ইংরেজি
ইংরেজি বাংলায় ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করার ব্যাপারটি শুরু হয় সতেরো শতকের ত্রিশের দশকে, প্রথমে বালাসোরে এবং পরে হুগলিতে ইংরেজ ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার পরে। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শুজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্যে যে ফরমান জারি করেন, তার মাধ্যমেই বাংলা তথা ভারতে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক আধিপত্যের সূচনা হয়; ইংরেজি ভাষা ব্যবহারেরও সূত্রপাত ঘটে তখনই। ব্রিটিশ রাজত্বের মতো ইংরেজি এখন আর সরকারি ভাষা নয়, তবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার দেশে ও বিদেশে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে একে শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাঠ্যবিষয় হিসেবে ইংরেজি এখন অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখানো হয় এবং প্রায় সকল পাবলিক পরীক্ষায় এটি একটি আবশ্যিক বিষয়। বহু ইংরেজি শব্দও বাংলা শব্দভান্ডারে যুক্ত হয়েছে।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মেকলের বিখ্যাত Minute-এ প্রথম ভারতে পাশ্চাত্য বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের সুপারিশসহ ইংরেজি ব্যবহারের প্রতি সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে লর্ড বেন্টিঙ্কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়। অবশ্য, এর আগেই ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যে প্রথম যোগাযোগের সময় থেকে বাংলায় ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় ইংরেজ প্রতিনিধি ও দেশিয় সহযোগী বানিয়াদের মধ্যে বাণিজ্যিক ভাষা হিসেবে।
বাংলায় ইংরেজি ভাষার প্রথম যে রূপটি প্রচলিত ছিল তা ছিল মিশ্র-অশুদ্ধ। বানিয়াদের অনেকেই ছিল বহুভাষী এবং আঠারো শতকের শুরুতে তারা মোটামুটি শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারত। বানিয়ারা ছাড়াও স্থানীয় যে-সকল ব্যক্তি ব্যাকরণ রচনা, অনুবাদ ইত্যাদি কাজে ইংরেজদের সহায়তা করত, তাদেরও ভালো ইংরেজি-জ্ঞান ছিল। যেমন ব্রিটিশদের সঙ্গে পূর্ব-যোগাযোগের ফলে রামরাম বসু যে ইংরেজি-জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তার সাহায্যেই তিনি উইলিয়ম কেরীকে অনুবাদকর্মে সাহায্য করতে পেরেছিলেন।
যথেষ্ট ইংরেজি জ্ঞানসম্পন্ন অপর এক অনুবাদক ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অনুবাদক হিসেবে Calcutta Journal-এ যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে পুরাণ অনুবাদে উইলসনকে (এইচ উইলসন) সাহায্য করেন। পরে তিনি English-Bengali Dictionary (১৮৩২) সংকলন করেন এবং বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদসহ মূল সংস্কৃত ভাষায় মনুসংহিতার (১৮৩২) একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন।
ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে ইংরেজি শিখেছিলেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। ব্যতিক্রমধর্মী রামমোহন গ্রামের বাড়িতে বাংলা, পাটনায় ফারসি ও আরবি এবং বেনারসে সংস্কৃত শিখে একজন ভাষাবিদের মর্যাদা লাভ করেন। বাইশ বছর বয়সে তিনি ইংরেজি শেখা শুরু করেন এবং John Digby-র সাহচর্যে এ বিষয়ে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। ডিগবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত তিনি তাঁর দীউয়ান হিসেবে কাজ করেন। তিনি ইংরেজিতে ৪৭টি গ্রন্থ, নিবন্ধ ও পত্র লেখার মতো যথেষ্ট ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন; ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনি ইংরেজি ভাষায় সাক্ষ্য দেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি-শিক্ষা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং ব্যক্তিগত প্রয়াস ও পরিস্থিতিভিত্তিক; পরে বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার প্রসার ঘটে। সতেরো শতকে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল প্রধানত ইউরোপীয় শিশুদের শিক্ষার জন্য। ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে সোসাইটি ফর প্রোমোটিং ক্রিশ্চিয়ান নলেজ কর্তৃক কলকাতায় প্রথম সর্বজনীন ইংরেজি শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে Rev. Kiernander ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আর একটি ইংরেজি স্কুল; বছর শেষে এর ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হয় ১৭৪। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রী স্কুল সোসাইটি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কলকাতা ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। পর্যায়ক্রমে মিশনারি স্কুলসমূহের পাশাপাশি কলকাতা ও তার আশেপাশে আরও অনেক ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য বাণিজ্যিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলগুলি ছিল মিশনারি স্কুলগুলি থেকে ভিন্ন ধরনের। ব্রিটিশ গোমস্তাদের অধীনে চাকরি প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় হিসাববিদ্যা ও বুককিপিং ছাড়াও ইংরেজি পড়া ও লেখার প্রশিক্ষণ দিত এ স্কুলগুলি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভকারী আঠারো ও উনিশ শতকের বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে ছিলেন রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭) এবং হেনরি ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)। এঁরা দুজন যথাক্রমে Mr. Cummings পরিচালিত ক্যালকাটা একাডেমি এবং David Drummond পরিচালিত ধর্মতলা একাডেমির ছাত্র ছিলেন।
ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষাসমূহে উন্নতমানের পাঠ্য বই সরবরাহ করার জন্য ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা স্কুল সোসাইটি, পুরনো স্কুলগুলির উন্নয়নে সাহায্য করা এবং প্রয়োজনে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল কলকাতা এবং অন্যত্র ইংরেজিসহ শিক্ষার উচ্চতর শাখা প্রতিষ্ঠা করা।
সে সময় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে কলকাতার হিন্দু কলেজ (পরবর্তীকালে পৈণ্ঠসিডন্সি কলেজ)। এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় রামমোহনের ভূমিকা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে কিরূপ মতবিরোধ ছিল। সে সঙ্গে নিজের অবস্থানের পক্ষে রামমোহনের লেখালেখি থেকে ইংরেজির ওপর তাঁর দখল সম্পর্কেও জানা যায়। রামমোহন বিশ্বাস করতেন যে, ঔপনিবেশিক কাঠামোতে সংস্কৃত শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষকে পিছিয়ে রাখবে এবং একমাত্র ইংরেজির মাধ্যমেই ভারতীয়রা লাভজনক শিক্ষা পেতে পারে।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ শুধু উনিশ শতকের বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানই রাখেনি, বরং এর ছাত্রদেরকে দিয়েছে ইংরেজি ভাষার ওপর ঈর্ষণীয় দখল এবং সৃষ্টি করেছে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। এখানে চিরায়ত ও আধুনিক ভারতীয় ভাষা ব্যতীত অন্য সকল বিষয়ের জন্যই ইংরেজি ছিল শিক্ষার মাধ্যম। হিন্দু কলেজের ইংরেজি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল শেকসপীয়রের নাটক, বেকন, এডিসন ও গোল্ডস্মিথের প্রবন্ধ, মিল্টনের কাব্য, জনসনের র্যাম্বলার ও রাসেলাস। সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। হিন্দু কলেজের জনপ্রিয়তার ফলে কলকাতায় আরও ৯টি এবং ঢাকায় ১টি অনুরূপ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন কলেজে যা পড়ানো হতো তার চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডিরোজিও কর্তৃক প্রবর্তিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যা ছাত্রদের যুক্তিপ্রয়োগ ও বক্তৃতা প্রদানে দক্ষ করে তুলত। ইংরেজি ভাষায় যে দক্ষতা নিয়ে ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করত, তা ছিল অসাধারণ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওর বিরুদ্ধে তাঁর অনুসারী ছাত্রদের বিনষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার অভিযোগ আনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। এর পূর্বেই তিনি একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্র গঠন করেন এবং Parthenon নামে একটি জার্নাল প্রকাশে ছাত্রদের উৎসাহিত করেন।
উনিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক ধরে অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে যে বিরোধ চলছিল, মেকলের Minute এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি স্কুলগুলি থেকে পাস করা ছাত্রদের চাকরিতে নিয়োগ করার পক্ষে স্যার হেনরি হার্ডিঞ্জের সিদ্ধান্তের ফলে তার অবসান ঘটে। হার্ডিঞ্জের ১৮৪৪ সালের ১০ অক্টোবরের প্রস্তাবে বলা হয় যে, বৈষয়িক দিক থেকে ইংরেজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হয়ে উঠেছে। হার্ডিঞ্জের এ প্রস্তাব ইংরেজির গুরুত্ব এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে, এটি তখন উচ্চতর পদে নিয়োগ প্রাপ্তির ছাড়পত্র হয়ে ওঠে। এর ফলে ইংরেজি শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং কলকাতায় এমন একটি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গড়ে ওঠে যারা ইংরেজিতে অধ্যয়ন করত এবং ইংরেজিতে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাত। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও ধীরে ধীরে তারাও ইংরেজির গুরুত্ব উপলব্ধি করে। ১৮২৬ সালে কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি ভাষার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাদের সে চেতনা প্রতিফলিত হয়।
সাহিত্যবিষয়ক সংসদ ও সমিতিসমূহের প্রতিষ্ঠাও ইংরেজি চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সমিতিগুলির সভায় আলোচিত বিষয় বা আদর্শসমূহ প্রায়শই ছিল পাশ্চাত্য সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত এবং সেগুলি ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত হতো। এভাবেই ১৮৩৮ সালে তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানানুশীলন সমিতি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি, ক্যালকাটা লিটারেরি সোসাইটি সবই এ অঞ্চলে ইংরেজি চর্চার উন্নয়নে অবদান রাখে। এ সোসাইটিগুলিতে পঠিত রচনাসমূহ শুধু লেখকদের পান্ডিত্যই প্রমাণ করত না, ইংরেজি ভাষায় তাদের দখল, বিশেষত তখনকার ইংরেজি ভাষার উৎকর্ষচিহ্ন periodic বাক্যের ওপরও তাদের দখল প্রকাশ করত।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উচ্চতর শিক্ষার ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রতিষ্ঠাকল্পে গৃহীত হয়েছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাসমূহের একটি। চালর্স উডের এডুকেশনাল ডিসপ্যাচ (১৮৫৪) প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করে; একই সঙ্গে গ্রান্টস্-ইন-এইড ব্যবস্থার মাধ্যমে হাইস্কুল ও কলেজসমূহের উন্নয়নেও উৎসাহ জোগায়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনটি প্রেসিডেন্সি শহরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ। এ ডিসপ্যাচে বলা হয় যে, নিম্নস্তরে শিক্ষাদানের ভাষা হবে স্ব-স্ব মাতৃভাষা, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে হবে ইংরেজি। এ কর্মসূচির আওতায় ১৮৫৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্য দুটি মাদ্রাজ ও মুম্বাইতে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ শিক্ষার উচ্চতর স্তরগুলিতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে পরিণত হয়। যেহেতু উচ্চশিক্ষালাভে আগ্রহী সকলকে ইংরেজি জানতে হতো, সেহেতু স্কুল পর্যায়েও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
বিভিন্ন ইংরেজি জার্নাল ইংরেজি ভাষার প্রসারে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বাঙালি লেখকরা এসব জার্নালে লেখা প্রকাশসহ নিজেরাও একাধিক জার্নাল প্রকাশ শুরু করে। বাংলাদেশে প্রথম খবরের কাগজ হলো ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেমস হিকি প্রকাশিত বেঙ্গল গেজেট, যা হিকির গেজেট নামেই অধিকতর পরিচিত। বেঙ্গল গেজেট স্থায়ী হয় মাত্র তিন বছর; এরপর প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়া গেজেট (১৭৮০), ক্যালকাটা গেজেট (১৭৮৪), বেঙ্গল জার্নাল (১৭৮৫), ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন অর ক্যালকাটা এমিউজমেন্ট (১৭৮৬) এবং ক্যালকাটা ক্রনিকল (১৭৮৬)।
বাংলায় ইংরেজি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভারতীয়দের দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকাগুলি, যেমন রামগোপাল ঘোষের বেঙ্গল স্পেক্টেটর, যা ছিল এডিসন ও স্টীলির সুপরিচিত পত্রিকার প্রতিধ্বনিস্বরূপ এবং তারাচাঁদ চক্রবর্তীর কুইল। রামমোহন রায়ের স্বত্বাধিকারে কয়েক মাস প্রকাশিত হয় বেঙ্গল হেরাল্ড (১৮২৯); এ থেকেও ইংরেজি সাংবাদিকতায় ভারতীয়দের আগ্রহ প্রকাশ পায়। কেশবচন্দ্র সেন কয়েকটি সাময়িকীর প্রকাশনা শুরু করেন: দ্য সানডে মিশন, দ্য লিবারেল এবং দ্য নিউ ডিসপেনসেশন।
ইংরেজি তখন শুধু দৈনন্দিন ভাব বিনিময়ের ভাষাই ছিল না, এতে কতিপয় ভারতীয়ের সাহিত্যচর্চার প্রত্যাশাও ঘনীভূত ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো যাঁরা রাজনৈতিকভাবে ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চার আকাঙ্ক্ষা ছিল। এক্ষেত্রে ঢাকার নবাব শামসুদ্দৌল্লাহ্র (১৭৭০-১৮৩১) ঘটনাটি খুবই কৌতূহলপূর্ণ। তিনি বাংলা থেকে ব্রিটিশকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও তাঁর সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি রাজদ্রোহের অভিযোগে কারারুদ্ধ হন। অথচ জেলে তাঁকে দেখতে গিয়ে উইলিয়ম হিকি লক্ষ করেন, নবাব ইংরেজিতে কিছু একটা লিখছেন। কি লিখছেন জানতে চাইলে নবাব জানান যে, তিনি শেকসপীয়রীয় সনেট লিখছেন। স্মৃতিকথায় হিকি লিখেছেন, নবাব ব্যাকরণসম্মত ইংরেজি লিখছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর বিশপ হেবার (১৭৮৩-১৮২৬) নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরে তিনি তাঁর ন্যারেটিভ অব এ জার্নি (১৮২৭) গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, নবাব ভালো ইংরেজি বলতেন এবং তাঁর সাহিত্যিক দক্ষতাও ছিল।
শামসউদ্দৌল্লাহ্র এ প্রয়াস ছিল ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্র ঘটনামাত্র, কিন্তু ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অন্যদের প্রয়াস বাংলার সাহিত্য-ইতিহাসের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়। এগুলি যদিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়ে অধিক কিছু ছিল না, কিন্তু পরীক্ষকরা এর মাধ্যমে যে সাহিত্যিক দক্ষতা অর্জন করেন তা তাঁরা বাংলা রচনায় প্রয়োগ করেন। ওই সময়কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি লেখকদের দুজন হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্র উভয়ই ছিলেন উদীয়মান বুদ্ধিজীবী ও সম্পন্ন বাঙালি মধ্যবিত্তের অংশ, যাঁরা ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে লাভবান হয়েছিলেন। ডিরোজিও বিদায় নেওয়ার পর ১৮৩৩ সালে মধুসূদন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সুতরাং, তাঁর ওপর ডিরোজিওর প্রভাব ছিল পরোক্ষ, তবে তখনও হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মুক্তচিন্তার ধারা এবং ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা অব্যাহত ছিল।
মধুসূদন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘মাইকেল’ নাম গ্রহণ করেন এবং ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ চলে যান। সেখানে মাদ্রাজ ক্রনিকল্-এ তাঁর দ্য ক্যাপটিভ লেডি কাব্যটি প্রকাশিত হয়। ভারতীয় কাহিনীনির্ভর এ কাব্যটি লিখতে গিয়ে তিনি ইংরেজি ভাষা ও ব্যালাডের আঙ্গিক ব্যবহার করেন। অবশ্য এ ইংরেজি কাব্যটির মাধ্যমে নয়, মধুসূদন খ্যাতি অর্জন করেন তাঁর বাংলা মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) এবং বাংলা সনেটের জন্য। পরবর্তীকালে তিনি ইংরেজি বর্জন করে বাংলা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর ইংরেজি শিক্ষা তাঁকে গভীরভাবে সাহায্য করে। তাঁর সনেট এবং মহাকাব্য ইংরেজির আদর্শে রচিত। যদিও মধুসূদন আধুনিক বাংলা ভাষার পুরোধাদের অন্যতম ছিলেন, তথাপি ইংল্যান্ডের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে তিনি কখনও বিসর্জন দিতে পারেননি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘I long for Albion’s shore’ কবিতায়।
বাংলা উপন্যাসের প্রথম সফল স্রষ্টাদের অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্রও ইংরেজি উপন্যাস রচনার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাঁর দুটি ইংরেজি উপন্যাস হলো: The Adventures of a Young Hindu এবং Rajmohan’s Wife. যদিও এ গ্রন্থদুটি কিংবা তাঁর প্রথম দিককার বাংলা রচনাগুলি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি, কিন্তু তাঁর ইংরেজি, বিশেষত, ওয়াল্টার স্কটের রোমান্সমূলক রচনার পঠনপাঠন তাঁর পরবর্তীকালের উপন্যাস রচনায়, কখনও কখনও সেগুলির কাঠামো নির্মাণে প্রেরণা জোগায় এবং ওই উপন্যাসগুলি তাঁকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। মধুসূদনের মতো বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর উপন্যাসের জন্য ভারতীয় প্রসঙ্গ গ্রহণ করেন; তবে ভারতীয় পুরাকাহিনীগুলি তাঁকে যতটা না উদ্বুদ্ধ করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে বর্তমান ও নিকট অতীতের বাংলা ও তার মানুষের প্রকৃতি ও বাস্তব অবস্থা। অবশ্য, যদিও তিনি তাঁর উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্রসমূহ জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ও মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেন, কিন্তু চরিত্রসৃষ্টি ও বর্ণনক্ষমতা অর্জনে তাঁকে সাহায্য করে তাঁর ইংরেজি পঠনপাঠন।
মধুসূদন কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনায় কম খ্যাতিমান হলেও লালবিহারি দে রেভারেন্ড (১৮২৪-১৮৯৪) ছিলেন একজন স্বীকৃত লোকসংস্কৃতিবিদ, যাঁর ইংরেজি রচনা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। লালবিহারী দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর পিতা রাধাকান্ত ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন; তাই পুত্রকে তিনি আলেকজান্ডার ডাফের অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। মধুসূদনের মতো লালবিহারীও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য, তিনি গীর্জার কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্ধমানে কর্মরত থাকাকালে লালবিহারী গ্রামীণ বাংলার জীবনকে নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং Bengal Peasant Life (১৮৭৪) গ্রন্থে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। লোকাচারবিদ হিসেবে লালবিহারীর খ্যাতি যেসব লোককাহিনীর ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলি তিনি বর্ধমানেই সংগ্রহ করেন; পরবর্তীকালে সেগুলি Folk Tales of Bengal (১৮৭৫) নামে প্রকাশিত হয়।
তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭) তাঁর বোন অরু দত্তের সঙ্গে একযোগে ইংল্যান্ডে শিক্ষালাভ করেন এবং ইংরেজি ও ফরাসি দু ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করেন। বোন অরু যখন যক্ষ্মায় মারা যান তখন তরু ১৬৫টি ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ A Sheaf Gleaned in French Fields নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। এর মধ্যে আটটি কবিতা অনুবাদ করেন তাঁর বোন এবং বাকিগুলি তরু নিজে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড উভয় দেশেই সংকলনটির প্রশংসামূলক সমালোচনা প্রকাশিত হয়। তরু ভারতে ফিরে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়, বিশেষত, Bengal Magazine-এ কবিতা-প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। মৃত্যুকালে তরু ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় লেখা কয়েকটি পান্ডুলিপি রেখে যান। তাঁর মুত্যুর পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হয় Ancient Ballads and Legends of Hinduism গ্রন্থটি। তরু খুব অল্প বয়সে মারা যান, কিন্তু তাঁর এবং সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের রচনাগুলি বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন মূলত বাংলা ভাষার লেখক, কিন্তু তিনি চমৎকার ইংরেজি লিখতেন। তাঁর নিজের করা গীতাঞ্জলির (১৯১২) ইংরেজি অনুবাদ পশ্চিমা বিশ্বে তাঁকে সুপরিচিত করে তোলে এবং ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। তিনি তাঁর অন্য অনেক রচনারও ইংরেজি অনুবাদ করেন, যেমন: The Gardener (১৯১৩), Fruit-gathering (১৯১৬), Fugitives (১৯২১) এবং The Crescent Moon. তাঁর কিছু ইংরেজি গদ্যরচনাও আছে, যেমন: Personality এবং The Religion of Man (১৯৩২)।
উনিশ শতকের তৃতীয় দশক নাগাদ মাদ্রাসা শিক্ষায় ইংরেজি প্রবর্তিত হয়। তখন ইংরেজির প্রতি বিরোধিতা এতো প্রবল ছিল যে ছাত্ররা ইংরেজি ক্লাস বর্জন করত। কিন্তু নবাব আবদুল লতীফের (১৮২৮-১৮৯৩) মতো কতিপয় বাঙালি মুসলমান ইংরেজির গুরুত্ব অনুভব করেন। কলকাতা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজি ছাড়া জীবনে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি মাদ্রাসায় নিয়মিত ইংরেজি ক্লাস করে এ ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর মুসলমান সঙ্গীদের বোঝাতেন যে, নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে হলে ইংরেজি জানা একান্ত আবশ্যক। এ লক্ষ্যে তিনি একটি রচনা প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন, যার বিষয়বস্ত্ত ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা করে মুসলমান ছাত্ররা কি সুফল পেতে পারে। আবদুল লতীফ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের (১৮৬৩) কার্যবিবরণী ইংরেজিতে লেখা হতো।
সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) অপর এক মুসলিম ব্যক্তিত্ব, যিনি ইংরেজির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। আবদুল লতীফের মতো তিনিও ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র; কলেজে পড়ার আগে তিনি হুগলি মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আমীর আলী বিশ্বাস করতেন যে, মুসলমানদের পুনর্জাগরণ সম্ভব হবে যদি তারা অতীত গৌরব স্মরণ করে। তদনুযায়ী তিনি বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে তাদের অতীত স্মরণ করানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই ক্ল্যাসিকসে পরিণত হয়। সেগুলির মধ্যে প্রধান দুটি হলো: The Spirit of Islam (১৮৯১) এবং A Short History of the Saracens (১৮৯৮)।
উনিশ শতকের শুরুতে মুসলমান বাঙালিরা যখন ইংরেজি শিক্ষা শুরু করে, তখন মুসলিম বাঙালি নারীদের জন্য ইংরেজি এমনকি বাংলাজ্ঞানও ছিল নিষিদ্ধ। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) জীবনী থেকে জানা যায় তখন মুসলিম বাঙালি নারীরা কীভাবে ভাষা শিখেছিলেন। একজন গৃহশিক্ষকের নিকট থেকে রোকেয়া আরবি, ফারসি ও উর্দু শেখেন; আর বাংলা ও ইংরেজি শেখেন প্রথমে ভাই এবং পরে স্বামীর সাহায্যে নিজ চেষ্টায়। Sultana’s Dream (১৯০৮) লেখার মতো যথেষ্ট ভালো ইংরেজি তিনি জানতেন; পরবর্তীকালে তিনি নিজেই গল্পটি বাংলায় তর্জমা করেন। নারীশাসিত একটি কল্পরাজ্য-বিষয়ক রচনা Sultana’s Dream এখনও একটি সুখপাঠ্য গল্প এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নারীবাদী কল্পনা ও স্বচ্ছন্দ ইংরেজির জন্য তা যথেষ্ট আদরণীয়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে উৎকৃষ্ট ইংরেজি রচনার অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক; সৃজনশীল রচনা খুব কম ছিল। যদিও ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা, কিন্তু তখন ইংরেজি শিক্ষার মান যথেষ্ট উন্নত ছিল। এ.কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) উভয়ই ইংরেজিতে দক্ষ ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে তাঁর বোন শায়েস্তা ইকরামুল্লাহর মতো ইংরেজিতে স্মৃতিকথা লেখেন। তাঁর ভাই হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্মৃতিকথা ছাড়াও ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। যদিও ফজলুল হকের মতো সোহরাওয়ার্দীর পরিবারও সম্পদশালী ছিল, কিন্তু সে সময় সাধারণ পরিবারের কোনো শিক্ষিত ব্যক্তিও ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারতেন। এভাবেই তমিজুদ্দীন খান (১৮৮৯-১৯৬৩) একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়েও জায়গির থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করতে সমর্থ হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী লেখেন। অসম্পূর্ণ হলেও এর ভাষা স্বচ্ছন্দ এবং তা সে সময়কার শিক্ষিত ব্যক্তিদের ইংরেজির মানকে তুলে ধরে।
বাংলার অন্য যে লেখকরা ইংরেজিতে লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে নীরদচন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) উল্লেখযোগ্য। নানা বিতর্ক থাকলেও বিশ শতকের প্রথম দিককার ব্রিটিশ শাসনাধীন গ্রামীণ বাংলার বিবরণসম্বলিত তাঁর The Autobiography of an Unknown Indian (১৯৫১) গ্রন্থটি একটি ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়েছে। A Passage to England, Thy Hand এবং Great Anarch তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি-শিক্ষা শুরু হয় ১৮৫৮ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সকল ডিগ্রি কলেজে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষা পূর্ব বাংলায় সহজতর হয়। তখন ভাষাবিভাগগুলি ছাড়া অন্যসব বিভাগে শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল ইংরেজি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু হওয়া ১২টি বিভাগের মধ্যে ইংরেজি ছিল একটি।
এখানে মাঝে মধ্যেই ইংরেজিতে শিক্ষামূলক প্রবন্ধ পঠিত হতো এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো। ইংরেজিতে সৃষ্টিশীল রচনা ছাড়াও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ শুধু ইংরেজিতেই লিখতেন। গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক প্রকাশিত উচ্চমানসম্পন্ন সাময়িকীসমূহও ছিল ইংরেজিতে লিখিত। আইনের ভাষা, আদালতের কার্যবিবরণী ও বিচারের ভাষা সবই ছিল ইংরেজি। বিপুল সংখ্যক সাধারণ বিদ্যালয় এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানও ইংরেজি মাধ্যমে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করত। এ সবকিছু এবং ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিদায়কালে ইংরেজিতে প্রকাশিত ব্যাপক সংখ্যক সংবাদপত্র ও সাময়িকী নির্দেশ করে যে, বাংলার জনগণ প্রায় সম্পূর্ণরূপেই ইংরেজিকে তাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ইংরেজি তার প্রাধান্য হারাতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাংলাকে সকল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম করতে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে। এ মানসিকতা বর্তমানেও ক্রিয়াশীল। তবে বর্তমানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিরও পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকহারে ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯৯২’ পাস হওয়ার পর থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে যেখানে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। বর্তমানে সকল ডিগ্রি কলেজ ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে বাধ্যতামূলক একটি ইংরেজি কোর্স চালু হয়েছে। [নিয়াজ জামান]
গ্রন্থপঞ্জি Surendra Prasad Sinha, English in India: A Historical Study with Particular Reference to English Education in India, জানকী প্রকাশনী, পাটনা, ১৯৭৮।