প্লাবনভূমি

প্লাবনভূমি (Floodplain)  নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অপেক্ষাকৃত মসৃণভূমি যা নদীর উপচে পড়া জলরাশি বা প্লাবনের ফলে সৃষ্টি হয়। ভূ-প্রকৃতি অনুসারে বাংলাদেশকে তিনটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা: (ক) প্লাবনভূমি অঞ্চল, (খ) সোপানভূমি অঞ্চল এবং (গ) পার্বত্য অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলেরই নিজস্ব নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে বিস্তৃত বিভিন্ন নদনদীসৃষ্ট প্লাবনভূমি এলাকা। বাংলাদেশের কৃষি এবং সংস্কৃতিতেও এই ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিরাট প্রভাব রয়েছে। অধিকাংশ চাষযোগ্য উর্বর ভূমি এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলভুক্ত এবং দেশটির সংস্কৃতি প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। বাংলাদেশের প্লাবনভূমি অঞ্চলসমূহকে আঠারোটি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে: ১) পুরাতন হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি ২) তিস্তা প্লাবনভূমি ৩) পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি ৪) যমুনা (নবীন ব্রহ্মপুত্র) প্লাবনভূমি ৫) হাওর অববাহিকা ৬) সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি ৭) মেঘনা প্লাবনভূমি ক) মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমি খ) নিম্নতর মেঘনা প্লাবনভূমি গ) পুরাতন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি ঘ) নবীন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি ৮) গাঙ্গেয় প্লাবন সমভূমি ৯) গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি ১০) সুন্দরবন এলাকা ১১) নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা ১২) আড়িয়াল বিল ১৩) গোপালগঞ্জ-খুলনা পীট অববাহিকা ১৪) চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি ১৫) উত্তর ও পশ্চিমাংশের পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি।

পুরাতন হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি  পর্বত থেকে সমভূমিতে পতিত বিভিন্ন জলধারা ও নদ-নদী কর্তৃক হিমালয় পর্বত থেকে বাহিত পলি পর্বতের পাদদেশে অবক্ষেপণের ফলে সুষম ঢালবিশিষ্ট এই পাদদেশীয় সমভূমি গঠিত হয়েছে। হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমির একটি অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সম্প্রসারিত হয়েছে যা প্রায় সমগ্র দিনাজপুর অঞ্চলে বিস্তৃত। মোট আয়তন প্রায় ৩,৮৭০ বর্গ কিলোমিটার। এই অঞ্চলটি হিমালয়ের পাদদেশীয় বালুকারাশি এবং নুড়ি দ্বারা আচ্ছাদিত। পাদদেশীয় সঞ্চয়নসমূহ নবীন প্লাইসটোসিন (Late Pleistocene) অথবা প্রবীণ হলোসিন (Early Holocene) সময়কালের মত পুরানো, তবে মধুপুর কর্দম থেকে নবীনতর। এই ভূমিরূপের নিষ্কাশন প্রণালী বিনুনি প্রকৃতির এবং একাধিক অগভীর, প্রশস্ত, মসৃণ কিন্তু অনিয়মিত আকৃতির শৈলশিরা বিশিষ্ট। এ সমস্ত শৈলশিরা অসংখ্য প্রশস্ত কিন্তু অগভীর নদীখাত দ্বারা বিভক্ত যেগুলো ঘন ঘন শাখায়িত হয়েছে, আবার পুনর্যোজিত হয়েছে। যখন এ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে উত্থিত হতে শুরু করে তখন থেকেই তিস্তা নদী অঞ্চলটি পরিত্যাগ করে। এলাকাটি উঁচু হয়ে ওঠার কারণেই এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীগুলো বর্তমানে সমভূমির প্রধান মাত্রার নিচে প্রায় ৬ মিটার গভীর পর্যন্ত খাত সৃষ্টি করে প্রবাহিত হচ্ছে (উত্তর থেকে দক্ষিণে এই পরিমাপ ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে)। পাদদেশীয় সমভূমি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সুষমভাবে ঢালু হয়ে গিয়েছে। ঢালের উত্তর প্রান্ত সমুদ্র সমতল থেকে গড়ে ৯৬ মিটার উঁচু এবং দক্ষিণ প্রান্ত ৩৩ মি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সমগ্র ঠাকুরগাঁও জেলা এবং পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ এই ভূ-প্রাকৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত। এই সমভূমির অধিকাংশ স্থানই বন্যায় প্লাবিত হয় না।

তিস্তা প্লাবনভূমি  পশ্চিমে হিমালয়ের পাদদেশীয় সমভূমি এবং পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বৃহৎ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। দক্ষিণে বগুড়া জেলার শেরপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল প্রাচীন তিস্তা নদীগঠিত একটি প্লাবনভূমি। মোট আয়তন প্রায় ১৩,২৮৩ বর্গ কিলোমিটার। এ অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিই বর্ষা মৌসুমে অগভীরভাবে প্লাবিত হয়। তবে ঘাঘট নদী বরাবর একটি অগভীর অবভূমির (Depression) অবস্থান রয়েছে যেখানে বন্যার গভীরতা মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে। তিস্তা, ধরলা এবং দুধকুমার  এই তিনটি বৃহৎ নদী তিস্তা প্লাবনভূমিকে ছেদ করেছে। এই নদীত্রয়ের সক্রিয় প্লাবনভূমিসমূহ তাদের বালুতট ও দিয়ারা প্রভৃতিসহ সচরাচর ছয় কিলোমিটারের চেয়ে কম প্রশস্ত।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি  ১৭৮৭ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিধারায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সে বছর ব্রহ্মপুত্র মধুপুর গড়ের পূর্ব পার্শ্ব থেকে গতি পরিবর্তন করে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদের এই নতুন গতিপথ যমুনা নামে অভিহিত হতে থাকে। বাহাদুরাবাদ এবং ভৈরবের মধ্যবর্তী ব্রহ্মপুত্রের পূর্বতন প্রবাহটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে খুবই সংকীর্ণ একটি ধারায় পরিণত হয়। পলি সঞ্চয়নের দরুন এটি মাত্র দুই কিলোমিটার প্রশস্ত একটি ক্ষুদ্র মৌসুমি নদীখাত হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে শুরু করে মধুপুর গড়ের পূর্ব প্রান্ত বরাবর হয়ে নিম্নে মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রশস্ত শৈলশিরা ও অবভূমি সমন্বয়ে সুষম ভূমিরূপ প্রদর্শন করে। অবভূমি অঞ্চলসমূহ সাধারণত এক মিটারের অধিক গভীরতায় প্লাবিত হয়। কিন্তু শৈলশিরাসমূহ কেবল বর্ষার সময় অগভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। মোট আয়তন প্রায় ৯,৪৩১ বর্গ কিলোমিটার।

যমুনা (নবীন ব্রহ্মপুত্র) প্লাবনভূমি  পুরাতন ব্রহ্মপুত্র এবং অপেক্ষাকৃত নতুন যমুনা নদীকে পৃথক করার জন্য এই প্লাবনভূমিকে দ্বৈত নামকরণ করা হয়ে থাকে। ১৭৮৭ সালের পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পূর্বমুখী বর্তমানের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বরাবর প্রবাহিত হতো। সে বছর ব্রহ্মপুত্রে প্রবল বন্যা সংঘটিত হওয়ায় নদীটি তার পুরাতন গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণমুখী ঝিনাই ও কোনাই নদী বরাবর প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং প্রশস্ত ও বিনুনি (braided) বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যমুনা নদী গঠন করে। ব্রহ্মপুত্রের এই গতি পরিবর্তন প্রক্রিয়া ১৮৩০ সাল নাগাদ সম্পন্ন হয়। বরেন্দ্রভূমি ও মধুপুর গড় এই দুটি প্লাইসটোসিন চত্বরের উত্থানের ফলে মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে গ্রস্ত উপত্যকার (rift valley) সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের নতুন প্রবাহ বৃহৎ যমুনার রূপ ধারণ করে। যমুনা নদীর উভয় তীর এই যমুনা (নবীন ব্রহ্মপুত্র) প্লাবনভূমি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের অর্ন্তভুক্ত।

এই প্লাবনভূমিকে আবার বাঙ্গালী-করতোয়া প্লাবনভূমি, যমুনা-ধলেশ্বরী প্লাবনভূমি এবং দিয়ারা ও চর প্রভৃতি কয়েকটি উপ-বিভাগে বিভক্ত করা যায়। যমুনার ডান তীর, তথা পূর্বতন তিস্তা প্লাবনভূমির একটি অংশ বৃহত্তর প্লাবনভূমিরই একটি অংশ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। যমুনার কয়েকটি শাখানদী যমুনা প্লাবনভূমির বাম তীর অংশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে যাদের মধ্যে ধলেশ্বরী বৃহত্তম। যমুনা ও ধলেশ্বরী মিলিতভাবে যমুনা-ধলেশ্বরী প্লাবনভূমি নামে একটি উপশ্রেণী গঠন করেছে। এই উপশ্রেণীর দক্ষিণাংশ একসময় গাঙ্গেয় প্লাবনভূমির অংশ ছিল। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গার প্রবাহ বরাবর বহু সংখ্যক দিয়ারা ও চর গড়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের অন্য যে কোন নদীর চেয়ে যমুনা নদীতে চরের সংখ্যা অত্যধিক এবং বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত যমুনায় চরের একটি ধারাবাহিক রেখা সৃষ্টি হয়েছে। উভয় তীর প্রচুর সংখ্যক দিয়ারার উপস্থিতি দ্বারা বিভক্ত। চর এবং দিয়ারার মৃত্তিকা ও ভূমিরূপে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এ সকল পরিবৃদ্ধির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ম উত্থানের মধ্যকার পার্থক্য প্রায় ৫ মিটারের মতো। যে কোন পাড়ে উচ্চতর পাড়সমূহ এবং এদের মধ্যকার ব্যবধান ৬ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। কিছু কিছু শৈলশিরা অগভীরভাবে প্লাবিত হলেও অধিকাংশ শৈলশিরা এবং প্লাবনভূমির অববাহিকাসমূহ বর্ষা মৌসুমে প্রায় চার মাসাধিককাল (মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত) ০.৯১ মিটারেরও অধিক গভীরতায় প্লাবিত হয়ে থাকে।

হাওর অববাহিকা  বৃহৎ, সুষম অবনমিত ভূ-প্রকৃতি যা পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে মেঘালয় মালভূমির পাদদেশ, পূর্বে সিলেটের উঁচু সমভূমি এবং দক্ষিণে পুরাতন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে এই অববাহিকার সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১১৩ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলটিকে সিলেট অববাহিকা নামেও অভিহিত করা হয়। অসংখ্য হ্রদ (বিল) ও বৃহদাকৃতির জলাশয় (হাওর) দ্বারা ৫,০২৫ বর্গ কিলোমিটারের এই হাওর এলাকা গঠিত। বৃহৎ পিরিচাকৃতির এই অববাহিকা অবনমনশীল এবং ভূতত্ত্ববিদদের মতে এই অবনমন প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে মধুপুর গড়ের উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিগত ২০০ বছরে এই এলাকা ৯ থেকে ১২ মিটার অবনমিত হয়েছে বলে পরিমাপ করা হয় এবং বর্তমানেও তা সক্রিয় রয়েছে। এই অববাহিকা বর্ষাকালে নিয়মিতভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। শিলং স্ত্তপ-পর্বতের দক্ষিণের অভিক্ষিপ্ত পার্শ্বীয় শাখা বরাবর অবস্থিত পাহাড়সমূহ ছাড়াও বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্বতমালা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃত রয়েছে। ভূরূপতাত্ত্বিক গঠনগত দিক থেকে ক্ষুদ্র পর্যায়ের তবে উল্লেখযোগ্য এই ক্ষুদ্র পাহাড়সমূহকে স্থানীয়ভাবে টিলা বলা হয়ে থাকে। কৈলাস টিলা, ডুপি টিলা এবং বিয়ানীবাজারের টিলাসমূহ সহ সিলেটের টিলাসমূহ সাধারণত প্লাইও-প্লাইসটোসিন যুগের কর্করীয় পলল (clastic sediments) দ্বারা গঠিত এবং এদের সর্বোচ্চ উচ্চতা গড় সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬০ মিটার।

সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি  হাওর অববাহিকা তথা সিলেট অববাহিকার পূর্ব অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহ দ্বারা গঠিত প্লাবনভূমি। মোট আয়তন প্রায় ৪,৮৬৫ বর্গ কিলোমিটার। সিলেট অঞ্চলের নিকটবর্তী কিছু ক্ষুদ্র পাহাড় এবং পাদদেশীয় এলাকাসমূহ এই প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত। অন্যত্র এই ভূমিরূপ সাধারণভাবে সুপ্রশস্ত শৈলশিরা ও অববাহিকা দ্বারা গঠিত একটি সুষম গঠনবিশিষ্ট ভূমিরূপ। কিন্তু স্থানীয়ভাবে নদীখাতসমূহ বরাবর এই ভূমিরূপ অনিয়মিত। মৃত্তিকা বৈশিষ্ট্য শৈলশিরা এলাকায় প্রধানত ভারি পলিগঠিত এবং অববাহিকা এলাকায় কর্দমগঠিত। প্রাক-মৌসুমি বায়ু, মৌসুমি বায়ু এবং মৌসুমি বায়ু উত্তর - এই তিন সময়কালেই এই প্লাবনভূমিতে আকস্মিক বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে প্লাবন গভীরতায় ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিক প্লাবনমাত্রা শৈলশিরাসমূহে প্রধানত অগভীর এবং অববাহিকা এলাকায় গভীর।

মেঘনা প্লাবনভূমি  ভূ-প্রকৃতির এই এককটি চারটি উপ-এককে বিভক্ত: (ক) মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমি (খ) লোয়ার মেঘনা প্লাবনভূমি (গ) প্রবীণ মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি এবং (ঘ) নবীন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি।

মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমি  উজানে মেঘনার মূল প্রবাহ থেকে ভৈরব বাজারের কাছে গঙ্গা ও ধলেশ্বরীর প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত নদীখাত মধ্য মেঘনা নামে অভিহিত। মধ্য মেঘনা গঠিত প্লাবনভূমি একাধিক বিস্তৃত চর ও বহু প্রশস্ত সর্পিলাকার প্রবাহবিশিষ্ট একটি নিম্নস্থিত ভূ-প্রকৃতি। দুই শতাব্দী পূর্বে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনার গতিপথ বরাবর প্রবাহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গঠিত প্লাবনভূমির অংশবিশেষ এই প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত। এই প্লাবনভূমির পলল প্রধানত পলিকণা ও কর্দম সমৃদ্ধ। উত্তরের কিছু শৈলশিরার পৃষ্ঠভাগে বালুকাময় ব্রহ্মপুত্র পলল বিদ্যমান। এই ভূমিতে মেঘনাসৃষ্ট মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত গভীর। অববাহিকা এলাকাসমূহ শুরুতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে এবং নিষ্কাশিতও হয় বিলম্বে। এই ভূ-প্রাকৃতিক উপ-এককের মোট আয়তন প্রায় ৯৭২ বর্গ কিলোমিটার।

লোয়ার মেঘনা প্লাবনভূমি  পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল থেকে দক্ষিণমুখী মোহনার পূর্ব পর্যন্ত অংশকে লোয়ার মেঘনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। লোয়ার মেঘনা নদীর বাম তীরের পলি গঙ্গা, যমুনা এবং মেঘনাবাহিত মিশ্র পলল দ্বারা গঠিত। এসকল সঞ্চয়ন পলিকণার প্রাধান্য দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। নদীতীরের নিকটবর্তী প্লাবনভূমি গাঙ্গেয় উপাদান অনুপ্রবেশের কারণে সামান্য পরিমাণে চুনযুক্ত। স্থলভাগের অভ্যন্তরে পলল চুনবিহীন এবং এদের বেশিরভাগই পদ্মা নদী আড়িয়াল খাঁ নদী বরাবর গতিপথ থেকে ১৮৪০ সাল নাগাদ বর্তমানের নিম্নতর মেঘনা বরাবর প্রবাহিত হওয়ার পূর্বেই সঞ্চিত হয়েছে। এই প্লাবনভূমিতে অল্পসংখ্যক অনিয়মিত শৈলশিরা এবং অববাহিকা ধরনের ভূমিরূপ বিদ্যমান, কিন্তু অধিকাংশ এলাকাই ঢিবি আকৃতির এবং বসতি ও চাষাবাদে ব্যবহূত। পূর্বে মৌসুমি প্লাবনমাত্রা ছিল পরিমিত পরিমাণে গভীর এবং দক্ষিণ অংশে দৈনিক দুবার জোয়ারভাটার কারণে এই গভীরতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটত। বর্তমানে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের সুরক্ষিত ও নিষ্কাশিত এলাকাসমূহে বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং প্রধানত বৃষ্টির পানি দিয়েই তা সংঘটিত হয়। ভূ-প্রকৃতির এই উপ-এককটির আয়তন প্রায় ৭৯৭ বর্গ কিলোমিটার।

প্রবীণ মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি  বিস্তৃত এই ভূমিরূপ মেঘনার নদীজ এবং জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি থেকে পুরোপুরি পৃথক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অববাহিকা এলাকা এবং শৈলশিরা এলাকার মধ্যে উচ্চতার সামান্য পার্থক্য ছাড়া প্রবীণ মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি প্রায় সমতল। এই ভূ-প্রকৃতির দক্ষিণাংশে প্রাকৃতিক নদনদী এবং জলধারার উপস্থিতি না থাকায় খাল খনন করে নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের মৃত্তিকা প্রধানত গভীর এবং পলিকণাসমৃদ্ধ, তবে কিছু কিছু অববাহিকার কেন্দ্রে মৃত্তিকা অগভীর কর্দমস্তর দ্বারা আবৃত থাকে। দক্ষিণ-পূর্বাংশ ব্যতীত সর্বত্র মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত গভীর। অববাহিকার কেন্দ্রগুলোতে শুষ্ক ঋতু জুড়েও আর্দ্র অবস্থা বিরাজ করে। বাইরের নদীসমূহ যখন উচ্চমাত্রায় প্রবাহিত হতে থাকে সে সময়ে মূলত বৃষ্টিপাতের ফলে ভূভাগে সঞ্চিত পানি দ্বারা এই এলাকায় বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদনদীর (যেমন, গোমতী) আশপাশের প্লাবনভূমিসমূহ নদীর পানি দ্বারা প্লাবিত হয়। এই ক্ষুদ্র নদীগুলোই প্রায় ৭,৩৮৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের প্রবীণ মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমিকে সংলগ্ন পাহাড় এবং পাদদেশীয় এলাকাসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

নবীন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি মেঘনা মোহনা এবং তৎসংলগ্ন এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সমতলপ্রায় ভূমি। মোহনা সংলগ্ন দ্বীপসমূহ এবং মূল ভূখন্ড এলাকা এই প্লাবনভূমির অন্তর্গত। প্লাবনভূমির প্রান্তীয় এলাকায় বিরামহীন নব নব পলি সঞ্চয়ন ও ক্ষয়কার্যের ফলে ভূমির আকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। এই প্লাবনভূমির বহু স্থানে মৃত্তিকার পৃষ্ঠভাগ শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়ে, তবে সকল অংশে এই ঘটনা ঘটে না। মৌসুমি প্লাবনমাত্রা প্রধানত অগভীর, তবে জোয়ার-ভাটার কারণে গভীরতা ওঠানামা করে। বৃষ্টিপাত অথবা নদ-নদীর স্বাদুপানির দ্বারাই মূলত এই বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। মৌসুমি ঋতুতে অপ্রত্যাশিত উচ্চ জোয়ার-ভাটা অথবা ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের সময় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি দিয়ে এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের একেবারেই প্রান্তীয় এলাকায় বন্যা সংঘটিত হয়।

গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি  গঙ্গা নদী কর্তৃক সৃষ্ট সক্রিয় প্লাবনভূমি এবং সংলগ্ন সর্পিলাকার বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমি নিয়ে গঠিত যার আয়তন প্রায় ২৩,২১৩ বর্গ কিলোমিটার। সর্পিলাকার প্লাবনভূমি প্রধানত শৈলশিরা, অববাহিকা এবং পুরাতন নদীখাত সমন্বয়ে গঠিত একটি সুষম ভূমিরূপ। গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি স্থানীয়ভাবে বর্তমান এবং পরিত্যক্ত নদীর গতিপথ বরাবর অনিয়মিতভাবে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে, পশ্চিমাঞ্চলে হঠাৎ হঠাৎ পর্যায়ক্রমে রৈখিক নিম্ন শৈলশিরা এবং অবনমনসমূহের একটি ধারা গড়ে উঠেছে। সক্রিয় প্লাবনভূমিতে গঙ্গা নদী প্রতি বছর বন্যার সময় অব্যাহতভাবে ক্ষয়কার্য এবং নতুন নতুন বৃহৎ চরাভূমি গঠনের মাধ্যমে তার গতিপথ পরিবর্তন করে চলেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার তুলনায় এই নদী কম চরোৎপাদী। সঞ্চয়নকালে গাঙ্গেয় পলল চুনযুক্ত, তবে অধিকাংশ অববাহিকা কর্দম শ্রেণীর। কিছু পুরাতন শৈলশিরার মৃত্তিকা ঊর্ধ্বস্তরে অ-চুনীকৃত এবং অম্লীকৃত, এধরনের মৃত্তিকার কেবল অন্তঃস্তরে চুনের উপস্থিতি দেখা যায়। অববাহিকাগুলোতে এবং অধিকাংশ শৈলশিরার মধ্যভাগে কর্দম মৃত্তিকার প্রাধান্য রয়েছে। শৈলশিরার শিখরদেশে প্রধানত দোঅাঁশ মৃত্তিকা এবং কখনও কখনও বালুকা মৃত্তিকার প্রাধান্য বিদ্যমান।

গাঙ্গেয় প্লাবনভূমির পশ্চিম এবং উত্তরভাগে মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং উঁচু শৈলশিরার শিখরদেশ স্বাভাবিক বন্যার আওতামুক্ত থাকে। তবে পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে বন্যার গভীরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। প্রধানত বৃষ্টিপাত এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উত্থিত হওয়ার ফলে বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। সক্রিয় গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি এবং এর নিকটবর্তী উপনদী খাতসংলগ্ন এলাকায় বর্ষা ঋতুতে নদীর প্রবাহমাত্রা বেড়ে গেলে অনেক সময় এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। উত্তর-পশ্চিমের মহানন্দা প্লাবনভূমি এবং দক্ষিণ-পূর্বের পুরাতন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমির কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা এই ভূ-প্রাকৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত। তিস্তা ও গঙ্গার মিশ্র পলল দ্বারা সৃষ্ট সকল অনিয়মিত ভূ-প্রকৃতি নিয়ে মহানন্দা প্লাবনভূমি গঠিত। মেঘনা প্লাবনভূমির বিচ্ছিন্ন অংশসমূহ প্রধানত পলিমাটি দ্বারা গঠিত যা মৌসুমি ঋতুতে বৃষ্টিপাতের কারণে গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও যশোর জেলার বেশিরভাগ এলাকা; সমগ্র কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা জেলা; মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার অংশবিশেষ গাঙ্গেয় প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত। ভূ-প্রাকৃতিক এই এককটি আকৃতির দিক থেকে প্রায় ত্রিকোণাকার এবং দক্ষিণে রয়েছে গাঙ্গেয় জোয়ার-ভাটা প্লাবনভূমি। গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি তার দক্ষিণ প্রান্তে গোপালগঞ্জ-খুলনা পীট অববাহিকাকে আবদ্ধ করে রেখেছে।

গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি  গাঙ্গেয় প্লাবনভূমির দক্ষিণাংশ গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি নামে পরিচিত। অসংখ্য স্রোতজ নদনদী (tidal rivers) ও খাড়ি (creeks)-এর সমন্বয়ে দাবার ছক-কাটা ঘরের মতো কর্তিত অনুচ্চ শৈলশিরা এবং অববাহিকা নিয়ে গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি গঠিত। স্থানীয় ভূমির উচ্চতার পার্থক্য সাধারণত ১ মিটারেরও কম, যেখানে গাঙ্গেয় প্লাবনভূমিতে এই পার্থক্য ২ থেকে ৩ মিটারের মতো। ভূমি গঠনকারী পলল প্রধানত চুনবিহীন কর্দম জাতীয়, তবে নদী তীরসমূহে এবং পূর্বদিকে নিম্নতর মেঘনা প্লাবনভূমি সংলগ্ন অবস্থান্তরিত অঞ্চল পলিকণাসমৃদ্ধ এবং সামান্য পরিমাণে চুনযুক্ত। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং সমগ্র ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলা গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমির অন্তর্গত। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সুন্দরবন এই প্লাবনভূমির বহির্ভূত। এই ভূ-প্রাকৃতিক এককটির আয়তন প্রায় ১০,৯৮১ বর্গ কিলোমিটার।

গঙ্গা নদী সারা বছর উত্তর-পূর্ব এবং পূর্বদিকে স্বাদুপানি বহন করলেও লবণাক্ত পানি স্থলভাগের দিকে শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিমে এবং প্রায় সারা বছরই কিংবা বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ক্রমেই অনুপ্রবেশ করছে। গঙ্গার শাখানদীসমূহ এবং নিম্নতর মেঘনা নদী উচ্চ প্লাবনমাত্রায় থাকাকালীন অবস্থায় প্রধানত বৃষ্টির পানি ভূভাগে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে উত্তর-পূর্বাংশে মৌসুমি ঋতুতে পরিমিত গভীরতার বন্যা সংঘটিত হয়। অন্যত্র সারা বছর অথবা মৌসুমি ঋতুতে ভরা জোয়ারের সময় প্রধানত অগভীর প্লাবন সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে যে সকল বিস্তৃত এলাকায় বাঁধ বা পোল্ডার দিয়ে জোয়ারসৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধ করা হয়েছে সে সকল এলাকা এর ব্যতিক্রম। উত্তরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা এবং পূর্বাংশের মাটি সারা বছর লবণমুক্ত থাকে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মাটি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়ে।

সুন্দরবন অঞ্চল  গাঙ্গেয় জোয়ার-ভাটা প্লাবনভূমির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বিস্তৃত ভূমি যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ০.৯১ মি উঁচু। এই অত্যধিক নিম্নভূমি জুড়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন এবং সুন্দরবন একক নামে পরিচিত পুনরুদ্ধারকৃত চাষের জমি। অত্যধিক নিচু এই বৃহদাকৃতির মোহনাজ এলাকার বিদ্যমানতার পেছনে সম্ভবত দুটি কারণ রয়েছে  গঙ্গার শাখাসমূহ কর্তৃক অপর্যাপ্ত সঞ্চয়কার্য অথবা ভূঅবনমন। গঙ্গার প্রধান প্রধান শাখাসমূহের কোনটিই কখনও এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হতো না। বরং ছোট ছোট কিছু শাখাই বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চয়কার্য করে আসছে। এই মোহনা এলাকার গঠনকার্য এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। আবার এটাও ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত ভূঅবনমন প্রক্রিয়া এই এলাকার অত্যধিক নিম্ন হওয়ার পেছনে কার্যকর ছিল। এই ধারণার পেছনে বহু সাক্ষ্য-প্রমাণও রয়েছে যেমন, জলমগ্ন এই এলাকার মধ্যভাগে শেখেরটেক ও বেদকাশি এলাকায় বৃহৎ ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব রয়েছে। উল্লিখিত এলাকাসমূহে সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক নিচে নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং গাছপালার গুঁড়ি পলি দ্বারা চাপা পড়ে গিয়েছে। চকোরিয়া সুন্দরবন নামে পরিচিত সুন্দরবনের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীর মোহনায় অবস্থিত।

নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা  মোটামুটি ৮৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি ক্ষুদ্র ভূ-প্রাকৃতিক একক যা আত্রাই এবং গঙ্গা নদীর মিশ্র পললগঠিত নিম্নস্থিত এলাকায় অবস্থিত। এই অববাহিকা ভর অববাহিকা নামেও পরিচিত; ‘ভর’ শব্দের অর্থ নিচু ভূমি। আত্রাই নদীর উত্তরের ভূমিরূপ প্রধানত সমতল, তবে নদীর দক্ষিণে অবস্থিত ভূ-প্রকৃতিতে প্লাবনভূমি শৈলশিরাসমূহ এবং সুবিস্তৃত অববাহিকা বিদ্যমান। মৃত্তিকা বৈশিষ্ট্যে ভারি কর্দমের প্রাধান্য রয়েছে, তবে দক্ষিণ এবং পশ্চিমের শৈলশিরাসমূহের মৃত্তিকা দোঅাঁশ প্রকৃতির। বর্ষায় যমুনার অতিরিক্ত প্রবাহ হুরাসাগর নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়ে এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের নিষ্কাশন ব্যবস্থা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পূর্বে মৌসুমি বন্যার মাত্রা ছিল গভীর এবং চলন বিলের বিস্তৃত এলাকা সারা বছরই জলমগ্ন থাকত। পরবর্তীতে ১৯৬০ সাল থেকে পোল্ডার নির্মাণের ফলে এই এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা অনেকাংশে উন্নতি লাভ করে। তা সত্ত্বেও কখনও কখনও স্থানীয়ভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে কিংবা আত্রাই নদীতে অথবা বরেন্দ্রভূমির সংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার ফলে বাঁধ ভেঙে পোল্ডারের ভিতরে ও বাইরে প্রবল বন্যা সংঘটিত হয়।

আড়িয়াল বিল  ঢাকার দক্ষিণে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি অবভূমি। প্রায় সমগ্র এলাকাই ভারি কাদা দিয়ে আবৃত। দুটো বৃহৎ নদীখাত কাছাকাছি থাকার পরও বৃষ্টিপাতের সঞ্চিত পানি দ্বারা এখানে গভীর মাত্রায় মৌসুমি প্লাবন সংঘটিত হয়ে থাকে, কেননা নদীগুলোর প্রবাহ সে সময় পরিপূর্ণ থাকার কারণে তারা এই সঞ্চিত পানি নিষ্কাশন করতে ব্যর্থ হয়। শুষ্ক ঋতুতেও এই এলাকার বেশিরভাগ আর্দ্র থাকে।

গোপালগঞ্জ-খুলনা পিট অববাহিকা  গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি এবং গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি এলাকার মধ্যে অবস্থিত একাধিক নিম্ন এলাকা নিয়ে ২,৭৬৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। এই এলাকার প্রধান দুটি বিল হচ্ছে বাঘিয়া বিল ও চান্দা বিল। বর্ষস্থায়ী আর্দ্র অববাহিকাসমূহ জুড়ে ভারি পীট মৃত্তিকা বিদ্যমান, তবে প্রান্তীয় এলাকায় এই মৃত্তিকা কর্দম দ্বারা আবৃত। বিল এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার শাখানদীসমূহ বরাবর এলাকা চুনযুক্ত পলিকণাবিশিষ্ট পলল দ্বারা আবৃত থাকে। এই এলাকা বাংলাদেশের বৃহত্তম পিট মজুতকারী অববাহিকা। বর্ষায় এই অববাহিকা অঞ্চল বৃষ্টির পানির দ্বারা গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। খুলনার কাছাকাছি অবস্থিত বিলসমূহে বন্যার পানি ঈষৎ লবণাক্ত হয়ে থাকে। এই ভূ-প্রাকৃতিক এককে ভূঅবনমন প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয়।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি  সমুদ্র উপকূল বরাবর চট্টগ্রাম জেলার সংকীর্ণ স্থান জুড়ে অবস্থিত একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। উত্তরে ফেনী নদী থেকে শুরু করে দক্ষিণে মাতামুহুরী নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত এ সমভূমি ১২১ কিমি দীর্ঘ। গড় প্রস্থ ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত, তবে কর্ণফুলি নদীর মোহনায় প্রায় ২৬ কিলোমিটার। পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি এই ভূমি সুষম ঢালবিশিষ্ট পাদদেশীয় সমভূমি গঠন করেছে। ফেনী, কর্ণফুলী, হালদা এবং অন্যান্য নদীর গতিপথ বরাবর গঠিত হয়েছে নদীগঠিত প্লাবনভূমি; নদীগুলোর নিম্ন প্রবাহ বরাবর গঠিত হয়েছে জোয়ার-ভাটা প্লাবনভূমি; উত্তরাংশে গঠিত হয়েছে নবীন মোহনাজ ক্ষুদ্র প্লাবনভূমি এবং সংলগ্ন উপ-একক নবীন মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি এবং দক্ষিণে সাগর উপকূল বরাবর গঠিত হয়েছে বালুকাময় উপকূলীয় শৈলশিরাভূমি। পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি পললের বৈশিষ্ট্য প্রধানত পলিকণাময় ও স্থানীয়ভাবে বালুসমৃদ্ধ এবং প্লাবনভূমি অববাহিকাসমূহে অধিকতর বিস্তৃত কর্দমবিশিষ্ট। সমগ্র মূল ভূখন্ড আকস্মিক বন্যার শিকার। বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং বন্যার গভীরতা জোয়ারভাটার সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করে। তবে উপকূলীয় বাঁধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকা এবং নদীর কারণে যেসকল এলাকায় জোয়ারভাটা বাধাগ্রস্ত হয় সে সকল এলাকায় বন্যা জোয়ারভাটার প্রভাবমুক্ত থাকে। জোয়ারভাটার দৈনিক গড় ব্যবধান প্রায় ২ মিটার। শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারভাটা এবং মোহনাজ প্লাবনভূমির মৃত্তিকা লবণাক্ত হয়ে পড়ে।

উত্তর ও পশ্চিমের পাদদেশীয় সমভূমি  উত্তর এবং পূর্বের পাহাড়সমূহের পাদদেশীয় সীমানা ঘেঁষে ঢালু প্রকৃতির এই পাদদেশীয় সমভূমি অবস্থিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়সমূহের পাদদেশ সংলগ্ন একই প্রকার ভূমিকে চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পলিজ পাখাগঠিত এই সমভূমি পাহাড়ের কাছাকাছি এলাকায় প্রধানত পলিকণা অথবা বালুকাময় অবক্ষেপ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। আশেপাশের প্লাবনভূমির নিকটবর্তী অববাহিকাসমূহে কাদার প্রাধান্য রয়েছে। সমগ্র এলাকা বর্ষা ঋতুতে আকস্মিক বন্যার শিকার হয়ে থাকে। উচ্চতর অংশে সংঘটিত বন্যা প্রধানত অগভীর এবং থেকে থেকে সংঘটিত হয়, তবে অববাহিকা এলাকায় বন্যার মাত্রা অল্প গভীর থেকে গভীর হয়ে থাকে। এই ভূ-প্রকৃতির আওতায় রয়েছে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা, সিলেট অঞ্চলের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, মাধবপুর, হবিগঞ্জ সদর, চুনারুঘাট, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ এবং কুলাউড়া। ভূ-প্রাকৃতিক এককটির আয়তন প্রায় ৪,০৬৬ বর্গ কিলোমিটার।  [জাবেদ কলিম]