মোহসীন, হাজী মুহম্মদ

মোহসীন, হাজী মুহম্মদ (১৭৩২-১৮১২)  একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম, চিরকুমার ও মহান জনহিতৈষী ব্যক্তি। ১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ের মহাদুর্ভিক্ষে তিনি বহু লঙ্গরখানা স্থাপন করেছিলেন এবং সরকারি সাহায্য তহবিলে অর্থ প্রদান করেছিলেন। ১৭৩২ সালে হুগলিতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা হাজী ফয়জুল্লাহ এবং মাতা জয়নাব খানম। এটি ছিল জয়নাবের দ্বিতীয় বিবাহ। তাঁর প্রথম স্বামী আগা মোতাহার ছিলেন একজন ইরানি ব্যবসায়ী। তিনি হুগলিতে বসতি স্থাপন করেন এবং হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় বিস্তীর্ণ জায়গির লাভ করেন। তিনি তাঁর বিপুল সম্পত্তি তাঁর একমাত্র কন্যা মন্নুজান খানম-এর নামে উইল করে যান। ফয়জুল্লাহর পিতাও  ছিলেন একজন ইরানি এবং জায়গিরদার।

মোহসীনের জন্ম এক ধনী পরিবারে এবং ফয়জুল্লাহ তাঁর পুত্রকে সেই আমলের সম্ভাব্য শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত করে তোলেন। একজন গৃহশিক্ষক মোহসীন ও তাঁর সৎ বোন মন্নুজানকে শিক্ষা প্রদান করতেন। মনোযোগী ছাত্র হিসেবে মোহসীন কুরআন, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে অসামান্য ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। পরে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বাংলা সুবাহর তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ গমন করেন। ভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে এই বিশ্বাসে তিনি খুব শীঘ্রই বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তিনি ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। সেই সঙ্গে তিনি মক্কা, মদীনা, কুফা, কারবালা প্রভৃতি তীর্থস্থানে যান।

ইতোমধ্যে তাঁর পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর একমাত্র বোন মন্নুজান হুগলির নায়েব-ফৌজদার ও একজন দায়িত্ববান  পুরুষ  মির্জা  সালাহউদ্দীনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া নিঃসন্তান মন্নুজান তাঁর সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য মোহসীনকে ব্যাকুলভাবে দেশে ফিরে আসার আহবান জানান। বোনের সনির্বন্ধ অনুরোধে মোহসীন দীর্ঘ ২৭ বছর পর বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮০৩ সালে মন্নুজানের মৃত্যুর পর মোহসীন তাঁর বিশাল সম্পত্তি লাভ করেন। জমকালোভাবে ধর্মীয় আচারাদি ও উৎসব পালনে তিনি তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। কঠোর তপস্বী মোহসীন ১৮০৬ সালে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন এবং দুজন মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত করেন। তিনি তাঁর সম্পত্তিকে নয়টি শেয়ারে ভাগ করেন। তিনটি শেয়ার ধর্মীয় কর্মকান্ডে ব্যবহারের জন্য; পেনশন, বৃত্তি এবং দাতব্য কাজে ব্যয়ের নিমিত্ত চারটি শেয়ার এবং দুটি শেয়ার রাখা হয় মুতাওয়াল্লিদের বেতন হিসেবে। মোহসীন খুব সাধারণ ও ধর্মীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বাংলার এই মহান ব্যক্তি ১৮১২ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হুগলির ইমামবাড়ায় তাঁর সমাধির উপর সৌধ স্থাপন করা হয়।

মুতাওয়াল্লিদ্বয় তহবিল তসরুফ করায় ১৮১৮ সালে সরকার মোহসীন ফান্ড-এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্জিত সম্পত্তির বর্ধিত অংশ বিভিন্ন দালান-কোঠা নির্মাণ কাজে ব্যয় করা হয়। উনিশ শতকের পঞ্চাশ-এর দশকে নির্মিত এই সকল দালান-কোঠার মধ্যে ছিল আবাসস্থল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল, সমাধিসৌধ ও ইমামবারার ব্যয় নির্বাহের জন্য একটি বাজার।  [মুহম্মদ আনসার আলী]