চুঁচুড়া

চুঁচুড়া  পশ্চিম বাংলায় হুগলি জেলার ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছোট একটি শহর। শহরটি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হুগলি-চুঁচুড়া পৌরসভার একটি অংশবিশেষ।

কথিত আছে যে, এ অঞ্চল চিঁচড়া জাতীয় বেতগাছের জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং সেখান থেকেই এ শহরের নাম হয়েছে চুঁচুড়া। ষোল শতকের কুলিহান্ডা নামের ছোট্ট এ গ্রামটি সাতগাঁও সরকার-এর অধীন আরসাহ পরগনায় অবস্থিত ছিল। পরে এটি ধরমপুর ও কুলিহান্ডা নামে দুটি জনপদে পরিণত হয়। ধরমপুর ষোল শতকের ধর্মরাজ মন্দির এবং মহিষমর্দিনী মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ ‘চিনসুরা’ বা চুঁচুড়া এলাকা উত্তর চন্দননগরের তুলাপটিঘাট থেকে ধরমপুর ও বালিমোড়ের দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত।

মুগল কর্তৃক  পর্তুগিজদের বিতাড়নের পর ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা হুগলিতে আসে। তারা ১৬৩৮, ১৬৫০ ও ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাটদের কাছ থেকে চুঁচুড়ায় বাণিজ্য করার ‘ফরমান’ বা হুকুমনামা লাভ করে। ওলন্দাজ নৌ-সেনাপতি ভ্যান ডার ব্রাক (Van Der Broucke) ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় কুঠি স্থাপন করেন এবং বাটাভিয়াস্থ ওলন্দাজ ডাইরেক্টরেটের প্রথম গভর্নর হন।

পরবর্তী ৫৭ বছরে  ওলন্দাজরা বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি লাভ করে এবং চুঁচুড়া শহরের পত্তন করে। তারা আফিম, সোরা, কাঁচা রেশম, রেশমজাত দ্রব্য, সুতা ও সুতিবস্ত্র, চাল, চিনি, মাখন, শাক-সব্জি প্রভৃতির ব্যবসা করত। এ সকল পণ্যসামগ্রীর অধিকাংশই সংগৃহীত হতো পাটনা, মালদহ,  কাসিমবাজার, মল্লিক কাসিম হাট বা হুগলি বাজার থেকে। নিজেদের চাষ-আবাদ থেকে সংগৃহীত হতো বাকি সামগ্রী। নদী তীরবর্তী কুঠি ও দুর্গের মধ্যে তারা বসবাসযোগ্য সুরম্য অট্টালিকা, বাগান, অফিস ভবন, গুদাম ও উদ্যান নির্মাণ করেছিল। সাঁপনাদ উদ্যানটি বহু বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে। পাকা সড়ক, ভূর্গভস্থ পয়ঃপ্রণালী ও পানীয় জলের সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ থাকায় নাগরিক সুখসুবিধা ছিল আরামদায়ক। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত গুস্টেভাস দুর্গ দ্বারা শহরটি সুরক্ষিত ছিল। শাসনব্যবস্থা একজন গভর্নর এবং তাঁর সদস্য-মন্ডলী দ্বারা পরিচালিত হতো। দেশি ও বিদেশিদের জন্য পৃথক আদালত ছিল। শহরে একজন সভাপতি, একজন কোষাধ্যক্ষ এবং রাজস্ব আদায়, টোল-ট্যাক্স, আবওয়াব ও নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য কয়েকটি বিভাগ ছিল। ওলন্দাজরা স্থানীয় লোকজন ও প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখত। এমনকি তারা বাঙালি মহিলাও বিয়ে করত।

পলাশী যুদ্ধের সময় ওলন্দাজগণের নিরপেক্ষতা নওয়াব ও  ইংরেজ এ দুপক্ষেরই অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। তাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ব্রিটিশদের ঈর্ষার কারণ হয়। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে বিদেরার যুদ্ধে পরাজয়ের পর ওলন্দাজরা ইংরেজদের অধীন হয়ে পড়ে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তারা বাংলার বাণিজ্যে ব্রিটিশদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেয়। ইংরেজরা ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই চুঁচুড়া অধিকার করে এবং ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর ওলন্দাজদের কাছে এটি প্রত্যার্পণ করে। এরপর থেকে ওলন্দাজরা তাদের সমস্ত উদ্যেগ ব্যবসা-বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। এমনকি তাদের রাজস্বের প্রধান উৎস যে জমি, তার প্রতিও তাদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তবে তারা ‘আবওয়াব’ ও অন্যান্য কর আদায় করত। ওলন্দাজ কর্মচারীরা এতই অসাধু ছিল যে, ব্যবসার লভ্যাংশ অসদুপায়ে নিজেরা নেওয়ায় কোম্পানির ক্ষতি হতে থাকে। ফলে, হল্যান্ডরাজ ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে হতাশ হয়ে চুঁচুড়া এবং আরও কয়েকটি জায়গা, সুমাত্রা দ্বীপ ও মার্ব্লো দুর্গের সঙ্গে বিনিময় করেন। এভাবেই বাংলায় ওলন্দাজ যুগের অবসান ঘটে।

১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১০০০ সামরিক ব্যক্তির বসবাসের জন্য ইংরেজরা গুস্টাভাস দুর্গ ধ্বংস করে একটি বিরাট দ্বিতল সৈন্যাবাস তৈরি করেন। ওলন্দাজ গভর্নর সিক্টারম্যানের (Sichterman) সন্নিকটস্থ দ্বিতল বাড়িটি এখন বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। চুঁচুড়া ময়দান (কুঠির মাঠ) ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজ সৈন্যদের কুচকাওয়াজের মাঠ হিসেবে ব্যবহূত হতো। কমিশনারের বাড়ির বিপরীতে রয়েছে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জি. ভার্নেট কর্তৃক নির্মিত ওলন্দাজ গির্জা। গোরস্থান রোডের পুরাতন কবরস্থানটি মূলত ওলন্দাজদেরই কবরস্থান।

চুঁচুড়ার কতকগুলি প্রাচীন স্থান যেমন মুগলটুলি, আর্মেনিটোলা, ফিরিঙ্গিটোলা, যুগীপাড়া, কাজীপাড়া, সোনাটুলি (স্বর্ণকার-অধ্যুষিত), বাবুগঞ্জ, সাহাগঞ্জ, কলুপাড়া, কামারপাড়া ইত্যাদির প্রথম তিনটি মুগল, আর্মেনিয়ান ও ইউরোপীয়দের বসতির আভাস বহন করে। অন্যগুলি বিভিন্ন পেশাজীবীদের আবাসস্থল নির্দেশ করে। নেতাজী সুভাষ রোডের কাছে খাড়ূয়াবাজারে অবস্থিত দয়াময়ী মন্দির প্রায় চারশ বছরের পুরানো। মিস্টার ব্রাম নামক এক ওলন্দাজ গভর্নর ষন্ডেশ্বরের দেবমূর্তিকে দুটি পিতলের ঢাক উপহার দেন। খাজা যোশেফ মার্জার ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিটোলায় আর্মেনিয়ান গির্জা, ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মিসেস সিবাস্টিয়ান রোমান ক্যাথলিক চার্চ, ও ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে হাজী মুহম্মদ মোহসীন মুগলটুলিতে ইমামবারা নির্মাণ করেন। নওয়াব খাজা খাঁর জ্ঞাতি ভাই নাসারাতউল্লা খাঁ ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। চন্দ্রশেখর শীলের ঠাকুর বাড়িটি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়।

যশস্বী সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায় চুঁচুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনের প্রথম কয়েক বছর এখানেই কাটিয়েছিলেন। উইলিয়ম কেরীর লিপিকার রামরাম বসু চুঁচুড়ায় বাস করতেন। বিপ্লবী নেতা জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, গৌরহরি সোম ও সাগর হাজরাও চুঁচুড়ার সন্তান।  [প্রফুল্ল চক্রবর্তী]