলাদেশ বহাল রাখে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলার রাজস্ব আদায়ের (দেওয়ানি) ক্ষমতা লাভের পর বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে তাদের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব বিস্তার থেকেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন সুনির্দিষ্টভাবে নিবর্তনমূলক আটক আইন হিসেবে বিবেচ্য না হলেও সেগুলি সরাসরি স্থানীয় জনগণের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছিল। প্রথমবারের মতো যেসব আইনে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল সেগুলি হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৭৮৪ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৭৯৩। বেঙ্গল স্টেট অফেন্সেস রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৮০৮ অনুযায়ী জারিকৃত সামরিক শাসন ১১৮ বছর বলবৎ ছিল। ১৯২২ সালে অপর একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। ফরেন ইমিগ্রেন্টস রেগুলেশন ১৮১২ আইনে শুধু বিদেশিদের আটকের বিধান থাকলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে বাংলায় বসবাসরত লোকদের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারিকৃত বেঙ্গল প্রিজনার্স রেগুলেশন ১৮১৮ আইনে নিবর্তনমূলক আটকের বিশেষ বিধান রাখা হয়েছিল। এটাই ছিল যথার্থ নিবর্তনমূলক আটক আইন যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি সীমিত নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষমতাসহ বিধিবদ্ধ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে প্রণীত ইন্ডিয়া অর্ডিন্যান্স ১৯১৪ এবং ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৫ অভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যাপকতর ক্ষমতা লাভ করে। তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমান দাবির প্রেক্ষিতে নৈরাজ্য ও বিদ্রোহ দমন আইন ১৯১৯ প্রণীত হলে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা সম্ভাব্য অপরাধ সঙ্ঘটন থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে সন্দেহভাজন যেকোন ব্যক্তিকে সীমিত সময়ের জন্য আটক রাখতে পারত।
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৯ এবং গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ ছিল নিবর্তনমূলক আটকের বিধানসহ অন্তর্বর্তীকালীন আইন। ১৯৩৫ সালের আইনটি ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল এবং পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৪৬ আইনেও নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল। প্রকৃতপক্ষে এ অধ্যাদেশই পরবর্তীকালে পাকিস্তানি আইনে পরিণত হয় ইস্ট বেঙ্গল টেম্পোরারি অ্যানেক্টমেন্ট অ্যান্ড রিঅ্যানেক্টমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯-এর মাধ্যমে এবং এতে নিবর্তনমূলক আটকের ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। এই অর্ডিন্যান্সের স্থলবর্তী হয় ১৯৪৯ সালের ইস্ট বেঙ্গল প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অর্ডিন্যান্স। ইতিমধ্যে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারাসহ পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯ পাস হয় এবং এতে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান রাখা হয়। এরপরেই নিবর্তনমূলক আটকের ব্যাপক ক্ষমতাসহ ইস্ট বেঙ্গল পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫১ জারি হয়। পরবর্তী সময়ে একই উদ্দেশ্যে জারি হয় সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্ট ১৯৫২। ১৯৫৩ সালে লাহোরে সামরিক আইন জারি হয় এবং ঘোষণাপত্রে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল। ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রেও নিবর্তনমূলক আটকের বিধান অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু এটা ছিল স্বল্পস্থায়ী, কারণ ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক প্রশাসন নিবর্তনমূলক আটকের বহু আদেশ জারি করে এবং একই উদ্দেশ্যে একই বিধান সংবলিত ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চালু ছিল, যদিও সংবিধানের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী এটি বাতিল বলে গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি বহাল ছিল।
পাকিস্তানে নিবর্তনমূলক আটকের বহু ধারা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার আটকের ব্যাপকতর ক্ষমতাসহ পাকিস্তান ডিফেন্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫ জারি করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্বভাবতই ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন জারি করেন যাতে নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক-রাজনৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক রেগুলেশন নং ৭৮ জারি করে যাতে ছিল নিবর্তনমূলক আটকের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে একই উদ্দেশ্যে জারি হয় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৭১।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটক আইনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধানও সংবিধানে ছিল না। কিন্তু সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধনী) অ্যাক্ট ১৯৭৩ মোতাবেক সংবিধানের ২৬ ও ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান চালু করা হয়। অধিকন্তু, জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে সংবিধানে একটি নতুন অংশ ৯এ সংযোজিত হয়। এ সময় সংবিধানের ৩য় অংশে বর্ণিত জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা যেত। কৌতূহলোদ্দীপক যে, তখনও যেকোন ব্যক্তিকে আটকের জন্য ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং বাংলাদেশ সিডিউল্ড অফেন্সেস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ স্বল্পকাল বলবৎ ছিল। বর্তমানে যে একটিমাত্র আইনে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারা রয়েছে সেটি হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪।
১৯৭৫-১৯৭৯ এবং ১৯৮২-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দুটি সামরিক শাসনকাল এবং ১৯৭৪-১৯৭৯, ১৯৮১, ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালের চারটি জরুরি অবস্থার সময়কালে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয় এবং হাজার হাজার লোক নিবর্তনমূলক আটক আইনের শিকার হয়। সংবিধানের তৃতীয় অংশে স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। ১৯৭৫-১৯৭৯ সালের বছরগুলিতে জরুরি অবস্থা, সামরিক আইন ও সাংবিধানিক বিধি একই সঙ্গে বলবৎ থাকে। ১৯৮২-৮৬ সালের সামরিক শাসন চলাকালে সংবিধান স্থগিত থাকে, তবে ১৯৮৫ সালে আংশিকভাবে এবং ১৯৮৬ সালে সম্পূর্ণভাবে সংবিধান পুনরায় কার্যকর হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবর্তনমূলক আটক আইনের আওতায় আটক লোকদের কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। তবে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে হেবিয়াস কর্পাস রিটের মাধ্যমে গৃহীত মামলার সংখ্যা থেকে আটক ব্যক্তিদের সংখ্যা নিরূপণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে হাইকোর্ট বিভাগের রিট বেঞ্চ ও ক্রিমিনাল মিসেইলিনিয়াস বেঞ্চের রেজিস্টার ও নথিপত্র, যাতে রিট পিটিশন দায়েরকালীন মামলা এবং মামলা শেষে বিচারকদের প্রদত্ত রায়ের আনুষঙ্গিক মন্তব্য লিপিবদ্ধ থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারার আওতায় হেবিয়াস কর্পাস রিটের মাধ্যমে হাইকোর্ট ডিভিশনে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের মোট সংখ্যা ২০,৫৭২। [কাজী রেজাউল হক]
গ্রন্থপঞ্জি T Patel, Personal Liberty Under the Constitution of India, Delhi, 1993; VG Ramachandran, Law of Writs, Lucknow, 1990. MI Patwari, Liberty of the People: Britain and Bangladesh, Dhaka, 1987; AC Banerjee, A Comprehensive History of India, Vol. 9 (1712-1772), London, 1978.