বরেন্দ্রভূমি
বরেন্দ্রভূমি (Barind Tract) বঙ্গ অববাহিকার বৃহত্তম প্লাইসটোসিন ভূ-প্রাকৃতিক একক। প্রায় ৭,৭৭০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বরেন্দ্রভূমি বিস্তৃত। চতুষ্পার্শেতর প্লাবনভূমি থেকে পৃথক এই ভূ-প্রকৃতি পুরাতন পলল গঠিত একটি ভূমিরূপ হিসেবে দীর্ঘ সময় থেকেই স্বীকৃত। বরেন্দ্রভূমির ভৌগোলিক অবস্থান মোটামুটি ২৪°২০´ উত্তর অংক্ষাংশ থেকে ২৫°৩৫´ উত্তর অংক্ষাংশ পর্যন্ত এবং ৮৮°২০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°৩০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভূ-প্রাকৃতিক এই একক পূর্বে করতোয়া নদী দ্বারা, পশ্চিমে মহানন্দা নদী দ্বারা এবং দক্ষিণে গঙ্গা নদীর উত্তর পাড় দ্বারা সীমাবদ্ধ। বরেন্দ্রভূমির পূর্ব প্রান্তে একটি চ্যুতির অবস্থান সুস্পষ্ট এবং চ্যুতিখাদ বরাবর ছোট যমুনা, আত্রাই এবং পুনর্ভবা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এই ভূ-প্রাকৃতিক এককের পশ্চিমাংশ আনত এবং পশ্চিম প্রান্তের অংশবিশেষ অবশিষ্ট ভূ-ভাগ এবং পার্শ্ববর্তী মহানন্দা প্লাবনভূমি থেকে ১৫ মিটারেরও অধিক উঁচু। বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী ও বগুড়া জেলা জুড়ে বরেন্দ্রভূমি বিস্তৃত।
বরেন্দ্রভূমির নামকরণের পেছনে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ‘বর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ ইন্দ্রের বর বা ইন্দ্রের আশীর্বাদ থেকে সাধারণভাবে বরেন্দ্র শব্দটির উৎপত্তি। এই কাহিনীর অনুসারিগণ বিশ্বাস করেন যে, বরেন্দ্রভূমি ইন্দ্রের পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। রামায়ণ ও মহাভারত গ্রন্থদ্বয়ে বরেন্দ্রভূমিকে ‘পুন্ড্র’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পুন্ড্র নামকরণের পেছনেও রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী। মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে, বলিরাজার পাঁচ সন্তানের মধ্যে একজনের নাম ছিল পুন্ড্র এবং তাঁর নামানুসারে এই ভূমির নামকরণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২১৩ থেকে ২৩২ সালের শিলালিপির বর্ণনা থেকে জানা যায়, সম্রাট অশোকের শাসনামলে বরেন্দ্রভূমিকে তার আদি অধিবাসীদের নামে নামকরণ করা হতো যাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিল পারিংদাগন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিংদাগন পরিবর্তিত হয়ে ‘বারিন্দা’ নাম ধারণ করে এবং ভূমির নামও তাই হয়ে যায়।
বরেন্দ্রভূমির অবস্থান গ্রীষ্মপ্রধান মৌসুমিমন্ডলে। কর্কটক্রান্তি এই ভূমির দক্ষিণে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলের জলবায়ু সাধারণভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র। বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং বায়ুর চাপের উপর ভিত্তি করে বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়াগত অবস্থাকে চারটি ধরনে বিভক্ত করা হয়েছে: (১) প্রাক-মৌসুমি, (২) মৌসুমি, (৩) মৌসুমি উত্তর এবং (৪) শীতঋতু। বৃষ্টিপাত এ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে স্বল্প এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১,৯৭১ মিমি। প্রধানত মৌসুমি ঋতুতে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। আবার, স্থানভেদে এবং বছরে বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণে পার্থক্য হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৮১ সালের রেকর্ড অনুযায়ী বরেন্দ্রভূমির গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৭৩৮ মিমি-এ কিন্তু ১৯৯২ সালে এসে তা দাঁড়ায় প্রায় ৭৯৮ মিমি। ইতোমধ্যেই এই এলাকাকে খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বরেন্দ্রভূমি এলাকার গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ২৫° সে থেকে ৩৫° সে পর্যন্ত এবং শীতকালের গড় তাপমাত্রা ৯° সে থেকে ১৫° সে পর্যন্ত উঠানামা করে। অর্থাৎ গ্রীষ্মে অত্যধিক তাপমাত্রা এবং শীতে অত্যধিক ঠান্ডাই হচ্ছে বরেন্দ্রভূমির আবহাওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোন কোন গ্রীষ্মকালীন দিবসে রাজশাহী অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৫°সে পর্যন্ত উঠে থাকে, এমনকি নাটোর জেলার লালপুর উপজেলায় তাপমাত্রা এর চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। আবার শীতকালে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার কিছু কিছু স্থানে তাপমাত্রা প্রায় ৫° সে-এ নেমে আসে। এভাবে দেশের অন্যান্য এলাকার জলবায়ু থেকে সুস্পষ্টরূপে পৃথক অধিকতর পুরাতন পলল গঠিত এই ভূ-প্রাকৃতিক এককে চরম জলবায়ু পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকে বরেন্দ্রভূমি তিনটি এককে বিভক্ত। বিভাগগুলি হচ্ছে সাম্প্রতিক পলিজ পাখা, বরেন্দ্র প্লাইসটোসিন চত্বর এবং নবীন প্লাবনভূমি। ভূসংস্থানিক এই এককসমূহ নবীন পলল গঠিত দীর্ঘ ও সরু ভূ-প্রাকৃতিক ফালি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। মহানন্দা প্লাবনভূমি পশ্চিম প্রান্তে এবং করতোয়া নদী পূর্ব প্রান্তে এই ভূসংস্থানিক এককসমূহের সীমানা নির্ধারণ করছে। হিমালয়ের পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত পুনর্ভবা, আত্রাই এবং পুরাতন যমুনা নদীত্রয় প্লাইসটোসিন ভূভাগকে একাধিক ভাগে ছেদন করেছে এবং সেইসঙ্গে নদীত্রয় দ্বারা সৃষ্ট প্লাবনভূমিসমূহ একক তিনটিকে পৃথক করেছে। উল্লিখিত নদীতিনটি আরও একাধিক নদীপ্রবাহ সহযোগে বরেন্দ্রভূমির উত্তর সীমা নির্দেশকারী প্রশস্ত পাদদেশীয় পললভূমি গঠন করেছে। তিস্তা পলিজ পাখা এই এলাকার উত্তরে অবস্থিত। হিমালয় পাদদেশের এই ভূ-পৃষ্ঠ প্রতি কিমি-এ প্রায় ০.৪৩ মি নতিমাত্রাবিশিষ্ট যা বরেন্দ্রভূমিকে অংশত আবৃত করে রেখেছে। এই অংশটি সমতল অথবা কিছুটা গম্বুজাকৃতি ভূ-পৃষ্ঠ বিশেষ। বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণে রয়েছে নবীন ভূতাত্ত্বিক যুগে গঠিত ভূমি যা দক্ষিণমুখী প্রতি কিমি-এ ০.০৬ মি নতিমাত্রা বিশিষ্ট।
বরেন্দ্রভূমি এলাকায় তিনটি সুস্পষ্ট নিষ্কাশন প্রণালী পরিলক্ষিত হয়। উত্তরভাগে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনুনি আকৃতির প্রবাহ বিদ্যমান, যেগুলি হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর গড়ে তুলেছে প্রশস্ত পাদদেশীয় পলিজ সমভূমি। পাদদেশীয় পলিজ সমভূমির প্রধান প্রধান নদীসমূহ হচ্ছে আত্রাই এবং পুনর্ভবা। প্লাইসটোসিন ভূ-প্রাকৃতিক এককের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট ছোট অনেক অাঁকাবাঁকা নদীখাত, যেগুলি প্রশাখী জলনিষ্কাশন প্রণালী গঠন করে বরেন্দ্রভূমির মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলিতে পতিত হয়েছে। কতগুলি প্রধান প্রধান নদী উপত্যকা প্লাইসটোসিন ভূ-প্রাকৃতিক একককে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত কয়েকটি এককে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমে মহানন্দা, পূর্বে করতোয়া এবং এ দুয়ের মাঝখানে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদী এসকল নদী উপত্যকার মধ্য দিয়ে বহমান। বৃহত্তম ভূ-প্রাকৃতিক এককটি পুনর্ভবা এবং আত্রাই নদীদ্বয় দ্বারা পরিবেষ্টিত। অন্য একটি বৃহৎ একক করতোয়া এবং ছোট যমুনা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। অনেক ছোট ছো্ট নদী প্রবাহ, যাদের বেশিরভাগই বৃক্ষসদৃশ নিষ্কাশন প্রণালী গঠন করেছে সেগুলি বিভিন্ন বরেন্দ্র ভূ-প্রাকৃতিক এককের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, করতোয়া নদীর গতিপ্রবাহ দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখী একটি চ্যুতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে তিস্তা ছিল এই অঞ্চলের প্রধান নদীপ্রবাহ যেটি জলপাইগুড়ির কাছে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতো। পশ্চিমে প্রবাহিত হতো ঢেপা-পুনর্ভবা, দক্ষিণে আত্রাই এবং দক্ষিণ-পূর্বে ছোট যমুনা। উপরোক্ত সবগুলি নদীই গঙ্গা নদীতে গিয়ে মিলিত হতো। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে আত্রাই নদী প্রধান গতিধারায় পরিণত হয় এবং পুনর্ভবা ছিল দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ। বর্তমানে তিস্তা, করতোয়া এবং আত্রাই নদীত্রয় যমুনা নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৭৮৭ সালে অকস্মাৎ সংঘটিত প্রবল বন্যার ফলে এই নদীসমূহ, বিশেষ করে তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে উত্থান প্রক্রিয়ার নবায়ন এবং বরেন্দ্র ভূ-পৃষ্ঠের আনতকরণ প্রক্রিয়ার ফলে এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়কালে, পুনর্ভবা, আত্রাই এবং ছোট যমুনা বন্যার পানি কিছুটা বহন করলেও সাধারণভাবে তারা পূর্বগামী নদীপ্রবাহ হিসেবে প্রধানত উত্থিত বরেন্দ্র এলাকার স্থানীয় প্রবাহকেই বহন করে থাকে।
দেশের প্রধান প্লাইসটোসিন চত্বর বরেন্দ্রভূমি পুরাতন পলল হিসেবে আখ্যায়িত প্লাইসটোসিন কালের পলল দ্বারা গঠিত। ভূ-গাঠনিক দিক থেকে এই অঞ্চল প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান ইন্ডিয়ান প্লাটফর্মের উপর অবস্থিত যার অধিকাংশই বর্মাঞ্চলের স্যাডল ও সোপান এলাকায় অবস্থিত। এই প্লাটফর্ম অঞ্চলটি বেশিরভাগ টারশিয়ারী এবং কোয়াটারনারী পলল এবং সাম্প্রতিক পলল দ্বারা আচ্ছাদিত।
আশেপাশের প্লাবনভুমি থেকে বরেন্দ্রভূমি তুলনামূলকভাবে উচ্চতর অবস্থানে অবস্থিত। এই এলাকার সমোন্নতি রেখা দুটি চত্বরতলকে নির্দেশ করে- একটি তল ৪০ মিটার উচ্চতায় এবং অন্যটি ১৯.৮ থেকে ২২.৯ মিটারের মধ্যে অবস্থান করে। এর ফলে যেসময় অন্যান্য প্লাবনভূমি মৌসুমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় সে সময় বরেন্দ্রভূমি প্লাবনমুক্ত থাকে এবং ক্ষুদ্র কয়েকটি প্রবাহ খাত দ্বারা নিষ্কাশিত হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় ৪৭ শতাংশ উঁচুভূমি, প্রায় ৪১ শতাংশ মধ্যম উঁচুভূমি এবং অবশিষ্টাংশ নিম্নভূমি হিসেবে শ্রেণিবিন্যস্ত। বরেন্দ্রভূমির ঢালু ভূভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমি সাধারণভাবে কৃষিকাজের আওতাভুক্ত। এই অঞ্চল স্বাভাবিক প্লাবনমুক্ত থাকায় বৃষ্টির পানিই ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্যোজনের একমাত্র উৎস। এক সময় এখানে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অবনমিত ভূমির অস্তিত্ব থাকলেও সাম্প্রতিককালে সেগুলো কৃষিভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থার এই পরিবর্তন সাধনের ফলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্নবায়ন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরতাকেও বাড়িয়ে তুলছে। আবার বিগত দুই শতাব্দীর মধ্যে তিস্তা ও আত্রাই নদী এবং তাদের শাখানদীসমূহের গতিপথ পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের জলবায়ু ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভূরূপতাত্ত্বিক রূপান্তর ধীরে ধীরে এই এলাকাটিকে একটি উষ্ণ এলাকায় পরিণত করেছে।
মধুপুর (বরেন্দ্র) কর্দম নামে পরিচিত প্লাইসটোসিন পলল ভিত্তির উপর বরেন্দ্রভূমি অবস্থিত। এই কর্দম লালচে বাদামি বর্ণের, জারিত, অাঁঠালো এবং কিছু মাত্রায় দৃঢ়। প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদদ্বয় মর্গান এবং ম্যাকিনটায়ারের মতে বরেন্দ্রভূমির অবক্ষেপ নদীজ উৎসসৃষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এই সকল অবক্ষেপ বিলম্বিত প্লাইসটোসিন মহাকালে শেষ বরফযুগের সমাপ্তিলগ্নে সঞ্চিত হয়। আজ থেকে প্রায় ১৮,০০০ বছর পূর্বে শেষ বরফযুগ তার সক্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে। সে সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ বর্তমানের সীমা অপেক্ষা ১০০ থেকে ১৩০ মিটার-এ নেমে আসে। অতঃপর বরফগলা পানি বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। ঠিক একই সময় উপমহাদেশে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি জলবায়ুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বঙ্গ সমভূমিতে তখনও বৃষ্টিপাতের প্রাধান্য ঘটে নি। এই ভূমির নদ-নদীসমূহ শুধুমাত্র বরফগলা পানি নিয়ে তাদের সংকীর্ণ ও কর্তিত খাতে প্রবাহিত হতো। পরবর্তীতে, আজ থেকে ১২,০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এ অঞ্চলের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে এবং বঙ্গ অববাহিকার উপর ভারি বর্ষণ ঘটাতে থাকে। এ অঞ্চলের সংকীর্ণ নদীখাতগুলো হিমালয় পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফগলা পানি এবং ভারি বর্ষণসৃষ্ট বিশাল পানিরাশি বহন করতে অসমর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে নদীগুলি দুকূল ছাপিয়ে বৃহৎ বঙ্গীয় সমভূমিতে পলি সঞ্চয়ন ঘটাতে থাকে। বিপুল পরিমাণের পানিরাশি বঙ্গ সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সঞ্চিত পলিরাশিকে দক্ষিণে যেসকল এলাকায় পলির প্রাধান্য রয়েছে যেমন- বরেন্দ্রভূমি, মধুপুর গড় এবং লালমাই এলাকায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে জলবায়ুর পরিস্থিতি ক্রমশ উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে থাকে যা অতি দ্রুত বঙ্গীয় নদ-নদীসমূহের গতিপ্রবাহকে প্রবাহিত করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ পুনরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং অবনমিত ভূভাগসমূহে অধিক পরিমাণে পলি সঞ্চিত হতে থাকে। কিন্তু এই হলোসিন (সাম্প্রতিক সময়কাল) পলিসমূহ পূর্বেকার মধুপুর পললের সীমার ঊর্ধ্বে উঠে তাকে আবৃত করতে ব্যর্থ হয়।
প্লাইসটোসিন চত্বরসমূহের উত্থানের পটভূমির ব্যাখ্যায় অপর একদল ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন যে, টেকটোনিক তথা ভূগাঠনিক আলোড়নের ফলশ্রুতিতে এদের উত্থান ঘটেছে। তাদের মতে, বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চলের বৃহৎ অবনমনসমূহে প্লাইসটোসিন পলল সঞ্চিত হয়। সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার পরবর্তীকালে নিওটেকটোনিক আলোড়নের ফলে এসকল অঞ্চলের উত্থান ঘটে এবং উঁচু চত্বর গঠিত হয়।
বঙ্গীয় অববাহিকার প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান ইন্ডিয়ান প্লাটফর্মের উপর সুস্থিত হওয়ায় বরেন্দ্রভূমি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, পিট, কঠিন শিলা, চুনাপাথর, চীনামাটি এবং কাঁচবালি গুরুত্বপূর্ণ। বরেন্দ্রভূমির প্লাইসটোসিন শিলা-এককের নিচে অবস্থিত প্লাটফর্ম এলাকায় মূলত এসকল খনিজ সঞ্চয়নের উপস্থিতি রয়েছে। বগুড়া, রাজশাহী এবং দিনাজপুর জেলায় উচ্চমানের বিটুমিন কয়লার সঞ্চয়ন আবিষ্কৃত হয়েছে। বরেন্দ্রভূমির প্লাইসটোসিন পললের নিচে প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান ভিত্তিস্তরে অবস্থিত গ্রস্ত উপত্যকা নামে পরিচিত ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অববাহিকায় এই কয়লা পাওয়া গিয়েছে। এই কয়লা পারমিয়ান যুগের গন্ডোয়ানা স্তরসমষ্টির অন্তর্গত এবং উৎকৃষ্ট মানের। বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণাংশে প্লাইসটোসিন শিলা-এককের নিচে অবস্থিত প্লাটফর্মের সোপান এলাকায় চুনাপাথর পাওয়া গিয়েছে। ইয়োসিন যুগের এই চুনাপাথর সিমেন্ট শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাচামাল। কঠিন শিলা বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্য আরেকটি মূল্যবান খনিজ সম্পদ। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র প্লাটফর্ম এলাকা প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। রাস্তাঘাট, সেতুসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে এই কঠিন শিলা একটি প্রয়োজনীয় নির্মাণ উপকরণ। চীনামাটি ও কাচবালি বরেন্দ্র শিলা এককের ঠিক নিচে ভিত্তিস্তর শিলার উপরের অংশে পাওয়া যায়। সিরামিক সামগ্রী, ইলেকট্রিক সামগ্রী এবং অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পজাত সামগ্রী তৈরিতে চীনামাটি ও কাচবালি ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়।
জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে ভূমিরূপের পরিবর্তন বরেন্দ্রভূমির পরিবেশের অবনতি ঘটিয়ে চলছে। এই অঞ্চলের বর্তমান জলবায়ুগত অবস্থা কোনভাবেই অনুকূল নয়। বৃষ্টিপাত খুবই সামান্য এবং দিবাভাগে আবহাওয়া উত্তপ্ত থাকে কিন্তু রাত্রির শেষভাগে তা অধিকতর ঠান্ডা হয়ে আসে। বরেন্দ্রভূমি এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্যোজনের প্রধান উৎস বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন তথা বৃষ্টিপাতের হ্রাস এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া এই এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্যোজন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পুনর্যোজন হার কম হওয়ায় বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক গভীরে অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে অবস্থিত হওয়া ছাড়াও এ অঞ্চলের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে বনভূমির আয়তন হ্রাস পাওয়া। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলের কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বরেন্দ্রভূমির প্রায় ৪২ শতাংশ এলাকা বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। ১৮৪৯ সালের ভূমি জরিপ পরিসংখ্যানের তথ্য থেকে পাওয়া যায় যে, বরেন্দ্রভূমির প্রায় ৫৫ শতাংশ জমি জুড়ে বিস্তৃত ছিল বনভূমি। কিন্তু ১৯৭৪ সালে দেখা যায় যে, বরেন্দ্রভূমির প্রায় ৭০ ভাগ এলাকাই কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে।
ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস করার পরিণতি হিসেবে বরেন্দ্রভূমি একটি শুষ্কপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তদুপরি, এই এলাকার চরম শুষ্ক প্রকৃতি এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণের বৃষ্টিপাত সংঘটনের ফলে উদ্ভিদ আচ্ছাদন উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। এ সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে উপগ্রহ চিত্রে বরেন্দ্রভূমিকে সহজেই একটি উষ্ণ ও শুষ্কভূমি হিসেবে শনাক্ত করা যায়। তবে এ বিষয়টিও সঠিক যে, এলাকাটি ভূগর্ভস্থ পানির উন্নয়ন এবং কৃষিকাজের জন্য একটি নিম্ন সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পানির জন্য এলাকাটিকে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ সকল প্রতিবন্ধকতার জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলে এক ফসলের বেশি ফসল ফলানো সম্ভব হয় না, যা এলাকাটিকে একটি খাদ্য ঘাটতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত করেছে। স্থানীয় প্রকৌশলিগণ বরেন্দ্রভূমির এই সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে ভূগর্ভস্থ পানির নতুন নতুন উৎস অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বেশকিছু উৎকৃষ্ট মানের ভূগর্ভস্থ জলাশয়ের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়, যেগুলি বৃহৎ মাত্রায় সেচকার্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৯৮০ সালের মধ্যভাগে বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা উন্নয়নের লক্ষ্যে Barind Integrated Area Development Project নামে একটি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় বরেন্দ্র এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে কৃষি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে সেচকার্যের উদ্দেশ্যে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এতদঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং এলাকাটি খাদ্য উদ্বৃত্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। কৃষি সুবিধা প্রদান করা ছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ অবক্ষয় রোধ করার লক্ষ্যে এই প্রকল্পের উদ্যোগে বৃক্ষ রোপণ এবং পুকুর ও খাল খননের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। শুরুতে প্রকল্পের উদ্যোক্তাগণ ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পনের বছরব্যাপী পরিচালিত বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়। সেচ সুবিধা প্রদান করা ছাড়াও প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন স্কীম এই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান সৃষ্টি করে। পরিবেশ অবক্ষয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে এবং সেইসঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রার হ্রাস ঘটানো, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অধিকতর উদ্ভিদ আচ্ছাদন তৈরি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ১৯৯০ সালের প্রথমার্ধে এই প্রকল্পটিকে নতুনভাবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (Barind Multipurpose Development Authority) নামে নামকরণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশি নলকূপ ভূগর্ভস্থ পানি আহরণ করছে। এর সুফল যেমন আছে, তেমনি কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বর্তমানে কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। একটি সমন্বিত পানি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার দ্বারা বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়ন না করলে বর্তমান ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর সেচ প্রকল্পটি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে এবং অনাকাংখিত পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। [কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ]