রেগুলেটিং অ্যাক্ট, ১৭৭৩

রেগুলেটিং অ্যাক্ট, ১৭৭৩  বাংলায়  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও দায়িত্বব সংজ্ঞায়িত করে বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রণীত প্রথম আইন। বাংলা জয়ের আগে এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিল। কোম্পানির শেয়ারের মালিকরা নিয়মিতভাবে আকর্ষণীয় মুনাফা লাভ করতেন। কিন্তু বাংলা জয়ের পর থেকে কোম্পানির বাণিজ্য ক্রমাগত লোকসানে চলছিল। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাতারাতি ধনী হওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলার সম্পদ লুটপাটে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে।  এই লুটপাটের কারণে ১৭৬৯/৭০ সালে যে বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তার ফলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থের সরকার উপলব্ধি করেন যে, কোম্পানি ও নববিজিত রাজ্যটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাপারে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে। এর সুযোগ আসে যখন ১৭৭৩ সালে কোম্পানির সনদ নবায়নের সময় আসে। কোম্পানি এ সময় সরকারের কাছে এক ‘ত্রাণ ঋণ’ প্রাপ্তির জন্য আবেদন জানায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঋণের জন্য এই আবেদন মঞ্জুর করে। তবে সেই সঙ্গে স্বদেশে ও বিদেশে কোম্পানির বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণমূলক এক আইনও চাপিয়ে দেয়। এই আইনে বেশ কয়েকটি জটিল বিধান সন্নিবেশিত করা হয়। কোম্পানির বাংলা রাজ্যের জন্য এসব বিধানে যেগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি নিম্নরূপ:

১.   বাংলায় ফোর্ট উইলিয়ম প্রেসিডেন্সি সরকারের জন্য একজন গভর্নর জেনারেল ও তাকে সাহায্য করার জন্য একটি কাউন্সিল থাকবে। কাউন্সিল চারজন কাউন্সিলর বা সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এই কাউন্সিলের পরামর্শক্রমে গভর্ণর জেনারেল দেশ পরিচালনা করতে বাধ্য থাকবেন। কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্ত মানা গভর্নর জেনারেলের জন্য বাধ্যতামূলক।

২.   ওয়ারেন হেস্টিংস হবেন প্রথম গভর্নর জেনারেল। আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন ক্লেভারিং, জর্জ মনসন, রিচার্ড বারওয়েল ও ফিলিপ ফ্রান্সিস হবেন গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের প্রথম চার সদস্য।

৩. কলকাতায় বৃটিশ নাগরিকদের বিচারকার্যের জন্য একটি সুপ্রিমকোর্ট স্থাপিত হবে।   একজন প্রধান বিচারপতি ও   তিনজন বিচারক দিয়ে গঠিত হবে এই সুপ্রিম কোর্ট। এর এখতিয়ারাধীন থাকবে বাংলায় নিবাসী সকল ব্রিটিশ নাগরিক ও কলকাতায় বসবাসকারী সকল দেশীয় প্রজা।

৪.   কোম্পানি এসব পদধারী ব্যক্তিদেরকে তার নিজস্ব আয় থেকে নিম্নবর্ণিত হারে বার্ষিক বেতন প্রদান করবে: গভর্নর জেনারেল পঁচিশ হাজার স্টার্লিং; কাউন্সিলরগণ প্রত্যেকে দশ হাজার স্টার্লিং; প্রধান বিচারপতি আট হাজার স্টার্লিং এবং অন্যান্য বিচারক প্রত্যেকে ছয় হাজার স্টার্লিং।

৫. গভর্নর জেনারেল, কাউন্সিলর ও বিচারকদের জন্য ভারতীয় রাজন্যবর্গ, জমিদার ও অন্যান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোন উপহার বা আর্থিক দান গ্রহণ নিষিদ্ধ।

৬. ভারতীয়দের কাছ থেকে বেসামরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যক্তি কোন উপহার, পুরস্কার ও কোন প্রকার আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না।

৭. কালেক্টর ও জেলার অন্যান্য কর্মকর্তাদের জন্য জমিদার ও অন্যান্য ব্যক্তির কাছ থেকে কোন উপহার, পুরস্কার অথবা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা অবৈধ।

দেখা যায়, কোম্পানি কর্মকর্তাদের অসদাচরণ ও দুর্নীতি দমনই ছিল এ আইনের বিধানগুলির লক্ষ্য। অবশ্য এ আইন দুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। সর্বোচ্চ গভর্নর জেনারেল থেকে শুরু করে নিম্নতম স্তর জেলা কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢালাওভাবে দুর্নীতি অব্যহত থাকে। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে যে অভিশংসনমূলক বিচার অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রধান অভিযোগগুলির মধ্যে দুর্নীতি ছিল অন্যতম। এই দুর্নীতি গভর্নরের কাউন্সিলকে দুটি পারস্পরিক বৈরী শিবিরে বিভক্ত করে। একটি ছিল হেস্টিংসপন্থী ও অন্যটি ফ্রান্সিসপন্থী। তাঁদের বিরোধ-সংঘাতের বিষয়বস্ত্ত ছিল এক তরফের বিরুদ্ধে অন্য তরফের দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি মোকাবেলার জন্য ১৭৮৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে আরও একটি আইন পাস করতে হয়। এই আইনের নাম পিটের ভারত আইন। এই আইনের আওতায়  লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]