কৃষি প্রতিবেশ এলাকা

কৃষি প্রতিবেশ এলাকা (Agroecological Zone)  ভূ-প্রকৃতি, মাটির প্রকারভেদ, জলপ্রণালী, জোয়ারভাটা, চাষপদ্ধতির ধরন ও মৌসুমের ভিত্তিতে চিহ্নিত স্থলাঞ্চলসমূহ। বস্ত্তত, একটি কৃষি প্রতিবেশ এলাকা বলতে সমসত্ত্ব  কৃষি ও বাস্তব্যতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন একটি এলাকাকে বোঝায়। উপাঞ্চল ও একক এলাকা পর্যায়ে এ সমসত্ত্বতা অধিকতর প্রকট। যে চারটি উপাদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের কৃষি প্রতিবেশ এলাকাগুলি চিহ্নিত হয়েছে সেগুলি হলো ভূ-প্রকৃতি, মৃত্তিকা, ভূমির উচ্চতা ও কৃষিজলবায়ু। বাংলাদেশ মোটামুটি ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ এলাকায় বিভক্ত এবং সেগুলি আবার ক্রমান্বয়ে ৮৮টি কৃষি প্রতিবেশ উপ-অঞ্চলে ও ৫৩৫টি কৃষি প্রতিবেশ এককে বিভক্ত।

বাংলাদেশের কৃষি প্রতিবেশ এলাকাগুলির সীমানির্দেশ ও বর্ণনায় ভূ-প্রকৃতিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, আর্দ্রতা সরবরাহ, উদ্ভিদমূলে বায়ু চলাচল ও পুষ্টিবস্ত্ত যোগানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মাটির অবস্থানির্ভর বিধায় বাংলাদেশের কৃষি প্রতিবেশ এলাকাগুলি নির্ধারণ ও বিভাজনে মাটির প্রকারভেদ দ্বিতীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তৃতীয় উপাদান হলো প্লাবন সাপেক্ষে ভূমির উচ্চতা। এক্ষেত্রে উচ্চতা অনুসারে সমগ্র দেশ ৪টি ভূস্তরে বিভক্ত: উচ্চভূমি (স্বাভাবিক প্লাবনপৃষ্ঠ অপেক্ষা উঁচু জমি), মধ্যম উচ্চভূমি (বন্যা মৌসুমে প্রায় ৯০ সেমি পর্যন্ত পানি দাঁড়ায়), মধ্যম নিম্নভূমি (বন্যা মৌসুমে পানির গভীরতা ৯০-১৮০ সেমি), নিম্নভূমি (বন্যা মৌসুমে সাধারণত ১৮০-৩০০ সেমি গভীর পানি দাঁড়ায়), অতি-নিম্নভূমি (বন্যা মৌসুমে ৩০০ সেমি-এর অধিক পানি দাঁড়ায়)। অতিরিক্ত আরেকটি শ্রেণি-  অবভূমি, পূর্বোক্ত যে কোনো পর্যায়ের ভূমির লাগোয়া খাদ যা সারা বছরই পানির নিচে বা পানিসিক্ত থাকে। বিভিন্ন ধরনের প্লাবন গভীরতার সীমানা সুস্থিত নয়। একই স্থানে প্লাবনের পানির গভীরতার পার্থক্য বিভিন্ন বছরে ১ মিটার বা ততোধিক হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট বছরে নির্দিষ্ট সময়ে মাত্র কয়েক দিনের জন্য প্লাবনের গভীরতা সর্বোচ্চ সীমায়ও পৌঁছাতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে চাষাবাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের জমিতে প্লাবনের গভীরতার যে নিরিখে খরিফ মৌসুমি  ফসল লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেটাই আসলে ভূমির শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি।

উচ্চভূমির মাটি ভেদ্য হলে খরিফ ফসল বা বহুবর্ষজীবী শুষ্কভূমির ফসলের উপযোগী হতে পারে। অভেদ্য মাটি বা মাটিকে কর্দমাক্ত করে অভেদ্য বানিয়ে আইলের সাহায্যে বৃষ্টির পানি আটকে রোপা আউশ বা আমন চাষের উপযোগী করা যায়। মধ্যম উচ্চভূমি স্বল্পমাত্রার বন্যাসহিষ্ণু ফসল অর্থাৎ বোনা বা রোপা আউশ,  পাট ও রোপা আমনের উপযোগী।  বন্যা আসার আগেই পাকে এমন শুষ্কভূমির আগাম খরিফ ফসল ভেদ্য মাটিতে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পানি নেমে যায় এমন জমিতে নাবী খরিফ ও শুষ্কভূমির আগাম রবি ফসল ফলান যায়। মধ্যম নিম্নভূমিতে প্লাবন এতটাই গভীর যে, রোপা আউশ বা রোপা আমন লাগিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এসব জমিতে সাধারণত বোনা আউশ ও গভীর পানির আমনের মিশ্র চাষ বা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমনের লম্বা চারা লাগানো ভালো। অক্টোবর বা নভেম্বরে পানি নেমে যায় এমন জমিতে শুষ্কভূমির রবি ফসল ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। নিম্নভূমি অত্যধিক প্লাবিত হওয়ায় সেখানে ছিটানো আউশ বা রোপা আমন ফলানো যায় না। এ ধরনের জমিতে সাধারণত গভীর পানির আমন চাষ চলে, যদিও শুকনা মৌসুমে এ ধরনের জমিতে সেচের মাধ্যমে বোরো চাষের ফলে বর্তমানে নিম্নভূমির গভীর পানির আমন চাষ হচ্ছে না। ডিসেম্বরের আগে বন্যার পানি নেমে গেলেই কেবল শুষ্কভূমির রবি ফসল চাষ করা যায়। অতি নিম্নভূমি সাধারণত এতটা গভীরভাবে প্লাবিত হয় যে সেখানে গভীর পানির আমনও ফলানো যায় না।

অবভূমিতে পানি থাকায় সেখানে ধানের বীজতলাও করা যায় না। এ ধরনের জমির প্রচলিত ফসল স্থানীয় বোরো  ধান যা সেচবিহীন বা দেশীয় অগভীর সেচ যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাষ করা যায়। অন্য কয়েকটি মাত্র অঞ্চলে যেখানে বন্যার পানি সাধারণত ১.৫ মি অতিক্রম করে না সেখানে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে আমন ধানের অত্যন্ত লম্বা চারা লাগানো হয়। বাংলাদেশে কৃষি প্রতিবেশ এলাকাগুলি শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বিবেচিত চতুর্থ উপাদানটি হচ্ছে দেশের ৪টি জলবায়ু অঞ্চল। পূর্ণাঙ্গ কৃষি প্রতিবেশ এককসমূহ গঠনের জন্য কৃষি জলবায়ুগত অঞ্চলগুলিকে অঞ্চল ও উপ-অঞ্চলগুলির উপর উপরিস্থাপন করা যেতে পারে।

কৃষি প্রতিবেশ এলাকাগুলির ডাটাবেস জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। কৃষি পরিকল্পনা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও অবস্থাভিত্তিক জীব-ভৌত সম্পদ ব্যবহার কার্যক্রমে কৃষি প্রতিবেশ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সড়ক যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে ওঠায় ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন,  বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ভিন্নতা, তথা বিভিন্ন পরিবেশগত প্রতিকূলতায় টিকে থাকার মতো আধুনিক ফসলের জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষি প্রতিবেশ এলাকা ডাটাবেস হালনাগাদ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ এলাকার বর্ণনা নিম্নে প্রদত্ত হলো:

সারণি  বাংলাদেশের কৃষি প্রতিবেশ এলাকা ও উপ-অঞ্চলসমূহ।

ক্রম কৃষি প্রতিবেশ এলাকা কৃষি প্রতিবেশ উপ-অঞ্চল
১. পুরাতন হিমালয় পাদদেশীয় পললভূমি ক) উত্তর-মধ্যভাগ খ) উত্তর অঞ্চল এবং গ) দক্ষিণভাগ
২. সক্রিয় তিস্তা পললভূমি
৩. তিস্তা সর্পিলাকার পললভূমি ক) মধ্যভাগ খ) পূর্বভাগ গ) নিম্ন-আত্রাই পললভূমি ঘ) নিম্ন-ছোট যমুনা পললভূমি ঙ) উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণভাগ চ) উত্তর-পশ্চিমভাগ এবং ছ) উচ্চ ছোট যমুনা ও মধ্য আত্রাই পললভূমি
৪. করতোয়া-বাঙ্গালী পললভূমি ক) উত্তর ও মধ্যভাগ এবং খ) দক্ষিণ-পশ্চিমভাগ
৫. নিম্ন-আত্রাই অববাহিকা
৬. নিম্ন-পুনর্ভবা পললভূমি
৭. সক্রিয় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা পললভূমি
৮. নবগঠিত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা পললভূমি ক) উচ্চ যমুনা পললভূমি খ) উচ্চতর ব্রহ্মপুত্র পললভূমি এবং গ) উচ্চতর ব্রহ্মপুত্র-যমুনা পললভূমি
৯. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পললভূমি ক) বংশী উপত্যকা খ) উঁচু অংশ গ) নিচু অংশ ঘ) মাঝারি উঁচু অংশ এবং ঙ) মাঝারি নিচু অংশ
১০. সক্রিয় গাঙ্গেয় পললভূমি
১১. উচ্চ-গাঙ্গেয় পললভূমি  ক) মধ্য ও দক্ষিণভাগ খ) গাঙ্গেয়-মহানন্দা পললভূমি এবং গ) উত্তরভাগ
১২. নিম্ন-গাঙ্গেয় পললভূমি ক) মধ্যভাগ এবং খ) পূর্বভাগ
১৩. গাঙ্গেয় কটাল (tidal) পললভূমি ক) খুলনা সুন্দরবন খ) অ-লবণাক্ত, চুনযুক্ত অংশ গ) অ-লবণাক্ত, চুনযুক্ত ও চুনবিহীন অংশ ঘ) অ-লবণাক্ত, চুনবিহীন অংশ ঙ) লবণাক্ত, এসিড সালফেট মাটি চ) লবণাক্ত, চুনযুক্ত ও চুনবিহীন এবং ছ) লবণাক্ত, চুনবিহীন
১৪. গোপালগঞ্জ-খুলনা #বিলবিলসমূহের কেন্দ্রভাগ
১৫. আড়িয়াল বিল
১৬. মধ্য-মেঘনা পললভূমি
১৭. নিম্ন-মেঘনা পললভূমি  ক) চুনযুক্ত, বন্যা নিয়ন্ত্রিত খ) চুনযুক্ত, বন্যাপ্লাবিত; গ) চুনবিহীন, বন্যা নিয়ন্ত্রিত এবং ঘ) চুনবিহীন, বন্যাপ্লাবিত
১৮. মেঘনা মোহনার নবীন পললভূমি ক) অ-লবণাক্ত: ভোলার মধ্যভাগ খ) অ-লবণাক্ত: মেঘনা মোহনা চরভূমি গ) অ-লবণাক্ত: ভোলার উত্তরভাগ ঘ) লবণাক্ত: ভোলার মধ্যভাগ ঙ) লবণাক্ত: নোয়াখালী, হাতিয়া ও মেঘনা মোহনা এবং চ) লবণাক্ত: সন্দ্বীপ ও ভোলার দক্ষিণভাগ
১৯. মেঘনা মোহনার পুরাতন পললভূমি ক) ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা প্রকল্প এলাকা খ) উঁচু: মেঘনা মোহনার পুরাতন পললভূমি, গ) নিম্ন: দাউদকান্দি- হবিগঞ্জ ঘ) নিম্ন: ঢাকা-শরীয়তপুর-বরিশাল ঙ) নিম্ন: কিশোরগঞ্জ পূর্ব চ) নিম্ন: গোপালগঞ্জ বিল এলাকার প্রান্তসমূহ ছ) নিম্ন:হবিগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার উত্তরভাগ জ) নিম্ন: তিতাস পললভূমি ঝ) পরিমিত নিম্ন, এবং ঞ) অত্যধিক নিম্নমাত্রায় নিষ্কাশিত: লাকসাম-বেগমগঞ্জ
২০. পূর্বাঞ্চলীয় সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমি
২১. সিলেট অববাহিকা ক) মধ্য ও দক্ষিণভাগ খ) উত্তরভাগ এবং গ) পশ্চিমভাগ
২২. উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাদদেশীয় পললভূমি ক) উত্তর ও পূর্বের অববাহিকা খ) উত্তর ও পূর্বের সমভূমি এবং অববাহিকা গ) উত্তর-পশ্চিমের সমভূমি ও অববাহিকাসমূহ এবং ঘ) দক্ষিণ সিলেটের পাদদেশীয় সমভূমি
২৩. চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি  ক) সৈকত শৈলশিরাসমূহ গরান জলাভূমি ও কর্দমভূমি খ) গরান স্রোতজ পললভূমি গ) পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি এবং নদীজ পললভূমি এবং ঘ) নবীন স্রোতজ পললভূমি
২৪. সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপ
২৫. সমতল বরেন্দ্রভূমি  ক) উচ্চভূমি ও পরিমিত উচ্চভূমি এবং খ) পরিমিত নিম্নভূমি ও নিম্নভূমি
২৬. উচ্চ বরেন্দ্রভূমি
২৭. উত্তর-পূর্ব বরেন্দ্রভূমি ক) প্রধানত নিম্নমানের নিষ্কাশিত ভূমি খ) প্রধানত উত্তমরূপে নিষ্কাশিত ভূমি এবং গ) মিশ্র নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্বলিত ভূমি
২৮. মধুপুর গড় ক) প্রধানত নিম্নমানের নিষ্কাশিত সমতল সোপান এবং খ) প্রধানত উত্তমরূপে নিষ্কাশিত কর্তিত সোপান
২৯. উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়  ক) নিচু পাহাড় ও পাদদেশীয় সমভূমি খ) প্রধানত উঁচু পাহাড়সারি এবং গ) প্রধানত নিচু পাহাড়সারি
৩০ আখাউড়া সোপানভূমি/চালাভূমি

পুরানো হিমালয়ের পাদদেশীয় পললভূমি (৪,০০৮ বর্গ কিমি)  হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বহির্গত পুরানো তিস্তা উপ-বদ্বীপে (Tista alluvial fan) উদ্ভূত এটি একটি বিশিষ্ট অঞ্চল। এ অঞ্চলের ভূমিরূপের ধরন জটিল। এখানে গভীর, সুভেদ্য বেলে-দোঅাঁশ ও বেলে-এঁটেল-দোঅাঁশ মাটির প্রাধান্য রয়েছে।  পৃষ্ঠমৃত্তিকা অত্যন্ত অম্লীয় এবং  অন্তর্মৃত্তিকা মাঝারি অম্লীয় আর তাতে ক্ষীয়মাণ পটাশিয়াম আকরিকের ঘাটতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বিদ্যমান ৭ প্রকার সাধারণ মৃত্তিকার মধ্যে চুনহীন বাদামি রঙের প্লাবনভূমির মাটি, কালো তরাই মাটি ও চুনহীন গাঢ়-ধূসর প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। বাংলাদেশের অধিকাংশ  প্লাবনভূমি (পললভূমি)-এর তুলনায় এখানকার মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ বেশি। মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা মাঝারি ধরনের, কিন্তু সুস্থিত। তবে নাইট্রোজেন, পটাশ, গন্ধক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও বোরন মৌলগুলির দ্রুত চুঁইয়ে যাওয়াই উর্বরতার প্রধান সমস্যা। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং দিনাজপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

সক্রিয় তিস্তা পললভূমি (৮৩০ বর্গ কিমি)  এ অঞ্চল তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীত্রয়ের সক্রিয় প্লাবনভূমি নিয়ে গঠিত। এটি হলো নিচু ও সাধারণত মসৃণ শৈলশিরা, সেগুলির মধ্যবর্তী খাদ, নদীপ্রণালী ও বিচ্ছিন্ন শাখানদীর এক জটিল বিন্যাস। এ অঞ্চলে ধূসর স্তরীভূত বালি ও পলি অনিয়মিতভাবে বিন্যস্ত। এগুলি সর্বত্রই মাঝারি অম্লীয় এবং আদি-পলিতে পটাশিয়াম আকরিকে ক্ষয় মাঝারি পর্যায়ের। মাটির ৪টি সাধারণ ধরনের মধ্যে চুনহীন পলির প্রাধান্য রয়েছে। জৈবপদার্থ ও মাটির উর্বরতার মাত্রা নিচু থেকে মাঝারি ধরনের।

তিস্তা সর্পিলাকার পললভূমি (৯,৪৬৮ বর্গ কিমি)  তিস্তা প্লাবনভূমির বৃহদাংশ এবং আত্রাই, ছোট যমুনা, করতোয়া, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পললভূমি নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। অধিকাংশ এলাকায় রয়েছে প্রশস্ত পললভূমির ভূ-শিরা এবং প্রায় সমতল অববাহিকা। সার্বিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে পললভূমির ভূ-শিরাগুলিতে আছে জলপাই বাদামি রঙের সুভেদ্য দোঅাঁশ মাটি এবং নিম্নভূমিতে ধূসর বা কালচে ধূসর, অভেদ্য ভারি পলি-দোঅাঁশ বা পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ মাটি। আদি-উপাদানে পটাশিয়াম আকরিকের ক্ষয় মাঝারি ধরনের। এখানকার মোট ৮টি সাধারণ ধরনের মাটি সর্বত্রই মাঝারি অম্লীয়, জৈবপদার্থের পরিমাণ উঁচুজমিতে কম, কিন্তু নিম্নাঞ্চলে মাঝারি আর উর্বরতার মাত্রা নিচু থেকে মাঝারি ধরনের, মাটির আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা উত্তম।

করতোয়া-বাঙ্গালী পললভূমি (২,৫৭৭ বর্গ কিমি)  প্রকৃতি ও মৃত্তিকার দিক থেকে বহুলাংশে তিস্তা সর্পিলাকার পললভূমি সদৃশ এ অঞ্চল তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র পললের সমন্বয়ে গঠিত। প্রায় সর্বত্রই আছে সমতল, প্রশস্ত প্লাবনভূমির ভূ-শিরা ও প্রায় সমতল অববাহিকা। ভূ-শিরার মাটি ধূসর রঙের পলি-দোঅাঁশ ও পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ এবং অববাহিকায় ধূসর বা কালচে ধূসর রঙের এঁটেল মাটি। এ অঞ্চলে সহজলভ্য ৫ প্রকার সাধারণ মাটির মধ্যে চুনহীন ধূসর পললভূমি ও চুনহীন কালচে ধূসর পললভূমির মাটির প্রাধান্যই বেশি। মাটি সর্বত্র মাঝারি ধরনের অম্লীয়, জৈব পদার্থের পরিমাণ সাধারণত ভূ-শিরার চাষাবাদ করা জমিতে কম এবং অববাহিকায় মাঝারি। সার্বিক উর্বরতা মধ্যম ধরনের। বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চল ও সিরাজগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এ এলাকার অন্তর্গত।

নিম্ন-আত্রাই অববাহিকা (৮৫১ বর্গ কিমি)   বরেন্দ্রভূমি ও গঙ্গা নদীর প্লাবনভূমির মধ্যবর্তী নিম্নভূমি নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত এবং  চলন বিল এলাকাও এতে অন্তর্ভুক্ত। এ সমতলীয় অববাহিকায় কালচে ধূসর, ভারি ও অম্লীয় এঁটেল মাটির প্রাধান্য রয়েছে। এখানকার ৭ ধরনের সাধারণ মাটির জৈবপদার্থ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টিবস্ত্তর পরিমাণ মাঝারি ধরনের আর পটাশিয়াম আকরিক আছে পর্যাপ্ত, উর্বরতাও মাঝারি।

নিম্ন-পুনর্ভবা পললভূমি (১২৯ বর্গ কিমি)  নিম্ন-প্লাবনভূমির ভূ-শিরা দিয়ে পৃথকীকৃত অববাহিকা ও বিলসমূহ (জলাভূমি) নিয়ে এ ছোট অঞ্চলটি গঠিত। এখানকার ভূ-শিরা ও অববাহিকা উভয় স্থানে রয়েছে কালচে ধূসর ও চিত্রবিচিত্র লাল রঙ ছড়ানো অত্যন্ত অম্লীয় ভারি কর্দম মাটি। জৈবপদার্থের উপস্থিতি মাঝারি থেকে অধিক। পর্যাপ্ত পটাশিয়াম আকরিকসহ সাধারণ উর্বরতা মাঝারি ধরনের। নওগাঁ জেলার পশ্চিমাঞ্চল ও নবাবগঞ্জ জেলার উত্তরাঞ্চল এ কৃষি প্রতিবেশ এলাকার অন্তর্ভুক্ত।

সক্রিয় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা পললভূমি (৩,১৯০ বর্গ কিমি)  অঞ্চলটি ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী বরাবর অস্থিতিশীল পলিগঠিত এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে, যেখানে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত স্থলভাগের ভাঙাগড়া চলে। প্রশস্ত ও সরু ভূ-শিরা ও খাদসহ এখানকার ভূমিরূপ অসমতল। অঞ্চলটি ক্ষীয়মাণ পটাশিয়াম আকরিকসমৃদ্ধ বেলে ও পলিময় দোঅাঁশ মাটিতে গঠিত। এ অঞ্চলে ৬টি শ্রেণির মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ কম এবং উর্বরতার মাত্রা নিচু থেকে মধ্যম।

নবগঠিত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা পললভূমি (৫,৯২৪ বর্গ কিমি)  ব্রহ্মপুত্র পলিভূমি নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। প্রশস্ত ও সরু ভূ-শিরা, মধ্যবর্তী খাদ, আংশিক ভরাট বিচ্ছিন্ন নদীপথ ও অববাহিকা নিয়ে গঠিত এটি এক জটিল ভূমিরূপ। এ অঞ্চলের ভূ-শিরার মাটি ভেদ্য পলি-দোঅাঁশ থেকে পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ এবং অববাহিকায় অভেদ্য এঁটেল ধরনের, বিক্রিয়ানিরপেক্ষ থেকে মৃদু-অম্লীয়। সাধারণ মাটির ধরনের মধ্যে ধূসর প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। জৈবপদার্থ ভূ-শিরার মাটিতে কম ও অববাহিকায় মাঝারি। মৃত্তিকায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও গন্ধকের ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু পটাশিয়াম ও দস্তার মাত্রা পরিমিত।

পুরানো ব্রহ্মপুত্র পললভূমি (৭,২৩০ বর্গ কিমি)  প্রায় ২০০ বছর পূর্বে  ব্রহ্মপুত্র নদ বর্তমান যমুনা নদীর গতিপথে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে ব্রহ্মপুত্র পললভূমির একটি বিশাল এলাকা নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত হয়েছিল। এখানকার ভূ-শিরা ও অববাহিকাগুলি প্রশস্ত। ভূমিরূপ, বিশেষত নদীর পুরানো ও বর্তমান গতিপথের কাছাকাছি স্থানে অসমতল। ভূ-শিরার মাটি প্রধানত পলি-দোঅাঁশ থেকে পলি-এঁটেল দোঅাঁশ এবং অববাহিকায় এঁটেল ধরনের। জৈবপদার্থের পরিমাণ ভূ-শিরার মাটিতে কম এবং অববাহিকায় মাঝারি। বিক্রিয়ার দিক থেকে পৃষ্ঠমৃত্তিকা মাঝারি অম্লীয়, কিন্তু অন্তর্মৃত্তিকা প্রশম। সাধারণ উর্বরতার মাত্রা কম।

সক্রিয় গাঙ্গেয় পললভূমি (৩,৩৩৪ বর্গ কিমি)  গঙ্গা নদী ও সংলগ্ন অস্থিতিশীল পলিভূমি নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। নদীর সক্রিয় ও আবদ্ধ প্রণালী দ্বারা বিছিন্ন প্রশস্ত ও সরু ভূ-শিরা ও খাদসহ এখানকার ভূমিরূপ অসমতল। মাটি চুনযুক্ত বেলে, পলি ও এঁটেল পলিসহ এক জটিল মিশ্রণ প্রকৃতির। মাটির সাধারণ ধরনের মধ্যে চুনযুক্ত পলিমাটি ও চুনযুক্ত বাদামি প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। এগুলিতে জৈবপদার্থ কম এবং বিক্রিয়ার দিক থেকে মৃদু অম্লীয়। সাধারণ উর্বরতামাত্রা মাঝারি, কিন্তু নাইট্রোজেনের ঘাটতি রয়েছে।

উচ্চ-গাঙ্গেয় পললভূমি (১৩,২০৫ বর্গ কিমি)  গাঙ্গেয় পললভূমির পশ্চিমাংশ নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। প্রধানত উচ্চ ও মাঝারি উচ্চতার প্রশস্ত ও সরু ভূ-শিরা এবং উচ্চভূমি মধ্যবর্তী খাদসহ এখানকার অধিকাংশ স্থানেরই ভূমিরূপ জটিল। ভূ-শিরার চূড়াগুলি স্বাভাবিক প্লাবনসীমার উপরে থাকে এবং উচ্চভূমির নিম্নাংশ ও অববাহিকার প্রান্তভাগগুলি মৌসুমি বন্যায় কিছুটা প্লাবিত হয়। মাটির সাধারণ ধরনগুলির মধ্যে চুনযুক্ত কালচে ধূসর প্লাবনভূমির মাটি ও চুনযুক্ত বাদামি প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। জৈবপদার্থের পরিমাণ ভূ-শিরার বাদামি মাটিতে কম, কিন্তু কালচে ধূসর মাটিতে বেশি। মাটির বিক্রিয়া সামান্য ক্ষারীয় এবং উর্বরতা নিম্নমানের।

নিম্ন-গাঙ্গেয় পললভূমি (৭,৯৬৮ বর্গ কিমি)  গাঙ্গেয় পললভূমির নিম্নাঞ্চলের পূবদিকের অর্ধেক অংশ নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। প্রশস্ত ভূ-শিরা ও অববাহিকাসহ এ অঞ্চলের ভূমিরূপ বহুদৃষ্ট বিসর্প প্লাবনভূমির মতো। ভূ-শিরার মাটি পলি-দোঅাঁশ ও পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ এবং নিম্নভূমিতে পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ থেকে ভারি এঁটেল ধরনের। সাধারণ মাটির ধরনগুলিতে চুনযুক্ত কালচে ধূসর ও চুনযুক্ত বাদামি প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। জৈবপদার্থ ভূ-শিরার মাটিতে কম ও অববাহিকায় মাঝারি, আর উর্বরতার মাত্রাও তদ্রূপ।

গাঙ্গেয় কটাল পললভূমি (১৭,০৬৬ বর্গ কিমি)  দেশের দক্ষিণ-পূর্বের জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত বিস্তৃত পললভূমি নিয়ে গঠিত। এখানকার সিংহভাগ এলাকা সমতল এবং লবণাক্ত। সংলগ্ন অববাহিকা থেকে নদীতীরের উচ্চতা ১ মিটার বা তারও কম। এ স্থানে সাধারণ মাটির মতো চুনহীন ধূসর প্লাবনভূমি মাটির প্রাধান্য রয়েছে। এ অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে  এসিড সালফেট মাটি যা শুষ্ক মৌসুমে অম্ল হয়ে ওঠে। অধিকাংশ পৃষ্ঠমৃত্তিকা অম্লীয় এবং অন্তর্মৃত্তিকা প্রশম থেকে মৃদু ক্ষারীয়,  সুন্দরবন এলাকার মাটি ক্ষারীয়। মাঝারি থেকে অধিক জৈবপদার্থসহ সাধারণ উর্বরতার মাত্রা উচ্চ।

গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল (২,২৪৭ বর্গ কিমি)  গাঙ্গেয় পললভূমি ও গাঙ্গেয় কটাল পললভূমির মধ্যবর্তী বিস্তৃত নিম্নভূমি নিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলের মাটি ধূসর ও কালচে ধূসর, অম্লীয়, ভারি এঁটেল ধরনের এবং ২৫-১০০ সেমি নিচেই পিট-কয়লার স্তর রয়েছে।  পিট ও চুনহীন কালচে ধূসর প্লাবনভূমি মাটির প্রাধান্য বেশি। জৈবপদার্থের পরিমাণ মাঝারি থেকে বেশি, উর্বরতা মাঝারি ধরনের।

আড়িয়াল বিল (১৪৪ বর্গ কিমি)  পূর্বতন বৃহত্তর ঢাকা জেলার দক্ষিণে পদ্মা ও  ধলেশ্বরী নদীর মধ্যবর্তী একটি নিম্নভূমির অববাহিকা নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। নিম্ন-আত্রাই অববাহিকা ও গোপালগঞ্জ-খুলনা বিলের সঙ্গে এটির অনেক মিল রয়েছে। এ অঞ্চলের মাটি কালচে ধূসর, অম্লীয় ও ভারি। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চুনহীন কালচে ধূসর প্লাবনভূমির মাটিই প্রধান। অন্তর্মৃত্তিকায় উপরের দিকে জৈবপদার্থের পরিমাণ ২ শতাংশের বেশি। উপরের দিকে আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা স্বভাবতই কম এবং উর্বরতার মাত্রা মধ্যম থেকে অধিক।

মধ্য-মেঘনা পললভূমি (১,৫৫৫ বর্গ কিমি)  বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার মধ্যবর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের পরিত্যক্ত খাত নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। মেঘনা নদীর অভ্যন্তর, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের চরসমূহ তথা মূলভূমির সংলগ্ন এলাকাগুলি এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ভূ-শিরার মাটি ধূসর ও দোঅাঁশ এবং অববাহিকায় ধূসর থেকে কালচে ধূসর এঁটেল ধরনের। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চুনহীন ধূসর প্লাবনভূমি মাটির প্রাধান্য রয়েছে। পৃষ্ঠমৃত্তিকা অতি-অম্লীয় এবং অন্তর্মৃত্তিকা মৃদু-অম্লীয় থেকে মৃদু-ক্ষারীয়। নিম্নমাত্রায় নাইট্রোজেন ও জৈবপদার্থসহ সাধারণ উর্বরতা মধ্যম ধরনের।

নিম্ন-মেঘনা পললভূমি (৯০৯ বর্গ কিমি)  মধ্য-মেঘনা পললভূমি ও মেঘনা মোহনার নবীন পললভূমির মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। মাটি অপেক্ষাকৃত সমসত্ত্ব, কিছুটা উঁচু এলাকায় পলি-দোঅাঁশ আর খাদগুলিতে পলি-এঁটেল দোঅাঁশ। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চুনহীন কালচে ধূসর পললভূমি ও চুনযুক্ত ধূসর পললভূমি মাটির প্রাধান্য রয়েছে। বিক্রিয়ার দিক থেকে বহির্মৃত্তিকা মাঝারি অম্লীয় এবং অন্তর্মৃত্তিকা প্রশম ধরনের। নিচু থেকে মাঝারি মাত্রার জৈবপদার্থ এবং পটাশিয়াম আকরিকসহ সাধারণ উর্বরতা মাঝারি থেকে অধিক।

মেঘনা মোহনার নবীন পললভূমি (৯,২৬৯ বর্গ কিমি)  মেঘনা মোহনার অভ্যন্তরীণ ও সংলগ্ন নতুন পলিগঠিত ভূমি এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ মাটিই ধূসর থেকে জলপাই রঙের, চুনযুক্ত গভীর পলি-দোঅাঁশ ও পলি-এঁটেল দোঅাঁশ ধরনের এবং সর্বত্র বা সামান্য নিচে স্তরীভূত। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চুনযুক্ত পলিভূমির ও চুনহীন ধূসর প্লাবনভূমির মাটির প্রাধান্য রয়েছে। এখানকার বহির্মৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকা সামান্য ক্ষারীয়, সাধারণ উর্বরতা মাঝারি, কিন্তু নাইট্রোজেন ও জৈবপদার্থের পরিমাণ কম।

মেঘনা মোহনার পুরাতন পললভূমি (৭,৭৪০ বর্গ কিমি)  এ বিশাল অঞ্চল প্রধানত সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমির দক্ষিণ ও মেঘনা মোহনার নবীন পললভূমির উত্তর পাশের মধ্যবর্তী নিম্নাঞ্চল নিয়ে গঠিত। উচ্চভূমিতে পলি-দোঅাঁশ এবং নিম্নভূমিতে পলি-এঁটেল থেকে এঁটেল মাটির প্রাধান্য দেখা যায়। মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ মাঝারি এবং বিক্রিয়ার দিক থেকে বহির্মৃত্তিকা মাঝারি অম্লীয়, কিন্তু অন্তর্মৃত্তিকা প্রশম ধরনের। সাধারণ উর্বরতামাত্রা মাঝারি।

পূর্বাঞ্চলীয় সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমি (৪,৬২২ বর্গ কিমি)  মেঘনা মোহনায় সুরমা-কুশিয়ারার স্রোতবাহিত জমাট পলির উপর গড়ে-ওঠা সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমির অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা নিয়ে গঠিত। উচ্চভূমি ধূসর রঙের ভারি পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ এবং অববাহিকা এঁটেল মাটিতে গঠিত। মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ মাঝারি, মাটির বিক্রিয়া অতি-অম্লীয় থেকে প্রশম ধরনের।

সিলেট অববাহিকা (৪,৫৭৩ বর্গ কিমি)  সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমির নিম্ন-পশ্চিমাংশ নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। নদীর নিকটস্থ ভূমিরূপ স্থানীয়ভাবে অসমান। উঁচু এলাকার মাটি ধূসর রঙের পলি-এঁটেল দোঅাঁশ ও এঁটেল-দোঅাঁশ ধরনের যা নির্দিষ্ট মৌসুমে শুকিয়ে যায় এবং জলাভূমির মাটি ধূসর এঁটেল প্রকৃতির। মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ মাঝারি এবং বিক্রিয়া প্রধানত অম্লীয়, উর্বরতা মাঝারি থেকে অধিক।

উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাদদেশীয় পললভূমি (৪,০৩৮ বর্গ কিমি)  উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ের পাদদেশে সরু ভূখন্ড হিসেবে অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বহির্মুখী ঢালসহ সমতল নিচু-অববাহিকায় বিস্তৃত উপ-বদ্বীপ নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ধূসর রঙের পাদভূমির মাটি ও চুনহীন ধূসর প্লাবনভূমির মাটির প্রাধান্য বেশি। মাটির বিক্রিয়া সামান্য অম্লীয় থেকে অতি-অম্লীয়, উর্বরতা নিচু থেকে মাঝারি।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি (৩,৭২০ বর্গ কিমি)  বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার সমভূমি ও ফেনী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত। অঞ্চলটি পাহাড়ের পাদদেশীয় ভূমি, নদী, জোয়ারভাটা প্রভাবিত ও মোহনার প্লাবনভূমি ইত্যাদি ভূমিরূপের এক যৌগিক একক। শুষ্ক মৌসুমে (অক্টোবর থেকে মে) অধিক লবণাক্ততা এখানকার মাটির প্রধান সমস্যা। ধূসর রঙের পলি-দোঅাঁশ ও পলি-এঁটেল-দোঅাঁশ মাটির প্রাধান্যই বেশি, তবে গরান বনভূমির জোয়ারভাটা প্রভাবিত প্লাবনভূমিতে রয়েছে অম্ল সালফেট মাটি। মাটির উর্বরতা মাত্রা মাঝারি, কিন্তু নাইট্রোজেন ও পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে। জৈবপদার্থের পরিমাণ কম থেকে মধ্যম।

সেন্ট মার্টিনস প্রবাল দ্বীপ (৮ বর্গ কিমি)  ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এ অঞ্চলটি দেশের সর্বদক্ষিণে গোটা  সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এখানে আছে বালুময় সৈকতবেষ্টিত সামান্য উঁচু-নিচু পুরাতন সৈকতের ভূ-শিরা ও সেগুলির মধ্যবর্তী খাদ। সম্পূর্ণ মৃত্তিকা গড়ে উঠেছে পুরাতন ও নতুন  প্রবাল সৈকতের বালুর উপর। এখানকার মাটি চুনযুক্ত বেলেমাটি। মাটির পানি ধারণের ক্ষমতা কম, উর্বরতাও নিম্নমানের।

সমতল বরেন্দ্রভূমি (৮ বর্গ কিমি)  অঞ্চলটি মধুপুর এঁটেল মাটির ওপর গড়ে উঠেছে। ভূমিরূপ প্রায় সমতল। অধিকাংশ মাটিই অভেদ্য লাঙ্গল-স্তর (ploughpan) সহ ধূসর, পলিগঠিত ও উপরে কর্দমাক্ত। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী এ অঞ্চলে রয়েছে অগভীর ধূসর  সোপান মৃত্তিকা (terrace soil) ও গভীর ধূসর সোপান-মৃত্তিকা। মাটির আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা কম এবং বিক্রিয়া সামান্য অম্লীয় থেকে অম্লীয়। জৈবপদার্থের পরিমাণ খুবই কম এবং অধিকাংশ পুষ্টিবস্ত্তর ঘাটতি প্রকট।

উচ্চ বরেন্দ্রভূমি (১৬ বর্গ কিমি)  এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বরেন্দ্র এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ যেখানে ভূগর্ভস্থ মধুপুর এঁটেল মাটি উপরে উঠে এসেছে এবং গভীর উপত্যকায় বিভক্ত হয়েছে। মাটির মধ্যে রয়েছে উপরের স্তরে কর্দমাক্ত পলি-দোঅাঁশ থেকে পলিগঠিত এঁটেল দোঅাঁশ এবং নানা গভীরতায় চিত্রবিচিত্র নমনীয় এঁটেল মাটিসহ সচ্ছিদ্র পলিমাটি। মাটির সাধারণ শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী এ অঞ্চলে গাঢ়-ধূসর রঙের সোপান-মৃত্তিকা ও ধূসর উপত্যকা মৃত্তিকার প্রাধান্য রয়েছে। কম পরিমাণ জৈবপদার্থ থাকায় মাটির উর্বরতা নিম্নমানের।

উত্তর-পূর্ব বরেন্দ্রভূমি (১,০৭৯ বর্গ কিমি)  এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে গঠিত। পৃষ্ঠমৃত্তিকায় রয়েছে পলি বা দোঅাঁশ মাটি এবং অন্তর্মৃত্তিকায় এঁটেল-দোঅাঁশ থেকে এঁটেল মাটি। বিক্রিয়ার দিক থেকে এ মাটি অত্যন্ত অম্লীয়। জৈবপদার্থের পরিমাণ কম হওয়ায় উর্বরতাও নিম্নমানের।

মধুপুর গড় (৪,২৪৪ বর্গ কিমি)  মধুপুর এঁটেল মাটিতে গড়ে ওঠা এক জটিল ভূমিরূপ ও মৃত্তিকা অঞ্চল। এখানকার ভূচিত্রে আছে সমতল উচ্চভূমি, অগভীর বা প্রশস্ত গভীর উপত্যকার সঙ্গে যুক্ত প্রশস্ত বা অপ্রশস্তভাবে খন্ডিত সোপানসমূহ। এ অঞ্চলের ১১ ধরনের মাটির মধ্যে গাঢ়-লাল বাদামি রঙের সোপান-মৃত্তিকা, অগভীর লাল-বাদামি সোপান-মৃত্তিকা ও অম্লীয় অববাহিকা এঁটেল মাটিই প্রধান। উপত্যকার মাটি কালচে ধূসর ভারি এঁটেল ধরনের। বিক্রিয়ার দিক থেকে অত্যন্ত অম্লীয় এসব মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ ও আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা কম এবং উর্বরতা নিম্নমানের।

উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় (১৮,১৭১ বর্গ কিমি)  দেশের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে অঞ্চলটি গঠিত। ভূমিরূপ জটিল, বিভিন্ন টিলায় পাহাড়গুলি নানাভাবে খন্ডিত। ঢাল সাধারণত অত্যন্ত খাড়া এবং কিছু নিচু পাহাড়ের উপরটা সমতল। এখানে সাধারণ পাহাড়ি মাটির প্রাধান্যই বেশি। জৈবপদার্থের পরিমাণ ও উর্বরতা কম।

আখাউড়া সোপানভূমি.চালাভূমি (১১৩ বর্গ কিমি)  ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার পূর্ব সীমান্ত ও হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পূর্ব পাশ নিয়ে এ ক্ষুদ্র অঞ্চল গঠিত। উচ্চভূমির মূল মাটিতে শক্ত বাদামি এঁটেল মাটির প্রাধান্য রয়েছে। উপত্যকায় পলি-এঁটেল থেকে এঁটেল মাটি পাওয়া যায়। সাধারণ মাটির ধরনগুলিতে আছে প্রধানত গাঢ় লাল-বাদামি সোপান-মৃত্তিকা, ধূসর পাদদেশীয় মৃত্তিকা ও অম্লীয় অববাহিকা মৃত্তিকা। মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ ও সাধারণ উর্বরতা কম এবং বিক্রিয়ায় অত্যন্ত অম্লীয়। [এম শহিদুল ইসলাম ও মামুনুল হক খান]

গ্রন্থপঞ্জি FAO/UNDP, Land Resources Appraisal of Bangladesh for Agricultural Development Report 2: Agroecological Regions of Bangladesh, FAO/UNDP, 1988; BBS, 1998 Yearbook of Agricultural Statistics, Bureau of Statistics, GOB, 1999.